কিছুদিন ধরে আমি পিঁপড়া দেখছি। যেখানেই থাকি, একটা পিঁপড়া খুঁজে বের করি। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। পিঁপড়া চলাফেরা করে। চলে যায়। তখন আরেকটা পিঁপড়ার জন্য অপেক্ষা করি। পিঁপড়া দেখার ভিতর বিরাম আছে। ঠিক কী কারণে আছে আমার জানা নাই।
যখন একা থাকি তখন একা থাকি। যখন মানুষ আমার খোঁজ করে তখন তাদের সাথে থাকি। সময় কাটাই। স্বাভাবিক বাক্যালাপ চলে। আমাকে দেখে মনে হয় একজন হাসিখুশি মানুষ। যখন কেউ আমার খোঁজ করে না তখন পুনরায় একা একা সময় কাটাই। পিঁপড়া দেখি।
আমি মানুষকে খুব বেশি টানি না। মানুষও আমাকে তেমন একটা টানে না। চারপাশে সব সময় কিছু বন্ধুবান্ধব থাকতেই হবে- এমন কিছু নাই। বরঞ্চ বেশিক্ষণ আমি মানুষের সঙ্গ নিতে পারি না। কথাবার্তার আগ্রহ মরে যায়। দম বন্ধ লাগে। মনে হয় কখন একা হওয়া যাবে।
আমার স্বভাবের মানুষদের একটা ইংরেজি নাম আছে -‘লোনার’। আমি একজন লোনার। একা একা অভ্যস্ত। আত্মকেন্দ্রিক বলে আমার বদনাম আছে। মেয়েবন্ধুরা সাধারণত আমাকে আত্মকেন্দ্রিক বলে গালি দিতে পছন্দ করে। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আত্মকেন্দ্রিক। তবে আমার ধারণা ব্যাপারটা এত জটিল না। আমি শ্রেফ একজন লোনার। কেউ কেউ আমার ঘনিষ্ঠ হয়। আমি তাদের কাছ থেকে আনন্দিত হতে শিখি। সবাই ভাল। বিভিন্ন সময় ওরাও আমাকে খারাপ মানুষ বলে মনে করে না। কিন্তু আমার ভিতর সুনিশ্চিত কোনো লক্ষণ দেখে না। অবহেলিত হয়। আমি অবহেলা দিতে চাই না। তথাপি তারা অবহেলিত বোধ করে। ঊষ্মা বোধ করে। আমাকে ছেড়ে চলে যায়। অবশ্য আমাকে তারা ছেড়ে চলে যায় না। কারণ আমিই কখনো তাদের সাথে থাকি না। শারীরিক ভাবে থাকলেও, মানসিক ভাবে থাকলেও, কোনো এক তৃতীয় উপায়ে আমি তাদের সাথে বর্তমান থাকি না, যা তারা ধরতে পারে। সুতরাং আমিও তাদের ছেড়ে চলে যাই।
তারপর গান শুনি। বই টই পড়ি। সময় কাটে। তবে ইদানিং কাটছে না বলে পিঁপড়া দেখছি। যেখানেই কিছুক্ষণ থাকি, একটা পিঁপড়া খুঁজে, তাকায় থাকি। পিঁপড়া দেখা ব্যাপারটা আমার কাছে জরুরী। মনে হয় মাথায় নতুন করে জট বাঁধছে। মাথায় জট থাকা দরকার। তা না হলে সমস্যা হয়।
ঊনিশ বছর বয়সে আমি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলাম। আমি আসলে ঘুমের ওষুধ দিয়ে নেশা করতাম। একবার ৩০ টা বড়ি একসাথে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওই ঘটনার পর থেকে আত্মহত্যা নিয়ে আমাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নাই।
তবে কিছুদিন ধরে এক পরিচিতর আত্মহত্যা আমাকে সমস্যায় ফেলেছে। খুব পরিচিত একজন মানুষ। পনেরো থেকে বিশ– এই পাঁচ বছর তাকে নিয়ে আমি অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। এর মধ্যে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়। বছর দেড়েক পর সেটা ভেঙেও যায়। দুই বছরের মতো একা থাকি, তারপর নতুন সম্পর্কগুলিতে জড়াতে শুরু করি। তবে তেমন ভাবে জড়াই না। আমি খবর পাই সে’ও জড়াচ্ছে। এক সময় তার বিয়ে হয়। আমার বিয়ে হয়। তার বিয়ে ভাঙে। আমার বিয়ে ভাঙে। কিছুদিন আগে শুনলাম পারুল আত্মহত্যা করেছে।
