চেনা ঘরে প্রবেশ করতেই ঘরের চাইতেও বেশী পুরনো খকখক কাশির আওয়াজ শোনা যায়। অবিরাম। ক্লান্তিহীন। যখন শুরু হয় তারপর সহজে আর থামাথামির নাম-গন্ধ নেই। কী যে যন্ত্রণার তা বলে শেষ করা যাবেনা। বাড়ির মানুষজন হিমসিম খায়। তবু আর কি করা? ডাক্তার–বদ্যি বহু দেখিয়েছে কিন্তু কেউই প্রতিকার করতে পারলোনা। শীতের বেলাতে প্রকোপ আরো বেড়ে যায়। তখন বারেক মিয়ার কাশির দমকে ঘরের দেয়ালগুলোও যেন কাঁপতে থাকে। হয়তো অনিচ্ছায়। হয়তো বাড়ির এককালীন কর্তার প্রতি ভালোবাসায়। ছেলে বদরুল বাপের ধারাবাহিক কাশির আওয়াজে গুঢ় কোন চিন্তায় নিজেকে জড়িত করতে আগ্রহী হয়না। বুড়ো বাপটা হাড়মাস কালি করে দিলো একেবারে। সারাটাজীবন।
অনেকদিন পরে আজকে সন্ধ্যাটা নির্ঝঞ্ঝাট কাটলো বদরুলের। কিন্তু সেখানেও বুড়ো বাপ থেকে নিস্তার ছিলো কই? সদ্যই পার্টির শামীম ভাইয়ের কল্যাণে বিক্রমপুরের জমিটার ব্যবস্থা ফাইনালী পাকা করে ফেললো। ছেলে-মেয়ে বড় হতে হতে সেই জমির দাম নিশ্চিতভাবেই হু হু করে বেড়ে যাবে। তাদের বিদেশে পড়ার খরচ এই জমি কেনাবেঁচা থেকেই দেওয়া যাবে। বাপ হিসাবে সন্তানদের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালনের পথে বড় একটা বাঁধা পার হওয়া গেলো। কোথায় সেই নিয়ে বাল্যবন্ধুরা তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, সেও খুশী মনে দামী স্কচ খাওয়াবে তা না। বন্ধুরা শুরুই করলো সেই পুরানো ক্যাচাল দিয়ে।
“কিরে, তোর বাপ এখনো সেই আগের মতোনই ট্যাটন আছে নাকি?”, ইদ্রিসের চোখে বিদ্রুপ, মুখে কৌতূহলের আন্তরিক ছাপ ধরে রাখবার চেষ্টা।
“ইশ, বাপটা তোর এতো বছর পরে এসেও মানুষ হলোনা। ছেলে টাকাপয়সা করে সংসার ভরে দিতেছে তবুও লোকটা যদি একটু ঠান্ডা হতো। নাহ , সেই আগের গোঁ ধরেই বসে থাকবে। কাঁচা পয়সার সুখ সহ্য হয়না।” তোরাবের কন্ঠ বন্ধুর প্রতি সমব্যথী শোনায়।
বদরুল বন্ধুদের কারো কথারই কোন জবাব দেয়নি। কি জবাব দেবে? এরকম গোয়ারগোবিন্দ লোক নিয়ে পারা যায়? মান্ধাতার আমলের সেই নীতি–নৈতিকতার কচকচানি। উফ, অসহ্য!! এখন সব জায়গায় খালি টাকাপয়সা উড়ে। বাতাসটাই পয়সায় ভরপুর। কেবল তাকে খামচে ধরবার কৌশল জানা চাই। না শিখলে মানুষ বাঁচবে কিভাবে? কিন্তু কে বুঝাবে লোকটাকে? তার সেই একই কথা, গৎবাঁধা। যেন টেপরেকর্ডার বাজছে অবিরাম। “আমাগো সময়ে রাজনীতি কি আমরাও করিনাই বদরুলের মা? দেশ নিয়া, জাতি নিয়া চিন্তাভাবনা অহনকার ছোঁড়াগুলার থেইকা অনেক বেশী আছিলো আমাগো। বিয়ার পরে পাঁচ বচ্ছর তুমি কতোই না কষ্ট করলা খেয়াল আছে? হের পরে কি হইলো? তোমার পোলা হইলো, আমিও আস্তে আস্তে সংসার গুছাইয়া আনলাম। কতো জায়গা থেইকা কতো লোভ দেখাইলো মানুষজনে। কই, আমি তো গুয়ে পা দেইনাই। তারপরেও তোমার ঘরে পিন্দনের শাড়ী কোনটা ছেঁড়া আছিলো কও? এই কথা আমারে কোনদিন কইতে পারবানা। রাজনীতি আমরাও করছি। কিন্তু দেশরে ভালোবাইসা। লগে সংসারের দেখভালও করছি। অহনকার ছ্যামড়াগুলারে দেহো। খালি ছোটে ট্যাকার পিছে। তোমার পোলারে দেহো। চিন্তা নাই ভাবনা নাই খালি আছে ট্যাকার ধান্দায়। ট্যাকার লাইগা পারেনা এমন কোন কাম আছে? একদিন দরকার হইলে তোমারে–আমারেও লাত্থি দিয়া ঘর থেইকা বাইর কইরা দিবো। তুমি দেইখা নিও, সেইদিনে বুড়ার কথা তোমার মনে ধরবো।”
