মলত্যাগ ও পদত্যাগের গল্প – হাবিবুর রহমান

সোরাব বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। তার প্রচন্ড হাগা ধরেছে। দুপুরবেলা কাঙালীভোজের লাইন ঘুরতে না ঘুরতে সোরাব আবার লাইনে পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঙালিভোজের মত একটা খাওয়ায় সে দুই নম্বরী করছে। আর কেউ না দেখুক আল্লায় তো দেখছে। ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে। তাইতো এই শেষ রাইতে তার তলপেটে প্রচণ্ড মোচড় দিচ্ছে। সোরাবের ঘুম কাইটা গেছে। কিন্তু দুই দিকে রাস্তার মাঝে উঁচু যে জায়গাটায় সে শুইয়া আছে, সেখানে খুবই সুন্দর বাতাস। শোয়া ছাইড়া সোরাবের উঠতে মন চায় না। শাহবাগ মোড়ের ট্রাফিক বাতিগুলি নিজে নিজেই জ্বলতেছে নিবতেছে। দিনের বেলায় এই জায়গাটা হাশরের ময়দানের মত হইয়া যায়। তামাম লোকজন যেন এখানে এসে হাজির হয়। সকলেই যেন ইয়া নফসি ,ইয়া নফসি পড়তেছে। সারাদিন এই চার রাস্তার মোড়ে গাড়ির হোগায় গাড়ি লাইগাই থাকে। আর প্রায় পত্যেক দিনই কুত্তার মত জ্যাম লাইগা যায়। মাঝে মাঝে সোরাবের মনে হয় মরিচের গুড়া আইনা লাগায়া দেয়। সোরাবের তলপেটে চাপ বাড়তে থাকে। আশেপাশে কোন মানুষের নড়চড় নাই। আনেকক্ষন পর পর একটা দুইটা ট্রাক হুঁশ কইরা চইলা যাইতেছে। দূরে রাস্তার ওইপারে ওভারব্রীজের নিচে একটা পুলিশের গাড়ি ঝিমাইতেছে। সোরাব ভাবে, নাহ! কাঙালীভোজের খাওয়া নিয়ে লালছ করা তার ঠিক হয় নাই। অবশ্য খিচুড়ি খাওয়ার জন্য সোরাব দ্বিতীয়বার লাইনে দাড়ায় নাই। যদিও তার বেজায় খিদেও লেগেছিল। খিচুরিটা একটু টক টক হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য লাইন দিয়া লোকজন সেই খিচুরি নিতে গিয়া মারামারি বেধে যাচ্ছিল। সোরাবরে এই মাজারটা প্রথম চিনাইছিল মোদাচ্ছের। প্রথম দিন তার খুব শরম লাগছিল। মোদাচ্ছের কইছে, ‘মাজারের শিরনি খাইতে শরম কী।’ এই শিরনির মইধ্যে নাকি আনেক বরকত আছে।


আজকে মন্ত্রীসাব আইছিলেন হাইকোর্ট মাজারে। মন্ত্রী সাবের নাকি কি ফাঁড়া যাইতেছে।মাজারের হুজুর জুমার নামাজের পর লম্বা কইরা মুনাজাত ধরছিল। বলছে, আল্লা তুমি মানী লোকের মান রাইখো, বালা মুসিবত দূর কইরো। মন্ত্রীসাবের লাইগা আল্লার দরবারে আরজ জানাইছে। মন্ত্রীসাবের নাম যদিও নেয় নাই। আল্লায় তো মাইনষের মনে কী আছে তা জানেই। সোরাব নামাজের আগেই মন্ত্রীসাবেরে একপলক দেখছে। হুজুর না বললেও, দেখার সাথে সাথেই সোরাব মন্ত্রীসাবরে চিনতে পারছে। এই লোক তাদের এলাকায় বছর তিনেক আগে নির্বাচনের সময় সোরাবের মত গরীবের বাড়িতেও আইছিল। কী সুন্দর লম্বা চওড়া মানুষ, কী টিপটপ, হাইসা হাইসা কথা কয়। আইসা তার ভালো মন্দের খোঁজ খবর নিছে, কইছে আমারে ভোটটা দিয়েন। মন্ত্রীসাব বাড়ি থেইকা বাইর হইয়া একটু সামনে গ্যাছে পর ছমু তার হাতে দুইশটাকা দিছে। ছমু এলাকার ছেলে। চুলে টেরি কাইটা, চোখে চশমা পিইন্দা হারাদিন চৌমুহনীতে চায়ের