তিন্নির সাথে – মেসবা আলম অর্ঘ্য

“মানুষ যে কেন প্রেমে পড়ে। কেন যে একজন আরেকজনের জন্য পাগল হয়! আবার সেই অবসেশন কেটেও যায়। এমন ভাবে কাটে, যে মনে হয় কখনো ছিলই না”।

কানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগের দিন তিন্নি ওনার এক্স-হাজবেন্ডের কথা বলছিল। তখন বিকালবেলা। সুন্দর একটা বিকাল। আমি তিন্নির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনোযোগী হবার চেষ্টা করছিলাম।

“সত্যিই নিয়াজ পাগল ছিল আমার জন্য। কিন্তু বিয়ের ছয় মাসের মাথায় সব অন্যরকম। বিয়ের আগে, পাঁচ বছর ও যেভাবে আমার টেক কেয়ার করসে, কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। কিন্তু বিয়ের সাথে সাথে কী যে হলো! প্রচন্ড সন্দেহবাতিক। কথায় কথায় খারাপ ব্যবহার করে। আমাকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। বিয়ের আগেও করতো। তখন বুঝতাম না। বিয়ের পর বুঝতে পারি যে নিয়াজ আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।”

“বিয়ের আগে বুঝেন নাই কেন?”

“তখন তো খালি পড়ালেখা করতাম। খুব পড়ুয়া ছিলাম। দিনের মধ্যে আধঘণ্টা শুধু কাটাতাম নিয়াজের সাথে।”

ওয়েইটার খাবার নিয়ে আসে। আমরা রেস্তোরাঁর প্যাটিওতে। সুন্দর রোদ আসছে। শীত শেষ। মানুষ হাঁটছে রাস্তায়। এটা একটা ইটালিয়ান পাড়া। সামনের দোকানপাট, রাস্তা, মানুষজন দেখলে মনে হয় কখনো কিছু ঘটে না এখানে। কোনোদিন ঘটবে না। সবকিছু ময়লাহীন। পৃথিবীর মাফিয়ারা তাদের ব্যবসাগুলি লিগাল করে ফেলেছে।

“মিঃ নিয়াজের সাথে আপনার পরিচয় হইলো কীভাবে?”

“ও তো আমাদের কমন ফ্রেন্ড ছিল। মানে, আমার আর আমার ছেলেবন্ধুর কমন বন্ধু। আমার সাথে রিলেশন ছিল ফারুকের। সেইটা ভেঙে যাওয়ার পর ও আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতে শুরু করলো।”

“তার মানে নিয়াজ ছিল আপনার রিবাউন্ড?”

“না। আমি নিয়াজকে ভালবাসছি। ওর জন্য পাগল ছিলাম।”

“তাহলে যে বললেন খালি লেখাপড়া করতেন?”

“না ব্যাপারটা তা না। আমি খুব ডিপেন্ড করতাম নিয়াজের উপর। ও খুব উপকারী ছিল।”

“পৃথিবীতে অনেক ধরণের উপকারী আছে।”

“আমি খুব বোকা”।

আমি নরম গলায় বললাম…“সরল মানেই বোকা না। চালাকরা সরল না যদিও। অনেক বোকাও বুদ্ধিমান। যদিও চালাক না”।

“আমি একদিন নিয়াজকে খুন করবো।”

বেশ দূরে, রাস্তার পাশে একটা গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। নতুন পাতা আসতে শুরু করেছে। কালো ডালে সবুজ কুচিকুচি। বাতাসে পাতাগুলি কাঁপছে বলে এক ধরণের হ্যালুসিনেশনের মতো হতে থাকে আমার। পাতাগুলি এখনো এত ছোট যে কাঁপার কোনো কারণ নাই। বা কাঁপলেও এত দূর থেকে বোঝা যাবে না। কিন্তু আমার মনে হয় কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে ঝরে পড়ছে, সেটাও দেখছি। তিন্নি আমাকে এত কিছু বলছে কেন? কেবল নিঃসঙ্গতা?

