[সক্রেটিস। দার্শনিক সক্রেটিস ছাড়া আরেক সক্রেটিস আছেন, যারে দুনিয়ার মাইনষে চিনে। তিনি ফুটবলার সক্রেটিস (১৯৫৪-২০১১)। আর্টিস্ট ফুটবলার। সেই যুগের মিথিকাল ফুটবলার। আজ যে প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে প্রায়। যে কোন মূল্যে জেতার জন্য যান্ত্রিক ফুটবল নয়, খেলতেন আনন্দ পাওয়ার ও দেয়ার জন্য। আহ , কী সব নাম, সেই মিথগুলান – গ্যারিঞ্চা, ম্যারাডোনা, সক্রেটিস বা এই সেদিনের জিদান। শৈল্পিক সব পাস আর ব্যাকহিলের সক্রেটিস বিশ্বকাপের এক ট্রাজিক নায়ক। বিশ্বকাপ জিততে পারেন নি। খুব কাছ থেকে ফিরে আসেন। তবে শুধু খেলার ধরণে নয়, আরো অনেক দিক দিয়ে আলাদা সক্রেটিস। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই দেখি – পেলে, গ্যারিঞ্চা নন, তার আইডল, নায়ক হন জন লেনন, চে গুয়েভারা আর ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তার সময়ের দমনমূলক নিপীড়ক সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে সর্বদা আওয়াজ তুলেছেন। আবার ছিলেন ডাক্তার।
এই সাক্ষাৎকার নেন সাংবাদিক এন্ডি মিটেন, ২০১০ সালে। নানান সাইটে নানান ভাবে আছে এই সাক্ষাৎকার। অনুবাদক রাইয়ানা মিতু অনুসরণ করেছেন জিকিউ ম্যাগাজিনেরটি। সক্রেটিস নামের মিথের প্রতি অনুবাদক ও আমাগো শ্রদ্ধা, ভালবাসা। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]

“আমার আইডল তিনজন – চে, ফিদেল, জন লেনন”, বলেন সক্রেটিস। ৮২’র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। সেই দুর্ভাগা দলের ক্যাপ্টেন, যেটি ছিল বিশ্বকাপ জিততে-না-পারা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবল টিম।
আজ(মানে সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিন-অনুবাদক) সক্রেটিসের ৫৬তম জন্মদিন এবং প্রথমেই তিনি তার লেটলতিফগিরির জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন। “পুরোটা সকাল আমি জিকো এবং এদেরের(Eder) সাথে কার্নিভালে ছিলাম। এ পর্যন্ত আমি যাদের সাথে খেলেছি তাদের মধ্যে জিকো সবচেয়ে দুর্দান্ত খেলোয়াড়। আর এদের(Eder) হল কার্নিভালের নাচের ওস্তাদ…”
আমরা আলাপ করি সাও পাওলোর এক বড়লোকী কাবাব-ঘরে(১), যেখানে রাঘব বোয়াল শিল্পপতিরা হাঁটুর বয়সী আমাজনীয় সুন্দরীদের সাথে লাঞ্চ সারেন। “ভালবাসি নারী”, ফিসফিসিয়ে বলে যান ছয় সন্তানের বাপ সক্রেটিস, “ভালবাসি নারীর তরে কবিতা লিখতে”। সাক্ষাৎকারের শেষ নাগাদ পেছন পকেট থেকে একতোড়া হাতে লেখা কাগজ বের করে জোরে জোরে তার ভালবাসার কিছু পঙক্তি আবৃত্তিও করেন। যেই সাক্ষাৎকার চলেছিল দক্ষিণ গোলার্ধের ফেব্রিয়ারির এক বিকেল জুড়ে।
