সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অনুবাদ – কাজী মুনতাসির বিল্লাহ
[কাফ থর – ডেনমার্কের একজন অখ্যাত সংগীত-শিল্পী। গানের ধরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন রেগেকে। জীবন যাপন ও চেতনায় একজন রাস্তাফারাইয়ান। নিজেকে বলেন মাল্টিরেস্পেক্টিং রাস্তাফারাইয়ান। ভক্তি রাখেন বৈষ্ণব ভাবে, সুফিবাদে আর বুদ্ধের দর্শনেও। গানে তিনি সরব বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, প্রাণ-প্রকৃতি ধংসকারী ভোগবাদী কর্পোরেট সিস্টেম – তথা যা কিছু ‘ব্যাবিলনীয়’, তার বিরুদ্ধে। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়কাল ডিসেম্বর’২০১৪]
কামুবি- সময় দেওনের লাইগা ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা। ভাল হয়, যুদি প্রথমে আপনের লাইফের টাইমলাইনের একটা চিত্র তুইলা ধরেন। শুনতে চাই বিশেষত আপনের যাত্রার শুরুটা – মিউজিশিয়ান হিসাবে আর স্পিরিচুয়াল বিদ্রোহী হিসাবে আপনের যেই যাত্রা বা যাত্রাগুলান। কোনটা আগে ঘটেছিল – সংগীত না আপনের জীবনদর্শন তথা একজন মাল্টিরেস্পেক্টিং রাস্তাফারাইয়ান হয়ে ওঠা? কখন আর কীভাবে রাস্তাফারাই-কে(১) জীবনদর্শন হিসাবে নিলেন? গান ধরছিলেন কবে? উস্কানি পাইছিলেন কই থিকা?
প্রশ্নগুলা একটু ব্যাড়াছ্যাড়া টাইপ হইতেসে। কিছু মনে কইরেন না। সব গুছাইয়া জিগাইতাসি না। খালি মোটাদাগে মাথায় আছে যে কিতা লইয়া আলাপ পারুম আপনের লগে।
কাফ থর- খুশি মনেই জবাব দেব, যে কোন প্রশ্নের, সামর্থ্য অনুযায়ী।
আগ্রহ আর বন্ধুত্বের জন্য শুকরিয়া, মাই ফ্রেন্ড।
পরিকল্পনা মাফিক একবারে সাজানো প্রশ্নের চাইতে ধাপে ধাপে আলাপটাই ভাল, আলাপ চলুক তার স্বাভাবিক গতিতে।
তো, উত্তর দেয়া শুরু করি।
মিউজিসিয়ান হিসেবে যাত্রা শুরু যখন আমার বয়স বিশের ঘরে(১৯৯০)।
কথার ফাঁকে প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা কইরেন।
লিরিক্স লিখতাম আর গাইতাম, এক প্রিয় বন্ধু সুর বাঁধত। কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়ে উঠে নাই, যদিও স্যাক্সোফোন, কী-বোর্ড, বেজ আর গিটার নিয়ে গুঁতোগুতি করেছি। কোন বাদ্যযন্ত্রেই ভালো ছিলাম না, ছিল না গাওয়ার অভিজ্ঞতাও।
কিন্তু প্রেরণা ছিল, ভালবাসা ছিল মিউজিকের জন্য, তাই থামি নাই। আর আমার প্রেরণাকে জিইয়ে রেখেছিল সেই গানের বন্ধুটি। তার ভাল লাগত আমার নিজস্বতা।
আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল কোপেনহেগেনের এক কালচারাল হাউজের এইট-ট্র্যাক ক্যাসেট স্টুডিওতে। আমরা আমাদের গান রেকর্ড করা শুরু করলাম, নানা স্টাইলে, রক, রেগে, ফোক আর নিরীক্ষাধর্মী গানের।
কিছু সময় পরে আমরা দুজনেই চিনি এমন কিছু কমন বন্ধুদের নিয়ে ব্যান্ড গড়লাম আর একটা শো-ও করলাম, একটাই যদিও। একটা গোটা শো-এর জন্য আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ নিজস্ব গান ছিল না, তাই গাইলাম “দ্যা ডোরস”-এর গানও। আমাদের ব্যান্ডের সবাই ভক্ত ছিল “ডোরস” এর, আর গাওয়াটাও সহজ ছিল আমার জন্য।
