বোরহানী – আল-বিরুনী প্রমিথ

প্রত্যেকেই কথা বলছে। যার যার সঙ্গী–সাথীর সাথে কিংবা পাশে বসে থাকা অপরিচিতজনের সাথে। রাশেদের কানে কারো কথাই তাই ঠিকভাবে পৌঁছায়না। কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকার পর থেকেই মনোযোগ দিয়ে পিলারগুলা দেখতে শুরু করেছিলো। সেই দেখা এখনো জারি আছে। পিলারের রঙের কম্বিনেশনের কারণে। কম্বিনেশনটা এমন যা আগে কোন কমিউনিটি সেন্টার কিংবা হলে তার চোখে পড়েনি। রাশেদের এই নির্দোষ কর্মে কি দোষ আছে অন্যরাই বলতে পারে তবে নির্বিঘ্নে তা সে দেখতে পারলোনা। কাঁধে একটা শক্ত হাতের স্পর্শ অনুভূত হয়। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে জুনায়েদ। সাদা রঙের চোস্ত স্যুট পরিহিত। তার গলায় জিজ্ঞাসা। গতানুগতিক।

“কিরে তুই একলা একলা এখানে খাড়াইয়া করোস কী, কাউরে পছন্দ হইলো নাকি?”

রাশেদের মুখে থুথু জন্মে। তবে সভ্যতার বেড়াজালে অভ্যস্ত বলে তা গিলে নেয়। হারামজাদা রাশেদের হিস্টোরি সব জেনেও হুদাই মজা মারতেছে । তার উদ্দেশ্যে করা প্রশ্নটার জবাব দেবে কি? উত্তর দেওয়ারই কোন মানে হয়না। দুই–এক সেকেন্ড ভেবে মনস্থির করলো আগ্রহ নিয়ে পিলার দর্শনের কথা জানাবে। কিন্তু তাকে কিছু বলতে হলোনা। তার আগেই জুনায়েদের মুখ ফের চলতে আরম্ভ করলো।

“ওই, চল ডান দিকের চার নাম্বার টেবিলে গিয়া বসি। এক্স জাস্টিস করিম সাহেব যেইখানে বসছে। ভালো আলাপ জমছে । তুই আয়, জয়েন কর”। জুনায়েদের চোখে মুখে কৌতূহল। কিসের, সেই প্রশ্ন রাশেদের মনে জাগে সত্য। তবে সেই কৌতূহল নিবৃত্ত করার ইচ্ছা হলোনা। আবার এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পিলার দেখবার যেই কাজটা করছিলো সেই আগ্রহেও ভাটা পড়েছে।

অনেকদিন পরে রাশেদ আজকে বিয়েবাড়িতে এসেছে। সেটা বাল্যবন্ধু আজিজের বিয়ে বলেই। এড়ায় কি করে? তবে এটুকুতেই থামলে যতোটুকু বলা হয়েছে তার চাইতেও বেশী কথা গোপন থেকে যায়। সে তা নিজেও স্বীকার করে। নেলীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পরে নারীদের দিকে ভালো করে তাকিয়েও পর্যন্ত দেখেনি। কতোদিন হয়ে গেলো। চার মাস? ছয় মাস? রাশেদ কড়ে আঙ্গুলে হিসাব করে। আঙ্গুলের সাথে তার হৃদকম্পনের বেগ বাড়তে থাকে। পাক্কা ছয় মাস। হিসাবে একশো আশি দিন। ঠিক আধা বছর।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার হিসাবে গোলমাল থেকেই গেছে। এই যে কমিউনিটি হলে ঢুকেই ধবধবে সাদা টাইলসে তার পালিশ করানো প্রিয় শু মিনিটে মিনিটে স্লিপ করার দশা হয়েছিলো সেখান থেকেই শুরু। মিনিট দুয়েক যেতে না যেতেই পেচ্ছাব লাগলে রাশেদ বিরক্তি চেপে রাখতে পারেনি। সব শালা আজিজের দোষ। এমনভাবে সময় মতো আসতে বলেছিলো যে রাশেদ বাড়ি থেকে বেরুবার আগে জলবিয়োগের কাজটাও করে যেতে পারেনি। বিয়ের আনন্দে বেটা আউলা ছিলো মনে হয়। সাথে আরো লেকচার ঝেড়েছিলো,

