দ্যা ড’ন অফ হিউম্যান কালচারঃ অধ্যায় এক, ২য় কিস্তি – (বঙ্গানুবাদ) প্রত্যাশা প্রাচুর্য

(রিচার্ড ক্লেইনব্লেইক এডগার সাব’এর “The Dawn of Human Culture” বইয়ের প্রথম অধ্যায় Dawn at Twilight Cave – এর অনুবাদ, দ্বিতীয় কিস্তি।  অনুবাদে প্রত্যাশা প্রাচুর্য – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)

প্রথম কিস্তির লিঙ্ক

600x913sr
প্রাপ্তিসূত্র – http://is2.mzstatic.com/image/thumb/Publication2/v4/16/0f/7d/160f7d13-2e6b-bd9e-6d49-3e5488b10c56/source/600x913sr.jpg

 

The Dawn of Human Culture (Chapter 1, Part 2): The game near Klasies

 

এবার লক্ষ্য আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল।

F1.large
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ অর্ধেক। মানচিত্রের উত্তর অংশে দৃশ্যমান – কেনিয়ার এনকাপুনে ইয়া মুতো আর দক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লাসিয়েস মোহনার গুহার অবস্থান; প্রাপ্তিসূত্র – http://science.sciencemag.org/content/sci/313/5788/796/F1.large.jpg

কেনিয়ার ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’ গুহা বা Twilight Cave থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরে ভারত মহাসাগরের ঢেউ বারংবার আছড়ে পড়ছে যেন ঠিক আফ্রিকার পায়ের ওপর। উপকূলীয় ঋজু পাথুরে পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়া জোরালো, তীক্ষ্ম ঢেউ খোদাই করে রেখেছে এক একটা গুহা, যেখানে সহজেই আশ্রয় নিতে পারত প্রস্তর যুগের মানুষেরা। এ ধরণের গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতগুলি আছে কেপ সেন্ট-ফ্রান্সিস থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে আর কেপ টাউন থেকে ৭০০ কিলোমিটার পূর্বে, যেখানে ক্লাসিয়েস নামক ছোট্ট একটা নদী এসে সমুদ্রে পড়েছে, অর্থাৎ এর মোহনায়।

988626694_c0a7cae74f_z
ক্লাসিয়েস মোহনার গুহা, ফটো – জন আথারটন; প্রাপ্তিসূত্র – https://www.flickr.com/photos/gbaku/988626694

প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকা জুড়ে গুহাগুলি পুঞ্জীভূত। উপকূলের ঠিক ধার ঘেঁষে। একসাথে এরা ‘ক্লাসিয়েস রিভার মাউথ সাইট’ নামেই পরিচিত। (লেখার সুবিধার্থে ক্লাসিয়েস নদীর মোহনায় অবস্থিত গুহাপুঞ্জের আদিম অধিবাসীদের সরাসরি ‘ক্লাসিয়েসবাসী’ বলেই অভিহিত করা হবে এরপর থেকে।) এই গুহাগুলির ভিতরের গা থেকে কঠিন শিলা হাজার বছর ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে তৈরি করেছে প্রাক্- বা প্রায়-আধুনিক মানুষদের ফসিল। সাথে আরো আছে পাথুরে হাতিয়ার, অগ্নিকুণ্ডের চিহ্ন আর অসংখ্য স্তন্যপায়ী, পাখি আর শামুক-ঝিনুক জাতীয় প্রাণীদের অবশেষ। খুব স্বাভাবিক জ্ঞানেই ধরে নেওয়া যায় যে, প্রাক্- কিংবা প্রায়-আধুনিক মানুষেরা সেসব প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এসবের প্রত্যেকটির সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আমাদের সেই পূর্ব-পুরুষদের বিষয়ে অনেক তথ্য আমাদের সামনে হাজির করে।

klasies_river_caves
ক্লাসিয়েস মোহনার গুহামুখ, চিত্র-২, ফটো – জন আথারটন; প্রাপ্তিসূত্র – http://f.tqn.com/y/archaeology/1/S/g/G/1/klasies_river_caves.jpg