একটাই শো করেছিলাম আমরা(বেশ সাফল্যের সাথেই), কারণ তার পরপরই আমি চলে গেলাম এশিয়ায় আমার প্রথম ভ্রমণে, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল আর ভারতে।
এই ভ্রমণ আমার চিন্তা-ভাবনাকে ওলট-পালট করে দিল। আর আমি বুঝলাম যে আদতে আমি আমার লিরিক্স নিয়ে সন্তুষ্ট নই। সেগুলা কেমন খালি-খালি, ফাঁপা – বড়জোর কৌতুক বলা যায় লিরিক্সগুলাকে।
কামুবি- আচ্ছা, আপনের একটা গানের কথা জিগাই ৯৬ সালের, “Building A House of Stone”। গানে আপনের একটা শক্ত অবস্থান দেখি প্রাণ-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে, মনে হয় আপনার সামাজিক ও স্পিরিচুয়াল সচেতনতা অনেকটা এখনকার চিন্তার লাহান। তো এই গান কি আপনের সেই অনুভবের আগের না পরের? আরেকটা কথা আপনাদের যে ব্যান্ড হয়েছিল, রকের প্রতি টান স্বাভাবিক ইউরোপে, রেগের প্রতি ঝুঁকলেন কেন?
কাফ- আসছি তার জবাবে.. আগে গল্প কিছুদূর এগোক।
আমি টের পেলাম মানুষের সামনে গান নিয়ে হাজির হবার আগে আমাকে অনেক গভীরে যেতে হবে। আর সে গভীরতায় পৌঁছানোর মত জীবনের অভিজ্ঞতা আমার তখনও হয় নাই।
তাই ভ্রমণ শেষে ছয় মাস পর যখন ডেনমার্ক পৌঁছালাম, মিউজিক স্থগিত রাখলাম। আমাদের সেই ব্যান্ডটিরও সেখানেই ইতি। অন্য কাজে জড়ালাম, ভিডিও প্রোডাকশন। কোপেনহেগেনের এক বিকল্প, প্রথাবিরোধী টিভি স্টেশনে হলাম এডিটর আর লাইভ টিভি প্রোডিউসার।
মনে হয়েছিল মানুষের মাঝে ছড়াতে হবে, আর এই অন্যধারার টিভির কাজ বেশ বৈপ্লবিক। কয়েক বছর পর মনে হল, হয়তো মানুষকে “মিথ্যা-বলা-ভিশন”(Tell-lie-vision) আরো বেশি দেখতে উদ্বুদ্ধ করা ছাড়া লাভের লাভ আর কিছুই হচ্ছে না। আর ব্যক্তিগতভাবে টেকনিকাল স্টাফের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না, ফলত ছেড়ে দিলাম টিভি প্রোডাকশন।
মাপ করবেন যদি বেশি বকবক করে থাকি, হাহাহা।
ইউরোপ জুড়ে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম। রাস্তায় মাস্ক পরে স্ট্রিট-থিয়েটার করতাম, ঘুরে বেড়াতাম হিচহাইকিং-এর মাধ্যমে, দিন এনে দিন খেতাম একেবারে।
তেমন কোনই টাকা কামাতাম না, ছিলনা খাবার আর আশ্রয়ের নিশ্চয়তা। কিন্তু নিজেকে মুক্ত, বাঁধনহারা মনে হ’ত। প্রতিদিন-ই কোন না কোন উপায়ে মৌলিক চাহিদাগুলা মিটে যেত। চেক রিপাবলিক আর ফ্রান্সের গ্রামীন এলাকায় একটু বেশি সময়-ই থাকা পড়েছিল, সাক্ষাৎ হল প্রচুর মানুষের সাথে। একটু ভাল বোধ করা শুরু করলাম, নিজেকে নিয়ে, জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। এমনকি টুকটুক করে স্যাক্সোফোন আর গিটারও বাজানো শুরু করলাম – কোনরূপ দক্ষতা ছাড়াই, আর মিউজিকের কোন ‘নিয়ম’ না মেনেই।
