কয়েক বছর আগে আমি বাজার থেকে এক বোতল মহিমা কিনেছিলাম। পাউরুটি, টোস্ট ইত্যাদিতে মহিমা লেপন করে খেতাম। মজা লাগতো। মাঝে মাঝে অসময়ে ঘুম ভেঙে যেত। একবার ভোররাতে দুই চামচ কাঁচা মহিমা খেয়ে ফেলি। সরাসরি। মন শান্ত হয়। এরপর থেকে আমি প্রতিরাতে ঘুম ভাঙলে মহিমা খেতাম।
একদিন পেট নেমে গেল।
চিন্তায় পড়লাম।
মহিমা হজম হচ্ছে না কেন? কাঁচা খাচ্ছি বলে? মহিমা কি অন্য কোনো মহিমা মাখিয়ে খাওয়া দরকার?
মহিমা তো ভাল জিনিস না। এটা খাই কেন?
আমি আমার পাউরুটিকে, টোস্টকে ক্রমশ মহিমাহীন করে ফেলার কাজে লাগলাম। কিছুদিন ভাল থাকলাম। বেশিদিন না। একদম স্বাদ পাই না। খাই না। রাতেরবেলা দুই ঘন্টা ঘুমাই। অফিস যাই না, কাজ করি না, গল্প উপন্যাস পড়ি। ভিতর ভিতর অস্বস্তি হতে থাকে- চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিলে খাবো কী?
বাজারে ফিরে যাই পুনরায়। নতুন ফ্লেভারের আরেক বোতল মহিমা কিনে আনি। আরো দামী, আরো প্রকৃত। রাসায়নিক সার মুক্ত। স্বাদ কম।
আশা করি কাজ হবে।
আমি খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম আবার। পাউরুটি, টোস্ট, পিটা- সবাইকে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু আমার পরিপাকতন্ত্রে যেন পাকাপাকি কোনো সমস্যা হয়েছে। উন্নততর মহিমাও হজম হলো না। পেটব্যথা সারলো না। গ্যাস করে, ঘুম হয় না, শেষরাতে ঘুমাই।
আমার অফিসযাত্রা বন্ধ হলো আবার। সকালে উঠতেই পারি না। অফিসে বলে দেই শরীর খারাপ। ওরা ভাবে আমি হয়তো উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাজগুলি একে একে অন্যদের দিয়ে দেয়া হয়।
কী করবো এখন? কেউ কেউ পরামর্শ দেয়- তোমার আরো উন্নত কোনো মহিমা ট্রাই করা উচিৎ, গুগল করো। আমি বলি ঠিক, করতে হবে।
কিন্তু আগ্রহ পাই না। গুগল করি না।
* * *
কার্যকরী কোনো মহিমা কি ছিল না আমার জীবনে কোনোদিন? ছিল তো। এমনকি সেই মহিমা কখনোই পেটে সমস্যা দেয় নাই। ও চলে যাওয়ার পর আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। দীর্ঘ এক বছর- ক্রমাগত ভেবেছি আমার কোনো পাউরুটি নাই, বিস্কুট নাই, পিটা নাই। পৃথিবীতে মহিমার অস্তিত্বই নাই। সব মিথ্যা।
নিজেকে ভুলে থাকাই শান্তি।
আমি ইতিহাস পড়া শুরু করলাম। কল্পনা করতে থাকলাম আমি একা না। আমার পাউরুটি, টোস্ট, পিটা- ওরাও একা না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আরো অনেকের পেটেই সমস্যা হয়েছে। তারপরেও বিভিন্ন প্রকারের রুটি-বিস্কুট টিকে থেকেছে হাজার হাজার বছর। এমনকি আরো রুটি, আরো বিস্কুট প্রস্তুত হয়েছে।
কিন্তু নিজেকে ভুলে থাকা খুব সম্ভবত শান্তি না, পাপ। জোর করলে হয় না। আমি আস্তে আস্তে মেনে নিতে শিখি যে, সমস্যা মহিমায় না, সমস্যা আমার হজমশক্তিতে।
আমি ডাক্তার আব্দুল্লাহর সাথে দেখা করি। উনি আমার পেটব্যথার বিস্তারিত বয়ান গ্রহণ করে। হাগু পরীক্ষা করে।
ডাক্তার আব্দুল্লাহঃ “আপনি অম্বর গিরি বারিধি বনানী ট্রাই করেছেন?”
আমিঃ “হ্যাঁ।”
“ধর্ম?”
