(রিচার্ড ক্লেইন ও ব্লেইক এডগার সাব’এর “The Dawn of Human Culture” বইয়ের প্রথম অধ্যায় Dawn at Twilight Cave – এর অনুবাদ, প্রথম কিস্তি। অনুবাদে প্রত্যাশা প্রাচুর্য – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)

পূর্ব আফ্রিকা। লেক নাইভাশা। গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির ফুটিফাটা মাটির কোলে নীল জলাশয়। পশ্চিম উপকূল জুড়ে মাও এস্কারপমেন্ট। এর গা বেয়ে অনেক উঁচুতে ছোট্ট একটা পাথুরে গুহা খোদাই করা। মধ্য কেনিয়ার পশুপালক জাতি মাসাই-রা এই গুহাটির খুব সুন্দর একটা নাম দিয়েছে। স্থানীয় ভাষায় নামটি হল ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’।

ইংরেজিতে ‘Twilight Cave’। বহুকাল ধরে এখানে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। এই গুহার নরম মাটি বিগত হাজার বছরের বহু সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে, যেমন কৃষিকাজ নিয়ে স্থানীয়দের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভেড়া আর ছাগলকে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করার চেষ্টা ইত্যাদি। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি তথ্য লুকিয়ে আছে এই গুহার তিন মিটার (প্রায় দশ ফুট) নিচে। বালি, কাদা আর মাটির মধ্যে। অবসিডিয়ান গ্লাসের হাজার হাজার টুকরা। অবসিডিয়ান গ্লাস হচ্ছে একরকম কালো কাচ। লাভা খুব দ্রুত ঠান্ডা হয়ে তৈরি হয়। পাতলা হলে কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে থাকে। তবে যে টুকরাগুলির কথা বলা হচ্ছে সেগুলি কোন সাধারণ আকৃতির টুকরা নয়। কতগুলিকে হয়ত আকৃতি দেওয়া হয়েছিল ছুরির। আঙুলের সমান। ঠিক স্ক্যালপেল এর মত তীক্ষ্মধার বিশিষ্ট। কিছু আছে বুড়া আঙুলের আকারের স্ক্র্যাপার। আরো কিছু নানা রকম পাথরের তৈরি ছোট ছোট যন্ত্রপাতি। প্রাচীন ওয়ার্কশপের অস্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু আর্কিয়োলজিস্ট স্ট্যানলি আম্ব্রোসকে মুগ্ধ করেছিল অন্য জিনিস!
উটপাখির ডিমের খোসার ভগ্নাংশ। সংখ্যায় প্রায় ছয়শ। এর মধ্যে তেরটি ৬ মিমি ব্যাসের রিং। সেগুলি কী করে যেন অক্ষত রয়ে গেছে শুধু আমারদের কৌতূহল আর মুগ্ধতা বাড়াতেই। চল্লিশ হাজার বছর আগে কে বা কারা ‘Twilight Cave’-এর মুখের কাছে উপুড় হয়ে বসে ড্রিল করেছিল উটপাখির ডিমের খোসার চারকোনা ভগ্নাংশগুলিকে। তারপর অতি যত্ন সহকারে ঘষে দিয়েছিল কিনারগুলি যতক্ষণ না শুধু একটা রিং রয়ে যায়। ড্রিল করতে বা ঘষতে যেয়ে যেগুলি ভেঙে যেতে সেগুলি ফেলে দিয়ে নতুন টুকরা নিয়ে আবার শুরু থেকে ড্রিল করা হত।

কিন্তু কেন? ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র মানুষেরা ফোর্জিং-এর (Forging) মত জরুরি কাজ ছেড়ে কেন এই উটপাখির ডিমের রিং তৈরির মত কষ্টকর কাজে মগ্ন ছিল? প্রশ্নটা খুবই জরুরি। কারণ, ইনকাপুনে ইয়া মুতোর অধিবাসীরাই একমাত্র মানুষ না যারা এরকম রিং তৈরি করত। ৩০ হাজার বছর আগে, প্রস্তর যুগের মানুষেরা তানজানিয়ার মুম্বা, কিসেসে ২ রকশেল্টার কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ডার, বুমপ্লাস গুহায়ও রেখে গেছে সেই একই রকম উটপাখির ডিমের খোসার তৈরি রিং। আম্ব্রোসের মতে, এই প্রাচীন রিংগুলি সে সময়কার কারিগর আর তার পরিবারের বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