“ও বদরুল”, চিকন মিহি স্বরে জননী আমেনার কন্ঠ এই শীতে তীব্র হয়ে বদরুলের কানে পৌঁছালে জনকের গৎবাঁধা ঝাঁঝালো বাক্যমালার রোমন্থন থেকে মুক্ত হতে পারে সে, স্বস্তি পায়। আজকের রাতটাও তার জব্বর কাটবে। তার বউ, ছেলেমেয়ে সহ নিজের বাপের বাড়িতে গেছে। রাতভর মাল গেলা যাবে। গলা অবধি। ভাবতে ভাবতে সরু অথচ ঋজু রেখার আমেনা বদরুলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“কাইল সকালে করিম ডাক্তারের চ্যাম্বারে গিয়া তারে বাড়িত আসতে কইস। তর বাপের কাশি আইজকা বাড়াবাড়ি হইছে। থামেইনা। এমনে আর কতো?”, আমেনার কন্ঠে অসহায়তা। সাথে ক্লান্তিও ছাপ ফেলতে আরম্ভ করেছে।
ঠোঁটে একটা নীরব অথচ তীব্র বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠে বদরুলের। যেন অদৃশ্য যেই লড়াইটা পিতা–পুত্রের মাঝে বছরের পর বছর ধরে চলছে তার মীমাংসা হয়ে গেছে। তীব্র অস্বস্তিকর দ্বৈরথটা যেন তার জয়লাভ করা হয়ে গেছে। নিষ্পৃহ থাকবার চেষ্টা করতে করতে সে হালকা শ্লেষ মেশানো গলায় বলে,
“তা বুড়া মিয়া কি রাজি হইবো? করিম ডাক্তারের যেই ভিজিট ফি তাতে সৎ পয়সায় তো তারে বাড়িত আনা যাইবোনা। আনতে হইলে আমার কামানো কাঁচা পয়সাতেই তারে নিয়া আসতে হইবো। হেয় সহ্য করবার পারবো?”
পিতা–পুত্রের দুর্বোধ্য লড়াইতে আমেনা বরাবরই অসন্তুষ্টি পোষণ করে এসেছে। সেটার প্রতিফলন তার কন্ঠে স্পষ্ট হয়।
“তোগো বাপ – ব্যাটার খিঁচ নিজেগো কাছে রাখ। আমারে হুনাইয়া লাভ নাই। কাইল সকালে করিম ডাক্তারের চ্যাম্বারে গিয়া তারে বাড়িত নিয়া আসবি। কাশতে কাশতে কোনদিন না মইরাই যায়।”
বদরুলের মুখে কিছু কথা এসে গিয়েছিলো। মুখ ফুটে বলার আগেই ঝট করে আমেনা ঘর থেকে সরে গেলে সেগুলো অব্যক্ত থাকে। তবে হারিয়ে যায়না। বদরুল এতোদিন লক্ষ্য করেনি তবে এখন দেখলো তাদের ঘরটার বিভিন্ন জায়গা থেকে চুন খসে খসে পড়তে শুরু করেছে। শীতকালে এই ড্যাম্পনেসটা আরো বেশী সমস্যার। বদরুল খাটের নিচ থেকে বোতল বের করতে হাত বাড়ায়। পেটের মধ্যখানে একটু ঝাঁকির মতো লাগে। একসময় বেশ স্লিম শরীর ছিলো। পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পাবার পর থেকেই বেশ একটা ভুড়ি বাগিয়েছে। মোটা বোতলটা ততক্ষণে টানটান বিছানার মাঝে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে বদরুলের মেদবহুল শরীরটা নিস্তেজ হতে শুরু করলে বোতলটা তার পাশে অর্ধেক পূর্ণ হয়ে পড়ে থাকে।