আবার শুরু হয়। আমি যে ওনার কথায় খুব একটা আগ্রহ বোধ করি তা না। মোটামোটি বোরিং লাগে। তার পরেও শুনতে থাকি। কোথাও একটা গল্প আছে। মনে হয় আমার শোনার চাইতে তিন্নির বলার দরকারটা বেশি। আরেকটা বিয়ার অর্ডার করি।

“আসলে নিয়াজের ফ্যামিলির সাথে আমার যায় নাই। আমি একটু যুক্তিবাদী। কিন্তু নিয়াজের বাসায় সবাই খুব ইয়ে। আমি চেষ্টা করসি মানায় চলার। কিন্তু আব্বা মারা গেল। ছোট ছোট ভাই বোন ছিল। আমাকে তখন টাকা উপার্জন করতে হবে। পাগলের মতো কাজ করতাম। দিন রাত। শ্বাশুড়ি পছন্দ করতো না। আমার গায়ের রঙ শ্যামলা। সেটাও পছন্দ করতো না। নানান কথা বলতো।”

“চিরন্তন বউ-শ্বাশুড়ি ক্যাচাল?”

“আমি নিয়াজকে ভালবেসেই বিয়ে করসিলাম। পণ করসিলাম যাই হোক মানায় নিবো। সেভাবেই চলতেসিল। সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে রান্নাবান্না করতাম। শ্বাশুড়ির খোঁজ নিতাম। কিন্তু ওদের মন ভরাতে পারি নাই।”

“মুরগি খান?”

“নিয়াজের গ্রাম থেকে বয়স্ক আত্মীয়স্বজন আসতো। বহু সপ্তাহ ধরে থাকতো। আমার হাজবেন্ড আর তার আম্মা চাইতো আমি ওনাদের পা টিপে দিবো। গদো গদো গলায় কথা বলবো। এতোটা পারতাম না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। একটা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার। অঙ্কে দক্ষ হতে গিয়ে যেন আমার বউ হবার ফর্মুলাগুলি সেভাবে তৈরি হয় নাই।”

আগুনে একটু ঘি ঢালি…”ওয়েল, নিয়াজ তো আপনেরে চিনতো। ওনার তো আপনার কাছ থেকে একজন আদর্শ বিবি আশা করার কথা ছিল না।”

“সেইটাই তো! বিয়ের পর ও কেমন অন্য মানুষ হয়ে গেল। আমি যে চাকরি করি সহ্য করতে পারত না। সারাক্ষণ কেমন একটা বিরক্তি। কী যে ওর খারাপ লাগতেসে পরিষ্কার করে বলতোও না কখনো। ছুতা নাতা নিয়ে ঝগড়া করতো। আর শেষে যখন গায়ে হাত তুললো, তখনই আমি বুঝে গেসিলাম যে …”

“হাত তুললো?”

“আমার ফোনে ফারুকের কল দেখসিলো।”

“ফারুক জানি কে?”

“আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড।”

“ও। ওনার সাথে আপনার যোগাযোগ ছিল বিয়ের পর?”

“না না। কিছুই না। ও তো আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় লাগে। আমার সাথে ওর ছিল অনেক আগে। আব্বা মারা যাওয়ার পর খোঁজ নিতে ফোন দিসিলো। পরে যখন চল্লিশার মিলাদে বাসায় গেলাম, সেইখানে ফারুক আসছিলো। নিয়াজ দেখলো যে ফারুক আসছে।

“সেই থেকে শুরু?”

“আসলে ফারুককে নিয়ে ওর ভিতর একটা জটিলতা ছিল সব সময়ই। ফারুক দেখতে বেটার। নিয়াজের চেয়ে বয়সে বড়। গাড়ি নিয়ে ঘুরতো। এইসব নিয়াজের ভিতর একটা কমপ্লেক্স তৈরি করসিলো আগে থেকেই।”

“ও।”

