[লঞ্চ নিয়া ডিটেইলমুখর একটা গল্প] – পাট ওয়ারী

আমি গল্প লিখতে চাই বটে। হইতে পারে নামে, বা ঘটনায়, বা নজরে, বা নন্দনে আমার ভুল। ঠিকঠাক একটা বিষয় যদিও আমি ফুটায়…
থাক এই টপিক,
না,
বাদ।
অনেকগুলা সেমিকোলন আমি এই গল্পে ব্যবহার করতে চাই। এইটা একটা চাওয়া। লঞ্চটার নাম আমি বলবো না। আমি চাঁদপুর যাবো লঞ্চে। এই গল্পে। ধরেন, আমি বললাম একটা নাম। কিন্তু আপনি দেখলেন লঞ্চটা চাঁদপুর রুটের না। বরং, বরিশাল বা ভোলা বা পটুয়াখালী রুটের। তখন আমার উপর রাগ করতেই পারেন আপনি। বা ধরেন আমি চাঁদপুর রুটের একটা লঞ্চের নামই আমি ব্যবহার করলাম। আপনি কোনো একদিন ঐ লঞ্চে গিয়া আমার গল্পের ডিটেইল নিয়া নস্টালজিয়ায় ভুগলেন। ব্যপারটা ভালো দেখাবেনা। (কার কাছে?)
ফালতু কথা এই গল্পে আমি বলতে চাইনা।
বাংলাদেশে কি একটাই চার তলা লঞ্চ? না,

আমার গল্পেরটা না।
আমি লঞ্চের বাইরে দাঁড়ায়া যখন বাতাস খাইতেসিলাম, তখন আমার চেষ্টা ছিল বাতাস না খাওয়ার। কারণ বুড়িগঙ্গার বাতাস দূষিত। আমার কান্না পাইতেসে খুব।
না।

লঞ্চের সামনের দিকটা জং ধরা। পিছনের বা দুই পাশের দিকটাও। আমি, আচ্ছা আমি, দিকটা বলতেসি কেনো? সামনে, পিছে, দুইপাশে বলাই তো যথেষ্ট। লঞ্চে আমি উঠলাম কাঠের সিড়ি দিয়া সাবধানে। লঞ্চ ছাড়ার প্রায় ৫০ মিনিট আগে আমি ঘাটে। হোয়াট আ শেইম! তবে, আজকে তাপমাত্রা বেশি। রাতে সাধারণত এতো গরম থাকেনা। তাই তো রাতে যাওয়া প্রেফার করি। তিনটা লঞ্চ রাতে।
লঞ্চে ঢুইকাই আমি যেই কাজটা করি মূলত। আজকে ঝড় হবেনা বোধহয়। আবহাওয়া তো সেই ইঙ্গিতই দিতেসে। আমি প্রথমেই বসার জায়গা খুঁজি। আমি বেকার। আমি ছাত্র বটে। আমার পকেটে টাকা নাই। তাই ফার্স্ট ক্লাস, কেবিন এগুলায় আমি যাবোনা। নিচ তলা বা দোতলার সাইড-বেঞ্চিগুলিতেও না। আমি যাবোনা দুইতলায় ডেকে ফ্লোরে শুয়ে। আমি যাবো বরং দুইতলা বা তিনতলা কেবিনের ফাঁকে যে জায়গাগুলা সেইখানে নিজের জুতার উপর বইসা। যেহেতু আমার সাথে পত্রিকা বা চাদর বা লুঙ্গি নাই। ভীড়ের দিনগুলাতে এই জায়গাগুলাও ভর্তি থাকে। আজ খালি। কারণ আজকে ভীড় না। তিনতলার একটা জায়গা বাছাই করলাম। পাশেই একটা সিঙ্গেল কেবিনের দরজা। কেউ আসেনাই অবশ্য।
আচ্ছা, আমি কি গল্পটা বানায়া কইতেছি না সত্য ঘটনা?

