এক একটা ক্লাসিক সাহিত্য যখন আমরা পাঠ করি, সেই পাঠে শুধুমাত্র পড়ে শেষ করাটাই মুখ্য নয়।

যতদিন সেই বইটা পড়ছি ততদিন নিজের জীবনের প্রতি পদে সেই ক্লাসিকের সাথে তৈরি হয় একটা অদ্ভুত বন্ধন। অনেকটা সংসার করার মত। মিলান কুন্ডেরার Life Is Elsewhere পড়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার প্রতিটা দিন অন্য যাপিত দিন থেকে আলাদাভাবে অনুভূত হয়েছে। সেই টুকরো দিনগুলোর বিচ্ছিন্ন কিন্তু প্রাসঙ্গিক সুতার মালাটা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
কুন্ডেরার ডেরায় প্রবেশ
আমবাংলোয় বৃষ্টি নামক গুঞ্জন আমার বন্ধু হল। তার সাথে বড্ড খাতির জমল। — নারকেল ঘেরা বাগান – কুন্ডেরার লাইফ ইস এলসহোয়ারে কবির জন্ম হল!
লাইফ ইস এলসহোয়ারে আমার মেটামরফোসিস
জারোমিল মানে Life Is Elsewhere এর কবি অভ্যাসবশত মানুষের শরীরের মুখমন্ডল এ কুকুর এর চেহারা বসিয়ে যখন ছবি আঁকে তখন বস্তুত কাউকেই ছোট করা হয়নি, না কুকুর না মানুষ। বরং কুকুরের বিশ্বস্ততা আর মানুষের শারীরিক সামর্থ্য দিয়ে মেটামরফোসিস ঘটানো হয়েছে। তাই কি? তবে এই প্রাক-ভোরের ক্ষণে বজ্রপাত এর বিষময় রাতে ওই কুকুরের সাথে কুন্ডেরার মত অঙ্গবিনিময় করতে পারতাম! তবে একাকী একাকী খেলতে হতনা। এটা তো সত্য যে, মানুষ ই অনন্য জীব যে একাকী বোধ করে।
আমি Up above the world এর বাসিন্দা
কর্মস্থলে যাবার সময় প্রতিদিন আমার একটি ব্রিজ পাড়ি দিতে হয়। এ ব্রিজ পার হতে বেশ ছোটখাট একটা জ্যাম পোহাতে হয়। জ্যামটা ক্রস করলেই কর্ণফুলীর রূপ আর জৌলুসে সহজেই যে কেউ আক্রান্ত হয়।
মিনিট দুই-তিন এর মত নিজেকে তখন up above the world এর প্রতিনিধি মনে হয়। up above the world বলতে কুন্ডেরা কবি-লেখকের মনোভূমিকে বুঝিয়েছেন তার ক্লাসিক ‘Life Is Elsewhere’ নামক উপন্যাসে। নিজেকে কবি-লেখক বলে দাবি করছিনা বরং ভাবুক বলে দাবি করতেই পারি!!
ঐ জগত নিয়ে ভাবতে ভাবতে down to the world অর্থাৎ এই যে ক্লিশে রিয়ালিটি – নয়টা পাঁচটা অফিস-পরিবার এসব এর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি।
এই বিচ্ছিন্নতা আমার নিজের দোষে ঘটল। কুন্ডেরা লাইফ ইস এলসহোয়ার বলতে অনেক কিছুই বুঝিয়েছেন। বোহেমিয়ান বিপ্লবী জীবন, সমাজ পরিবর্তনে মাতাল হয়ে যাওয়া সময়ের কথা ও বুঝিয়েছেন যেখানে মূলমন্ত্র—“The more I make love , the more I want to make a revolution — the more I make a revolution, the more i want to make love”
তাই সমাজ হতে বিচ্ছিন্নতার কোন বাণী ঐ আপ্তবাক্যে নেই। বিচ্ছিন্ন হবার কোন রাস্তা নেই—
খানিক পর পর পিতার হৃদয়ে পুত্রের জাহাজ ভেড়ে, প্রেয়সীর ইমেজে ব্রেনের সেল উঁকি মারে, আর আন্দামান উপসাগরে যারা অনিচ্ছাকৃত অত্যাচারী এডভেঞ্চারে মৃত্যু মৃত্যু খেলছেন তাদের কে আমি স্বপ্নে ত্রাণ সামগ্রী ছুঁড়ে মারি—-ঘুম শেষে দায়িত্ব সম্পন্নের ঢেঁকুর তুলি!!!! ভাবি is dream a reality অথবা is reality a dream?????