৯৬-এ আমি প্রথমবারের মত রেইনবো গ্যাদারিং-এ(২) গেলাম; সেখানে কিছু পুরোদস্তুর হিপ্পিদের সাথে পরিচয় হল। সে সময়ের আগ পর্যন্ত কখনোই আমি তাদের সাথে কোনপ্রকার একাত্মতা বোধ করি নাই। কিন্তু তখন মনে হল যে, আরে, যে জীবন আমি কাটাচ্ছি, তার সাথে তাদের খুব একটা ফারাক নাই।
তার পরপর আমার এই ধরণের গ্যাদারিং-এ আরো যাওয়া পরে, দেখা হয় কয়েকজনের সাথে, যারা আমাকে গিটারে রেগে(reggae) গাওয়া শেখান। আপনি যে গানটার কথা একটু আগে বললেন, “Building A House of Stone” – সেটা আমার (সুরটুর সহ) প্রথম লেখা গান। ঐ সময়েই।
স্পেনে যাই একদল মানুষের সাথে থাকতে, যারা বাস করত টিপিতে(৩)। খাবারের সময়গুলোতে বেশ গান-বাজনা চলত, তবে প্রধানত ছিল একদল রাস্তা(রস্তাফারাইয়ান), যাদের কাছে ঘটে আমার রাস্তাফারাই দর্শনে হাতেখড়ি।
অবশেষে আমি আমার প্রথম গিটারখানা কিনি, দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হই, পথ খুঁজে পেলাম যেন। আর পথে ঘাটে মাস্ক-থিয়েটার করা ছেড়ে মিউজিশিয়ান বনে যাই। গাইতে থাকি, কনসার্টে বা পথের ধারে।
এইতো আমার রেগে আর রাস্তাফারাই-এ আসার গল্প।
আর আপনার প্রশ্নের জবাব একটু বাকি থাকে, যে একদম প্রথমে, ব্যান্ড ছিল যখন, রেগে গাইতাম কেন – এর উত্তর হল, আসলে আমরা সব ধরণের স্টাইলই মেলাতাম, সব স্টাইলই পছন্দ করতাম আর স্বাধীনভাবে মেলাতাম এটার সাথে ওটা। রক তো বটেই, তা প্রধানই ছিল। আসলে তখন মনে হয় (রেগে গান) একটাই করেছিলাম আমরা, “Give Me Back My Record Player”। এটা তেমন কোন সিরিয়াস গান ছিল না… ইউরোপ থেকে তখন ভিনাইল ক্যাসেট(ফিতাওলা ক্যাসেট) বিদায় নিচ্ছিল, জাগা করে নিচ্ছিল সিডি।
কামুবি- রেগে? গানটা? আপনের গান?
কাফ- হ্যাঁ, আমার গান, আমার করা প্রথম রেগে গান বলা যায়। তেমন আহামরি কিছু না, আমার এমনকি মনেও নাই তার লিরিক্স।
কামুবি- টাইটেল থিকাই মোটামুটি বোঝা যায়, কী নিয়া গান।
কাফ- হুম, আসলেই, টাইটেলই বলে দেয় সব। হাহা।
টীকাটিপ্পনি বা অনুবাদকের ফাতরা আলাপ-
(১) রাস্তাফারাই – জামাইকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ভিতরে গইড়া ওঠা এক ধর্মীয় জীবন দর্শন। কালোদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এক ধর্মীয় লেবাসও কওন যায়। রেগে গান(এবং বব মার্লি)-এর লগে যার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।
(২) রেইনবো গ্যাদারিং – ৬০ এর দশক থেকে ইউরোপ-আম্রিকায়(বর্তমানে আরো নানা জাগায়), প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরোধী লুকজন, যেমন ধরেন গিয়া হিপ্পি, বোহেমিয়ান, এনার্কিস্ট ইত্যাদি কিসিমের মাইনষে বনে জঙ্গলে একটা ক্যাম্পের মতন কদিনের লাইগা কমিউন গড়ে।
(৩) টিপি(tipi) – একধরণের তাঁবু। মাইনষে থাকে। এই ছুডকালে গল্পের বইয়ে বা সিনামায় আমরা রেড ইন্ডিয়ানগো যেরাম তাম্বুতে থাকতে দেহি, হেডি।
কাফ থরের একটি গানের লিঙ্ক –
কাফ থরের সাইট – http://www.actiontaken.dk/