প্রথমেই ধরা যাক ফসিলগুলির কথা। ক্লাসিয়েসের মোহনার সেই গুহাগুলি থেকে যে দু’ডজনের মত ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলি নিঃসন্দেহে অপ্রতুল এবং অসম্পূর্ণ। তবে সে টুকরো কয়টি সেখানে বসবাসকারী মানুষগুলির আধুনিকত্ব প্রমাণ করার জন্য অবশ্যই যথেষ্ট। কারণ, ফসিলগুলি আধুনিক মানুষের মগজের কিছু জরুরি অংশের সাথে অকাট্য সাদৃশ্য বহন করে। যেমন, একটা প্রায় সম্পূর্ণ নিচের চোয়াল পাওয়া গেছে সেসব ফসিলের মধ্যে। সেটা পর্যবেক্ষণ করে এটা বলতে খুব বেগ পেতে হয় না যে, এই চোয়ালের অধিকারী ‘এনাটমিকালি’ অবশ্যই আধুনিক মানুষের নিকটাত্মীয়। এরা এখন থেকে প্রায় ১০০ হাজার বছর আগে, বর্তমান ইউরোপ দাবড়ে বেড়ানো লম্বা-সরু- আর কিছুটা যেন সামনের দিকে বেরিয়ে আসা মুখের অধিকারী নিয়ানডার্থালদের সমসাময়িক। কিন্তু তাদের মুখাবয়ব ছিল নিয়ানডার্থালদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু প্রশস্ত আর ভোঁতা গোছের।

10f02
ক্লাসিয়েস গুহায় পাওয়া হাড়-হাড্ডি; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.scielo.org.za/img/revistas/sajs/v109n5-6/10f02.jpg

অক্ষিগোলকের ঠিক উপরের একটা হাড়ের ফসিলও পাওয়া গিয়েছে সেখানে। সেই হাড়টিতে খাঁজের ‘অনুপস্থিতি’ একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অক্ষিগোলকের উপরের এই খাঁজ মানবগোত্রের আদি সদস্যদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আরেকটা অত্যন্ত জরুরি তথ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। এই হাড়ের ওপর একটা পাথরের হাতিয়ার দিয়ে আঘাতের চিহ্নও বিদ্যমান। দেখলে মনে হয় যেন খুলি থেকে ছাল-মাংস ছাড়ানোর চেষ্টা চলেছিল। হয়ত খাদ্যের জন্য। অন্যান্য ভগ্নাংশগুলিও কিছু কিছু ছেঁড়া-ফাঁড়া, পোড়া। মানবদেহের বিভিন্ন অংশও হয়ত এন্টিলোপ বা সীল জাতীয় প্রাণীর মতই কেঁটে টুকরো টুকরো করা হতো। এ সব থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করে নিয়েছেন যে, ক্লাসিয়েসবাসীরাও আমাদের জ্ঞাত ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরের আধুনিক মানুষদের মতোই নরমাংস ভক্ষণ করত।

ফসিলগুলি আকার আকৃতিতে আলাদা হলেও, গঠনগত দিক দিয়ে এগুলি যে আধুনিকত্বের দাবিদার একথা এরই মধ্যে বেশ ক’বার বলা হয়ে গেছে। ক্লাসিয়েসবাসীদের তাই ইতিহাসের আওতায় পরা আফ্রিকান বা পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলের মানুষের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ বলেই ধরে নেওয়া যায়। হাড়গুলির বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১২০ হাজার বছর আগের বলে। মাঝে কিছু বিরতি দিয়ে (যখন হয়ত মাত্রাতিরিক্ত অনুর্বরতা তাদের হাজার দশেক বছরের জন্য এ অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য করেছিল) এই মানুষেরা ক্লাসিয়েসে বাস করেছে ১২০ হাজার থেকে প্রায় ৬০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোনাল্ড সিঙ্গার ও জন ভেইমারই সর্বপ্রথম ক্লাসিয়েসে খুঁড়া-খুঁড়ি করতে গিয়েছিলেন। আর সাম্প্রতিককালে স্টেলেনবস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিলারি ডিকন গিয়েও একই স্থানে ক্লাসিয়েসবাসীদের ফেলে যাওয়া অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর দেহের ভগ্নাবশেষ খুঁজে পান। এইসব টুকরো যেন আমাদের আধুনিক ‘রান্নাঘরে’ যেমন ডিম আর সবজির খোসা, মাছের কাঁটা, হাড় পাওয়া যায়, ঠিক সেরকমই অনেকটা।

Blombos_Cave_processing_kit
ক্লাসিয়েস গুহা নয়, তবে তার প্রতিবেশি ব্লমবস গুহায় প্রাপ্ত মোলাস্ক-খোলশের চিত্র; প্রাপ্তিসূত্র – https://en.wikipedia.org/wiki/Blombos_Cave