“সেদিন রাতে নিয়াজ খুব অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। বিছানায়। আমি জিজ্ঞেস করি কী হইসে? সে কথা বলে না। আবার জিজ্ঞেস করি কী হইসে? বলে না। এক পর্যায়ে জানায়, আমার সাথে ফারুককে নিয়ে নাকি মানুষ কথা বলে।
কে বলে?
কে বলে সেইটা জরুরি না, বলে এইটাই জরুরি।
কী বলে?
কী বলে তুমি জানো না? তুমি তোমার বাসায় গিয়া ফারুকের সাথে দেখা করো না? প্রেম
করো না?
এইসব কী বলতেসো?
“নিয়াজ আরও কুৎসিত কিছু কথাবার্তা বলে এবং আমার গালে একটা ঘুষি মারে। আমি উল্টায় পড়ে যাই। ডিভোর্সের পর চিন্তা করে বের করসিলাম যে, এই অভিযোগটা পুরা বানোয়াট ছিল। ও ইচ্ছা করে গল্প বানাইসিলো।”

“মানুষের ভিতর অনেক ধরণের অন্ধকার থাকতে পারে।
নেপালের খবর দেখসেন? কি সাঙ্ঘাতিক
তাই না?”… আমি প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করি।

“দেখসি।”

“অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক মানুষ আটকা পড়সে।”

“পুরুষমানুষের ভিতর যেমন অন্ধকার, পৃথিবীর ভিতরেও অনেক ধরণের অন্ধকার।”

“হা হা হা। এইটা একটা রেলেটিভ কথা বললেন। মানে, যেহেতু স্বজাতি মারা গেছে, মনে হচ্ছে টেকটনিক প্লেটের কায়কারবারগুলির কালার হইলো ‘অন্ধকার’। পৃথিবীতে তো ভূমিকম্প লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হচ্ছে, মানুষ আসছে আর কয়দিন আগে…”

“ইরানে এক হুজুর এই কথাও বলসে যে ভূমিকম্পের কারণ হচ্ছে মেয়েদের বেশরিয়তি আচরণ।”

“হাঃ হাঃ… হ্যাঁ, দেখসি।”

“আমি নিয়াজকে একদিন খুন করবো।”

“খুবই বেশরিয়তি কথা বলতেসেন।”

“ও আমার জীবনটা শেষ করে দিল! আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারি না। আমরা একাকীত্ব দূর হয় না। মানুষের সাথে অভ্যস্ত হতে পারি। ডিপেন্ড করতে পারি। কিন্তু কারো প্রতি ভালবাসা ফিল করি না।”

“ভালবাসা কী?”

“নিয়াজের জন্য বিয়ের আগে যা ফিল করতাম… নিয়াজ আমার জন্য যা ফিল করতো!”

“ঠিক।”

“কিন্তু বিয়ের পর সেটা যে কই গেল… আসলে ভালবাসা বলেই বোধহয় কিছু নাই।”

“কেন থাকবে না? ”

“তাহলে সেটা কই গেল?”

“শেষ হইয়া গেছে হয়তো।”

“সত্যিকারের ভালবাসা হলে শেষ হতো না। আমাকে নিয়াজ কখনো ভালই বাসে নাই।”

“আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় উনি আপনাকে সত্য সত্যই ভালবাসছিলো। ওনার ভালবাসা স্রেফ এক্সপায়ার কইরা গেছে। ভালবাসা এক্সপায়ার করতে পারে।”

“আমি কখনো দাবী করি নাই ও আমাকে চিরকাল ভালবাসুক। আসলে ও যে আমাকে আর ভালবাসতে পারতেসিলো না বিয়ের পর, এই নিয়ে ওর উপর আমার কোনো রাগও নাই। আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারি। আমার রাগ ও আমার সাথে যা করলো তা নিয়ে।”

“হু।”

“ও তো আরেক মেয়ের প্রেমে পড়সিলো। ওপেনলি প্রেম করতো ফেসবুকে। আর এদিকে ফারুককে নিয়ে আমার উপর জন্তুর মতো সন্দেহ দেখাইতো।”

“বাহঃ”

“ও নিজে প্রেম করতো আর আমাকে সন্দেহের চাপে রাখতো। আমি ঠিক করলাম মাস্টার্স করতে বিদেশ যাবো। এ্যডমিশন পেয়ে গেলাম। কানাডা আসলাম। কিন্তু আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল নিয়াজ। পড়াশোনা করতাম আর নিয়াজের জন্য কানতাম। ওর সাথে কথা না হলে আমার পাগল পাগল লাগতো।”

“আর নিয়াজ?”