“পড়ি, ট্রাই করি না।”
“তাহলে তো ফজিলত নাই। অর্থ, কাম?”
“ইউ মিন বিয়া? হ্যাঁ।”
“প্রেম?”
“আছে একজন কমপ্লিকেটেড। মানে, ও বিশ্বাসই করে না আমি ওকে ভালবাসি।”
“আপনি গান পছন্দ করেন?”
“মাঝে মাঝে।”
“সাহিত্য?”
“আমি একজন লেখক।”
“কী লেখেন?”
“কবিতা, গল্প, কম্পিউটার প্রোগ্রাম ইত্যাদি।”
“বাহ! এক্সেলেন্ট। চাকরি করেন কখন?”
“অবসরে।”
“আপনার তো চাকরি টিকবে না বেশিদিন।”
“জ্বী, ঠিক ধরসেন।”
“আপনি কি এই নিয়ে ভীত?”
“কিছুটা। তবে আমার সমস্যা আমার হজমশক্তি কম।”
“আপনার স্টুল ভাল না। দিনে কয়টা সিগারেট হয়?”
“২০-২৫ টা হবে।”
“হুম। আমি আপনাকে একজন ব্রিদিং-স্পেশালিস্টের কাছে রেফার করে দিচ্ছি। ফুসফুস পরীক্ষা করাতে হবে। সিগারেট ছাড়তে হবে। মদ্যপান কমাতে হবে।”
আমি হাসিমুখে তাকিয়ে থাকি। ডাক্তার আব্দুল্লাহ খস খস করে প্রেস্ক্রিপশন লিখতে থাকে। উনি দেখতে খুব সুন্দর। মানুষের চেহারা জিনিসটা অদ্ভুত। কারো সাথে কারো মিল নাই। আবার এমন কেউ নাই যার সাথে কারো না কারো মিল নাই। যেমন ডাঃ আব্দুল্লাহ দেখতে অনেকটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো।
“মেসবা সাহেব।”
“জ্বী।”
“জীবনটা এঞ্জয় করেন।”
“আমি তো খুবই এঞ্জয় করছি!”
“গুড। বাচ্চাকাচ্চা ট্রাই করতে পারেন। বাচ্চাকাচ্চার অনেক ক্ষমতা।”
“ওরা আমার পেট ভাল করে দিবে?”
“দিতেও পারে। বলা যায় না…”
…ডাঃ আব্দুল্লাহ মিষ্টি করে হাসলো। আমি ওনার হাসির সৌন্দর্য নকল করে হাসলাম।
আব্দুল্লাহঃ “ওকরাকোক দ্বীপে গেছেন কখনো?”
আমিঃ “হ্যাঁ! কেন বলেন তো?”
“না, আমি আর আমার ওয়াইফ প্ল্যান করেছি আগামী মাসে বেড়াতে যাবো ওখানে। জায়গাটা কেমন?”
“সুন্দর।”
“শুধু সুন্দর? আর কিছু দেখেননি?”
“একবারই গেছি। প্রায় বিচ্ছিন্ন, সূতার মতো চিকন একটা দ্বীপ… সন্ধ্যার সময় পূবদিকের সৈকতটা সুন্দর লাগে.. সূর্য ডোবে সমুদ্রের উল্টাদিকে… মানুষজন কেউ থাকেনা…বড় বড় ঢেউ দেয়… ওই জায়গায় সমুদ্রটার নাম ‘আটলান্টিকের গোরস্থান’… অনেক জাহাজ টাহাজ ডুবসে অতীতে। এখনো ডোবে।”
“আপনি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন।”
…উনি মিষ্টি করে হাসলো।
* * *
ক্লিনিক থেকে বের হয়ে কফির দোকানে যাই।
আমার ঠিক সামনে এক চিরলকেশী মহিমা দন্ডায়মান। কফি নিতে নিতে সামনে ঝুঁকে, কাউন্টারের উল্টাপাশে আরেক মহিমার সাথে বাক্যবিনিময় করছে। স্কার্ট আরো উপরে উঠে এসেছে। অপরূপ। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়ায় পরিষ্কার করে হাসলো।
“তোমরা কি ফরাসীতে কথা বলতেসিলা?”
“তুমি ফরাসী জানো?”
“আই উইশ!”
“হাঃ হাঃ… একটা ফরাসী বান্ধবী জোগাড় করো, শিখতে সুবিধা হবে।”
আমি মহিমাটির চোখের ভিতর যথাসম্ভব সূচারুভাবে তাকিয়ে বলি, “আশা করি তুমি সিঙ্গেল?”