পরদিন সকালে করিম ডাক্তারের চিকিৎসা শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বারেক মিয়া ঘরে পড়ে থাকাকে সমীচীন বলে মনে করেনা। স্ত্রীর মৃদু নিষেধ অতঃপর হালকা অভিশম্পাতকে এড়িয়ে ঘর থেকে বেরুলে বাইরের সূর্য ছাড়াও বুকের ভেতরে নতুন সূর্যকে বারেক মিয়া অনুভব করতে পারে। ছেলের কামানো কাঁচা পয়সায় তার আজকের চিকিৎসা হয়েছে। এই অবস্থায় ঘরে বসে বসে সে কথা মনে করে কি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়বে নাকি? বউকে এই কথা বলাও যায়না। কাউকেই বলা যায়না। বিশটা বাড়ি পার হয়ে আনোয়ার মাস্টারের বাড়িতে যাবার প্রয়োজনীয়তা এই কারণেই তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। এই আনোয়ার মাস্টারের বাড়িটা তার জন্য মস্ত সুবিধার হয়েছে। অস্বস্তিকর সময় এড়াতে চাইলেই সেখানে চলে যাওয়া যায়।
সোজা আনোয়ার মাস্টারের ঘরে ঢুকলে তার গলায় হালকা আনন্দের আভাস পাওয়া যায়।
“আরে তুমি? আইজকা আইবা এইডা আশা করিনাই। পরশুদিন ভাবীর লগে দেখা হইছিলো। কইলো কাশতে কাশতে তোমার অবস্থা কাহিল। অহন দেখি নিজেই আইসা পড়লা, বাহ বাহ।”
বারেক মিয়া সলজ্জ হাসি হাসে। এই একটা আনন্দের জায়গা। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই আনন্দ। স্বস্তির আগমন। সাধে কি কারণে–অকারণে এখানে আসে?
কিন্তু হালকা কুশলাদি বিনিময়ের পরে সেই আনন্দে ব্রেক কষে আনোয়ার মাস্টার বলে বসে, “তোমার পোলায় তো দেখাইয়া দিছে। দুই সপ্তাহ আগে খবর পাইলাম বিক্রমপুর না কই জানি জমিও কিনা ফালাইছে। তোমার নাতিপুতির বিদেশে পড়ালেখার বন্দোবস্ত নিশ্চিত। কাশির রোগ বাদ দিলে অহন তোমার কেবল পায়ের উপরে পা তুইলা আরাম করনের সময়।”
এইসব কথার কি জবাব দিতে পারে বারেক মিয়া? শৈশবে চাচীর মুখে প্রায়ই একটা কথা শুনতো। ‘টকের ডরে পালাইয়া আইসা তেঁতুলতলায় বাস’। তারও এখন এই অবস্থা। কোথায় হারামজাদা ছেলের কাছে তার পরাজয়ের কথা ভুলতে এখানে এসেছে তাও নিস্তার নাই। এখানেও ঘুরেফিরে সেই ছেলের কথাই চলে আসলো। বারেক মিয়ার দাঁত শিরশির করে। বহু বছরের পুরানো দাঁত। যদিও এখনো তার কোনটাই পড়ে যায়নি।
চা আর হালকা নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আনোয়ার মাস্টারের স্ত্রী জমিলাও বারেক মিয়ার পুত্রের প্রশংসায় যোগ দেয়, “আপনার পোলায় আসলেই একখান হীরার টুকরা বারেক ভাই। কাছ থেইকাই তো দেখতাছি। অল্প সময়ের মইদ্দে কত কি না কইরা ফালাইলো। আপনি অন্য পোলাদের কথা ভাবেন। জলিল মিয়ার পোলায় নেশা–ভাং কইরা বস্তিতে পইড়া থাকে মাসের বিশদিন। শিকদার সাহেবের পোলারে ছিনতাইয়ের লাইগা পাবলিক রাস্তায় পিটাইয়া মারলো। আকরাম সাহেবের পোলায় মাইয়া মানুষ নিয়া বেলেল্লা করে। পাড়ার সবে জানে। কিন্তু বদরুল? টাকাপয়সা কইরা বুড়া মা–বাপরে দেখতেছে। নিজের পোলামাইয়াগোর বন্দোবস্তও কইরা ফালাইছে অল্প বয়সে।”
