
পিঙ্ক ফ্লয়েড নামক বিশ শতাব্দীর একটি ঘটনা নিয়ে কোন কিছু বুঝে ওঠা একটু কঠিন, এবং এইটাকে নিয়ে যুক্তিসজ্জিত কোন কথা বলা প্রায় অসম্ভব। পিঙ্ক ফ্লয়েড প্রায় প্রেমের মতোই এক ঘটনা, প্রত্যেকবারে এবং প্রত্যেকের কাছে ইউনিক। প্রত্যেক শ্রোতা পিঙ্ক ফ্লয়েড-কে চেনে তার নিজের মতো করে, একদিনে যেমন চেনে আরেক মঙ্গলবার তেমন চেনে না, এক ভোরে যেমন চেনে সন্ধ্যায় তেমন চেনে না। পিঙ্ক ফ্লয়েড অভিজ্ঞতা তাই অনন্য ব্যাপার। ঠিক প্রথম চুমু খাওয়ার মতোই কি? প্রায় ডুবে যাওয়ার মতোও মনে হয়। কিন্তু প্রায় পিঙ্ক ফ্লয়েডের মতোই!
গানশোনা জীবনের বিভিন্ন পিরিওডে হরেক লুপে আমি আক্রান্ত হয়েছি, আর্টসেল, অর্ণব, মেটালিকার পাপেট… তবে দীর্ঘতম লুপটি নিঃসন্দেহে পিঙ্ক ফ্লয়েডের কীর্তি। গানের নাম হেই ইউ। ‘এইযে তুমি’, কিংবা ‘এই শুনছো’? আমার কাছে কিন্তু এটার অনুবাদ সবসময়-“এই”…বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে, রেলিঙে গাল ঠেকিয়ে যেভাবে ডাকা যায় রাস্তার পরিচিতকে, সেই ডাক। কিংবা বালিকাস্কুলের সামনে নীলরঙা প্রেমিকা-কে ডাকার সম্বোধন, কিছুটা বিব্রত লাল হয়ে গিয়ে, কিংবা কোনটাই না, কোন বন্দির নোনাভেজা আহ্বান- শেষের দিকে একটু স্ট্রেস দিয়ে লম্বা করে ডাকা আবেদন, এইইই…
দ্য ওয়াল- এলবামটা বের হয় ১৯৭৯ সালে। বিভিন্ন কারণে পিঙ্ক ফ্লয়েডের এই এ্যালবামটি বেশ গুরুত্ববহ। এ্যালবামটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানা শুনে গেলে মনে হয় একটা গানই চলছে, চলে যাচ্ছে; এই পৌনঃপুনিকতা আর আহা, সাইকেডেলিয়া, একটার পায়ের মধ্যে আরেকটার মাথা, হেলিকপ্টার, আমাদের জীবনের আনন্দিত দিনসকল; ছন্দপতন নেই, কেননা উদ্বোধন নেই…
ওয়াল-এর দ্বিতীয় ডিস্কের প্রথম গান হেই ইউ। লিখেছিলেন রজার ওয়াটার্স, ঠিক বউয়ের ডিভোর্স খাওয়ার পরপর। গানটি চারমিনিট চল্লিশ সেকেন্ড দীর্ঘ। পরে ২০০১ এ বের হওয়া “ইকোস” এ্যালবামেও ছিলো গানটি। কন্ঠ দিয়েছিলেন ওয়াটার্স আর গিলমোর মিলে, প্রথম দুই ভারস ডেভিড গিলমোরের কণ্ঠে, পরে ওয়াটার্স।
হেই ইউ পিঙ্ক ফ্লয়েডের খুব রহস্যময় গানগুলোর একটা,প্রত্যেক স্তবকে একবার করে কাউকে আহ্বান করা, কাউকে ডেকে তোলা, কারোর সাহায্য চাওয়া। জটিল মানুষের ইস্পাতমুখী আধুনিকতার সাথে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে চলে আসা একাকীত্ব; এই একাকীত্ব শুনা যায় হেই ইউ-এর প্রত্যেক স্ট্রোকে স্ট্রোকে। সূচনার প্লাকিং ঝুপ করে অনেকটা জানিয়ে দেয় পরিস্থিতি, দুই ফ্ল্যাটের মধ্যেকার মেইল দূরত্ব, এই বোধটা নেমে আসে একেবারেই ঝুপ করে, শীতের সন্ধ্যাপরের রাত্রির মতোন!
একটা মানুষ অবিরাম চিৎকার করেই চলে, আবেদন জানায়, বিভিন্নভাবে। এই আবেদন দেয়াল ভাঙার, যেই দেয়াল আলাদা করে রেখেছে প্রত্যেককে; প্রত্যেকের নিজস্ব ওয়াল। এরই মধ্যে মধ্যে ট্রেডমার্ক নিউরন নিয়ে খেলা!
একজন কেঁদে চলছে একলা না থাকতে পেরে, সে ফিরতে চাইছে বাড়ি। এই বাড়ি ফেরার কান্নাটা ঠিক কোথায় গিয়ে প্রতিফলিত হয়? আদৌ হয় কি? সে যে প্রেমিকাকে বলে রাখলো- ‘হৃদয় খোলা রাখো, আমি ঘরে ফিরছি’… ঘর আছে কি? নাকি সব চলে গেছে ডাইনোযুগে? উঠোন রাখা তো নাগরিক না, আধুনিক না, তাই একলা থাকা প্রায় আরশের কাছাকাছি! দশদিকে সেই দেয়াল নিয়ে ঘোরাফেরা…
উঠে থাকে সেই ওয়াল, অভেদ্য দেয়াল, আলাদা করে রাখার, আর বাড়ি ফেরা হলো না, আহা! মগজে ঢুকে পড়ে পোকার দল, একা একা একা হয়ে জমে থাকা নাগরিক মানুষ।
তারপরও… আবার উঠে বসলো, আবার শুরু করলো সেই আহ্বান, বিচ্ছিন্নতাহীন চিৎকার, বিচ্ছিন্ন থাকতে না পেরে। দেয়ালের বাইরেও মানুষ আছে তো! এইইই, রেবেল টিনেজার, তুমি বাঁচিয়ে নিয়ে যাও, কংক্রিট আর সারবাঁধা দেয়াল থেকে-
‘এই, বোল না, কোন আশা নেই,
একসাথেই বেঁচে থাকি, আলাদা হলেই যাবো হারিয়ে’


[ আজমাঈন তূর হক – কবি, পাঠক। লিরিসিস্ট হিসেবে যুক্ত আছেন ‘ইলোপ’ ব্যান্ডে। অহন পড়তাছেন রেসিডেন্সিয়ালে, এইচ এস সি প্রথম বর্ষে – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]