“দুঃখিত, না।”
“কাহার সনে তবে ফরাসী চর্চিবো?”
“হাঃ হাঃ হাঃ।”
“তোমার হাতে কী বই?”
“টেক্সট বই, আইন পড়তেসি।”
“কফিসপে আইন পড়তেসো, সামনে পরীক্ষা বুঝি?”
“এই শনিবার। তোমার বগলে ওইটা কী?”
“উপন্যাস। স্প্যানিশের ইংরেজি অনুবাদ।”
“স্প্যানিশের সাথে কিন্তু ফরাসীর মিল আছে অনেক।”
“তাই?”
“হু! আমি মরিয়ম, তুমি?”
“অর্ঘ্য।”
“আজব নাম।”
“তোমার নামটাও আজব।”
“তুমি কোন দেশের?”
“বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কই জানো?”
“হ্যাঁ চিনি। আমি তিনমাস থাইল্যান্ডে ছিলাম।”
“বাহ! খুব ভাল। বাংলাদেশে গ্যালা না?”
“যাওয়া হয় নাই।”
“তুমি কি এই শহরেরই?”
“না। এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।”
“ওকে তুমি পড়ো।”
আমি মরিয়মের পাশের টেবিলে বসে আধঘন্টা পড়লাম। আরেক কাপ কফি নিলাম। তারপর অর্ধ্বেক ঘন্টা পড়লাম। অত্যন্ত মনযোগ সহকারে এক ঘন্টা ধরে আমি ৩১২ নং পাতাটা পড়লাম। আরো মনযোগ দিতে হবে।
মরিয়মকে শুভকামনা জানিয়ে উঠে পড়ি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকি।
চারপাশে নানারকম মহিমা। এক জটাধারী, ধূসর বৃদ্ধ এসে সিগারেট চায়। দেই।
“ধন্যবাদ। তোমার দিন কেমন যাচ্ছে?”
“তোমার মতই।”
“শহরের জীবন…হায়…ভাল থাকো।”
আমি দেখি এক জায়গায় বিপুল সংখ্যক মহিমা খাওয়া দাওয়া করছে। মুরগিভাজার গন্ধের সাথে ওদের গায়ের সুরভি মিলেমিশে গেছে। সুন্দর একটা রোদ সবার পরনে। ফুটপাথে একটা মহিমা দড়ি দিয়ে বাঁধা। লেজ নেড়ে কুৎকুৎ করে তাকাচ্ছে। এক জায়গায় পুলিশ, প্যারামেডিক, স্ট্রেচার। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে মারামারি হয়েছে। কেউ নিশ্চয়ই মার খেয়েছে। আমি দেখলাম রাস্তার উল্টাপাশে হাতের মুঠিতে ব্যান্ডেজ প্যাচাচ্ছে এক বলিষ্ঠ পুরুষ। কব্জির কাছে চাপ চাপ রক্ত। এখানে হোমলেস শেলটার আছে। হোমলেসদের বেশিরভাগই ‘নেটিভ’।
* * *
আমি শহর থেকে বের হয়ে নদীর ধারে আসি।
প্রায় সব নদীর নামকরণ নেটিভরা করেছে। তবে বর্তমানে বাঁধানো রাস্তার পাশে সুন্দর নদী। বাঁধানো ঘাস। বাঁধানো গাছ। সুন্দর ইট। এক জায়গায় সুন্দর বালু, সমুদ্রতটের মতো।
বালু পার হয়ে ঝোপের দিকে আগাতে থাকলাম। একটা সুন্দর, জেনেটিকভাবে পরিশীলিত মহিমা ঘেউ ঘেউ করে উড়ে আসলো। ঝোপের আড়াল থেকে আরেক মহিমা উড়ে আসলো পেছন পেছন-
“দুঃখিত দুঃখিত। এই টেড, খামোশ। দুঃখিত। কিছু মনে নিবেন না।”
“ভয়ের কিছু নাই।”
“ঘেউ! ঘেউ! ঘেউ!”
