হাওয়ায় বিদ্রোহের গর্জন – আল-বিরুনী প্রমিথ

বড় কাটারায় যাবার আগের রাস্তাটা বরাবরের মতোই মানুষজনে ভরপুর ছিলো।

সাধনা ঔষধালয়ের রাস্তায় সেই সময়ে এলাকার প্রাচীনতম ভিক্ষুক ষাটষট্টি বছরের হাফেজ মিয়া নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলে। কেউ তাতে কর্ণপাতও করেনা। তবুও হাফেজ মিয়া একা একাই রাজনৈতিক স্মৃতিচারণ করে চলে।

“ আজকাইলকার পুলাপান রাজনীতির ‘র’ ও বুঝবার পারছে যদি। সাফসুতরা পায়জামা পিন্ধা খাড়াইয়া চিল্লাইলেই যেনু রাজনীতি হইবার লাগছে। আমাগো সুমায় নেতারা কেমনে মাইনষের লগে হাইসা হাইসা কথা কইতো । অহনকার চ্যাংড়া চ্যাংড়া ছাওয়ালগুলা কেবল রোয়াব দেখাইবার পারে। হালার বুকাচুদা।“

এলাকার মানুষজন কোনকালেই হাফেজ মিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপরে ভরসা রেখেছে কিনা জানা নেই। কথিত আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজে সরাসরি রাজাকার না হলেও চাল – ডাল আর পরনের কাপড় জোটাতে রাজাকারদের নানা সময়েই বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতো হাফেজ মিয়া। একাত্তর পরবর্তী সময়ে রাজনীতির কলুষিত চেহারা কিভাবে প্রতিক্রিয়াশীল , ভন্ড চরিত্রের হাফেজ মিয়াকে অপাংক্তেয় হিসাবেই রেখে দিয়েছে সেটা এক রহস্যই বটে।
সাধনা ঔষধালয় থেকে সাড়ে পাঁচ গজ দক্ষিণের ডাস্টবিনে একটি কালো কুকুরকে একাগ্রচিত্তে কি যেন চাটতে দেখা যায়। আতরের যে একগাদা পাইকারী দোকান আছে তার একটা থেকে বউয়ের জন্য আতর কিনতে যাওয়া হালকা নীল রঙের কলারওয়ালা এক মধ্যবয়ষ্ককে আতর নিয়ে দোকানীর সাথে দরদাম করতে দেখা যায়। সে বেশ জোরে জোরেই দোকানদারের সাথে আতরের দাম নিয়ে ঝগড়া করছে ।

“ মিয়া এতো দাম দিয়া কেঠায় আপনের আতর কিনবো ? খালি তো বয়া বয়া মাছি মারোন লাগবো আপনের।“

পান খেয়ে হৃষ্টচিত্তে পুনরায় দোকানে বসা দোকানদারকে আতরের দাম নিয়ে আপোষহীন মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। সে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে “ যা দাম কইছি দিবার পারলে আতর লয়া যান । “

নীল রঙের কলারওয়ালা নিজের মনে গজগজ করতে করতে পরাজয়ের গন্ধমাখা মন নিয়ে খালি হাতেই ফিরে যায়। মিনমিনে স্বরে দোকানদারকে দুইবার “ চুদির ভাই “ বলে গালি দিতে ভোলেনা। দোকানদার স্থানীয় কাস্টমার হারিয়েও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। শহরের বড় বড় দোকানদার সব তার দোকান থেকে আতর নিয়ে সেখানে বিক্রি করতে বাধ্য, এই সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দোকানদারী মন সম্পূর্ণই ওয়াকিবহাল।

সমগ্র রাস্তাটাই এমন খন্ড খন্ড ঘটনার সমাহারে প্রতিদিন পরিপূর্ণ থাকে। জীবনের এই প্রাত্যহিক ধারাকে ঠিক নিস্তরঙ্গ বলা যাবেনা যদি মানুষের জীবনের এইসব বৈচিত্রপূর্ণ আঙ্গিকের নানা খুঁটিনাটি বিষয় কাউকে মুগ্ধ করে থাকে।WP_20141223_001

বড় কাটরার রাস্তাটা পার হয়ে সোয়ারীঘাটে সস্তা দামের যেই খোলা হোটেলগুলো দেখা যায় সেখানে সবজিগুলো প্রবেশ করার পর চোখের সামনেই থাকে। যার যেই সবজি ভালো লাগে সে চোখের সামনে সেটা দেখে বেয়ারাকে অর্ডার করে। আজিজ সবেমাত্রই শিং মাছের ঝোল আর নিরামিষ দিয়ে ভাত খেতে আরম্ভ করেছে। ধীরে ধীরে সে মুখের গ্রাস শরীরের ভেতর গ্রহণ করে।

সকালে বউ নাজমার সাথে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছিলো তার। আর কতোদিন এই জায়গায় দমবন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে সেই নিয়ে।