ছেলের প্রশংসায় আনোয়ার মাস্টারের বাড়ির কর্তা–কর্ত্রী উভয়ই দীর্ঘসময় পঞ্চমুখ থাকে। বারেক মিয়ার ইচ্ছা হয় হাতুড়ি কি শাবল জোগাড় করে নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি দেন। কী কুক্ষণে এই সময়ে এখানে এসেছিলেন আল্লাহই মালুম। হীরার টুকরা পোলা তার, থুঃ। এই কুলাঙ্গার পোলার কাছে নেড়ি কুত্তার মতো এই বুড়া বয়সে পড়ে থাকবার লজ্জা অন্যরা বুঝবে কি? টাকাপয়সা করছে, হাহ। কতজনের মুখের খাবার কাইড়া নিয়া সেই পয়সা হইছে খবর রাখে বাইরের মানুষে? হয়তো সেই খবর রেখেও চুপ করে থাকে। এখন তো এটাই নিয়ম। যুগের নিয়ম। আনোয়ার মাস্টারের কথাই ধরা যাক। শালা, সরকারী হাইস্কুলে সামান্য কয় পয়সা বেতন পায়। দিব্যি সাইত্রিশ ইঞ্চি কালার টিভি কিনে বসে আছে। কোত্থেকে এই পয়সা আসে বারেক মিয়া বুঝেনা? সে কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? অবশ্য এরা তো বাইরের মানুষ। ঘরের ভেতরেও তো সেই একই কেচ্ছা । ছেলে যেই টাকাপয়সার মুখ দেখতে শুরু করলো তার বউ নিজের পোলার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে। সাবধানে। প্রথম অনেকদিন বারেক মিয়াও বুঝতে পারেনি। যখন বুঝলো ততোদিনে অনেক দেরী। সে ততোদিনে ঘরেও নিঃসঙ্গ হতে শুরু করেছে। শালার, চারিদিকে ধান্দাবাজ দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। বারেক মিয়া না পারে কিছু বলতে না পারে সইতে।
এরপরে আর বেশীক্ষণ আলাপ চালানো যায়না। প্রায় ঘন্টাখানেক থেকে বারেক মিয়া বের হয়ে আসে। বাইরের আকাশটা গতানুগতিক দেখায়। নীল এবং নৈর্ব্যক্তিক। নর্দমা দিয়ে রাস্তার ধারের দেওয়ালে যেই শ্যাওলা লেগে আছে তার আস্তরণ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। মনুষ্যপ্রাণীর মল-মূত্র সমেত। বারেক মিয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে সচেতন। দীর্ঘদিন ধরে বুকে জমে থাকা অনুভূতির ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে তার আটপৌরে সময় অতিক্রান্ত হয়। একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলো। ঠেলাগাড়ীর সাথে ধাক্কা খেয়ে পেটে বেশ জোরসে ব্যাথা পেলে দুইটা খিস্তি দিয়ে বারেক মিয়া সামনে এগোয়। কাশির থেকে মুক্তি পেলো তো এখন পেটে গোত্তা খেলো। বেশ ব্যথা করছে। ছরে গেছে কিনা কে জানে। বাড়ি ফিরে পাঞ্জাবী খুলে দেখলেই হবে। এই বয়সে এতো শারীরিক কষ্ট আর নেওয়া যায়না।
দরজায় কড়া নাড়লে কাজের লোক হাসমত সবল হাতে দরজা খোলে। সদ্য রঙ করার দরজার ঘ্রাণ বারেক মিয়ার নাকে এসে লাগে। নাকটা হালকা কুঁচকে গেলে নিজের ঘরে এগোতেই সামনে স্ত্রী ও পুত্রকে দেখে। তাদের নিজেদের মধ্যকার কোন গোপন কথোপকথন। বারেক মিয়াকে দেখে উভয়েই নিজেদের মধ্যে ইশারা করলে বারেক মিয়া দেখেও না দেখবার ভান করে। পোলায় নিশ্চয়ই নতুন কোন ধান্দাবাজির গপ্প শোনাচ্ছে নিজের মাকে। আগে এসব দেখলেই সাথে সাথে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় উঠাতো। পোলার সাথে আদর্শগত দ্বন্দ্ব আর ঝালিয়ে কাজ নেই। ঠেলাগাড়ির যেই গুতা পেটে খেয়েছে এখনো ব্যাথা করছে। হয়তো ডাক্তার দেখাতে হতে পারে। এখন তার বয়স তো হয়েছে অনেক। বাকি সময়টা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করে পার করে দিলে কি দোষ?
[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট ‘। ]