দোকানে বইয়া থাকে। কয়দিন হয় সে একটা মটরসাইকেল কিনছে। হারাদিন খালি ঘুইরা বেড়ায়, কাম কাজ কিছু করে না, সে নাকি পার্টি করে। মন্ত্রীর উছিলায় সোরাব অনেকদিন পর সেদিন সন্ধ্যায় দু’ পাঁইট চোলাই খাইছিল। এই বাজে নেশাটাই তারে ডুবাইছে। না হয় গ্রামে এত লোক থাকতে তার সব জমি জমা গুলাই যে গাঙের তলে গেল সে কি আর এমনি এমনি। মাইনষে মরার পর লাশ কবর দিয়া লোকজন চল্লিশ কদম দূরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত মুনকার-নাকীরও নাকি মুর্দারে সময় দেয়। গাঙের পেটে জমি জমা যাইতে না যাইতে তেনারা হাজির। যে ছেলেটা কিস্তির টাকা তুলতে আসে তার দিলটা অবশ্য ভালো আছে। ছেলেটা কইল আপনে গ্রামে থাইকেন না, টাকা পয়সা যা আছে নিয়া শহরে চলে যান। আমি এদিক সামাল দিমু নে। ভিটাটা তার তখনও আছে। এই ভিটা মাটি ছাইড়া সোরাবের যাইতে মন চায় না। ঘরে টাকা পয়সা, মাল সামান যা ছিল তা দিয়া কোনমতে ছেলেটারে বিদায় করে। ছেলেটা কয়, এই মাস নাহয় গেল, পরের মাসে কৈ থেইকা দিবা। ছেলেটার বুদ্ধি তার দুইদিন বাদে মনে ধরল। টাকা-পয়সা শেষ, ধার কর্য কইরা আর কয়দিন। তার গাঁয়ের অনেকেই শহরে রিকশা চালায়, অনেক মেয়েরা গার্মেন্টসে কাজ করে আর বাড়িতে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। একবার মনে হয় বউ ছাওয়াল নিয়া শহরেই চলে যায়। বউটা যদি গার্মেন্টসে কাজ করে আর সে যদি রিকশা চালায় বা কোন একটা কাজ পায় তাইলে তাগো আর অভাব থাকবো না। কিন্তু অচেনা শহরে বউরে নিয়া যাইতে তার মন সায় দেয় না। আবার এই খালি বসত ভিটায় টাকা পয়সার যোগার যন্ত না কইরা বউটারে কেমনে সে একলা ফালায়া আসে। অবশেষে চৌমুহনীতে গিয়া ছমুর সাথে দেখা করে। বসত ভিটা বন্ধক দিয়া ধার দেনা – দোকানের বাকী শোধ করে, কিছু টাকা বউয়ের হাতে দেয়, আর বাকি টাকা নিয়া সেরাব ট্রেনে কইরা মাস দুয়েক হইল ঢাকায় চইলা আসছে। ঢাকা শহরে চিন পরিচয় ছাড়া রিকশা পাওয়া খুব কঠিন। তার গ্রামের মোদাচ্ছের রামপুরার যে মহাজনের গাড়ি চালায় , মহাজনরে কইয়া তারে একটা রিকশা জোগাড় কইরা দিছিল। গত মাসের শেষে গুইনা দেখে, রিকশার ডেইলি জমা, গ্যারেজে থাকা খাওয়ার খরচ বাদ দিয়াও তার কাছে তিন হাজার টাকার মত ছিল। বউরে সে টাকা পাঠাইছে। কিস্তি শোধ দিয়া, ছমুরে কিছু দিয়া, বউ ছেলে কোনরকমে চলতে পারব। কিন্তু চোলাইয়ের এই বাজে নেশাটা তার গেল না আর বিপদও তারে ছাড়ল না। মোদাচ্ছেরের সাথে দুই দিন আগের রাইতে একটু খানি চোলাই খাইছে। আর কি, পরদিন সন্ধ্যাবেলায় কাণ্ডটা ঘটল। কাকরাইল থেইকা প্যাসেঞ্জার নিয়া সে বায়তুল মোকারম আসছে। বায়তুল মোকারম আইসা প্যাসেঞ্জার তারে দিছে পাঁচশ টাকার নোট। প্যাসেঞ্জাররে সিটে বসায়া থুইয়া সোরাব গেছিল টাকা ভাঙাইতে। আইসা দেখে প্যাসেঞ্জারও নাই রিকশাও নাই। গতকাল সারা সন্ধ্যা-রাত সে বায়তুল মোকারম থেকে গুলিস্তান চক্কর খাইছে। গুলিস্তান মাজারে