“ সেই কবে থেইকা বড় ভাই কইতাছে তার নতুন মাছের ব্যবসার লগে তোমারে লাইগা যাইতে । তোমার কোন নড়ন-চড়নই নাই।“

এই বিষয়টা নিয়ে এই পর্যন্ত একশোবার বউয়ের কাছে তার অনাগ্রহের কথা বলেছে ফলবিক্রেতা আজিজ। যদিও আসল কারণগুলো বলতে পারেনি। তবে এইবারে সে আর সেই একই একঘেঁয়ে কথাবার্তায় যায়না। নিজেকে প্রাণপনে শান্ত রেখেই গমগমে স্বরে বলে উঠে , “ তোমারে আগেও অনেকবার কইছি যে তোমার ভাইয়ের লগে এই ব্যবসায় আমি যাইতাছিনা। আমি যেই ব্যবসা করি সেইটা লইয়া খুশী আছি আমি। আল্লায় বাঁচাইয়া তো রাখছে ভালোভাবে। এতো চিন্তা করো ক্যালা? “

নিজের কপাল নিজের মনেই চাপড়ায় নাজমা। “ ওরে আমার আল্লারে , এই পোড়া জায়গায় তোমার মন টানে? দেখতাছোনা কেমনে প্রতিদিন কুত্তা– বিলাইয়ের মতো পইড়া থাহি ? পাশের বাড়ির শিরিন ভাবির খবরদারী তো দেহোই আমরা উপ্রে। কিছু কইবার পারছো মুখ ফুইটা কোনদিন? আমি আর এইহানে থাকবার পারুমনা আমার শ্যাষ কতা।“

রুটির সাথে হালকা যেই সবজি ছিলো সেটা চুপচাপ সাবাড় করে স্ত্রীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে আজিজ। নাজমার বড় ভাই খোরশেদ হোসেন কেন বোনজামাইকে নিজের মাছের আড়ৎদারীতে সাথে নিতে চায় সেটা তার বউয়ের মোটাবুদ্ধিতে ধরবে কেন? বোনজামাইকে নিজের ব্যবসায় নিলে সারাজীবন তাকে চাকর বানিয়ে রাখা যাবে। নিজের ভরন্ত সংসারে আপন বোনকেও বিনা পয়সার ছুটা বুয়া বানিয়ে ফেলাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে আজিজ প্রধানত যেই কারনে নিজের সম্বন্ধীর সাথে মাছের আড়ৎদারীতে যুক্ত হতে চায়না সেটা হলো নিজের ছোট বোন আলেয়ার জন্য।

সবেমাত্র সতেরোতে পা দেওয়া উচ্ছল , প্রাণবন্ত চরিত্রের আলেয়ার দিকে আজিজের সম্বন্ধীর বেয়াল্লিশ বছরের খোরশেদের কুনজর সম্পর্কে আজিজ অনেক থেকেই ওয়াকবিহাল। আলেয়াও খোরশেদ হোসেন বাড়ি আসলেই সিঁটিয়ে থাকে। প্রায় সোয়া এক বছর আগে থেকে আজিজ মিয়া লক্ষ্য করতে আরম্ভ করেছিলো তার বাড়ি আসলেও কোন না কোন ছুতায় আলেয়ার আশেপাশে থাকবার জন্য খোরশেদ মিয়ার প্রাণ আকুলি– বিকুলি করে। তখন থেকেই আজিজ এই বিষয়টি সম্পর্কে শতভাগ সচেতন থাকে।

উপরের আপাদমস্তক সাংসারিক বিষয়টির সাথে সাথে আরেকটি সূক্ষ্ণতম অনুভূতি আজিজ নিজের মনের মধ্যে বয়ে বেড়ায় সবসময়। সোয়ারীঘাটের বাতাসে যেই নদীর গন্ধ আজিজকে সবসময় শীতল রাখে, তার খোঁজ নাজমা কিভাবে জানবে? এই যে সে মধ্যমসারীর লাভের ফলের ব্যবসাতে হাজার বড় ঝামেলায় থাকে তবু তার মন তৃপ্ত থাকে তার পেছনে সোয়ারীঘাটের বাতাসের অবদানকে সে অস্বীকার করে কিভাবে? আজিজ নিজের হাতের তালুর মতো করে এই বাতাসকে চেনে, এই বাতাসের আগেপিছের মানুষদের চেনে, এই জায়গার মাটিকে চেনে।