সক্রেটিস ডাক্তারি প্র্যাকটিসের পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরটিতে যান, এক টক-শোতে হাজিরা দিতে। যেখানে তিনি তার প্রথাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেন বুদ্ধি আর আবেগের মিশেলে। আর অট্টহাসি হেসে ওঠেন তার বহু বছরের বিড়ি-ফুঁকা গলায়। বাক্সমার্কা স্টুডিওর খুপরি বড়ই বেমানান লাগে তার ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির বিশাল দেহকাঠামোর কাছে। আরেকটি টভি শো আছে তার। নিজ শহর রিবেইরাও প্রেতোতে। সাম্পা থেকে এক ঘন্টার ফ্লাইট। সেই শোতে, সোশ্যাল একটিভিস্ট সক্রেটিস নিজেই প্রশ্ন ছুড়েন, সাক্ষাৎকার নেন রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিকদের, শিল্পী আর লেখকদের।
স্পেন-৮২’র বিশ্বকাপে তার অভাবনীয় কীর্তিকলাপের জন্য প্রজম্নের পর প্রজন্ম জুড়ে গোটা দুনিয়ার ফুটবল-ভক্তদের কাছে সক্রেটিস প্রায় মিথ হয়ে আছেন। তার মেজাজী সৌষ্ঠব, তার টু-স্টেপ পেনাল্টি, তার নাম, মুখ-ভরা দাড়ি, গোটানো মোজা, তার খেলার ধরণ, যা দেখলে মনে হত একটা সিগারেটের জন্য হাঁসফাঁস করছেন তিনি, আর খেলছেন এক্কেবারে স্রেফ আনন্দের জন্য – এসব কিছুই মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল তার ভক্তদের।
ব্রাজিলের অনেক সেরা খেলোয়াড়ের থেকেই সক্রেটিস আলাদা, বিশেষত মগজে-মননে মাগ্রাও(তার ডাকনাম, যার অর্থ ছিপছিপে তরূণ) চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল। এতোটাই যে, একই সাথে তিনি পারেন চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে, ফুটবলে সাও পাওলোর সেরা ক্লাব করিন্থিয়ান্স আর নিজ দেশ ব্রাজিলের নেতৃত্ব দিতে এবং গোটা সময় জুড়ে তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে, গণতন্ত্রের পক্ষে। তাকে দেখাতোও চে গুয়েভারার মতন। যদিও দাড়ি রাখার পেছনের কারণ হিসেবে তার ব্যাখ্যাটা মোটেও রোমান্টিক নয়। “আমার তৈলাক্ত ত্বক, মুখ ভরা দাগ, তাই দাড়ি রাখি ঢেকে রাখতে”, জানান সক্রেটিস।
“তবে আমার এক ছেলের নাম রেখাছি ফিদেল”, তিনি বলেন আর মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে তার কাবাবে মনোযোগী হন। পাম্পাসের(দক্ষিণ আমেরিকার সমতল তৃণভূমি) পশুর কাবাব। “কিউবা আমার স্বপ্নকেই ধারণ করে। সকল নাগরিকের সেখানে সমান সুযোগ, সমান অধিকার। আর হাজারো বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আদর্শ থেকে সরেনি কিউবানরা, তাদের প্যাশনের কারণে। আমার অবাক লাগে, একটা ছোট্ট দেশ, নাই তার কোন শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি – তাও টিকে আছে তারা; শিক্ষা, চিকিৎসা আর খেলাধুলায় অভাবনীয় সাফল্যের নজির রেখে(২)। অন্য যে কোন লাতিন আমেরিকান দেশের চাইতে অলিম্পিকে তারা বেশি স্বর্ণপদক যেতে। আহ, যদি জন্ম নিতে পারতাম কিউবায়!”
