১. মিশন ‘ঢাকা’
গতকাল রাতে নাগরিক বাসে করে বাসায় ফেরার কালে কলাবাগান এলাকায় বাস থামাতে বলে এক মধ্যবয়স্ক লোক ব্যাগ হাতে ঝুলতে ঝুলতে বাসে উঠছিলেন।
একটু খেয়াল করে দেখলাম : আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আমারই বিভাগের এক শিক্ষক(তেমন ঘনিষ্ঠ না উনার সাথে, ৫ বছরে কোন ক্লাস পাইনি তাঁর)। আমাকে তার চেনার কথা না কারণ ওভার-পপুলেটেড সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দুই-এক জন ছাত্র-ছাত্রীর।
যাই হোক, উনি আমার পাশে আসতেই উনাকে সালাম দিলাম। উনি বেশ ভড়কে গিয়ে বললেন : কি, সোশিওলজি নাকি? —তোমার পাশেই বসি।
বসে কোন ভূমিকা ছাড়াই উনি বলা শুরু করলেন : ‘রাস্তাঘাটে যা বিশৃঙ্খল অবস্থা, বাসে চলাফেরা করা ভাল, বুঝছ?’
আমি মনে মনে ভাবলাম, উনি বাসে চড়ার যুক্তি দেখাচ্ছেন কেন!!!
যাই হোক তার কথায় আমি ‘জি স্যার জি স্যার’ বলে সায় দিলাম।
আবার কিছুক্ষণ পর নিজেই বলে উঠলেন : ‘বুঝছ, কয়েক দিন আগে ছিনতাই হইসিল, তাই এখন বাসে চড়ি, রিকশায় চড়া অনেক রিস্কি। তুমিও সবসময় বাসে চড়বা।’
আমার আর কিছু বুঝা বাকি থাকলনা, ভদ্রলোক কোন এক ক্রাইসিস থেকে তার এই বাসে উঠার কারণ ব্যাখ্যা করছেন!!!!!!
হাজার হোক ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ এর শিক্ষক তিনি, তাকে সিটি বাসে ঝোলাটা কি মানায়????!!!!!! তার উপর তার এক ছাত্র দেখে ফেলল…বদমাশ ছাত্র স্যারের বাসে ঝোলা’র গল্প সবাইকে রসিয়ে রসিয়ে বলবে পরে পুরো রাষ্ট্র হবে—“অমুক স্যার বাসে ঝুলে”
নাগরিক ঢাকা-গ্রামীণ আমরা – প্রাচ্যের অক্সফোর্ড—–সবই এখন কল্পিত ধারণা——বাস্তবতা হল ক্রাইসিস, কমপ্লেক্সিটি!!!!!
২. Habits of Insensibility: আমরা মডার্ণ সাবেজেক্ট হচ্ছি!?
মিরপুর টু আজিমপুর’গামী লোকাল বাস ১৯/ই এর একটা বাস পুড়ছিল মিরপুর ১১ তে ঠিক ১০:১৫‘র দিকে।
বাসের পোড়া গন্ধ আমার বাসের সকল যাত্রীর নাকে লাগতেই একরাশ ভীতি এবং একইসাথে নিস্তার এর অনুভূতি সবাইকে ছুঁয়ে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগল, আমরা নাকি জীবন বাজি রেখে চলাফেরা করতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছি!! কেউ বলল, বাঙালদের এই কপাল, মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই বৈকি!
রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নামক এক সামাজিক সংস্কার-ঐতিহ্যের মূলে আঘাত করেছিলেন এই বলে : ‘আমাদের ছোটবেলা থেকে সতীদের জীবন্ত আগুনে পোড়া দেখতে দেখতে নাকি আমরা এর মাঝে মানুষ পোড়া দেখতে পাইনা। চোখে সামাজিক প্রথার একধরণের দুর্ভেদ্য পর্দা তৈরি হয় এবং আমাদের মানসে জন্ম নেয় এক বদভ্যাস যারনাম ‘Habits of insensibility’’..
সমাজে বসবাসকারী অপর জন তা শ্রেণী, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ভেদে যাই হোক না কেন, কোন শারীরিক টর্চারের প্রতি অনুভূতি ‘ভোঁতাকরণ’ এর নানা প্রক্রিয়া নানা ভাবেই আমাদের সমাজে বলবৎ আছে, বিশেষ করে সমগ্র ভারতবর্ষের কথা বলতে গেলে ফতোয়া জারি করে দোররা মারতে মারতে মেরে ফেলা, পুড়িয়ে মারা এবং আরও কত কি আমাদের মজ্জায় প্রথার নামে গেঁথে আছে, তা কিভাবে দেখছি বর্তমান কালে, তাই বড় প্রশ্ন। আনক্রিটিকাল-পোস্টমর্ডানিজম নাম দিয়ে যার যার সংস্কৃতি তার তার বলে এসব চালিয়ে দেবার চরম টেন্ডেন্সি লক্ষ্য করা যায়।
দীপেশ চক্রবর্তী এই জায়গাতেই বেশ ইন্টারেস্টিং একটা পজিশন নিলেন : তিনি বলছেন যে, রামমোহন রায় বা বিদ্যাসাগরের ঐ যাবতকালের জীবনীকারেরা বয়ানের ক্ষেত্রে বেশ দ্বিচারিক ভূমিকা নিয়ে ফেলেছেন।
তাদের একটা বক্তব্য হচ্ছে : রামমোহন রায় বা বিদ্যাসাগর আমাদের মডার্ণ এডুকেশন এ অন্তর্ভুক্ত হলে পরবর্তী প্রজন্ম অনেক যুক্তিবাদী হবে, যা ব্রিটিশ কলোনিয়াল শিক্ষার এক ফল। আবার অন্য এক দিক থেকে বলছেন যে, ভারতীয় রস-শাস্ত্রে যে ‘সহৃদয়’ গুণের কথা উল্লেখ আছে, তারা আসলে সেই rare গুণের অধিকারী। এরকম ঈশ্বরসম মানুষ নাকি কোটিতে গুটিকয়েকমাত্র হয়!!!!
একদিকে তারা সবাইকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য তাদের জীবনী লিখেছেন আবার এও বলছেন যে তাদের এই গুণাবলি সবার কাছে আসেনা, এগুলো ঈশ্বরবা প্রভু প্রদত্ত বান্দার কাছেই আসবে, এখানে সাধারণের কোন হাত নেই।
এই অঞ্চলের মডার্ণ সাবজেক্ট এই ধরণের অনেক চিহ্ন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলে যা ২০১৫ সালেও avoid করা যাবেনা। এগুলোকে পরিহার করে কোন পলিটিকাল প্রজেক্ট নিলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই সাবজেক্ট এর শরীরে, আত্মায় তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের life-being গেঁথে আছে।
Habits of insensibility যতদিন বাসা বেঁধে দিব্যি সুখে থাকে ততদিন কোন প্রতিবাদ আসেনা, ঘুম ভাঙেনা। এই অভ্যস্ততা কোন একদিন আর নিতে পারেনা কোন অত্যাচার।
নাকে-চামড়ায় পেট্রোল বোমা গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে এক সময় ব্রেনের সেলে প্রবেশ করে। তখনি এখানে প্রতিবাদ হয়, মানুষ জেগে উঠে। আমাদের নিজস্ব দীক্ষার মাধ্যমে যতদিন এই অভ্যস্ততার চাদর খুলতে পারবনা ততদিন চেয়ে থাকব বোকার মত।অন্যদের শহীদ হওয়া দেখে ভয় পাব, আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব যতক্ষণ নিজেনা পুড়ছি!

