স্করসেজির চিঠি : মামণিকে বাবা

আদরের ফ্রঞ্চেস্কা,
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তোমাকে লিখছি। আমার জগতের চোখে আজ আমি তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে। আর, আমার এই জগতের মধ্যমণি একটাই- সিনেমার চোখ।
বিগত কয়েক বছর ধরেই একটা বিষয় বুঝতে পারছি-
ছোটবেলা থেকেই সিনেমা সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি; তুমি যখন অনেক ছোট, তখন থেকে তোমাকে যেসকল সিনেমা আমি দেখিয়েছি; যখন আমি, সবে ছবি বানানো শুরু করেছি তখন চলচ্চিত্র-নির্মাণের যে দিকটি ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, বিকশিত হয়েছে সেই ব্যাপারটিই আজ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
আর তাই, আজ আমি পূর্ব-নির্মিত সিনেমার কথা বলবনা। আজ বরং বলব সেইসকল সিনেমার কথা, যা সৃষ্টি হবে সামনের দিনগুলোয়।
ফ্রঞ্চেস্কা, আমি আশাহত নই। পরাজয়ের যন্ত্রণা থেকেও এই চিঠি লিখতে বসিনি। বরং, আমি বলব –
আলো আসছে। সিনেমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয় – আলো আসছে।
সেই সময়, আমরা শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, সিনেমা ব্যাপারটা ব্যবসার সাথে জড়িত। এবং, ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার জন্যই হয়তো আমাদের মাঝে সিনেমাকে শিল্পে উন্নীত করার তাগিদ ছিল। আমরা সিনেমাকে ভালোবাসতাম, আর তাই এটাও জানতাম যে- আমাদের এই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের খাটতে হবে, প্রচুর কষ্ট করতে হবে। জানতাম যে, কখনো না কখনো আমদের খুব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, বাধা আসবে। কিন্তু, কোথাও না কোথাও আমাদের মাঝে একটা বোধের জায়গা ছিল- এমন একদিন আসবে, যেদিন চলচ্চিত্র-নির্মাণের সব অপ্রয়োজনীয় বাধা, অনিশ্চয়তা সীমিত হয়ে আসবে, মুছে যাবে; বাধাগুলো থাকবেনা। বলতে পারো সেই সময়টায় চলচ্চিত্র-নির্মাণের সবচেয়ে অনিশ্চিত উপাদানটি কি ছিলো? – চলচ্চিত্র-নির্মাণের সবচেয়ে অনিশ্চিত উপাদানটি ছিলো ফিল্ম নিজেই অর্থাৎ ফিল্ম-রিল এবং যারা তা তৈরি করতো।
ফিল্ম বিজনেসের এসব পরিবর্তন, ফিল্ম-রিল থেকে ডিজিটাল টেকনোলজির আগমন নিয়ে আমার আগে অনেকেই কথা বলেছেন, লিখেছেন। আমি সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করবোনা। এত পরিবর্তনের মাঝেও আমি উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত যে, এর মাঝেও অনেকে আলাদা; ব্যতিক্রম। ওয়েস এন্ডারসন, রিচার্ড লিংকলেটার, ডেভিড ফিঞ্চার, আলেকজান্ডার পেইন, কোয়েন ব্রাদার্স, জেমস গ্রে এবং পল থমাস অ্যান্ডারসনেরা এখনো ফিল্ম-রিলে সিনেমা বানাচ্ছে। এমনকি পল তার ‘দ্যা মাস্টার’ কেবল ৭০ মিলিমিটারে শুট করেই ক্ষান্ত হয়নি, সে কিছু শহরে সেটির প্রদর্শনীও করেছে ৭০ মিলিমিটারের উপযুক্ত কায়দায়; যেকোন চলচ্চিত্র-সচেতন ব্যক্তির উচিৎ কৃতজ্ঞ থাকা।
আমি শুভেচ্ছা জানাতে চাই ফ্রান্স,দক্ষিন কোরিয়া,ইংল্যান্ড,জাপান,আফ্রিকা সহ পৃথিবীব্যাপী সেইসকল শিল্পীদের, যারা এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফিল্ম-রিলে সিনেমা বানাচ্ছে। বর্তমানে, দিনকে-দিন ফিল্ম-রিলে শুটিং এর কাজটি কঠিন হয়ে উঠছে, কিন্তু পৃথিবীব্যাপী এসকল শিল্পীরা থামেননি।
আমি বলব, চলচ্চিত্র-শিল্প এবং চলচ্চিত্র-বাণিজ্য দুটোই এখন ভিন্ন পথের পথিক। কিন্তু, একথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমি হতাশ। দৃশ্য-শব্দের এই বিনোদন-মাধ্যম, যাকে আমরা সিনেমা বলি, লোকে যাকে চলচ্চিত্র বলে চেনে, সে বাস্তবিকই আজ নতুন পথের যাত্রী। ভবিষ্যতে তোমাদের সিনেমা দেখার পরিবেশটাই হবে আলাদা ধাঁচের। সিনেমা হলের সুবিশাল পর্দার জায়গা নেবে থিয়েটার হলের ছোট্ট পর্দা, অথবা আরো ছোট অনলাইন প্রদর্শনীর পর্দা। হয়তো এমন কোন স্থান বা পরিবেশে তোমরা সিনেমা দেখবে যার আন্দাজ আমি এই মুহূর্তে করতে পারছিনা।
তবুও আমি বলতে চাই – সিনেমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয় – আলো আসবেই। কেন জানো? কারণ – শিল্প-মাধ্যমের ইতিহাসে এই প্রথম খুব অল্প খরচে সিনেমা বানানোর দিন এসেছে। যেটি কিনা আমার ছেলেবেলায় অকল্পনীয় ছিল। তখন খুব কম পয়সায়, লো বাজেটে যেসব সিনেমা হত, সেগুলো ছিলো ব্যতিক্রম; কখনোই উদাহরণ নয়। আর এখন, বিষয়টি পুরো উল্টো। তুমি খুব সহজলভ্য ক্যামেরাতেই সুন্দর ছবি পাচ্ছো। সহজে সাউন্ড রেকর্ড করতে পারছো। ঘরে বসেই এডিটিং, কালার কারেকশনের মত জটিল বিষয় সামাল দিচ্ছো।
তবে, প্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব উন্নতি এবং তার ফলে কম খরচে, সহজে, ঘরোয়া উপায়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের গোটা প্রক্রিয়ায় যে বিপ্লব এসেছে সেটিই কিন্তু শেষ কথা নয়। একটা বিষয় এখনো মনে রাখা জরুরী-
যন্ত্র কখনোই সিনেমার জন্ম দেয়না, সিনেমার জন্ম দাও- তুমি !