আইসা নগদ দশ টাকা দিছে, তওবা করছে আর মদ খাইব না, হুজুরের নামে মানত করছে। অনেক রাইত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুইরা যখন সে বুঝতে পারছে রিকশটা সে আর পাইব না, তখন হাটতে হাটতে হাইকোর্ট মাজারে চইলা আসছে। পরদিন দুপুর পর্যন্ত সে ওইখানেই বইসা ছিল। দুপুর বেলা তার দেশী, এলাকার মন্ত্রীরে দেইখা তার মনে হইল আল্লায় মনে হয় তারে মাফ করছে। মন্ত্রীর সাথে দেখা কইরা তার পরিচয় দিলে, মন্ত্রী তো তারে চিনবই। আর যাই হউক তার দেশী লোক বইলা কথা, কিছু একটা কি মন্ত্রী সাব তার জন্য করব না? মন্ত্রীসাব আইসাই মাজারের অন্দর মহলে ঢুইকা গেল। সোরাব তো আর ভেতরে ঢুকতে পারে না। তারপর জুমার নামাজের সময় হইলে সে ওজু কইরা নামাজ পড়তে দাড়াইল। সারাক্ষণ মাজারের অন্দর মহলের দরজায় তার নজর ছিল। নামাযে খাড়াইয়া উঁকি দিয়া দেখল মন্ত্রী সাব প্রথম কাতারে আছেন। নামাজ শেষ কইরা লোকজন হুড়মুড় কইরা কাঙালীভোজের লাইনে দাঁড়াইল। মন্ত্রী সাব ডেকচির একটু পিছনে দাড়িয়ে। সোরাবও লাইনে দাড়াল। তার খিদাও লাগছে। গতকাল বিকালের পর আর কিছু খাওয়া হয় নাই।


মাজারের ডেকচি থেকে লোকজনকে খিচুড়ি দেয়া হচ্ছে। দুলাল ডেকচির একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন সার বেঁধে খিচুড়ি নিচ্ছে। তাদের চোখে মুখে আনন্দ। এই যে এতগুলা গরীব মানুষরে সে খাওয়াইল তারপরও কি আল্লা তার কথা শুনবে না। অনেক কষ্ট কইরা সে মন্ত্রী হইছিল। কি ঝামেলায় যে সে পড়ল। একটার পর একটা বিপদ তার লাইগাই আছে। কিছুতেই ঝামেলা তার পাছ ছাড়ে না। টাকা পয়সা কি সে একলা নিছে।এ খন তার বিপদে কেউ তার পাশে কেউ নাই। অনান্য মন্ত্রীদের কথাবার্তা আর আচরণ দেখলে মনে হয় যেন তারা সব ফেরেশতা। এইসব মন্ত্রীদের নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা আছে। যাই হোক, এত কিছুর মধ্যেও সান্ত্বনার বিষয় এই যে ম্যাডাম তার প্রতি বিশ্বাস হারান নাই। ম্যাডাম কি আর যা তা মানুষ। কত বড় পরিবারের মেয়ে তিনি। সে ছোটবেলা থেইকা মানুষ দেইখা আসতেছেন। দুলাল যে কত আলাভোলা, সহজ সরল একটা মানুষ, এইটা কি ম্যাডাম বুঝে নাই? নিশ্চয়ই বুঝছে, আর সেজন্যই তো এতসব ঝামেলার পরও ম্যাডাম তারে সাপোর্ট দিছে। ম্যাডামেরও তো কিছু করার ছিল না। ম্যাডাম কি তার জন্য কম চেষ্টা করছে, তার উপরেও তো কত রকমের চাপ। দেশটা যে তার দুইটা হাতের উপরে চলতেছে এইটা আর কেউ জানুক আর না জানুক দুলাল তো জানে। দুই হাতে ম্যাডাম আর কত দিক সামলাবে। বাকি মন্ত্রীরা যে কি করতেছে তা কি আর ম্যাডামের অজানা! এই মন্ত্রীগুলাই তো তারে ডুবাইল। ম্যাডাম কি কম চেষ্টা করতেছে! কিন্তু সে একলা একলা আর কি করবে।