আজিজ উদাসীন মনে গ্রাসাচ্ছাদন করতে থাকে। ইদানিং রশীদ মিয়া তাকে বড্ড বিরক্ত করছে। প্রায় প্রতিদিন এসে তার চ্যালাচামুন্ডারা আজিজের কাছ থেকে চাঁদা চায়। সামনে কি এক পৌরসভার ইলেকশন হবে সেই জন্য। তার মতো মাঝারী মানের অনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই নাকি নিচ্ছে। আজিজ নিজের স্ত্রীকে এখনো পর্যন্ত এসবের কিছুই বলেনি। বললেই আর কোনভাবে এখানে টিকে থাকা যাবেনা। খোরশেদ মিয়ার ভরন্ত সংসারে তাদের উঠতে হবে। তারপর কোন এক স্তব্ধ সময়ে আজিজের বোন আলেয়াকে একলা পেয়ে হারামী খোরশেদটা …………

হোটেলের বিলটা মিটিয়েই নিজের ময়লা রুমালে মুখ মুখ মুছতে মুছতেই বাড়ি থেকে নাজমার ফোন এলো। প্রায় দেড় মিনিট পরে ফোনটা রেখে দেওয়ার পর আজিজ মিয়াকে রাস্তার চেনা লোকজন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখতে পেলো। তারা দেখলো আজিজ মিয়া একলা একলা নিজের মনে কথা বলতে বলতে তার দোকানের দিকে এগোচ্ছে এবং কাঁপা কাঁপা অস্থির আঙ্গুলে কাকে যেন একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে।

অবশেষে আজিজ মিয়া বুঝতে পারে অপেক্ষা করা ছাড়া তার সামনে আর কোন উপায় নেই। সে অস্থিরচিত্তেই পুনরায় নিজের দোকানে বসে। নিজেকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করে। আলেয়ার বাড়ি ফিরে আসবার কথা সাড়ে তিনটায়। এখন বাজে চারটা চল্লিশ তার বাড়ি ফেরার কোন খবর নাই। তবে কি খোরশেদ মিয়ার আর তর সহ্য হলোনা?? নিজের মনের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে আজিজ। এই মুহূর্তে সে বাতাসে নদীর গন্ধ পায়না। তার দোকানের কিছু সামনেই যেই ঘাট আছে সেখানে বরাবরই শত শত মানুষজন নৌকায় করে অপরপ্রান্তে পার হবার জন্য অপেক্ষারত। যাত্রীদের অনেকের কপাল থেকেই এই খরতপ্ত প্রহরে টপটপ করে ঘাম পড়তে থাকে।

“ কি হে মিয়া? বারবার তোমার কাছে আসবার লাগতাছে চাঁদার লাইগা, তুমি তো মিয়া মানুষ ভালা না। ফাইনাল কও কবে দিতাছো…………”

তারপরে যা কখনো রশীদ মিয়ার স্যাঙ্গাতরা প্রত্যাশা করেনি সেটাই ঘটলো। আজিজের ভেতরে যেই সূক্ষ্ণতম আগুনটা এতোক্ষণ সুপ্ত অবস্থায় ছিলো সেটাই দপ করে জ্বলে উঠলো। সে খেঁকিয়ে উঠে বলা শুরু করলো
“ ওই মিয়া আপনারা পাইছেন কি? কি পাইছেন? চান্দা চাইতে আহেন প্রতিদিন আমাগো কাছে। মাস্তানী দেহান? আমরা কি রশীদ মিয়ার বাপের গোলামী করি? চান্দা চাইতে উঠবার লাগছেন, আপনাগোরে চান্দা দিমু আমি হেহ, খবরদারী দেহায় ……………………” আজিজ অনর্গল বকে যেতেই থাকে। রশীদের চ্যালারা সেই আক্রমণের সামনে বিস্ফোরিত চোখে মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

অবশেষে পুনরায় বাড়ি থেকে নাজমার ফোন এলে আজিজ শান্তমুখে সেই ফোন ধরে। তার ভেতরকার যেই অস্থিরতা এতোক্ষণ যাবত প্রত্যেকেই দেখছিলো তাকে শেষমেষ উধাও হয়ে যেতে দেখা যায়। বড় একটা নিঃশ্বাসে বাতাসটা মুখর হয়ে উঠেছে বলে আজিজের মনে হয়। রশীদ মিয়া মানুষ অতোটাও খারাপ না। দরাজ দিল আছে লোকটার। সে না হয় মেজাজ খারাপ করে দু চারটা মন্দ কথা বলেই ফেলেছে। তাই বলে কি রশীদ মিয়া তার মতো চুনোপুটির সাথে শত্রুতায় সময় নষ্ট করবে নাকি? এলাকায় তার একটা ইজ্জত আছে তো। ভালো দেখে একটা পাঙ্গাস মাছ ধরে এনে রশীদ মিয়ার বাড়িতে দিয়ে আসলেই মানুষটা খুশী হবে। না হয়ে যাবে কই? গোটা এলাকায় পাঙ্গাস মাছের খোঁজ আজিজের চাইতে ভালো কেউ জানেনা।


DSC_1008

[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : “এসকেপিস্ট “। ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s