Botswana-র কালাহারি মরুভূমিতে বাস করে এক শিকারী গোত্র। তাদের নাম !কুন সান। (!Kung San; বিস্ময়বোধক চিহ্নটা ইচ্ছাকৃত। সঠিক বাংলা উচ্চারণ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই বলেই এই কাণ্ড! একটা উপায় অবশ্য বের করা যেতে পারে। উচ্চারণের ঠিক আগ মুহুর্তে ‘The Gods Must be Crazy’-র কথা একটু মনে করার চেষ্টা করা যেতে পারে) এই !কুন সানদের মধ্যে ‘যারো’ (hxaro) নামক এক প্রকার উপহার আদান-প্রদানের প্রথা এখনো চালু আছে। !কুনরা খাদ্যদ্রব্য সরাসরি ভাগাভাগি করলেও, কখনোই উপহার হিসেবে দেয় না। যে বস্তু উপহার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেটা হল উটপাখির ডিমের খোসার তৈরি রিং-এর মালা! যেকোনো উপলক্ষ্যে সবচেয়ে যথাযথ উপহার হল এই। !কুন ভাষায় ‘উপহার’ শব্দের প্রতিশব্দই হচ্ছে রিং-এর মালা। !কুনরা যাযাবর জীবন যাপন করলেও এই মালা তৈরিতে যথেষ্ট সময় ও সামর্থ্য ব্যয় করে।
রিংগুলি আসলে ‘সিম্বল’। এগুলি ভৌগলিকভাবে কাছে বা দূরে অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্রের মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা এক রকম লেনদেনের সম্পর্কের পরিচয় বহন করে। হয়তো খরা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোন এক জায়গায় খাবারের ঘাটতি দেখা দিল। সে অঞ্চলের লোক তখন সে জায়গা ছেড়ে চলে আসে পার্শ্ববর্তী অন্য গোত্রের এলাকায়। আশা আছে তাদের থেকে সাহায্য পাওয়ার। কোন এককালে হয়ত এই দুই গোত্রের মধ্যে hxaro দেয়া-নেওয়া চলত। !কুনদের জন্য এই রিং-এর মালা হালকা, ‘পোর্টেবল’ টোকেন। পুরো ব্যাপারটাই যেন এক রকম সোশ্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। Urbana-র ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় এর প্রফেসর আম্ব্রোস বলেন, !কুনরা এভাবে এক রকম হেলথ্ ইনসিউরেন্স ট্যাক্স দেয়। তবে সেটা কোন দেশের হর্তাকর্তা রাজা বা সরকারকে না, বরং ওরা ট্যাক্স দেয় একজন আরেকজনকে।
এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না যে, ইনকাপুনেবাসীরা উটপাখির ডিমের খোসা দিয়ে তৈরি করা সেই হার আদৌ কোন সামাজিক উপহার সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করত কি না! কিন্তু যদি এ যুগের !কুনদের মত ইনকাপুনের মানুষেরাও প্রতীকী অর্থে এই হার কোন কালে যদি ব্যবহার করে থাকে, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি আধুনিক মানুষের জন্য প্রথম সূর্য হয়ত উঠেছিল এই ‘Twilight Cave’-এই। কারণ ‘Symbol’ বা প্রতীকের সাহায্যে তথ্য আদান-প্রদান কিংবা যোগাযোগ রক্ষা করা নিঃসন্দেহে আধুনিক চিন্তা ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে। মানব প্রজাতির বিবর্তন যে লম্বা (অ-নে-ক লম্বা) সময় ধরে চলে আসছে (এখনো চলছে!) তার মধ্যে প্রতীকের ব্যবহার নিঃসন্দেহে বেশ আধুনিক আচরণ।