হ্যাঁ, এটা খুবই সহজ যে তুমি ক্যামেরা হাতে নিলে, কিছু একটা শুটিং করলে, ঘরে এসে ফাইনাল কাট প্রো’তে সেটা জুড়ে দিলে, ব্যাস- সিনেমা হয়ে গেল। কিন্তু, সত্যিকারের সিনেমা- যা নির্মাণ করা উচিৎ – সেটা অন্যকিছু; তা এত সহজ নয়। সত্যিকারের সিনেমার কোন শর্টকাট নেই।
আমার বন্ধু এবং পরামর্শদাতা- জন ক্যাসাভেট আজ বেঁচে থাকলে অবশ্যই এবং অবশ্যই সে এই নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ছবি করতো। কিন্তু, ক্যাসাভেট আজো সেই কথাগুলোই বলত, যা সে সবসময় বলত; তা হল- তোমাকে নিজের কাজের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে হবে, নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। নিজের সবটুকু দিয়ে দিতে হবে সিনেমার জন্য। ঠিক যেই আগুনের ফুলকি তোমাকে তোমার সিনেমাটির জন্য পাগল করে তুলেছিলো, তোমাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে হবে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে- নিজের জীবন দিয়ে হলেও।
আর তাই, আমাদের পুরনো দিনে সিনেমা বানানোর ব্যাপারটি এত ব্যয়বহুল ছিলো যে, সকল অবসাদ-ক্লান্তি, আপোষ এবং বাধা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সিনেমাকে যেকোনো মূল্যে আগলে রাখতাম, লড়াই করতাম, বাঁচিয়ে রাখতাম। অদূর ভবিষ্যতে তোমাদের এই বাঁচিয়ে রাখার লড়াইটি হবে অন্য কিছুর বিরুদ্ধে। তোমাদের লড়াই হবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। হ্যাঁ, সময়ের সাথে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে, অন্ধ অনুকরণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে তোমরা এবং বাঁচিয়ে রাখবে নিজের শিল্পকে। নিজের সিনেমাটাকে উচ্ছন্নে যেতে দিওনা, কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দিওনা তোমার সিনেমাকে।
তাই, সিনেমা-সৃষ্টির, চলচ্চিত্র-নির্মাণের গোটা ব্যাপারটি কেবল ফিল্ম-রিল বা ডিজিটাল টেকনোলোজি নিয়ে বিতর্কের ব্যাপার নয়। গোড়ার কথাটি হল- পৃথিবীতে কোন কিছুই সহজে আসেনা। চেষ্টা, অধ্যবসায় এবং সাধনা ছাড়া মহৎ কিছু অর্জিত হয়না। সহজে যে ধন মেলে তা ক্ষণস্থায়ী।
এর মানে এই নয় যে আমি সহজের বিরুদ্ধে – কঠিনের পক্ষে, দুর্গমের পক্ষে; আমি তা নই।
আমি বলব সেই কণ্ঠস্বরের কথা, সেই উচ্চারণের কথা, মধ্যযুগের অন্ধকারেও কোয়েকারদের বলা সেই অন্তর্নিহিত আলোর কথা, যা আমাদের স্বপ্ন দেখায়, সাহস দেয় স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের কথাটি বলার, নিজের পথে চলার। সেই কণ্ঠস্বর যা বুকের মধ্যে আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বালিয়ে দেয়- সিনেমা গড়ার স্বপ্ন… এবং সেই স্বপ্নটিই সত্যি, সেই কণ্ঠস্বরই হলে- তুমি !
ভালো থেকো।
ভালোবাসায়-
বাবা।

[L’ESPRESSO তে প্রকাশিত MARTIN SCORSESE A LETTER TO MY DAUGHTER অবলম্বনে। অনুবাদে সাব্বির পারভেজ সোহান]
[ সাব্বির পারভেজ সোহান – কবিতা আর সিনেমা ভালবাসেন। সিলেট থাকেন। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]