মৃত্যু ভাবনা নামক বিষয়টা সেই ৯-১০ বছর বয়স থেকেই আমাকে যন্ত্রণা দেয়। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পরে রাত এলেই আমার মনে হত ঘুমের মধ্যে আজই মারা যাব। ঘুম মানে এক অর্থে মৃত্যু তা আমি অনেক লেখক-বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মারফত জেনেছি। আবার মৃত্যুই নাকি প্রকৃত জীবন তা বলতে শুনেছি তারকোভস্কিকে। তিনি জেনেছেন তলস্তয় এর কাছ থেকে।
১০ বছর বয়স থেকেই মৃত্যু চিন্তা নিয়ে আমি বিশেষ ভাবে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তাম আমার খালার বাসায় বেড়াতে গেলে। খালার বাসা শহরের এক প্রান্তে। এই প্রান্ত না শহর, না মফস্বল, না গ্রাম। মূল শহরের সাথে অন্য শহরের যোগাযোগের মাঝখানে এমন একটা জায়গা যা গ্রামের নিস্তব্ধতাকেও হার মানায় রাতের বেলা। আবার দিন হলে শহরের মত ব্যস্ততা খেয়াল করি।এই এলাকাকে কী বলা যায়, তা পাঠক ও নগর বিশারদদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
খালার বাড়ির প্রতি প্রধান আকর্ষণ মূলত না গ্রাম-না শহর-না মফস্বল অবস্থার কারণে। আরও একটা কারণ আছে- তা হল আমার খালাত ভাই-বোনেরা ভূতের গল্প বলতে দারুণ পারদর্শী।
মূল রাস্তার বাম পাশে একটা ছোট গেঁয়ো রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলেই খালার বাড়ি। সেই মূল রাস্তার ডান পাশে ছোট ঘন একটা টিলামতন আছে। এই টিলাটাই আমার খালাত ভাইবোনদের গল্পের উৎস।
আমি যখনি বেড়াতে যেতাম তারা আমাকে রাতের বেলা সে টিলার গাছপালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলত – এই টিলাতে একটা অজগর সাপ অভিশপ্ত হয়ে চাপা পড়ে আছে নিচে। অজগর সাপটা নাকি সেই এলাকার এক পীরের দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিল। অজগরটার অভিশাপ যতদিন না উঠছে ততদিন এই টিলার আশেপাশে কোন মনুষ্য ঘরবসতিও করতে পারবেনা।
সেই পীর প্রায় শ’বছর আগে ঐ টিলায় এক গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল দুপুর বেলা। পীরের সাথে কোন মুরিদ আশেপাশে থাকত না। থাকত শুধুমাত্র এক ষোড়শী কন্যা। কন্যার সাথে পীরের সম্পর্ক নির্ধারণে কেউ কোনদিন স্পষ্ট করে কিছু বলেনা এই ভয়ে যে যদি তাদের অনুমান মিথ্যা হয় তবে তাদের উপরও অভিশাপ আসতে পারে।
ষোড়শী কন্যাটা গাছের এক আড়ালে দিব্যি ঘুমুচ্ছিল। পীরেরও একটু একটু চোখ বুজে আসছিল। হঠাৎ কন্যার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল পীরের। ঘুম থেকে যা দেখল, তাতে পুরো জগত আছড়ে পড়ল পীরের মাথায়।
বিরাট এক অজগর আস্তে আস্তে সেই ষোড়শী কন্যার পরনের কাপড় খুলে ফেলছিল!
পীর ও অজগর সম্পর্কিত সেই গল্প এটুক পর্যন্ত সবাই একমত পোষণ করে। এর পরের অংশ নিয়ে হাজারটা ভাষ্য শুনেছি।
একটা ভাষ্য এমন – অজগর সেই কন্যার কাপড় খোলার পর ঐদিনই প্রথম সেই ষোড়শীর ভরা যৌবন দেখতে পেয়েছিল পীর। ঘুমন্ত অবস্থায় পীর সেই কন্যার সাথে সংগমে লিপ্ত হয়। এর পরে পীর দারুণভাবে অনুতপ্ত হয়ে অজগর কে অভিশাপ দিয়ে টিলার নিচে জীবন্ত পুঁতে রাখে। অজগর যদি কন্যার কাপড় না সরাত তবে পীর এমন কাজ করতেন না। তাই সব দোষ ঐ অজগরের।
অন্য একটা ভাষ্য – আসলে অজগরটা কন্যার কাপড় খুলে তার সারাদেহ স্পর্শ করে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে পীর ঈর্ষাকাতর হয়ে অজগরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতঃপর অজগরকে টিলার নিচে পুঁতে রাখে জীবন্ত।
কেউ কেউ বলে – ঐ দিন আসলেই কি কোন অজগর এসেছিল?
প্রচলিত গল্পগুলোর কোন ব্যাখায় আর যাচ্ছিনা। এই গল্প শুনার পর থেকে ঐ টিলার দিকে তাকালে আমি দেখতে পাই সেই পীর, আস্ত অজগর সাপটাকে একটা কাফনে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃত্যু চিন্তা যখনি আমাকে কাবু করে তখন এই পীর আর অজগরের ছবি ভেসে উঠে আমার মনে।
এই যে এতক্ষণ এই গল্পটা বললাম পীর ও ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে, সে গল্পের টুইস্ট টা এখনো বলা হয়নি। আমাকে যারা গল্পটা শুনিয়েছে – তারা আমাকে বলেছে যে, যে এই গল্পটা শেয়ার করে তার কোন পরিচিতজন কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। আমি তখন তাদের বলেছিলাম – ‘তাহলে আমাকে বলছিস কেন? কেউ মারা গেলে কি হবে?
তারা বলেছিল – ‘না, ভুল বলেছিস। এই গল্পটা বেঁচে থাক। গল্পটা ছড়িয়ে যাক। মানুষের তো অভাব নেই। গল্পটা নানা ডালপালা ছড়িয়ে হয়ে উঠুক মহীরুহ’।
গল্পের প্রতি তাদের ভালবাসার এই যুক্তি আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি এত বয়স পর্যন্ত এই গল্প কারো সাথে শেয়ার করিনি। কিন্তু আমিও আর ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না।
গল্পটা আমি অবশেষে বলেছিলাম আমার দশ বছরের ছোট এক মেয়ে বন্ধুকে। অসম্ভব গল্পপাগল সে। সে এই গল্প টা শুনে বলেছিল – ‘এই অসাধারণ গল্প নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখব’।
এর ঠিক ৫ দিনের মাথায় আমার সেই বন্ধু রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
সে আরেক গল্প।


[ইলিয়াছ কামাল রিসাত : সিনেমাখোর, প্রবন্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষ করে বর্তমানে চাকুরিরত। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]