বেশ ভালো লাগে লঞ্চ ছাড়লে। আমার সাথে এই জার্নিতে মূলত ২টা লোকের কথা হয়। ওহ, ভালো কথা। আমার বসার জায়গাটার পাশের সিঙ্গেল কেবিনটায় চারটা লোক ঢুকে। কিছুক্ষণ আগে। গল্পটা লেখার কিছুক্ষণ আগে। অথবা ঘটনাট ঘটার কিছুক্ষণ আগে। ৩ জন মাল্টিকালার্ড পাঞ্জাবি-পায়জামা আর একজন স্যুটেড। ২৯-৩০-৩১ বছর বয়স।

লঞ্চের দোকানদারের সাথে কথা হয়। নেভি সিগারেট টানতে টানতে তিনি তার বক্তব্য পেশ করেন। লঞ্চে ভূত-প্রেত নাই। ইঞ্জিনের আওয়াজ প্রচুর। ইঞ্জিনরুমের একটু আগেই কেন্টিন আর দোকান। দোকানদাররে আমি জিগাই। “ঐ লঞ্চটা চলেনা কেনো? ভালো সার্ভিস দিতো। মেশিন নষ্ট হইছে নাকি?” দোকানি বলেন, “আমি তো জানিনা। তবে, না, মেশিন না, কিতা জানি রঙ-টং দিবো মনে হয়।” আমি হাসি। আর মিস্টার টুইস্ট চিপস্ খাই। “এই হরতাল-টরতালে লস হয়নি লঞ্চে?” “এগুলার লগে ধরেন লঞ্চে, টেরই পাইতেন না আপনে, কেমনে, কইযে কী হয়, লঞ্চ তো চলেই ভালো। নদীতে তো হয়না কিছু”

আরেকটা লোকের সাথে আমার দেখা হয়।
আহা, লঞ্চের ফ্লোরে বইসা আছি। বাইরে তাকাই। অন্ধকার আর দুই একটা আলো। উপরে তাকাই। প্রায় একই। কুয়াশা নাই। গরমের দিন। মনেহয় কেউ এক বিশাল আকৃতির আয়না এমন কোণে বসাইছে যে চারপাশ আর আকাশ এক লাগতেসে। যদিও মুন্সীগঞ্জ সেতুটা পার হইতেই ঠাণ্ডা একটা বাতাস দিতেসে। আমি ছাই কালারের একটা হাফ-হাতা গেঞ্জি পড়া। দোকানি মাল্টি-কালার্ড ফুলপাতা আঁকা লিলেন কাপড়ের হাওয়াই শার্ট পইড়া ছিলেন। ঠাণ্ডা লাগছে অবশ্য অল্প। বাতাসটা মৃদু না। আমার পাশের কেবিনের বাতি জ্বালানো। লোকগুলা কথা কইতেছে। তাদের কথা শুনার ফুরসত কাহা। আমি আবার উঠলাম লঞ্চটা ঘুরতে। যদিও ছাদ তিনতলায় তবুও কেবিনের এই সাইড থেকে ছাদের খোলা দিকটায় যাওয়ার রাস্তা নাই। নিচতলায় নাইমা দুইতলায় ডেকে উইঠা সেইখান থেইকা উঠতে হয় ছাদে। ছাদে ছোট এক হুজুর। বারো-তেরো বছর বয়স। গোলাপি কালারের পাঞ্জাবি পড়া। শাদা পায়জামা। তিনি কি একা? আশেপাশের লোকগুলার সাথে তো তার যোগাযোগ দেখতেছি না। কী এক ছোট সাইজের রেডিও সে বাজাইতে চাইতেসে। আহা, নদীর মাঝখানে চলবে না তো! তার কি একা লাগছে?