“তুই দোস্ত ঠিক আটটার মধ্যে চইলা আসবি। দেরী য্যান না হয়। আর তোর খাসিলত জানি। পোলাও-মাংস খাইয়াই বাড়ির দিকে দৌড় দেওনের জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়বি। আজকে এইসব হাংকিপাংকি চলবোনা। শাহরিনের সাথে দেখা না কইরা কোন যাওয়াযাওয়ি নাই”।

রাশেদের মুখে গালি চলে এসেছিলো। বিয়েবাড়িতে এসে কনের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলে সেটা হারাতে চায় কোন পুরুষমানুষ? বিয়ে করতে যাচ্ছে এমন লোকের মুখে এইসব বালছাল মানায়? তবু নিজেকে সেন্সর করে নিয়েছিলো। তারপরে বিশ মিনিট অপেক্ষা করে যেই সিএনজি পেয়েছিলো আড়াইশো টাকায় তাতে চড়ে মালিবাগের এই কমিউনিটি হলে আসা আর দুই মিনিটের মাথাতে পেচ্ছাব করতে টয়লেটে ঢোকা।

এদিকে ডান দিকের চার নাম্বার টেবিলে ততোক্ষণে

হিরোগ্লিফস-জশ লেইন; প্রাপ্তিসূত্র - http://geektyrant.com/news/hero-glyphics-art-series-by-josh-lane
হিরোগ্লিফস-জশ লেইন; প্রাপ্তিসূত্র – http://geektyrant.com/news/hero-glyphics-art-series-by-josh-lane

আলাপ বেশ জমে উঠেছে। এক্স জাস্টিস করিম সাহেব, জুনায়েদ আর কালো স্যুট পরা নাম না জানা এক ভদ্রলোকের মধ্যে। আলোচনার বিষয় সাম্প্রতিক রাজনীতি। প্রত্যাশিত। সম্বিত ফিরে পেলে রাশেদ মনে মনে শব্দটি উচ্চারণ করে। নিজের কাছেও গোপন শোনায় এমনভাবে। এই ঝকমকে কমিউনিটি সেন্টারে খাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করার সময়ে রাজনৈতিক আলাপ ছাড়া আর কি নিয়েই বা ঝড় তোলা যায়?

“এই সরকার একেবারে অপদার্থ। আটারলি ওর্থলেস। এতো এতো অবরোধ হচ্ছে, বিরোধী দলের কর্মীরা যেখানে সেখানে হামলা করছে। বাড়ি থেকে বেরুলেই বোমা কি গোলাগুলি। কই, শুনতে তো পেলাম না পুলিশ কাউকে ধরতে পেরেছে। কেবল আক্রান্তই হয়ে আসলো। আর নিরীহ সাধারণ মানুষগুলা কিভাবে মারা যাচ্ছে। আজকে গুলি খেয়ে তো আগামীকাল বোমায়, আহারে”। এটুকু বলে কালো স্যুট পরা ভদ্রলোক থামেন। কপালে একটা কড়া ভাঁজ। যেন আক্রান্ত জনগণের সমস্ত দায়ভার তার প্রশস্ত কাঁধের উপরেই। তিনি সেই দায় নিয়ে সামনে থাকা পানির বোতলটা খুলতে থাকলে জুনায়েদ বলেতে শুরু করে।

“এটা তো একতরফা গভর্নমেন্টেরই দোষ দেওয়া হয়ে গেলো। গতকালকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শুনলাম। তিনি বললেন এই অতর্কিত হামলায় হতাহত যাই হয়েছে তার সংখ্যা আর তিনি বাড়তে দেবেন না। শহরে এর মধ্যেই বিজিবি নামানোর আদেশ দিয়েছেন। র‍্যাব–পুলিশ তো আগে থেকেই রাস্তায় আছে। সত্য যে মারা যাওয়ার সংখ্যাটা কম না। কিন্তু সরকার তো বসে থাকছেনা। প্রয়োজনীয় একশন নেওয়া হচ্ছে”।