২/
খবরটা আমাকে বিচলিত করে না। আমি বেশ স্বাভাবিক থাকি। জীবনে তেমন কোনো বদল আসে না। তবে কয়েক সপ্তাহ পর একটা ঘটনা ঘটে। আমি একরাতে আমার মৃত, প্রথম বান্ধবীকে বারান্দায় দেখতে পাই।
বারান্দায় কাচের দরোজা লাগানো। আমি দেখলাম দরোজার বাইরে, কাচের অন্যপাশ থেকে পারুল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় তাকিয়েই আছে। ঠিক স্পষ্ট না। হয়তো আমার দিকে না। আমার সাধারণ ডিরেকশনে তাকিয়ে আছে।
নিশ্চয়ই চোখের ভুল। বাতি জ্বালাই। পানি খাই। বারান্দায় সিগারেট ধরাই। সিগারেট শেষ করে বিছানায় ‘বহুব্রীহি’ নাটক ছেড়ে শুয়ে থাকি। এই নাটকটা আমি গত আট বছর ধরে ঘুমানোর সময় দেখে আসছি। ডায়লগগুলি মুখস্থ বিধায় ঘুম চলে আসে। কিন্তু আজকে আসছে না। কেমন ভয় ভয় লাগছে। দেয়ালের দিকে পিঠ ফিরে শুই। নাটকের চরিত্ররা কথা বলতে থাকে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন আমার তেমন কিছু মনে থাকে না। মনে না রাখার চেষ্টা করি। ব্যস্ত থাকি। কিন্তু রাতে ব্যাপারটা আবার ঘটে। আমি পুনরায় পারুলকে আমার বারান্দায় আবিষ্কার করি।
এইবার আমি ভয় পেলাম। সারারাত ঘুম আসলো না। বাতি জ্বালিয়ে রাখি। কয়েক গ্লাস মদ খেয়ে শুয়ে থাকি। কম্বলের মত একটা ভয় শরীরে লেপ্টে থাকে।
পরদিন একজন সাইকেয়াট্রিস্ট্রের শরণাপন্ন হই। সাইকেয়াট্রিস্ট আমাকে ঘুমের ওষুধ দেয়। ওনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, গোপনে গোপনে পারুলের প্রতি আমার এখনো এক ধরণের আবেগ বর্তমান বিধায় ওর অপমৃত্যু আমাকে আচ্ছন্ন করেছে।
আমি সামান্য অবাক হই। আমি তো জিয়ল মাছের মতো কোনো আবেগ পারুলের জন্য জিয়ায় রেখেছিলাম বলে টের পাই নাই কখনো! রাখলে এই পনরো বছরের ভিতর কখনো না কখনো তো আমার পারুলের সাথে যোগাযোগ করার কথা ছিল। সাইকেয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমি আরও জানতে পারি যে, মানুষের মন বিচিত্র; সবকিছু সহজে বোঝা যায় না।
ঘুমের ওষুধগুলি খাই না। রেখে দেই। ঘুমের ওষুধ আমি খেতে পারি না। মদ্যপান বেড়ে যায়।
সেদিন রাতে পাড় মাতাল অবস্থায় বের হলাম। বাস স্টেশন পার হয়ে বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করি। লম্বা ঘাসের জঙ্গল। পরিষ্কার আকাশ। অনেক তারা। অন্ধকারেও সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি যাচ্ছে। আমি ঘাস কেটে আগাতে থাকি। ঘাসগুলি ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে। আমি নদীর ধারে গিয়ে পৌছাই। বসে থাকি। বেশিক্ষণ বসতে পারি না। প্রচণ্ড মশা।
৩/
আমি অনেক সময় ব্যয় করে পারুলের ফেসবুক একাউন্ট খুঁজে বের করলাম। বস্তুজগতে মানুষ হুট করে মারা গেলেও তার ফেসবুক একাউন্ট তত সহজে মরে না। ফেসবুকে মানুষ খুব ধীরে ধীরে মৃত হয়। পারুলের ছবিগুলি দেখতে থাকি। সিঙ্গেল ছবি। ডাবল ছবি। পারুলের লেখা স্টেটাস, কমেন্ট ইত্যাদি পড়তে থাকি অনেকক্ষণ ধরে।