আমার মনে হচ্ছে আমার মাইন্ড কোনো কিছু খেয়াল করতে চাইতেসেনা। সিলেক্টিভ ইনফরমেশন নিতেসে। চোখ যেনো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে।

“হ, তুমি আমার ধনডা বুঝো।” এইখানে এক্সপ্রেশনটা খেয়াল করতে হবে। ঠাণ্ডাও তো লাগতেসে বেশ। তাই তাদের কথা আমি বুঝতেসি বাট বক্তা কে বা কোনটা তা বুঝতেছিনা ঠিকঠাক। কোন কথাটা কে কইতেছে উত্তর কে দিতেসে তা স্পেসিফাই করতে পারতেসিনা ঠিকঠাক। বা ধরেন বুঝা না বুঝার সাথে ঠাণ্ডা মৃদু বাতাসের সম্পর্ক নাই। লঞ্চের কেবিনগুলার থেইকা তো আরো বেশি আওয়াজ আসতো। শুনা যাইতো ঠাপানোর গান। অবিরাম, অবিরাম ঠাপ।
“তুই হুদা বালের কথা না কইয়া উদাহরণ দে, তোর পয়েন্টটা কী?”
“তোর উদাহরণটা কি তোর নিজের কাছেই হাস্যকর মনে হয় না?”
“আমি অবশ্য ব্যপারটাতে ডিফার করি একটু”
“আচ্ছা, আমি তো কোনো সিদ্ধান্তে আসিনাই, একটা সম্ভাবনার কথা বলছি মাত্র। এইরকম চ্যাটের মৌলবাদীগো মত তো নেয়ার দরকার নাই।”
“হাহা“
“আচ্ছা। ঠিকআছে। নিলাম না। কিন্তু আমার লজিক অন্যরকম।”
“হ, তর লজিক হইতেছে ঠিক কইরা দেওইন্যা লজিক। তালগাছ যারই হোক, বালগাছ আমার”
“ফাইজলামি পোন্দাইয়ো না। ইউ আর নট ফানি”
“হাহা, আচ্ছা?”
“যা কইতেছিলাম। মার্ক্সের মৃত্যু মনে হয়না হবে। মিনিমাম লাগবেই এই রোম্যান্টিকতা,”
“আসলেই লাগ্বে, না তুই ধইরা নিলি?”
“না, তুই-ই ক। মানুষের স্বাধীনতার ধারণাটাই তো যথেষ্ট। প্রগতি কি? মানুষের স্বাধীনতার বিপক্ষে যা আছে তা ধ্বংস কইরা দিয়া আগানো। এইটা তো গতিশীল ব্যপার। প্রগতি মনে রাখতে তো সবাইরে সমান করার দরকার নাই, মার্ক্স তো ইনএভিটেবল না বর্তমানে, উদাহরণ তো… ”
“হাহা, মার্ক্স না পইড়া মানুষের স্বাধীনতার কনসেপ্ট টা পাকাপোক্ত হইবো কেমনে? তুই ক। অর্থনৈতিক একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তো লাগবই”
“লাগবোই মানে কী? এইরকম অবভিয়াস ভঙ্গিতে কইলেই তো হইলো না। আমি তো আমার কাজিনের উদাহরণ দিলামই…”
“যেইটা হাস্যকর”
“র্যাডিকাল হইতে তো লাগেনা এখন মার্ক্স। ইরাক ইস্যু, এই দেশের ইস্যু সবখানেই তো তারে দেখছি র্যাডিকালি ভাবতে। সে তো পড়েনাই মার্ক্স”
“এইটা তো আইচ্ছা, এইটা তো…”
“না, দেখ… বল,”
“এইটা তো আইসোলেটেড একটা উদাহরণ”
“দেখ, মানুষের স্বাধীনতা ব্যপারটার কনসেপ্ট আরো স্ট্রং হওয়া দরকার। সঠিক কথা হইলো অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না কইরা স্বাধীনতা প্রকাশ…”
“তোরে তো যা-ই কই, তা-ই আইসোলেটেড”
“স্বাধীনতা ব্যপারটারে একটা ইজমে পরিণত না কইরা, একটা স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে কাউন্ট করা উচিত। খেয়াল কর অন্যান্য ইজমগুলা অভার-অল স্বাধীনতার ছিঁটাফোঁটা।”
“এক্স্যাক্টলি .…”