কুন্ডেরার সাথে ভাবের বৈরাগ্য
গতকাল রাতে ‘লাইফ ইস এলসহোয়ার’ এর সাথে অম্ল-মধুর দেড় মাসের সংসার শেষ হল। কবি মারা গেছে উপন্যাসে। মা তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
কবি কোন ধরণের আত্মহত্যা বা বিপ্লবে বা অপঘাতে মারা যায়নি। যেভাবে মৃত্যু হয়েছে তা সাধারণই বলা যায়। অস্বাভাবিক; কারণ তার বয়স অনেক কম ছিল। কবির আবার বয়স কি গো?
কবি এক দিন বাঁচলেও সেটা ১০০ ভাগ খাঁটি জীবন। তার মৃত্যু নিখাদ, ভালবাসা মাতাল-পাগলা, সামাজিক জীবন একেবারে নগ্ন—হয় শূণ্য নয় একশ!
যারা বইটা পড়বেন তারা আবার এটা ভাববেন না যে কবি মারা গেছে এতবড় ইমোশনাল-ক্লাইমেক্স জেনে গেলাম? ধুর!!!
–কুন্ডেরার লেখা এইসব ক্লাইমেক্স-এন্টি ক্লাইমেক্স এর রাস্তা ধরে চলেনা। কুন্ডেরা নিজেই একটা সাসপেন্স এর নাম। সাত চ্যাপ্টার এর শেষ টার নাম – The Poet Dies…
তাহলে বুঝুন?! কবি মারা গেছে বা কিভাবে মারা গেল সেটা মুখ্য নয়। সপ্তম চ্যাপ্টার এর আগের চ্যাপ্টার এ তার মৃত্যুর প্রিটেক্সট আছে যাতে বর্ণনা দেয়া হয়েছে কবির মৃত্যু পরবর্তী একটা ঘটনার। সেই ঘটনা আবেগবিদারী–গগন চিরে যায়।
রাতে ঘুমানোর সময় আস্তে আস্তে আমার চোখ বুজে আসছিল। হঠাত আধোঘুমে দেখলাম—আমার বিছানার আশেপাশে হাঁসের ছানা সমেত একটা পুকুর। পুকুরে একটা ভেলা ভাসিয়ে জারোমিল (কবি) মানে হাভিয়ের আমাকে বলছে- ‘জানো তো, ঘুম মানে জীবন? ঘুমে নাকি মানুষ বহু জীবনের সমুদ্রে চলাচল করে। তুমি কোন কোন জীবনে যাচ্ছ’?
——-Banished from the land of dreams
I seek shelter in the crowd
And wish to change my song
To insults
কুন্ডেরা ও জীবনানন্দ যখন আমার দুই খাঁচায় বন্দী হল
লাইফ ইস এলসহোয়ার!!! পুরো নামটাতেই কাব্যিকতা ভর করে আছে। উপন্যাস পড়ার শুরু আমার মূলত হাই-স্কুল লাইফের শেষের দিক থেকে। অনেক অনেক উপন্যাস না পড়লেও যা পড়েছি, তার মধ্যে উপন্যাস বলতে কি বুঝি তার একটা ভাবনাগত, দার্শনিক মাত্রার ব্যাখ্যা নিজের কাছে আছে।কিন্তু মিলান কুন্ডেরার এই উপন্যাস নাম্নী ২৬১ পৃষ্ঠার বইটা আমার কাছে একটা কবিতা মনে হল। কবিতা ঠিক কোন অর্থে? উত্তরটা কুন্ডেরার মারফতেই দেয়া যায়!!