আমি পারুলকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। ১৫ বছর পর প্রথম চিঠি।
পারুল,
তোমাকে আমার লেখার মৌলিক বা যৌগিক কোনো কারণই নাই। তারপরেও লিখছি। অকারণ কাজটার জন্য দুঃখিত। অনেকদিন হয়ে গেছে। আশা করি সব ভুলে গেছো। আমি লিখলে তোমার মনে রোদ ঝড় বৃষ্টি কিছুই যেন না ওঠে। পড়ন্ত বিকালে বাংলা একাডেমির ফুটপাথে উড়তে থাকা একটা ছেড়া কাগজের টুকরার মতো এই চিঠি তোমার পায়ের কাছে এসে পড়ুক। কয়েক সেকেন্ড বাদে হারিয়ে যাক।
কারো কারো কাছে আমি ভাল ছেলে। কারো কারো কাছে ভয়াবহ। এটাই স্বাভাবিক। আমার বারান্দায় দুইটা কবুতর আসে প্রায় প্রায়। একটা শাদা, একটা কালো। সেদিন আমি ওদের পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়াতে গেলাম, খুব সাবধানে– কিন্তু ওরা উড়ে চলে গেল।
তুমি কেমন আছো জানতে ইচ্ছা করে। নিজের কথাও বলতে ইচ্ছা করে।
গতবছর আমি নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি। ১৬ তলায় চারশ বর্গফুটের ব্যাচেলর। লোপার সাথে ছাড়াছাড়ির পর পুরানো বাসা ছাড়তে অনেক ঝামেলা হলো। ২ মাসের নোটিশ দিতে হয়। এদিকে ঐ বাসায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
যাই হোক। ভাল থাকো।
শুভেচ্ছা সহ
অর্ঘ্য
(তোমার কিছু কথা, বহু আগে যখন বলতা, আমি বুঝতাম না। সেই সব কথা আমি পরে বুঝেছি। পৃথিবীর কোনো এক জঙ্গলে কোথাও, ঠিক এই মুহূর্তে একটা অর্কিড ফুটছে। )
চিঠি পাঠিয়ে ভাল লাগে। তিন দিন পর রাতে ভাল ঘুম হয়।
৪/
পরদিন সকালে উকিলের সাথে দেখা করার কথা ছিল। উকিল আমাকে ‘সেপারেশন এ্যগ্রিমেন্টের’ নিয়ম কানুন বোঝায়।
চেম্বার থেকে বের হয়ে বউর সাথে দেখা করি। আজকে লোপা, অর্থাৎ, আমার এক্স-বউ একটা নতুন ফ্ল্যাটে উঠছে। সারাদিন ওর সাথে বাসাবদল করি। জিনিস পত্র টানাটানি করি। নতুন টিভির টেবিল লাগাই। জানালায় এয়ার কুলার ফিট করি। একসাথে রেস্টুরেন্টে খাই। সন্ধ্যাবেলা ওকে ওর নতুন বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে আসি। লোপা বার বার বলে আরেকটু থাকো। আমি থাকি না। বলি আমার কাজ আছে। যদিও কোনো কাজ নাই। উকিলের প্রসঙ্গ তুলি না।
বাসায় ফিরে আসি। কেমন ভয় ভয় লাগতে থাকে। বিনা কারণে ভয়। আমি টেবিলে, মেঝেতে পিঁপড়া খুঁজি। কোনো পিঁপড়ার দেখা মেলে না। অনুবাদ নিয়ে বসি। কবিতা অনুবাদের সময় আমার অন্য কোনো দিকে খেয়াল থাকে না সাধারণত। কিন্তু আজকে কিছুই আগালো না। নিচে নেমে আসি। নদীর ধারে যাই। হাঁস দেখি।
শত শত পরিযায়ী হাঁস। বাংলাদেশের রাজহাঁসের চাইতে আকারে বড়। গায়ের রঙ বাদামী। গরমকালে আসে। বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলি দ্রুত বড় হয়। মা হাঁসগুলি ভয়ঙ্কর।
বাসায় পা দিতেই লোপার ফোন আসে। আমি ধরি না। ফোন বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার ফোন আসে। ধরি না। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার ফোন আসে। আবার ফোন আসে। আবার ফোন আসে। আমি ফোন ধরি।
“হ্যালো”
“হাই”
“কেমন আছো?”