“শাট আপ টেড।”
আমি ঝোপের ভিতরে ঢুকে পড়ি। ঝোপ শুধু ঝোপ না, ভিতরে ভিতরে আরো ঝোপ আছে বিধায় এক প্রকার গভীরতা তৈরি হয়েছে।
আমি গভীরে প্রবেশ করলাম। পেশাব করলাম। বের হয়ে আসলাম। সূর্য হেলে পড়ছে।
আমার সামনে বিরাট পানি। পায়ের কাছে খাটো খাটো ঢেউ। চিকন ঘাসের জঙ্গল। পানিগুলি জঙ্গলে ঢুকেছে। ঘাসের ভিতর একটা পেটমোটা খালি বোতল ভাসছে, ছিপি আটকানো বিধায়। বোতলের কল্লাটা পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। ডুবছে আর ভাসছে। উল্টাপাশে মাটিতে কয়লার টুকরা, আধাপোড়া ডাল ইতস্তত ছড়ানো। একটা বড় পাথরের গায়ে কয়লা দিয়ে বেশ কিছু মহিমার ছবি এঁকে গেছে কেউ- বুক, বিচি, পাছা, শিশ্ন ইত্যাদি। সূর্য হেলে পড়ছে। একটা প্রতীকী পরিবেশ। যেন যেই মহিমা দেখছি তা আসলে তা না, তার পেছনে আরো আরো মহিমা লুকানো আছে বলে গভীরতা তৈরি হয়েছে; এবং শুধু তাই না, উক্ত গভীরতা আমার অনুধাবন করা দরকার; এবং করতে পারলে একপ্রকার সহযোগে পৌছানো যাবে।
আমার হাত-পা চুলকাতে থাকে। প্রচন্ড মশা।
* * *
বাসায় চলে আসি।
রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রহ্মবিহার’ পড়ি।
“বুদ্ধ উত্তর দিচ্ছেন, অসৎগণের সেবা না করা, সজ্জনের সেবা করা,
পূজনীয়কে পূজা করা, এই হচ্ছে উত্তম মঙ্গল।”
. . .
“মনে ক্রোধ দ্বেষ লোভ ঈর্ষা থাকলে এই মৈত্রীভাবনা সত্য হয় না–
এইজন্য শীলগ্রহণ শীলসাধন প্রয়োজন। কিন্তু শীলসাধনার পরিণাম হচ্ছে
সর্বত্র মৈত্রীকে, দয়াকে বাধাহীন করে বিস্তার। এই উপায়েই আত্মাকে সকলের
মধ্যে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।”
পড়তে পড়তে আশাবাদী হয়ে উঠলাম আমি। বহুদিন পর গুগল করলাম।
“মহিমা-কেন্দ্রের আনন্দযজ্ঞ”
তোমার এলাকায় বর্তমানে অফার করা হচ্ছেঃক্লাশ-১: ধ্যান শিক্ষা
~~~~~~~~~~~~~~আগে ধ্যান করেছো কি না ব্যাপার না, এই সিরিজ তোমার চর্চাকে আরো উন্নত করবে। প্রতিটা ক্লাসে রয়েছে দুইটা করে চালিত ধ্যান, ভাব বিনিময়, প্রশ্নোত্তরপর্ব। আগে থেকে রেজিস্টার করার দরকার নাই।
ক্লাশ-২: ভালবাসার শান্তি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বুদ্ধ বলেছেন, ভালবাসা হলো শান্তির এক শক্তিশালী উৎস। এই সিরিজে আমরা ভালবাসার ধারণাগুলি শাণিত করবো বুদ্ধের শিক্ষা এবং ধ্যানের মাধ্যমে।ক্লাশ-৩: একাকীত্বের পরমানন্দ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সবকিছু তো খালি। যতই ভরাট দেখাক, অস্তিত্ব আসলে শূন্যতার মাঝেই পরিব্যাপ্ত। এই সিরিজে আমরা এইসব নিগূঢ় বিষয় শিখবো, শূন্যতার ধ্যান শিখবো, এবং আমরা শিখবো এই সত্য দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে মিলিয়ে নেয়া যায়।বি দ্রঃ ‘মহিমাকেন্দ্রের আনন্দযজ্ঞ’ নন-প্রফিট। মিনিমাম দানঃ ১০ ডলার।
আমার বিজ্ঞাপনটা ভাল লাগে। কয়েকবার পড়ি। কিয়ৎপর পেটব্যথা শুরু হলে বাথরুমে গিয়ে বসে বসে চিন্তা করি একটা গল্প লিখবো।