সেসব স্তুপের মধ্যে আরও পাওয়া গেছে ঝিনুক-শামুক জাতীয় ‘মলাস্ক’ পর্বের আরো কিছু প্রাণীদের খোলসের টুকরা। ক্লাসিয়েসের আশেপাশে লঘু ঢেউয়ের সমুদ্রতীরে আজো এসব প্রাণীদের অভাব নেই। ক্লাসিয়েসের তীরের গুহাবাসীরাই সম্ভবত পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন খাদ্যরসিক যারা কিনা সর্বপ্রথম সামুদ্রিক খাবারের (Sea food) কদর বুঝেছিল।

Blombos_Cave_bifacial_points
পাথরের নানা হাতিয়ার। তবে এই চিত্র ক্লাসিয়েস গুহায় প্রাপ্ত হাতিয়ারের নয়, মোটামুটি কাছাকাছি আরেক গুহা ব্লমবস কেইভের; প্রাপ্তিসূত্র – https://en.wikipedia.org/wiki/Blombos_Cave

সামুদ্রিক প্রাণীদের ভাঙা খোলস ছাড়াও গুহাগুলিতে আরো প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য স্থলচর প্রাণীদের হাড়ের টুকরাও পাওয়া গেছে। সমুদ্রের তীরে প্রায়শই যে রকম ছোট ছোট কিন্তু মসৃণ, গোলাকার পাথর দেখতে পাওয়া যায়, সে রকম পাথরকে চূর্ণ করে তৈরি করা অসংখ্য হাতিয়ারও ছিল। (ইংরেজী ‘Tools’ শব্দের বাঙলা হিসেবে হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি দুইই হয়ত ব্যবহার করা চলে। কিন্তু এই দুটো শব্দই, অন্তত আমার কাছে আর পাথরের টুকরা হিসেবে সহজে কল্পনায় আসে না। দূরহ হলেও মনে রাখতেই হবে, এখানে প্রস্তর যুগের কথা বলা হচ্ছে। পাথরের ‘হাতিয়ার’ মানেই মুগুর-বন্দুক নয়, ‘যন্ত্র’ মানেই হাজার টনের ড্রিল মেশিন নয়।) সেই সাথে ঝলসে যাওয়া ঝিনুকের খোল দেখে বোঝা যায় ওরা রান্নাও করত। অগ্নিকুণ্ডের চিহ্নও বেশ ঘনঘন দেখা গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, দরকার পরলেই এরা আগুনও জ্বালাতে পারতো। বিজ্ঞানী ডিকন-এর মতে, এক একটি অগ্নিকুণ্ড এক একটি পরিবারের নিজস্ব চুলার মত ছিল হয়তো। খুব সোজাসাপ্টা শুনতে হলেও এই বক্তব্যের গুরুত্ব কিন্তু গভীর এবং অর্থবহ। এর মানে দাঁড়ায়, অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের পশুপালক সমাজের একক পরিবার গঠনরীতির সাথে ক্লাসিয়েসের গুহাবাসীদের সাদৃশ্য ছিল। অন্যদিকে আবার ক্লাসিয়েসের গুহাগুলির একটিতেও ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র মতো উটপাখির ডিমের খোসা থেকে তৈরি কোন রিং-এর মালা পাওয়া যায় নি। একটিও না। এমনকি অন্য কোন রহস্যময় প্রতীকী কোন বস্তুরও সন্ধান মেলে নি সেখানে।

এবার আসা যাক টুকরো হাড়ের প্রসঙ্গে। যে সব হাড়ের টুকরা সেখানে পাওয়া গেছে, সেগুলির অধিকাংশের গায়েই রয়েছে কাঁটার চিহ্ন। অনেকগুলি দেখলে মনে হয় যেন সেগুলিকে ভেঙে ভিতর থেকে অস্থিমজ্জার বের করার চেষ্টাও হয়েছিল। এগুলি কিন্তু মোটেই খাপছাড়া পর্যবেক্ষণ না। হাড়গুলির আকার-আকৃতি থেকে বোঝা যায় ক্লাসিয়েস-গুহাবাসীরা ছোট-বড় সব রকমের শিকারকেই বাগে আনতে পারত। ছোট-খাট গ্রে-হাউন্ডের (এক ধরণের কুকুর) আকারের এন্টিলোপ (যেমন- কেপ গ্রীজবক) জাতীয় পশু থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত বড়, শক্তিশালী বুনো মহিষ আর ইল্যান্ড (এই পশুটিও এক জাতের এন্টিলোপ) পর্যন্ত। এমনকি পেঙ্গুইন আর সিলমাছও বাদ পরত না। আরো একটা লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। ক্লাসিয়েসের মানুষেরা সিংহ-হায়েনার এঁটো খুব একটা খেতো না বললেই চলে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্ক্যাভেঞ্জিং’। এর প্রমাণ হচ্ছে হাড়গুলির গায়ে মাংসাশী পশুর (Carnivorous) তীক্ষ্ম দাঁতের কামড়ের চিহ্ন অতি বিরল। প্রায়ই বুনো মহিষ কিংবা ইল্যান্ডের মতো বিশালাকৃতির প্রাণীদের শিকার করে প্রায় একলাই ভাগ বসাত।