“ভাল। আজকের জন্য ধন্যবাদ।”
“কোনো ব্যাপার না।”
“আমি তোমাকে খুব মিস করি।”
আমি চুপ করে থাকি।
“আমি তো বুঝি নাই সবকিছু এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।”
চুপ করে থাকি।
“তুমি কি কালকে দেখা করতে পারবা একবার?”
“দেখি।”
“ফোন দিলে ধইরো, ওকে?”
“ওকে। আমি এখন রাখি কেমন? ঘুম পাচ্ছে।”
“আমি তোমার সাথে কথা বলছি কেন? গুড নাইট।”
ফোন রেখে বহুব্রীহি ছাড়ি। আবার ফোন আসে। আমি ধরি না। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার ফোন আসে। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে দূরে সরিয়ে রাখি। মদ খেয়ে বিছানায় শুই। বহুব্রীহি দেখার চেষ্টা করি। এক সময় ঘুমিয়ে যাই।
রাত আড়াইটায় ঘুম ভাঙলো স্বপ্ন দেখে। খুব স্পষ্ট একটা স্বপ্ন। শুয়ে থাকি। সিগারেট খাবো? না, ঘুম চটে যাবে। অনেকক্ষণ চেষ্টা চালাই। ঘুম আসে না। চা বানাই। সিগারেট ধরিয়ে ফেসবুকে পারুলের এ্যকাউন্টে যাই। আবার চিঠি লিখতে বসি।
পারুল,
কেমন আছো?
একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছি। চা বানিয়ে এখন চা খাচ্ছি। বাসায় দুধ নাই। সুতরাং লেবু চা। কিছুতেই রাতের বেলা দেখা একটা স্বপ্ন মাথা থেকে যাচ্ছে না। স্বপ্নতো স্বপ্নই।
আমি তোমাদের সেই পুরানো বাসাটা দেখলাম। বৃষ্টি বৃষ্টি। তোমাদের বাসার সামনের সবুজ জায়গাটা কাদা কাদা হয়ে আছে। সেই কাদার ভিতর আমরা হাঁটছি আর গল্প করছি। এক পর্যায়ে তুমি পাশে আরেকটা একতালা ছোট বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলে আমাকে। ওইখানে তুমি থাকো। তোমার ঘরে দেখলাম অনেকগুলি গিটার সাজানো। একটা পিয়ানো। তবলা। তানপুরা।… কিছুক্ষণ পর তোমার আম্মাকে দেখলাম। উনি আমাদের জিজ্ঞেস করলো আমরা চা খাবো কি না। আমি তোমাদের সেই পুরানো বারান্দায় বসে ওনার সাথে চা খেলাম।
ভাল থাকো।
চিঠি পাঠিয়ে ঘুমাতে যাই। ভাল ঘুম হয়। এরপর থেকে চিঠি লেখার ব্যাপারটা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো। পারুলের ইনবক্সে কিছু না লিখলে ঘুম আসে না। ভয় লাগে। লিখলে ভাল ঘুম হয়।
পরের সপ্তাহে উকিলের চেম্বার থেকে গেলাম সাইকেয়াট্রিস্টের চেম্বারে। আগে থেকে এ্যপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ছিল। চলে যাওয়া কম ঝামেলার। সাইকেয়াট্রিসটকে আমি চিঠি লেখার ঘটনাটা জানাই।
সাইকেঃ আপনার কোনো বান্ধবী আছে?
আমিঃ না।
সাইঃ ডিভোর্সের কী অবস্থা?
আঃ চলছে। সময় লাগবে।
সাঃ আপনি বিভিন্ন জিনিস নিয়ে ডিপ্রেসড। এক কাজ করেন। কোথাও ঘুরে টুরে আসেন।
আঃ আচ্ছা।
সাঃ পারুলকে আর চিঠি লেখার দরকার নাই।
আঃ আচ্ছা।
সাঃ আপনার বন্ধুবান্ধব নাই?
আঃ আছে।
সাঃ তাদের সাথে মেলামেশা বাড়ান। একা থাকবেন না।
আঃ আচ্ছা।
সাঃ ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন তো?
আঃ না। ঘুমের ওষধ খেতে পারি না।
সাঃ কেন?