গল্পের চরিত্রগুলি হবে বানোয়াট, কথাবার্তা বানোয়াট, ঘটনা কাল্পনিক- সবকিছুর প্রস্থচ্ছেদ করে এগিয়ে যাবে জটিল জটিল মহিমার স্রোত।
কমোড ফ্লাশ করে লেখা শুরু করি, আগায় না, দেড় পাতা লিখে আরেকটা গল্প শুরু করি, আগায় না, দেড় পাতা লিখে ফেলে দেই।
মহিমাকে ফোন করি।
ধরে না। আবার করি।
…আমি তোমাকে ভালবাসি মহিমা…
…ফালতু কথা বলতেসো কেন? তুমি কাউকে ভালবাসো না। নিজেকেও না…
…আমি সবাইকে ভালবাসি…
…ভাল তো। সবাইকে নিয়ে থাকো…
…আমি তোমাকে চাই মহিমা…
…সাতদিন আগেও বলসো চাও না। আমি গেসিলাম। তুমি আমাকে ডিকন্সট্রাক্ট করসো…
…সেইজন্যই তো তোমাকে চাই…
…আমি চাই না, অর্ঘ্য…
…আমি তোমাকে ভালবাসি…
…শরীরের যত্ন নাও। মদ খাওয়া কমাও…
…সোজা হয়ে যাবো। আমাকে ছেড়ে যেও না মহিমা…
…হ্যাঁ সোজা হও। তারপর একটা বিয়ে করে নিও…
…এমনভাবে কথা বলতেসো কেন?…
…শখ মিটে গেছে। বিদায়…
আমি কোনো যুক্তি দিতে পারি না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের মহিমাগুলি দেখি।
সারি সারি পার্ক করা মহিমা। নীল। লাল। ছাই। কালো। শাদা। একটা বৃহদাকার সবুজ মহিমা- অনেক ডাল, অনেক পাতা। একগুচ্ছ শিশু বল খেলছে। মাথার উপর বিস্তারিত নদী। ষোলতলা থেকে দেখার কারণে অতিকায় এক লম্বন-ত্রুটিতে নদীটাকে আকাশ বলে মনে হয়।
যত সরল হচ্ছি, তত পেটব্যথা বাড়ছে। যেন কতগুলি মজার লম্বন-ত্রুটি তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু সরলতা আদি বিধায় যেকোনো একটা বিশ্বাসের ভিতর ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করে। খুব দুর্বল লাগতে থাকে।
কি অর্থহীন এই দূর্বলতা! কি সাময়িক আমার এই বিশ্বাসী হয়ে উঠতে চাওয়া!
* * *
মদ খাওয়া শুরু করি। যিশু ফোন দিয়ে বলে “বাসায় আছেন?” “আছি।” “ওকে আসতেসি।” “শোনেন, এক বোতল মদ নিয়া আইসেন।” “ওকে।”
* * *
বাসায় আধবোতল শস্তা ওয়াইন, অর্ধ্বেক বোতল শস্তা জিন ছিল। জিন প্রায় শেষ করে ওয়াইন শুরু করি। কার্যকর মিশ্রণ। সন্ধ্যা হই হই। বৃহস্পতি গ্রহ দেখা যাচ্ছে। আমি বারান্দায় বসে আছি। চিন্তা করছি। বাতাস দিচ্ছে।
শার্ট খুলে ফেলি। একটা কবুতর আমার কাঁধে এসে বসে। বেশ অস্বস্তিকর- নড়াচড়া করলে খামচি দিয়ে ধরে।
যিশু দরজা ধাক্কাচ্ছে।
আমি কবুতরটাকে ষোলতলা থেকে ছুড়ে ফেলে শার্ট পরলাম।
“অলরেডি তো খাইতেসেন। আবার আনতে বললেন কেন?”
“আরে যিশু আসেন আসেন! হুইস্কির জন্য ধন্যবাদ।”
“কেমন আছেন?”
“ভাল।”
“নতুন কিছু লিখলেন?”
“ওইগুলাই।… কেমন চলে আপনের?”
“একটা ছবি আঁকতেসি।”
“কীরকম?”
“দেখাবো পরে, ছবিটা আমায় ভর্তি করে রাখসে ইদানিং।”
“বাহ! বেশ। ভর্তি থাকাটা জরুরি। আমি তো পারিই না, মহিমা দিয়া ভইরা যাই।”
“প্রত্যেক মহিমার কোনো না কোনো এ্যন্টিবডি আছে, খুঁজেন।”
“যিশু, আপনের ভিতর একটা আলো আছে, আলোটা আমি ভালবাসি।”
“আমার জীবনের ঘটনা বলা শুরু করলে শেষ হবে না।”
“আপনার লেখা কবে পড়বো?”
“কোন লেখা?”