এখানেই কিন্তু শেষ না। আরো তথ্যের জানান দেয় এই হাড়ের স্তুপ। যেমন, ক্লাসিয়েসের মানুষেরা স্বাভাবিক কারণেই সংখ্যায় অধিক হলেও বিপজ্জনক শিকার বুনো মহিষের চেয়ে সংখ্যায় কম কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিরীহ ইল্যান্ডকেই ধাওয়া করত বেশি। কারণ, এই দু’জাতের প্রাণীর আকার প্রায় সমানে-সমান হলেও, চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। বুনো মহিষ বিপদের আঁচ পেলে দাঁড়িয়ে থাকে, পালায় না। আক্রমণকারীকে শিং উঁচিয়ে প্রতি-আক্রমণ করে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে ইল্যান্ড ভীরু-প্রকৃতির, বিপদের আশংকায় পালানোর উদ্যোগ করে। কিন্তু তাই বলে ক্লাসিয়েসবাসীরা বুনো মহিষ একদমই শিকার করতো না সেটা ভাবা ভুল হবে। এটা ধরে নিতে বাধা নেই যে, ক্লাসিয়েসবাসীরা হয়তো অপেক্ষাকৃত কমবয়সী বা একদম বুড়িয়ে যাওয়া বুনো মহিষদেরই শিকারের জন্য বেছে নিত। লম্বা শিংওয়ালা, বিশাল আকৃতির এক বিলুপ্ত প্রজাতির বুনো মহিষের ঘাড়ের দিকের একটা হাড় পাওয়া গেছে। হাড়টায় এখনো একটা চোখা, ছোট পাথরের টুকরা গাঁথা অবস্থায় রয়েছে। চোখা পাথরের টুকরাটি সম্ভবত কোন বর্শার ফলার অংশ ছিল। তবে দূর থেকে নিক্ষেপ করার মত বর্শা নয়, বরং শিকারের অনেকটাই কাছে গিয়ে তার গায়ে ঠুকে দিতে হয় এমন বর্শার (thrusting spear) কথা বলা হচ্ছে এখানে। কেননা দূর থেকে নিক্ষেপ করার উপযোগী কোন হাতিয়ারের হদিস সেখানে পাওয়া যায় নি। তাহলে? কাছে গিয়েও কোন জখমের সম্ভাবনা ছাড়া কিভাবে শিকার করা হত? একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, ইল্যান্ডগুলিকে তাড়িয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত করে ফেলা বা কোন রকম ফাঁদে ফেলা।

তবে আরো যেন প্রমাণের দরকার আছে। কোন জীবিত পশুপালের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য সংখ্যা সাধারণত কিছু নিয়ম-অনুপাত মেনে চলে। ক্লাসিয়েসের গুহায় পাওয়া ইল্যান্ডের হাড়গুলির সংখ্যা হিসেব করে দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক ইল্যান্ডের হাড়ের অনুপাত সেখান প্রায় জীবিত পশুপালের প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য সংখ্যার সমান।

এর মানে কি?