সাবেক জাস্টিস করিম সাহেব বিরোধীদল ক্ষমতাসীন থাকবার আমলে জাস্টিস ছিলেন। সেই ইতিহাস এখনো মনে রেখেছেন বলেই কিনা তার দুই বাক্যের বক্তব্য কালো স্যুট পরা জাতির বিবেকের বক্তব্যের ইকোর মতো শোনালো –

“এরকম ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে কিন্তু সরকারের উপরেই সবাই তাকিয়ে থাকে। সেটা প্রত্যাশিতও বটে”।
ইতোমধ্যে টেবিলে পোলাও–মাংস আসেনি তবে বোরহানী চলে এসেছে। রাশেদ লক্ষ্য করে নিজের গ্লাসে বোরহানী ঢালতে ঢালতে স্যুট পরা লোকটার মুখে নীরব কিন্তু বিষাক্ত হাসি ফুটে উঠে। দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়না। সেটা নিশ্চয়ই তার বক্তব্যের সাথে সমাজের মান্যগণ্য এক ব্যক্তির সম্মতি জ্ঞাপনের আনন্দে। রাশেদের চোখ এবারে জুনায়েদের দিকে যায়। বাস্তবে জোঁকের মুখে নুন পড়লেও ভঙ্গিমায় জুনায়েদ দার্শনিকের মুখ করে বসে আছে। দূর থেকে তাকে কেউ ডেকে উঠলে সিট ছেড়ে সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। যেন কারো ডাকের জন্যেই এই মুহূর্তে সে বসে ছিলো। রাশেদের মনে হয় সে নিজেও টোটাল কমিউনিটি সেন্টারটায় আরো একবার এক পাক ঘুরে আসে। মাত্রই তৃতীয় ব্যাচের খাওয়া শেষ হয়েছে। সহসাই তাদের খাবার আসবার কথা নয়।

আজকে, এই শীতের রাতে তার সাথে নেলী থাকলেই কি এই পরিবেশটা রাশেদের কাছে সুশোভিত বলে মনে হতোনা? হলের যেই দিকটায় দাঁড়ালে বিয়ে উপলক্ষ্যে সাজগোজ করা রমনীদের সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা যায় সেখানে দাঁড়িয়ে রাশেদ প্রশ্নটা নিজেকেই করে। তবে উত্তর দেওয়ার ফুরসত পায়না। কেননা ততোক্ষণে অপরিচিতা নারীকূলের চলাফেরা রাশেদকে ব্যাকুল করতে আরম্ভ কর। কিছুক্ষণ আগের স্যাঁতসেঁতে মনটা তখন ভিজে উঠতে শুরু করেছে।