“ডায়রি।”
“আদি ডায়রিটা তো পোড়ায় ফেলসি, এখন যেটা আছে সেইটা ছাইপাশ।”
“ছাইপাশই দেন… পোড়া ধূপের গন্ধ পেতে চাই… হিঃ হিঃ হিঃ”
“আচ্ছা আপনাকে দিবো।”
যিশু আসাতে আমি আনন্দিত।
আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি। সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। বাচলামি করতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করলাম…
“যিশু।”
“হু।”
“মহিমা কী?”
“আপনে ভইরা আছেন, আপনে বলেন।”
“না না… আসলেই…”
“বলেন বলেন।”
“গ্যাজানির মুড আছে?”
“চলেন গ্যাজাই।”… যিশু ঠোঁটের কোণা দিয়ে তেরছা করে সিগারেট ধরায়।
“ওকে,… সরলভাবে যদি ভোগবাদী এপ্রোচটা চিন্তা করি… সবকিছুই ভোগের বস্তু, ঠিক?”
“হ্যাঁ এবং না। যাই হোক আপনে কী ভাবতেসেন সেইটা কন।”
“ধরেন, ভোগবাদীতা আমাদের কী বলে? বলে, খাইতে থাকার ধারাবাহিকতাই সফলতা। খাইতে থাকো, সাবধান! থামলেই কিন্তু শূন্যতা!”
“অর্থাৎ না-খাওয়াটা বোকামি?”
“হ। তো, এই এপ্রোচটা সরল করে আমরা কী পাইলাম? যে, সবকিছু হইলো মূলত খাদ্য, যেমন আমি, আপনি, পাউরুটি, টোস্ট ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যেহেতু শিষ্ট, আমাদের এখন এই ক্যাপিটালে চিনি মাখাতে হবে। পাউরুটি খালি খালি খাইয়া শান্তি পাবো না, মহিমার জেলি মাইখা খেতে হবে- অর্থপূর্ণ উপায়ে।”
“হুম।”
“সুতরাং কী হইলো? মহিমার চাহিদা গেল বাইড়া। নানান কিসিমের মহিমা প্রস্তুত হতে থাকলো- শিক্ষার মহিমা, সফলতার মহিমা, প্রেমের মহিমা, ক্যারিয়ারের মহিমা, সংসার, বংশ, যন্ত্র, প্রকৃত ইত্যাদি।”
যিশু ধূম্রজাল বিস্তার করতে করতে বলে…
“পাগলের সুখ মনে মনে, পাতা কুড়ায় আর টাকা গোনে। মানে আপনের কথায় যা বুঝলাম- এক অর্থে, আত্মকেন্দ্রিকতার টিকা থাকার লাইগ্গা এই চিনি দরকার। নাইলে থলির বিড়াল বাইর হইয়া যায়। এই কথা আর বিশ্বাস হয় না যে আমরা ধাপে ধাপে উন্নত হচ্ছি, বরং কাহিনী পুরা উল্টা বইলা ঠাহর হয়।”
“যিশু, কথা হচ্ছে- এই মহিমার বাইরেও তো মহিমা আছে।”
“কীরকম?”
“বাহ! নাই? সবকিছুই তো মহিমা!”
“কীরকম?”
“এই যেমন ধরেন পৃথিবীটা ঠান্ডা হয়, গরম হয়, ঠান্ডা হয়… আমাদের মতন, ওদের মতন কত কী পয়দা হয়, মুইছা যায়, আবার পয়দা হয়… মহিমা না?”
“সব মহিমাই ভাবলে মহিমা।”
“না ভাবার অপশন কি আছে?”
“তো এই বিমূর্ত দিয়া আমরা কী করবো?”
“কী আর করবো- রাস্তাঘাট বানাবো!”
“হাঃ হাঃ হাঃ…খুবই শূন্যবাদী কথা। ইঁদুর দৌড়ের কী হবে?”
“এইটা তো শেষ হইয়া যাবার পথে।”
“তাই নাকি? কবে শেষ হচ্ছে?”
“আর বড়জোর দেড়শো বছর!”
“আমার মনে হয় না। সবকিছু অতিরিক্ত প্যাচাইয়া গেছে।”
“মানুষ কিন্তু বদলাইতেসে। স্বপ্ন বদলাইতেসে।”
“খুব ধীরে, বিচ্ছিন্নভাবে।”
“সেই জন্যই তো দেড়শো বছর। পুরুষের অভ্যাস ভাইঙ্গা আমাদের নতুন কিছু বানাতে হবে না? নিজেরে বানানোর মধ্যে দিয়া শুরু করতে হবে না?”