এই সব ভাবতে ভাবতে আর সামনের সারি সারি গরীব মানুষের খিচুড়ি নেয়ার উত্তেজনা দেখে নিজের প্রতি দুলালের একরকম কোমল অনুভূতি হয়। আহা! মানুষটা সে খারাপ না। কিন্তু এই পত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেন কেমন? তার মত মানুষরে তারা বুঝতে পারল না। এই টেলিভিশন আর পত্রিকাওয়ালাদেরও সে হাড়ে হাড়ে চেনে। ম্যাডামই তো বললেন, টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য টাকা কে কোথা থেকে পেয়েছেন তা কি আর তিনি জানেন না। কিন্তু দুলাল বুঝতে পারে না, সে কোনদিন তো এদের সাথে লাগতে যায় নাই, সে ছিল তার মত। কেন যে এরা তার পিছনে এভাবে লাগল! এই পত্রিকাগুলো যে আসলে দালাল তা আর তার বুঝতে বাকি নাই। শুধু দুলাল ক্যান, সারা দেশের মানুষই তা জানে। যাই হোক মন্ত্রীত্ব গ্যাছে গ্যাছে, ম্যাডাম তো তারে ভুল বুঝে নাই, তারে সাপোর্ট দিয়া গ্যাছে। আর সে ও তো কম করে নাই দলের জন্য, ম্যাডামের জন্য। ম্যাডামের নামে এত বড় একটা র্গালস কলেজ সে নিজের খরচায় করেছে। তারচেয়ে ম্যাডামের জন্য, দলের জন্য বেশি করেছে এরকম কেউ বলুক তো! এইসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ ছলছল করে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে লাইনের মধ্যে দাড়ানো মাঝবয়স্ক একটা লোকে তারে মন্ত্রীসাব … মন্ত্রীসাব বলে হাত নাড়তেছে। আর ভিড় সামলাতে ব্যস্ত তার ভলান্টিয়াররা লোকটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। আহা! তার সাদাসিধে কাপড় চোপড় সত্ত্বেও এবং কোন প্রচার ছাড়াও লোকটা তারে ঠিকই চিনতে পেরেছে। নিশ্চয়ই লোকটা তারে পছন্দ করে, কী আবেগ দিয়ে ডাকছিল লোকটা তারে। লোকটা এখনও জানে না যে সে পদত্যাগ করেছে। পদত্যাগ করার পর তার মনে হল মাজারে শিরনি দেবে। তার যখন মন খারাপ হয় তখন সে গরীব মানুষদের একবেলা খাওয়ায়। মনটা যে তার কত নরম! ভাবতে ভাবতে সে আর চোখের পানি সামলাতে পারল না, কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে মাজারের অন্দর মহলে চলে গেল। কিছুক্ষন পর ড্রাইভার এবং সঙ্গের লোকজনকে ডেকে চলে যেতে বলল, সে একটু একা থাকতে চায়।


সোরাব খিচুড়ির লাইনের সামনে দাড়িয়ে চিৎকার করে ডাকল ‘মন্ত্রীসাব’ , ‘মন্ত্রীসাব’। মন্ত্রীসাব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। তার ডাক শুনতে পেল না। সোরাব মন্ত্রীসাবকে ডাকতে থাকল। কিন্তু খিচুড়ির লাইন সামলাচ্ছিল যে ছেলেগুলো, তারা তাকে ঠেলে ধাক্কা দিয়ে পিছন দিকে নিয়ে গেল। মন্ত্রীসাব যখন তার দিকে তাকাল তখন সে মন্ত্রীর থেকে অনেকটা দূরে ছেলেগুলো তাকে পিছন দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে তাড়াতাড়ি ওই প্লেটের খাবার শেষ করে, হাত ধুয়ে সোরাব আবার লাইনে দাড়াল। এবার সে লাইনের বেশ পিছনে। মন্ত্রীসাবকে এখন আর দ্যাখা যাচ্ছে না। তারপরও যদি মন্ত্রী আবার আসেন এই ভেবে সোরাব দীর্ঘ লাইনের মধ্যে দাড়িয়ে রইল।