“খালি সন্দেহ করতো! খুব খারাপ সময় গেছে আমার। ও খালি সন্দেহ করতো। আমাকে সরাসরি বলতো ও জানে আমি কোন কোন ছেলের সাথে শুই, কোথায় মদ খাই, খাটো স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াই। আমি এসব কিছুই করতাম না। কোনো সোশাল লাইফ ছিল না আমার কানাডাতে। রেজাল্ট দেখে প্রফেসর বলসিলো পিএইচডি করতে। আমি বললাম অসম্ভব। আমার একমাত্র লক্ষ্য মাস্টার্সটা শেষ করেই হাজবেন্ডের কাছে দেশে ফিরে যাওয়া।”

“প্রবাসে ভালবাসা নবায়িত হইলো?

“নিয়াজের প্রতি আমার টান সব সময়ই ছিল। নিয়াজ যা করতেসিলো, ওর ফ্যামিলি যা করতেসিলো আমি আর নিতে পারছিলাম না। বিদেশে আসার পর সেই বাস্তবতার হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাই। আমার সাথে ছিল কেবল নিয়াজের জন্য ভালবাসা। স্বপ্ন।”

“এই না বললেন গায়ে হাত তোলার…?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তারপরেও, আমি কখনো ডিভোর্স পর্যন্ত ভাবি নাই। আমি ভাবসিলাম যেমন করেই হোক থাকবো। আই লাভ হিম।”

“উনিই ডিভোর্স দিলো?”

“অনেক নাটক করে।”

“কেন”

“বাহঃ… সবাইকে দেখাতে হবে না যে ও ভিকটিম?”

“ও আচ্ছা।”

“গায়ের জোরে সবার কাছে বলে বেড়াইতে লাগলো যে আমি একটা খারাপ মেয়েছেলে। কানাডায় গিয়ে পরপুরুষের সাথে ঘুমাইসি। ওর মন ভেঙে টুকরা টুকরা করসি ইত্যাদি। আমি পড়াশোনার মাঝখানে ঢাকা গেলাম। গেলাম মানে যেতে বাধ্য হলাম, নিয়াজ এমন পরিস্থিতি তৈরি করসিলো। ডিভোর্স হয়ে গেল। তিন মাসের মাথায় নিয়াজ ওই ফেসবুকারকে বিয়ে করলো।”

“বাহ! খুব হিসাবী তো!”

“এখন বেশ খুশি আছে। খালি ছবি আপলোড করে। গাড়ির ছবি। বাড়ির ছবি। বউর ছবি। বউটা একটু কেমন যেন। দেখলে মনে হয় ওর কথায় উঠবে আর বসবে। সাত চড়ে রা করবে না।”

“বেশ।”

“ও ওর আসল সহবাস খুঁজে পাইসে ফাইনালি।”

“ভাল তো। আপনিও একটা খুঁইজা নিবেন।”

“মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক সমস্যারে ভাই। ওর জন্য সবকিছু সহজ।”

“কিন্তু উনি আপনাকে বিয়ে করলো কেন?”

“অবসেস্‌ড হয়ে গেসিলো তো! ডি ইউতে পড়ার সময়। ও আমাকে খুব ভালবাসতো।”

“তারপর? কানাডা প্রত্যাবর্তন?”

“দুই মাস পর ফিরলাম। বাংলাদেশে অবস্থা ভয়াবহ ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদ আকছার হয় বাংলাদেশে এখন। কিন্তু মানুষ খুব নাক গলায়। ডিভোর্সি মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ খুব খারাপ জায়গা। পুরুষরা ছোক ছোক করে। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষগুলি। ডিভোর্সি মেয়ে দেখলেই মনে করে এর সাথে লাইন মারা যাবে।”

“নতুন এক প্রকার ওয়াশিং মেশিন আবিষ্কার হওয়া দরকার, যা দিয়া পৃথিবীর পুরুষদের মাথা ধোয়া যায়।”…

তিন্নি ভুরু কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলো চুপচাপ। ভেবেছিলাম হালকা চালের কথায় হাসবে। কিন্তু হাসলো না।