নিজের নামটির জন্য সক্রেটিস কৃতজ্ঞতা জানান তার বাবাকে। “আমার বাবার জন্ম খুবই দরিদ্র এক পরিবারে। নিজে নিজেই পড়তে শিখেন আর পড়েছেনও প্রচুর। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে আগ্রহী ছিলেন তিনি, আমাকে ডাকতে থাকেন সক্রেটিস নামে। তার সব সন্তানের নামই গ্রীক দার্শনিকদের নামে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জানতেন কেবল তিনজনকে। তাই শেষমেষ সক্রেটিস, সফোক্লিস আর সস্থেনিস।(৩)”
তাঁর(সক্রেটিসের বাবার) দুই ছেলে ফুটবলার হয়েছিলেন। ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি-ই শুধু নয়, পাশাপাশি অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও পরেছেন দুজন-ই। সক্রেটিসের ছোট ভাই রাই ৯৪-এর বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের নেতৃত্ব দেন(৪), এডমুন্ডো, রোমারিওরা(এবং বেবেতো, ডুংগা, তাফারেল, কাফু…..) খেলেছেন যে দলে। “১৯৬৪ তে একটা সামরিক ক্যু হয়েছিল”, সক্রেটিস স্মরণ করেন। “আমার বয়স তখন দশ। মনে আছে, বাবা তার বলশেভিকদের উপর লেখা বামপন্থী বইপত্র পুড়িয়ে ফেলছিলেন। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ আমার সেখান থেকেই শুরু।”
ছাত্রাবস্থায়, তুখোড় মেধাবী সক্রেটিস তার খেলাধুলা দিয়েও নজর কাড়েন সবার। “ফুটবলের ব্যাপারটা এসেছিল আকস্মিকভাবেই”, বলেন তিনি। “আমার আগ্রহ রাজনীতিতেই বেশি ছিল। আমার দেশের সামাজিক অবিচার-শোষণের প্রতি আমি সজাগ ছিলাম। দেখেছি আমার সাথের অনেককেই লুকিয়ে থাকতে বা পালিয়ে বেড়াতে। স্রেফ ঘটনাক্রমে আমি ফুটবলটা ভাল খেলতাম, তাই আমার ভাগ্যে জুটে একটা সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভিন্ন পরিবেশ।”
দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সেরা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, স্থানীয় ক্লাব বোতাফোগো-য় খেলেন সক্রেটিস। “ফুটবলের যেই জিনিসটা আমার ভাল লাগত, তা হল এর সামাজিক মিশ্রণ। অনেক গণতান্ত্রিক সেটা। পাশাপাশি ফুটবল আমাকে নিজের দেশকে চিনতে-জানতে শিখিয়েছে। এবং আমি বুঝতে শিখেছি যে এর পরিবর্তনে আমাকে সচেষ্ট হতেই হবে।”
(চলবে )
সক্রেটিসের খেলা দেখতে চাইলে, দেখুন।
অনুবাদকের ফাৎরা আলাপ –
(১) শব্দটা চুঢ়াস্কারিয়া(Churrascaria), ওলন্দাজ যে শব্দের মানে হল যে জাগায় বারবিকিউ পাওয়া-খাওয়া যায়। এন্ডি মিটেন বলেছেন স্টেকহাউজ।
(২) আগ্রহীদের জন্যে – (শিক্ষা) কিউবার শিক্ষার হার(২০০৪) – ১০০ (তুলনা করুন, বাংলাদেশ-৪১)।
(চিকিৎসা) কিউবার শিশু মৃত্যুর হার(২০০৪) – ৬ (বাংলাদেশ-৫৭, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-৭)। গড় আয়ু কিউবায়(২০০৪)-৭৮ (বাংলাদেশ-৬৩, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-৭৮)। (সূত্র – The State of the World’s Children, 2006 – UNICEF)
(খেলাধুলা) বিপ্লবের পূর্বের শেষ ৩ অলিম্পিকে(৫২, ৫৬, ৬০ সালের) কিউবার মোট পদক সংখ্যা – শূন্য। বিপ্লব পরবর্তীকালে, ৬৪’ সালে ১, ৬৮’তে ৪, ৭২’এ ৮, ৭৬ সালে ১৩, ৮০ সালে ২০, ৯২’এ ৩১টি পদক জয়………..
(৩) দার্শনিক সক্রেটিস আর নাট্যকার সফোক্লিসকে চিনলেও সস্থেনিসকে চিনতে পারছি না। হতে পারে, তিনি মেসোডোনিয়ান সেনাপতি ও সম্রাট সস্থেনিস। বা বাইবেলে উল্লিখিত করিন্থের সিনাগগের নেতা সস্থেনিস।
(৪) ফাইনালে খেলেননি রাই। এর আগ পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন ব্রাজিল দলের। ফাইনালে নেতৃত্ব দেন ডুঙ্গা, ফলে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ হাতে তুলে চুমু খান ডুঙ্গাই। তাই অনেকের স্মৃতিতে ডুঙ্গাই ৯৪’এর ব্রাজিলের অধিনায়ক।