আঃ পরদিন শরীর খারাপ লাগে।
সাইকেয়াট্রিস্ট বৃদ্ধ হালকা চোখে তাকালো। আরও হালকা ডোজের একটা ওষুধ লিখে দিলো। নিয়মিত খেতে বললো। আমি ঠিক করি এখানে আর আসবো না।
বাসায় ফিরে পারুলকে লিখতে বসি।
কেমন আছো?
একটু আগে বাসায় ফিরলাম। সন্ধ্যাবেলা আমি বারান্দায় সময় কাটাই। বারান্দাটা কি তুমি চেনো? পশ্চিমমুখী। আকাশ ভাল থাকলে সূর্য ডুবতে দেখা যায় নদীর ওই পারে। কত কথা মনে আসে। কত মানুষের কথা যে মনে আসে! সন্ধ্যার তেরছা আলো কমলা রঙের। সেই আলো শাদা শাদা চিলগুলির শরীরে এসে লাগে। ওরা খুব ওড়াওড়ি করে।
দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যায়। আকাশ ভাল থাকলে তারা দেখা যায়। এই তারাগুলি নিয়ে কত রকমের কিচ্ছা আছে তাই না? তবু যেন কোনো মিথই যথেষ্ট না। যেমন কোনো দূরবীণ যথেষ্ট না আকাশের জন্য। প্যাসকাল বলেছিল- “প্রত্যেকের মনের ভিতর ঈশ্বরের আকৃতির একটা গর্ত আছে”। ডারউইনের পর সেই কথাটা অন্যরকম হয়ে গেলো। বলা হতে থাকলো- “আকাশে একটা ঈশ্বরের আকৃতির গর্ত আছে”। কিন্তু আমি কোথাও কোনো গর্ত দেখতে পাই না। গর্ত খোঁজে সমতল। সমতল ছাড়া গর্ত বলে কিছু হয় না। কিন্তু কোনো হাতও কি এখনও তল স্পর্শ করেছে? যুক্ত থাকার জন্য ভাষাটাকে কাঠামো দিলাম, কিন্তু দিতে দিতে দেখলাম নিজেই নিজের খাঁচা হইয়া গেছি। যোগাযোগই যদি ভাষার উদ্দেশ্য, তাইলে খাঁচা কেন? সবার সবকিছু হয় না। কিছু কিছু মানুষ থাকে মনে মনে একা। সবাই কি মনে মনে একা নাকি? জানিনা। …
আমি লক্ষ্য করি আমি টিনেজারদের মতো ভাবালুতায় ঘোলাটে চিঠি লিখছি আমার অধুনামৃত প্রথম যৌবনের প্রেমিকাকে তার ফেসবুক ঠিকানায়, যার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে পনেরো বছর আগে। লিখতে ভাল লাগছে। না লিখলে ভয় লাগছে।
*
ওই রাতে পারুলকে তৃতীয়বারের মতো দেখলাম আমার বারান্দায়। সে দুই হাতের আঙুলগুলি ছড়িয়ে কাচের দরোজায় চেপে ধরে উঁকি দেয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে। আমার দিকেই কি? মনে হয় তাকিয়ে আছে। ঠিক স্পষ্ট না। হয়তো আমার দিকে না। আমার সাধারণ ডিরেকশনে।
জমাট বেঁধে থাকি। অন্ধকার হাতড়ে ফেসবুকে ঢুকে পারুলের ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠাই– “পারুল, কেমন আছো?” বারান্দার দিকে মুখ ফেরাই। পারুল একই ভাবে দাঁড়ানো। আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে জিজ্ঞেস করি– “পারুল কেমন আছো?”।
ফোন বেজে ওঠে। লোপা। ১৬ টা মিসড্ কল। সব ওর। আমি ফোনের ভাইব্রেটর বন্ধ করে আবার বারান্দার দিকে তাকাই। পারুল তখনো একই ভঙ্গিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।

[ মেসবা আলম অর্ঘ্য : কবি, লেখক, প্রকৌশলী। ঢাকার পুলা, দেশের বাইরে থাকেন, বিদাশে। প্রকাশিত গ্রন্থ-গ্রন্থিকা – ‘আমি কাল রাতে কোথাও যাই নাই ’, ‘তোমার বন্ধুরা বনে চলে গেছে ’ এবং ‘মেওয়াবনে গাণিতিক গাধা ’। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]