রাস্তা দিয়ে দুইটা মেয়ে যাচ্ছে। গজগামিনী। চোখের কোণা দিয়ে ওদের উপর নিচ পরীক্ষা করতে করতে বললাম, “ফেরত এসে পিএইচডিতে ঢুকলেন…”

“হ্যাঁ?… হ্যাঁ…
কিন্তু সব মিলায় আর চাপ নিতে পারতেসিলাম না। আমার খুব খারাপ সময় গেছে। খুব খারাপ। এত ভাল একটা পিএইচডি প্রোগ্রামে ঢুকেও চালাতে পারলাম না। চাকরি নিয়ে চলে আসলাম অন্য শহরে।”

“চাকরিও তো ছাইড়া দিলেন।”

“হ্যাঁ। ভাল লাগে না কোথাও। এখন বাংলাদেশে ফিরে যাবো।”

“ভাল লাগবে?”

“না। লাগবে না। কিন্তু আমি কানাডার একাকীত্ব নিতে পারছিলাম না। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে… আমার কিছু করার নাই … কেউ নাই … এইভাবে দেড় বছর থাকলাম। আর না।”

“ফেরত আসার চান্স নাই কানাডাতে?”

“না।”

“বাংলাদেশে গিয়ে একটা বিয়ে করেন।”

“আবার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে? একটা বাংলাদেশি ছেলেকে বিয়ে করার জন্য যেই পরিমাণ এনার্জি লাগে, শুধু প্রথম বিয়েতেই সেটা দেয়া সম্ভব। অন্তত আমরা মতো ক্যারিয়ারিস্টিক মেয়ের জন্য।”

“সব ছেলে নিশ্চয়ই ইবলিশ না… ঠিক আছে… বিয়া না করেন, কিছু বন্ধুবান্ধব বানান। নিজের মতো থাকেন। অনেকেই থাকতেসে।”

“আমার বাসার মানুষ খুব রক্ষণশীল। দুই বোন হিজাবি। মা হিজাবি। আমি বলছি না হিজাবি মানেই অন্ধকার। তা না। কিন্তু আমার সাথে কারো বনে না। বনবে না। আমি জানি। আমার আসলে পৃথিবীতে কেউ নাই।”

“এই কথাটা ভুল। ওনাদের সাথে থাকেন কিছুদিন। আপন মানুষের সাথে। পরে না হয় অন্য কোথাও গেলেন পিএইচডি করতে।”

“আবার বাইরে একা একা?”

“কেউ একজন চইলা আসবে ঘরে।”

“এমন কেউ নাই। নিউজ দেখো না? বাংলাদেশের অবস্থা দেখো না?”

“বেশি সরল কইরা ভাবতেসেন হয়তো। একটু তো পজিটিভ হওয়া দরকার। বাংলাদেশে যখন পাকাপাকি ভাবে চইলাই যাচ্ছেন…”

“জানিনা। আমি পজিটিভ থাকার চেষ্টা করে দেখসি জীবনে। অনেক দুঃখের ভিতরেও একটা একটা দিন… ভাল থাকার চেষ্টা… একদিনের জন্য বাঁচার চেষ্টা..”

* * *

সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি। নতুন পাতা আসতে শুরু করেছে। বাতাসে পাতাগুলি কাঁপছে বলে আমার এক ধরণের হ্যালুসিনেশন হয়। তিন্নিকে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি আপনার কথাগুলি একটা গল্পে লিখতে পারি?”

“কী হবে লিখে?”

“কিছু হবে না। এমনি। অন্য কাউরে নিয়া ভাবা…”

“লিখো। আমিও এক সময় লিখতাম। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে। গল্প। কবিতা…”

“তাই…”

“হ্যাঁ। কই গেল সেই সব দিন!”