এর মানে হল, এই বিপুল পরিমাণ ইল্যান্ডের এরকম বিলোপের কারণ মোটেই কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগ-মহামারী নয়। কারণ, কোন দুর্যোগ বা রোগের প্রকোপে সাধারণত কোন প্রজাতির অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক আর বৃদ্ধ সদস্যরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু হাড়ের স্তুপে প্রাপ্তবয়স্ক ইল্যান্ডের আনুপাতিক হাড়ের সংখ্যাই বলে দেয় যে এই বিপর্যয় প্রজাতির সব বয়সের সদস্যকেই সমানভাবে আঘাত হেনেছিল। ক্লাসিয়েস গুহাগুলির শিলার স্তর পরীক্ষা করে সেরকম কোন বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত বা মহামারীর চিহ্নও পাওয়া যায় নি। তাহলে? ইল্যান্ডের চোখ দিয়ে দেখলে সে বিপর্যয়ের কারণ কিছুটা হয়তো আঁচ করা গেলেও যেতে পারে। সে বিপদ আর কিছুই নয়- ক্লাসিয়েসের গুহার অধিবাসী আমাদের পূর্বপুরুষ, প্রাক- বা প্রায় আধুনিক মানুষদের বুদ্ধি খাটিয়ে শিকারের ক্ষমতা! এদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আশেপাশ কাছাকাছি কোন পাহাড়ের খাঁজের একদম কিনারে নিয়ে গিয়ে ফাঁদে ফেলার কৌশল!

ক্লাসিয়েসের গুহাগুলির চেয়ে অপেক্ষাকৃত পরের সময়কার যেসব গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলিতে আবার ঠিক বিপরীত ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। যেমন- নেলসন বে’র গুহায় ইল্যান্ডের তুলনায় বুনো মহিষ আর শুকরের মত বিপজ্জনক পশুর হাড়ের সংখ্যা ছিল অধিকতর। নেলসন বে’র গুহায় আজ থেকে প্রায় ২০ হাজার বছর আগে বসতি স্থাপিত হয়েছিল। ততদিনে মানুষ তীর-ধনুকের মত হাতিয়ার আবিষ্কার করে ফেলেছে। এগুলি দূর থেকে ছোঁড়া যায়। ফলে শিকার ততদিনে আগের তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে নতুন শিকারের পদ্ধতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ সুফলও বয়ে এনেছিল। ততদিনে নিশ্চয়ই আশেপাশের নিরীহ ইল্যান্ডের সংখ্যা কমে কমে প্রায় বিলুপ্তির পথে, আর সে স্থান দখল করে নিচ্ছিল বুনো শুকর আর মহিষের দল।

Nelson_Bay_Cave,_Roberg_Penninsula,_Plettenberg_Bay,_South_Africa
নেলসন বে গুহামুখ; প্রাপ্তিসূত্র – https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/1/1e/Nelson_Bay_Cave,_Roberg_Penninsula,_Plettenberg_Bay,_South_Africa.jpg

 

আবার ফিরে আসি ক্লাসিয়েসবাসীদের কাছে। ক্লাসিয়েসের লোকেরা শুধু যে বিপজ্জনক শিকার এড়িয়ে চলত তাই না, হাতের নাগালের মধ্যে থাকা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অনেকটাই ভোগ করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। ক্লাসিয়েসের শিলাস্তর আমাদের বলে যে, এখানে বসবাসরত মানুষেরা বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই উপকূলের কাছাকাছিই থাকত। যদিও সব ঋতুতে খাদ্যের পরিমাণ সব অঞ্চলে সমান ছিল না। বছরের কিছু সময় এমন হত যে, উপকূল থেকে দূরে মহাদেশের কিছুটা ভিতরের দিকেই বরং খাবারের খোঁজ পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। এর বিপরীতে নেলসন বে’র গুহার অধিবাসীরা উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করতে আসত শীতের শেষ বা বসন্তের শুরুর দিকে। সে সময়টাতে খুব সহজেই ৯ থেকে ১১ মাস বয়সী সিলমাছদের সমুদ্রের তীর থেকেই ধরে আনা যেত। বছরের অন্য সময়টা তারা কাটাত উপকূল থেকে দূরে, মহাদেশের অভ্যন্তরে। ঋতুর ওপর ভিত্তি করে এদের এমনতর বাসস্থান পরিবর্তনের কৌশল নিশ্চয়ই উটপাখির ডিমের খোসার তৈরি জল রাখার পাত্র ব্যবহার করতে জানার উপরও কিছুটা নির্ভরশীল ছিল। এরকম জল সংরক্ষণের পাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে শুধু নেলসন বে’ মত অপেক্ষাকৃত নতুন গুহাগুলিতেই; ৫০ হাজার বছর পুরানো ক্লাসিয়েসে তীরের গুহাগুলিতে নয়। এমন করে জল সংরক্ষণ আর স্থানান্তর করার কোন উপায় জানা ছিল না বলেই হয়তো ক্লাসিয়েসবাসীরা সারা বছর নদীর কাছাকাছি থাকতে বাধ্য হয়েছিল।