যদি মন্ত্রীসাবকে তার সমস্যার কথাটা কোনভাবে বলা যায়, নিশ্চয়ই তিনি কিছু একটা করবেন। আর তার উপর সে দেশী লোক। মোনাজাতের সময় সে খাস দিলে মন্ত্রীর জন্য দোয়া করছে। মন্ত্রী নিশ্চয়ই তার জন্য কিছু করবে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে থাকার পর যখন সোরাব লাইনের সামনের দিকে তখন সে খেয়াল করল, মন্ত্রীসাবের গাড়িটা(এত বড় আর এত সুন্দর গাড়ি যে মন্ত্রীসাবের না হয়েই যায় না)তার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে গেল। গাড়ির কালো কাঁচের জন্য ভেতরটা দেখা গেল না। সোরাব বুঝল তার কপালে অনেক দুঃখ আছে। মন্ত্রীসাব চলে যাচ্ছেন। তার সমস্যার কথাটা বলাই হল না। মন খারাপ করে সোরাব দ্বিতীয় প্লেট খিচুড়ি শেষ করল। তারপর আপনমনে হাঁটতে লাগল। রাত একটু হলে সোরাব ঘুরতে ঘুরতে শাহবাগ মোড়ে এসে দেখে রাস্তার মাঝখানে একটা উঁচু জায়গায় লোকজন ঘুমাচ্ছে। গতকাল থেকে সে ঘুমায় নাই। সে লোকগুলোর পাশে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে সে তার গ্রামের কথা, বউ-ছেলের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।


দুলাল অনেকক্ষণ একাকী বসেছিল। কতক্ষণ সে জানে না। মাজার আগর বাতি আর গোলাপজলের গন্ধে তার নরম মনটা আরও নরম হয়ে আসে। তার মধ্যে যেন প্রথম যৌবনের মত সততা ফিরে এসেছে। এখন কিছুতেই তার আর যায় আসে না। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে দেখল অনেক মিসকল হয়ে রয়েছে। সে তার গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিবে এমন সময় দুলাল লক্ষ্য করল তার গাড়ির সামনে তখনও পতাকাটা লাগানো আছে। দুলাল imagesকিছু বলল না। তখন প্রায় মধ্য রাত। দোয়েল চত্বর পার হয়ে, টি এস সি হয়ে গাড়ি শাহবাগে পৌঁছালে দুলাল ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, “কী ব্যাপার, তুমি গাড়ির সামনের পতাকাটা এথনও খুলো নাই কেন? যাও পতাকাটা খেলো।” ড্রাইভার ছেলেটাকে পতাকাটা খুলতে বলে দুলাল জানালা দিয়ে পাশে তাকাল দেখল রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডে নারী-পুরুষ শিশু ঘুমাচ্ছে। দুলালের মনটা আবার ভারী হয়ে উঠল। আহা! লোকগুলোর কি অবস্থা! দেশের মন্ত্রীরা যে কী করছে! ম্যাডাম দুই হাতে আর কত কিছু সামলাবে!
সোরাব দেখল অবস্থা বেগতিক। শোয়া অবস্থা থেকে সে উঠে বসে, এদিক ওদিক তাকায়। শহরের এই চার রাস্তার মোড়ে কোন আড়াল তার চোখে পড়ল না। কয়েকটা রিকশাওয়ালা পুলিশবক্সের সামনে রিকশার সিটে ঘুমাচ্ছে। নাহ, কেউ তারে দেখছে না। অন্ধকারের মধ্যে এক টুকরো কাপড় সে হাতে পেল। কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে সোরাব দৌড় দিল। রাস্তার পাশে গ্রিলে ঘেরা ফুটপাতের দিকে এক কোণায় লুঙ্গি তুলে বসে পড়ল। পিছনদিকে পড়ে যাওয়া সামলাতে সামনের গ্রিলটা শক্ত করে ধরল, তারপর সোরাব তার শরীরের সব ছিটকিনি খুলে দিল। কিছুতেই তার আর কিছু যায় আসে না।

(রচনাকালঃ ১২/১০/২০১২)


DSC_3476

[হাবিবুর রহমান : চলচ্চিত্র-নির্মাতা, রাজনীতি-কর্মী। ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s