“অর্ঘ্য, অভ্যাসগুলি তো খামাখা তৈরি হয় নাই।”
“যে কোনো কিছুই অভ্যাস করা যায়। সমস্যা হয় তখনই যখন অভ্যাসগুলি প্রতিভার একটা ভোগবাদী মূল্যমান হইয়া দাঁড়ায়। কারণ, তখন সে আপনার ভিতর নিয়ন্ত্রিত হবার চাহিদা তৈরি করবে।”
“সমস্যার ভিত্রেই মানুষ বাঁইচ্চা থাকার চেষ্টা করে। আপনারেও করতে হবে।”
আমি যিশুর মুখপানে চেয়ে দেখি, আসলেও বাচলামি শুরু করেছি। থামতেও পারছি না। যিশুর সাথে বাচলামির মজা আছে…
“আমাজনের জঙ্গলে কত রকমের ভাষা- চিন্তা করসেন? ওদের প্রত্যেকটা ট্রাইব অনেকগুলি কইরা ভাষা জানে। ক্রস-ট্রাইব বিবাহ হয়। ওরা আলাদা আলাদা, কিন্তু আবার যুগ্ম। আর আমাদের চিহ্নগুলি কি বিশিষ্ট চিন্তা করেন!
“কেমন?”
“আমরা তো খালি আলাদা হইতেসি! আমগোর সাথে ভেড়ার পেকিং অর্ডারে মিল আছে। বড় শিঙের ভেড়া দেইখা ছোট শিঙের ভেড়া কী করে? দূর দিয়া যায়। সে জানে এর লগে কাইজা কইরা ফায়দা নাই, গুতা খেতে হবে। এরচে বরং আপস বেটার। আমরাও তো তা’ই করি। আমাদের পার্থক্যটা হইলো আমরা শিংগুলিরে সফলতা মনে কইরা ফেলি, যেহেতু আমরা দেখি শিং প্রস্তুত করা যায়, অর্জন করা যায়।”
“মানুষের যেহেতু বুদ্ধি বেশি, কুবুদ্ধিও বেশি।”
“ঠিক। কুবুদ্ধি দিয়া মানুষ লোহার শিং বানাইলো। যাঁর যত বড় শিং তাঁরে আমরা তত ডরাইতে থাকলাম। ভাবতে থাকলাম উহারা শিং, উহারা আগে খাক, বেশি খাক। নিয়তি আর প্রকৃতিরে আমরা মিলায় ফেললাম।”
“এই জন্যই ভেড়ার বেহেশতো-দোজখ নাই, আমগোর আছে।”
“হিঃ হিঃ হিঃ।”
যিশু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে…
“আপনে ‘অফ লাভ এ্যন্ড আদার ডেমনস’ পড়েন, মজা পাইবেন।”
“ভাল লেখকদের সূচিকর্ম ভাল তাই না?”
“হ্যাঁ। ভাল লেখকরা প্রকৃতির মতো, প্রতীকগুলি ডুবায় রাখতে পারে।”
যিশু আর আমি চুপচাপ বসে থাকি।
সুন্দর বাতাস দিচ্ছে।
অন্ধকার হয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে ঘোলাটে ছোপ ছোপ মেঘ।
“আপনের চাকরির কী অবস্থা অর্ঘ্য?”
“তথৈবচ।”
“চিন্তার বিষয়।”
“চিন্তার কিছু নাই, আপনি কী ছবি আঁকতেসেন বলেন।”
“দেখাবো পরে। এখন উঠতে হচ্ছে, বান্ধবী ফোন দিচ্ছে।”
“ওকে বলেন চইলা আসতে।”
“না। এখন উঠি। কবুতরগুলি কেমন আছে?”
“মনে হয় সুখে আছে।”
“অর্ঘ্য
উঠলাম
ভাল থাকেন।”
* * *
যিশু চলে যায়। আমি ওনাকে বিদায় দিতে নিচে নামি। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করে না।
আমি শহরের একজন বাঁশিবাদককে ফোন করলাম।
“কৃষ্ণভাই কী অবস্থা?”
“এই তো, তুমি কেমন?”
“ভাল। বসবেন নাকি?”