কোন প্রত্নতাত্ত্বিক যদি মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে কখনো রহস্যময় জ্যামিতিক চিহ্ন বা নকশা সম্বলিত কোন বস্তু, মানুষ বা পশুর আকৃতি খোদাই করা কোন হাতির দাঁত কিংবা কোনপ্রকার পুতি, অলংকার-এর নাগাল পেয়ে যান তবে বুঝে নিতে হবে, এসবের কারিগরেরা আমাদের খুব কাছের মানুষ। (নৈকট্য মাপার স্কেলটা অবশ্যই একটু বড়। বরং পরিষ্কার করে বলা উচিত সে স্কেলটা সময় কিংবা দূরত্বের স্কেলের সাথে তুলনীয়ই নয়। এই স্কেল শারীরবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত।) তারাও আমাদেরই মত যন্ত্র আর হাতিয়ার প্রস্তুত করত। জটিল সামাজিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। আর প্রকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করে আমাদেরই মত মুগ্ধও হত। ভাবত এসব কিছুর মধ্যে তাদের স্থান কোথায়! এমন সব মানুষদের কথা বলা হচ্ছে যারা এক কথায় ‘আত্মসচেতন’।
‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র রিংগুলির প্রাচীনত্ব প্রায় নিশ্চিত। এরপর আম্ব্রোস আরো আবিষ্কার করলেন যে, উপরের দিককার তুলনায় গভীরতা যত বেড়েছে, প্রতি কিউবিক মিটারে তার চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি রিং পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকে এই গুহার প্রথম দিকের বাসিন্দাদের কাছে এই রিংগুলির গুরুত্ব বেশ ভালোভাবেই প্রতীয়মান হয়। আম্ব্রোসের মতে এখনকার কালাহারিবাসীদের মতই লক্ষ বছর আগের সেই মানুষগুলির জন্যও এই উটপাখির ডিমের খোসার তৈরি রিং-এর গভীর এবং প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে।
আম্ব্রোসের মতানুসারে, যদি ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র রিংগুলি কঠিন আর দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বা প্রতিবেশে জীবন রক্ষায় সাহায্য করে থাকে, তাহলে এগুলি হয়তো আদিম মানুষকে আরো সংকটপূর্ণ বা অনিশ্চিত পরিবেশ আর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতেও উব্ধুদ্ধ করেছিল। হয়তোবা সাহস জুগিয়ে ছিল খোদ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পরার।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমাদের বিবর্তনের সাফল্য আর পরবর্তীকালের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিকধারা তৈরির পিছনের ‘সম্ভাব্য’ কারণ জানতে আরো অতীতে যেতে হবে। আমাদের আফ্রিকান অতীত। যদি বুঝতে চাই ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র গুরুত্ব, তাহলে বেরিয়ে পরতে হবে। গন্তব্য আফ্রিকার একদম দক্ষিণ প্রান্ত।
(চলবে..)

রিচার্ড জি. ক্লেইন – প্যালিওঅ্যানথ্রপোলজিস্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। লেখক।
ব্লেইক এডগার – বিজ্ঞান লেখক।
[ প্রত্যাশা প্রাচুর্য – বুয়েটে পত্তেন, অহন উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে। বই পত্তে ভালবাসেন। ভবিষ্যতে মাছ চাষ করার (গোপন) ইচ্ছা রাখেন। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]
পছন্দ অইছে। অনুসরণ চলবে……
ফন্ট সাইজ একটু বড় হলে পড়তে সুবিধা অইতো।
LikeLiked by 1 person
[…] প্রথম কিস্তির লিঙ্ক […]
LikeLike
[…] প্রথম কিস্তির লিঙ্ক […]
LikeLike
[…] প্রথম কিস্তির লিঙ্ক […]
LikeLike
[…] প্রথম কিস্তির লিঙ্ক […]
LikeLike