“আপনি কিন্তু খুব আত্মমগ্ন। ডিপ্রেশন আপনাকে দিয়ে খালি নিজের কথাই ভাবায়।”

“ছিলাম না এরকম। সবার জন্য ভাবতাম। সবার জন্য আমার…”

আমি লক্ষ্য করি, তিন্নি আবার নিজের কথাই বলা শুরু করেছে। নিজের কথাই ভাবছে। আমার মায়া হয়। ওনার সাথে কই যেন নিজের একটা মিল খুঁজে পাই। আমিও তো সারাক্ষণ নিজের কথাই চিন্তা করি! এই যে একটা গল্প লিখছি, কেন লিখছি? তার চাইতেও বড় কথা, এই গল্প কি আসলেও কোনো গল্প হচ্ছে? গল্প কীভাবে লেখে জানিনা। একজন কাজল শাহনেওয়াজ যেভাবে লেখে, একজন মার্কেজ, হেমিংওয়ে, একজন শহীদুল জহির বা এবাদুর রহমান – কেমনে কেমনে যেন লেখে। জানিনা। না জানার দ্বন্দ্বর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

“আপনি নিউজে বাংলাদেশের ঘটনা ইত্যাদি দেখে বেশি ভয় পাইয়েন না। ওরা অনেককিছু স্টেরিওটাইপ কইরা দেখায়।”

“যা রটে তার কিছু তো বটে। শুধু নিউজ কেন, নিউজের নিচে মানুষের কমেন্ট দেখো না?”

“দেখি।”

“বাংলাদেশ কেমন যেন হয়ে গেছে। ভয় লাগে। মনে হয় থাকতে পারবো না। দুই বছর পর বয়স হবে চল্লিশ। কোথায় যাবো আমি?”

“শক্ত হতে হবে।”

“আমি ক্লান্ত।”

“না না… তা না। পরিস্থিতির ইনপুটগুলা তো মানুষ নানা ভাবে ঠিক ঠাকও কইরা নেয়। মানুষ খুব এডাপটিভ না?”

“আমি এর মধ্যে বাংলাদেশ গেছি। কোনো আলো দেখি নাই। আমার খুব সম্ভাবনা ছিল।”

“সম্ভাবনা এখনো আছে। দেশে যাবেন। ছাত্র পড়াবেন। ওরা একজন মেধাবী শিক্ষক ফিরা পাবে।”

“নিয়াজকে আমি একদিন খুন করবো।”

* * *

আমি আমার পায়ের কাছে একটা পিঁপড়া দেখতে শুরু করি। নিজে নিজেই কথা বলি। মানে, কথাগুলি যে তিন্নিকে বলছি তা না… “মানুষের জীবন একটা তক্তার মতো।”

“মানে?”

“ঘটনা দুর্ঘটনাগুলি যেন অপেক্ষা কইরা থাকে। ছোট ছোট মার্বেলের মতো। জীবনের তক্তা তার উপর দিয়া গড়ায় গড়ায় সামনে আগায়।”

“মানে কী”

“তক্তাটা থাইমা থাকে না আর কী! গড়াইতেই থাকে। জীবনের মানেগুলি তো সামাজিক ইনপুট। নিজেরে ব্যর্থ ভাবা, সার্থক ভাবা ইত্যাদি সামাজিক ইনপুট। সমাজ মানুষের ভিতর অপরাধবোধ তৈরি করে আমরা জানি। সব অপরাধবোধ যে ভাল না তাও জানি। তবু জীবনে কী করতে হবে না হবে ইত্যাদি নিয়া এমন একটা বাড়াবাড়ি ভয়… ”

“আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয় না। আমি খুব এ্যমবিশাস।”

“এ্যমবিশন না থাকলে কেমন হতো? ধরেন, যেই যেই কারণে আপনি এ্যমবিশাস, সেই কারণগুলির অস্তিত্ব নাই…”

“হা হা হা। তাহলে তো গান গেয়েই জীবন পার করে দিতাম।”

আমি হাসিমুখে তিন্নির দিকে তাকালাম…”এই যে দেখেন আমার পায়ের কাছে একটা পিঁপড়া। ওর জীবনে কি ডিপ্রেশন আছে? মনে হয় না কেমন একাগ্র? আমার জুতার এক পাড়ায় যে চিড়া চ্যাপটা হইয়া যাইতে পারে, এই বিপদ সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণা নাই। ভয় নাই। ভয় না পাওয়াটাই ট্রিক।”

“আমি আসলে জীবনে বেশি বুঝে ফেলসি।”

ঘড়ি দেখি…
“অনেক কথা হইলো। ভাল থাকবেন আপনি।”