“Poetry is a domain in which all assertions become true. Yesterday the poet said: “Life is as useless as tears,” today he says: “Life is as joyous as laughter,” and he is right both times.
কুন্ডেরা’র উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কবি জারোমিল এর কাব্যময়তার রেশ কাটতে না কাটতেই হাতে নিলাম জীবনানন্দ’র গল্প। প্রথম গল্পটাতেই আবার আটকে আছি কুন্ডেরার চরিত্রে। ‘আর্টের অত্যাচার’ নামক গল্পের নিখিল চরিত্রের মাঝে জারোমিল এর মনস্তত্ত্ব খুঁজে পাচ্ছি।
গল্পের নিখিল একজন লেখক। সে লেখকের মনোজগৎকে অন্য সাধারণের জীবন থেকে আলাদা ভাবে ভাবতে শিখে গেছে। শুধু তাই নয়, লেখক যখন সাধারণ জীবন থেকে অন্য এক ভাষার জগতে দিব্যি নিজের জাল বুনতে থাকে ততই বিযুক্ত হতে থাকে অন্য সাধারণেরা যে জীবন এর আস্বাদ গ্রহণ করে তার থেকে।
জীবনানন্দ নিখিল এর হয়ে কি বলছে দেখুন: ‘জীবনকে বোঝা হচ্ছে, কিন্তু আস্বাদ করা হচ্ছেনা। নিখিল কবি, তাই মারাত্মক। সামান্য মানুষের পরম গভীর বিশ্বাসও তার কাছে খেলার জিনিস। কত অসামান্য লোক এই জন্য তার কাছে সামান্য হয়ে যায়’।
লেখকের নিজস্ব টানাপোড়েন এ নিখিল অন্যদের সাথে নিজের পার্থক্যটা বুঝতে থাকে শব্দের অত্যাচার দিয়ে! শব্দ, ভাষা নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে থেকে ঐ নিখিল এর আশেপাশে এসে আর্তনাদ করতে থাকে এবং বলে তাদের কে রূপ দিতে, সাজাতে!! দ্বিধাগ্রস্ত নিখিল হঠাত বলে উঠে: ‘আর্ট মানুষকে না দেয় সুখ, না দেয় সোনা’।

কুন্ডেরার জারোমিল ছিল তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অন্ধ অনুরাগী। তার কবিমন যদিও পৃথিবীর তাবৎ বোধ কে আলিঙ্গন করে কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়ায় চাপিয়ে দেয়া যান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক শাসন তার জীবনে জন্ম দেয় অনেক অঘটন-দুর্ঘটনার।
নিখিল এর প্রসঙ্গটা আনার পেছনে মূল কারণ লেখক সত্তার পবিত্রতা বুঝার জন্যে। লেখার মাঝে আর্ট খুঁজে বেড়ানোটা হয় লেখকের নিজের মননের তাগিদে। এখানে পার্থিব কোন চাওয়া পাওয়া কাজ করেনা। কাজ করেনা কোন দালানঠাসা বিত্ত বৈভব।
গল্পে নিখিল এর পরিণতি আমরা পাইনা, শুধু তার মনের সংকটটা টের পাই। ওদিকে জারোমিল তার মৃত্যুকালে স্বপ্ন পূরণ করে হাভিয়ের নামক অল্টার ইগোতে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে। পৃথিবীর ঠুনকো সব আদর্শের যাঁতাকলে হারিয়ে যায় মায়াকোভস্কি, আর্থার র্যাঁবো এবং কুন্ডেরার জারোমিল সহ প্রমুখ অত্যাচারিত কবি-লেখকেরা।

[ইলিয়াছ কামাল রিসাত : সিনেমাখোর, প্রবন্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষ করে বর্তমানে চাকুরিরত। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]