ভিড়ের মধ্যে গণহারে সেলফি তোলায় ব্যস্ত নারীদের একটা বড় দল দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ডানদিকের থেকে তিন নাম্বারজন। বিয়ে উপলক্ষ্যে উটকো এক সাজ দিয়েছে। তবুও রাশেদের বেশ ভালো লাগে। পরনের সবুজ রঙের শাড়িটায় এক ধরণের ব্যতিক্রমী সফিসটিকেশন। এরকম বেশী চোখে পড়েনা। চোখে আইলাইনার যেটা দিয়েছে তা রাশেদের চোখে পড়লে সে নির্বিকার থাকতে পারেনা। কী ক্ষতি হয় যদি সে নিজে গিয়ে মহিলার সাথে পরিচিত হতে যায়? তাকে ছ্যাবলা মনে করবে, নাহ সেই সুযোগই রাশেদ দেবেনা। বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর মার্কেটিং বিভাগে চাকরী করছে সাড়ে চার বছর হলো। গায়ে দামী পারফিউমের ঘ্রাণ এখনো চলে যায়নি। একবার সেলফি তোলা থেকে ব্রেক নিলে রাশেদ স্বভাবসুলভ স্মার্ট ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে, “এক্সকিউজ মি, আপনাকে আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। আপনি কি শাহরিন আই মিন কনের বান্ধবী” ……… নাহ এভাবে এপ্রোচ করাটা বেশ মেইনস্ট্রিম। হিন্দী ছবিগুলোতে অসংখ্যবার দেখা গেছে। অল্টারনেটিভ স্মার্ট বাক্যবলী কি হতে পারে ভেবে রাশেদের মন দিশেহারা হয়। তার চাইতে বরং অন্য কারো দিকে মন দেওয়া যাক। হ্যাঁ, ওই যে মেরুন রঙের শাড়ি পরা আছে, সে। রাশেদ এতোক্ষণ সেলফি তোলায় নিমগ্ন নারীদের দলটিকে মনোযোগ দিয়ে দেখেছে কিন্তু সেখানে এই মহিলাকে দেখেনি। রাশেদের দিকে একবার তার চোখ গেলো কি? তার পা জোড়ায় হালকা কাঁপুনি। ডান দিকের পকেটে পকেট টিস্যু আছে। বের করে মুখ মুছবে নাকি একবার? কেমন তৈলাক্ত হয়ে আছে। নাহ থাক, তার দিকে আরেকবার তাকালেই বুঝবে সে নার্ভাস হয়ে গেছে। তখন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নাকে দড়ি দিয়ে তাকে ঘোরাতে চাইবে। এসব রঙ-ঢঙ করার বয়স চলে গেলেও কিছু নারীর চরিত্রে থেকেই যায়।

কাঁপুনি পা জোড়া থেকে শরীরের অন্যত্র ট্রান্সফার হলে রাশেদ অনুভব করে এমন অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে নারী শরীর দেখার চাইতে ভারমুক্ত হওয়াটাই ভালো। সচরাচর কমিউনিটি হলগুলার টয়লেট বেশ ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এখানে তেমন দেখা যায়নি।

ওয়াশরুমে গিয়ে রিফ্রেশড হতে গেলে কোনার দিকে স্লাইড দিয়ে ঘেরা অংশটুকুর কাছে যেতে হয়। তার বিপরীত দিকের দেয়ালের পাশে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার। পালিশ করানো শু নিয়ে, এই ধবধবে সাদা রঙের টাইলসে যা বারবার স্লিপ কেটে যাবার উপক্রম করেছিলো, রাশেদ টলমল পায়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতেই কিছু পথ পরে থমকে যায়। আশেপাশে এই মুহূর্তে কেউ নেই। মানুষজন অনেকেই খাওয়ার অপেক্ষায় মগ্ন থেকে নিজ নিজ সিটে বসে আছে। ভিড় যতোটুকুই আছে তার প্রায় সবই বর-কনের রিসেপশনের জায়গাটুকুতে। সেখানে সেলফি তুলে অপরের সান্নিধ্যে থাকবার সময়টিকে ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত নারী–পুরুষের কমতি নেই। কিন্তু স্লাইড দিয়ে ঘেরা অংশটুকুর সামনে আপাত এই নির্জনতার সুযোগে যুবক বয়সের এক যুগলকে পরস্পর চুমু খেতে দেখা যাবে এই দৃশ্যের জন্য রাশেদ প্রস্তুত ছিলোনা । তাদের নির্বিঘ্নে চুমু খাওয়ার সুযোগেই নাকি নিজের বিব্রতভাবে কাটাতে কে জানে রাশেদ দ্রুত ওয়াশরুমের একটায় ঢুকে পড়ে। প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতেও সে মনস্থির করতে পারেনা কার কথা কল্পনা করে শরীরের কাঁপুনি থামাবে। প্রেমিককে চুমু খাওয়া সাহসী মেয়েটাকেও লিস্টে ঢোকানো যায়। ক্ষতি কি? তবে মেয়েমানুষ আজকে কম দেখলোনা। ছয় মাস, গুনে গুনে ঠিক ছয় মাস পরে একসাথে এতো উর্বশী চোখে পড়লে নিজেকে সামলে রাখবার কোনও মানে আছে?


DSC_1008

[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট ‘। ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s