“আমি তো ফৃ। তোমার টাইম থাকলে চলে আসো।”
“আচ্ছা আসতেসি।”
বিপুল বেগে উড়তে থাকি। গত বছরের পুনরাবৃত্তি হলে জেলে যেতে হবে। কিন্তু মদের একটা ব্যাপার আছে- ‘লিকুইড কনফিডেন্স’। জুয়াড়ির মতো মনে হতে থাকে আমি কোনোদিনও ধরা খাবো না।
দুই চোখে দুইটা রাস্তা দেখতে দেখতে কৃষ্ণভাইয়ের বাসায় পৌছালাম।
* * *
একজন লাজুক সাধক। খুব ভাল ঈমন, বাগেশ্রীর সুর বাজায়।
কৃঃ “ভাল?”
আঃ “জ্বী। আপনি?”
কৃঃ “ভাল। অনেকদিন ধরেই তোমার কথা ভাবছিলাম। ভাল হলো তুমি আসলে।”
আঃ “আরে কী বলেন! চলেন বসি।”
কৃষ্ণ মেঝের উপর বাঁশি ছড়িয়ে আয়োজন করে বসে। একটা বাঁশি তুলে নিয়ে ফু দেয়
এবং ম্যাজিকের মতো সবকিছু বদলে যায়।
“সোম ধরতে পারছো?”
“জ্বী না।”
“এই যে এখানে…”
আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকি।
“অর্ঘ্য, বাজাও।”
বাজাতে শুরু করি। ত্রিতালে ঈমন। আমার বাজনা কৃষ্ণের ভাল লাগছে না বুঝতে পারি। ত্রিতাল আদ্ধা করে, কাহার্বা করে, আবার ত্রিতাল করছি। কোমলে কঠিন বাজাচ্ছি। বেমানান র্যালা দিচ্ছি। জট পাকিয়ে যাচ্ছে। চাটি বাদ পড়ছে। মদ খেয়ে গান হলেও হতে পারে, তবলা হয় না।
কৃষ্ণ থামলো। আমার দিকে মিষ্টি করে হাসলো।
“অর্ঘ্য, ড্রিঙ্ক করেছো?”
“জ্বী”।
“আচ্ছা, এইটা শোনো…”
উনি একটা সুর বাজাতে থাকে। জসীমউদ্দীনের গান,
‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি
প্রাণ কোকিলা রে’…
গম্ভীর, নিচু অক্টেভে।
“অর্ঘ্য, গাইবান্ধায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে একজন কাজ করতেন। মুসা ভাই। আমার বয়স তখন দশ-এগারো। মুসাভাই একদিন আমাকে কাঁধে চড়িয়ে মেলায় নিয়ে যান। বাড়ি থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটারের পথ। মেলা থেকে দুইটা বাঁশি কেনা হয়। একটা আমার, একটা ওঁর। আমরা বাজারের পাশে, মাঠে, কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসি। উনি আমাকে বাঁশি শেখাতে শুরু করেন। আমার আদি গুরু। এই গানটা কি যে ভাল বাজাতেন মুসাভাই! আর বাজাতেন ‘দাইমা’। ‘এত রাতে কেনে ডাক দিলি’ আমার তোলা প্রথম সুর।”
“আরো বাজান।”
কৃষ্ণ বাজাতে থাকে। গম্ভীর, নিচু অক্টেভ। ‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি’…
কিছুতেই এই সুরের মহিমা বুঝতে পারি না আমি।
কাহার্বা? কাহার্বাই তো, কিন্তু যেন কাহার্বা না, অন্য কোনো কিছু। আমার ক্রমাগত মনে হতে থাকে কৃষ্ণভাই, মুসাভাই, যিশু, মরিয়ম, ডাঃ আব্দুল্লাহ- আমরা একজন আরেকজনকে আকর্ষণ করছি। তীব্র ভাবে টেনে ধরছি। ধরেই আছি।
* * *
বাসায় ফিরে আসি। মহিমাকে ফোন করি। ধরে না। করতে থাকি, ধরে না…
যেন আমি অনন্তকাল মহিমাকে ফোন করে যাচ্ছি…
করেই যাচ্ছি…
যেন ও মহিমা না।
মহিমা না?

[ মেসবা আলম অর্ঘ্য : কবি, লেখক, প্রকৌশলী। ঢাকার পুলা, দেশের বাইরে থাকেন, বিদাশে। প্রকাশিত গ্রন্থ-গ্রন্থিকা – ‘আমি কাল রাতে কোথাও যাই নাই ’, ‘তোমার বন্ধুরা বনে চলে গেছে ’ এবং ‘মেওয়াবনে গাণিতিক গাধা ’। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]