৩. লোরকা ও এক বিজ্ঞানমনস্ক ক্যানভাসার
ট্র্যাফিক জ্যাম এ ঢুলু ঢুলু চোখে ঘর্মাক্ত ঘুমে আমি জবুথবু হয়ে বাসে বসে আছি। ঘুম না ঠিক, ঘুম ঘুম ভাব। তখনি পল্টন থেকে বাসে উঠল সরস এক ক্যানভাসার।
অবচেতন ভাবে তার হাতে লোরকা’র ‘বিদায়’ কবিতাটা দিয়ে বললাম : ‘তোমার মত করে তুমি এই কবিতা খানি আবৃত্তি কর তো। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও পুরোপুরি’।
-সে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে তার সহজ ভঙ্গির হাসিখানা মুখ করে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলা শুরু করল : ‘আপনারা হয়তো লোরকা কে চেনেন না। আমি তাঁর সম্পর্কে এই মাত্র জানলেও আমার সাথে তাঁর এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। এই যে স্যারেরা দেখেন, লোরকা ‘বিদায়’ কবিতাতে বলছেন, মৃত্যু কাছে এলে তার ব্যালকনিটা যেন কেউ সরিয়ে দেন যাতে করে তিনি এক বাচ্চা ছেলের কমলা খাওয়া দেখতে পান এবং কাস্তের ধান কাটার আওয়াজ শুনতে পান’
‘আমিও মৃত্যুর কথা মনে আসলে আমার বউয়ের চুল এলানো দেখতে যাই, বাচ্চার হাতে বল গড়াগড়ি দেখতে চাই’
‘আমি নিশ্চিত যে, মৃত্যু থেকে মুক্তি পেতে লোরকার কবিতা আপনাদের জন্য এক মহৌষধ’

‘এই কবিতা আমি আপনাদের কাছে বিক্রি করব নামমাত্র মূল্যে। যে যা দিবেন, তাই আমি নিব’
-আচমকা আমার ঘুম ভাব কেটে গেল। শুনতে পেলাম ঐ প্রিয় ক্যানভাসার এর সরল কণ্ঠ, খুব বিনয়ের সাথে সে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে : ‘দেখেন আমি কিন্তু তাবিজ-ঝাঁড়-ফুকের মত বাজে ব্যবসা করিনা। আমি স্পোকেন ইংলিশ এর বই বিক্রি করছি যাতে আপনারা বিদেশ গিয়ে উন্নতি করেন’।
আমার কানে তখন বাজছে প্রিয় লোরকা :
বিদায়
(অনুবাদঃ অমিতাভ দাশগুপ্ত)
মৃত্যু ঘনিয়ে এলে
ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।
দোহাই।
ছেলেটা কমলালেবু খাচ্ছে।
আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।
চাষী কাস্তে দিয়ে ফসল কাটছে।
আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।
মৃত্যু ঘনিয়ে এলে
ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।
দোহাই আপনার।

[ইলিয়াছ কামাল রিসাত : সিনেমাখোর, প্রবন্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষে ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে কর্মরত। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]