লঞ্চের দুইতলার ডেকে যখন আমি হাঁটতেছি, তখন বেশ কিছু লোক একটা লোককে ঘিরে জটলা পাঁকায়া ছিল। লোকটা ছিল কালো, খাটো। পইরা ছিল ফুলশার্ট হাতা ভাজ করা। চুলে তেল। দারুণভাবে আঁচড়ানো। সে বলতেছিল সে জাদু দেখাবে, আর আগ্রহী কেউ ২০ টাকা দিলে সে ট্রিকটা বইলা দিবে। কার্ড ট্রিক। তার হাতে এক ডেক বোনাস কার্ড। পকেটেও এক্সট্রা আছে কি? তার প্যান্ট হইতেছে মোবাইল প্যান্ট। আট টা পকেট মোট। তার পকেটগুলার ভিতরে কি সেইটা আমি গল্পকার হিসাবে জানলেও বলবো না। সে পাঁচটা কার্ড ট্রিক দেখায়। এরমধ্যে তৃতীয় ট্রিকটা পছন্দ হওয়ায় আমি তাকে অনুরোধ করি এইটা শিখাইতে। সে আমাকে সাথে নিয়ে নিচতলায় লঞ্চের দোকানটার পাশের বেঞ্চিতে বসে। আসেপাশে কেউ নাই। সে টাকা চায়। আমি টাকা দেই। সে খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে শেখায়।
“চলেন, এইবার উপরে উইঠা আপনি এই ম্যাজিকটা দেখান সব্বাইরে”
“না, থাক। না। আমি। দেখাবোনা”
কারণ আমার হাত স্লো এবং স্লপি। আমি ঠিক করি (মনে মনে, লুকায়ে) বাসায় ট্রিকটা প্র্যাকটিস করার।

একদিন আমি রক্ত দিছিলাম। সেইদিন আমি দৌঁড়ায়া লঞ্চে উঠি। উঠার পর প্রায় পাঁচ মিনিট আমার হার্ট খুব দ্রুত বাজে। আমার মনে হয় আমি হার্ট অ্যাটাকে মইরা যাবো।

“না, হেতির তো বিয়াই হইয়া গেছে”
“তুই কি ভালোবাসতি নাকি হেতিরে?”
“হাহাহা ”

শালার, কোন দুঃখে যে মাঝ নদীতে এতো ঠাণ্ডা লাগতেছে।

আমি এখন নামবো।
লঞ্চের দ্বিতীয়তলার ফ্রন্টসাইডে আমি দাঁড়ায়া আছি। একটা মেয়ে মাত্র আইসা দাঁড়ালো। তার ওড়না বাতাসে উড়তেছে। আমি তার বুকের দিকে তাকায়া আছি। তাকায়া আছি। আমি কী ধরবো এই তাকায়া থাকাকে? জ্যামিতি, বৃত্ত, উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত, কিংবা অধিবৃত্তের ছায়া? নাকি মানুষের শরীর দিকে নির্লিপ্ত তাকায়া থাকা? নাকি মন? বেশি রোম্যান্টিক শুনাইবে কি তখন? কারণ বুকের ভেতরেই তো মন। আমার চোখে তো কামনা নাই কোনো। আমি কি প্রেমে ব্যর্থ সেই সমকামী পুরুষ? আমি এখন নামবো।

ব্যানানা লঞ্চ - লিওন আন্ডারউড ; প্রাপ্তিসূত্র - http://www.wikiart.org/en/leon-underwood/banana-launch
ব্যানানা লঞ্চ – লিওন আন্ডারউড ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.wikiart.org/en/leon-underwood/banana-launch

ফটো - রিয়াজ মাহমুদ উচ্ছ্বাস
ফটো – রিয়াজ মাহমুদ উচ্ছ্বাস

[পাট ওয়ারী – ছাত্র (আসলেই কি?), বেকার (টিউশনি করাইতে আগ্রহী ) ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s