* * *

তিন্নির সাথে বিদায় নিয়ে শহরের উত্তর বরাবর আগাতে থাকলাম।

দেখতে দেখতে বরফ গলে গেছে। আজকে ২২ কি ২৩ ডিগ্রি। এপ্রিলের শেষে নদী অস্বাভাবিক উচ্ছল থাকে। এত পানি থাকে না। কিছুদিন আগেও পুরা বরফ হয়ে ছিল। পায়ে হেঁটে মাঝনদী পর্যন্ত গেলাম মার্চে। মানে, মাঝনদীতে যাবো, এই লক্ষ্যে হন্টন শুরু করেছিলাম একদিন প্রচণ্ড শীতের ভিতর। যেন লক্ষ্যহীনতা মানেই অন্ধকার! ভালবাসা কি এক অর্থে একটা এ্যমবিশন না? ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকুরির মতন? মিঃ নিয়াজের ভালবাসা মরে গেল কেন? তিন্নি যে ডিভোর্সের তিন বছর পরেও কোথাও স্থির হতে পারছে না, কারণ কী? এ্যমবিশন?

বেঞ্চে বসে থাকি। শীত শীত লাগে।
বেঞ্চে বসে থাকিনা। বাসায় চলে যাই।

গল্পটা লিখে শেষ করলাম। এখন ন্যারেটর ভদ্রলোকের কথা ভাবছি। এত আলগা কেন সে? তিন্নি এতকিছু আগ বাড়ায় না বললে কি কথকের সাথে ওনার একটা প্রেমের সূত্রপাত ঘটতে পারতো? কথক তো একই সাথে বোরড্‌ আবার বোরড্‌ও না। তার নিজের নিঃসঙ্গতা গল্পে অনুপস্থিত। পুরা লেখাটাই মূলত তিন্নির কথার মধ্য দিয়ে তিন্নিকে কথকের পর্যবেক্ষণ। এরকম ভাবাই যায় যে, এই পর্যবেক্ষণ অর্থহীন, যেহেতু তিন্নি কথকের ভিতর তেমন কোনো কম্পন তৈরি করতে পারে না শেষ পর্যন্ত।

* * *

লেখার ফাইল বন্ধ করে নেপালে ভূমিকম্পের খবর দেখতে থাকি আমি। ভিডিও ফুটেজ। সবকিছু থর থর করে কাঁপছে। সার্ভেলেন্স ক্যামেরায় ধারণকৃত দোদুল্যমান সুইমিং পুল। কাঁপছে। কম্পিত মানুষ দৌড়ায় দিগ্বিদিক। চলন্ত গাড়ি থেকে দুইজন ঝাঁপ দিল। উপর থেকে বিশাল বিলবোর্ডের মতো কী যেন একটা হুড়মুড় করে নেমে আসলো গাড়িটার উপর। মানুষগুলি সরতে পারলো, নাকি চাপা পড়লো, ভিডিওতে স্পষ্ট না।

"Human Misery" - পল গগ্যাঁ, জলরং, ১৮৮৯ ; প্রাপ্তিসূত্র - http://www.wikiart.org/en/paul-gauguin/human-misery-1889
“Human Misery” – পল গগ্যাঁ, জলরং, ১৮৮৯ ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.wikiart.org/en/paul-gauguin/human-misery-1889

1517432_10152145826315056_518945034_n

[ মেসবা আলম অর্ঘ্য : কবি, লেখক,  প্রকৌশলী। ঢাকার পুলা, দেশের বাইরে থাকেন,  বিদাশে।  প্রকাশিত গ্রন্থ-গ্রন্থিকা – ‘আমি কাল রাতে কোথাও যাই নাই ’, ‘তোমার বন্ধুরা বনে চলে গেছে ’ এবং ‘মেওয়াবনে গাণিতিক গাধা ’।     – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]

One comment

  1. আপনার শুধু তিন্নির সাথে নয়,পুরো প্রোফাইলটাই পাঠ করছি একটি উপন্যাসের ভিতরের দীর্ঘ কবিতা ধরে হাঁটছি অনেকঅনেকদিন পর একটু intoxication হল….

    Liked by 1 person

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s