এছাড়াও নদীর মোহনার কাছে মাছের আধিক্যও নিশ্চয়ই ছিল। করমোরেন্ট(পানকৌড়ি) নামের এক জলের পাখির এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যাদের লম্বা গলায় ছোট মাছ ধরে রাখার মত থলি থাকে। মানুষের অনুপস্থিতিতে এরা গুহার মুখে গলার থলিতে মাছ ভর্তি করে কখনো-সখনো বসত অবশ্যই। কিন্তু! ক্লাসিয়েসের গুহাভ্যন্তরের শিলার যে স্তরে নানা রকম ফসিল, হাড় আর অনেকগুলি অগ্নিকুণ্ডের হদিস মানুষের বসবাস সন্দেহাতীতভাবে নির্দেশ করে, ঠিক সে স্তরেই একটিও মাছের কাঁটার সন্ধান পাওয়া যায় নি। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল জুড়ে আরো যেসব সমসাময়িক বা প্রাচীনতর গুহা আছে, সেগুলির একটিতেও কোন মাছের কাঁটার চিহ্নমাত্র নেই। এমনকি সেই গুহা থেকে সমুদ্র এক ঢিল পরিমাণ দূরত্বে অবস্থিত হলেও না। অন্যদিকে, নেলসন বে’র মত নতুনতর গুহারগুলি’র ‘রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়িতে’ মাছের এঁটো-কাঁটার অভাব নেই। পার্থক্যটার কারণ প্রযুক্তির আবির্ভাব ছাড়া আর অন্য কিছুই না। অপেক্ষাকৃত নতুন গুহাগুলিতেই মাছ ধরার নানা রকম হাতিয়ার পাওয়া গেছে। যেমন, জাল বা দড়ি প্যাঁচানোর খাঁজ-কাটা পাথর, অত্যন্ত যত্নসহকারে গড়া দাঁতের-খিলানের আকারের হাড়ের তৈরি টোপ গাঁথার হুক ইত্যাদি। সংক্ষেপে বললে, তুলনামূলক নতুন সময়ের মানুষেরই একমাত্র মাছ ধরার পদ্ধতি জানা ছিল।

ক্লাসিয়েসবাসীরা পাখি শিকারও খুব একটা করতো না, একমাত্র উড়তে অক্ষম, বোকা-সোকা পেঙ্গুইন ছাড়া। সমুদ্র তটে পেঙ্গুইন নিশ্চয় খুব সহজেই ধরা যেত। সিগাল, করমোরেন্ট বা অন্যান্য জাতের পাখির অভাব আশেপাশে না থাকলেও, ক্লাসিয়েস গুহায় এদের হাড়ের অস্তিত্ব নিতান্তই বিরল। আরো অনেক পরে বিপুল পরিমাণে এদের দেখা মেলে হাড়ে তীর বা তীরের ডগায় ব্যবহৃত তীক্ষ্ম পাথুরে ফলাবিদ্ধ অবস্থায়।

মোদ্দা কথা হল, এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক আর প্রাণীজগত সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত এটাই প্রমাণ করে যে, ৫০ হাজার বছর আগে বেঁচে থাকা ক্লাসিয়েস গুহাবাসীরা তাদের উত্তরসুরিদের তুলনায় খুব একটা কুশলী শিকারী ছিল না। তাদের ছিল না বিপজ্জনক পশু শিকারের হাতিয়ার, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি। জানা ছিল না জল রাখার পাত্র তৈরি পাখি শিকারের কৌশল। দক্ষ এবং সম্পূর্ণ আধুনিক পদ্ধতিতে শিকারে সক্ষম শিকারীদের আবির্ভাব ঘটে নিঃসন্দেহে সে সময়ের পরে। আর এই শিকারীদের দেখা মেলে ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’বাসীদের মতো উটপাখির ডিমের খোসা দিয়ে রিংয়ের মালা তৈরি করতে জানা কারিগরদের মধ্যেই।

bordercave3
উপরে বামে বর্ডার কেইভে প্রাপ্ত উটপাখির ডিমের খোসার রিং, আর বাদবাকি চিত্র বর্তমানে কালাহারি’র !কুন সান নারীরা কীভাবে তা বানায়, তার (বিস্তারিত এই অনুবাদের প্রথম কিস্তিতে); প্রাপ্তিসূত্র – http://popular-archaeology.com/issue/fall-09012014/article/the-neanthropic-revolution1

(চলবে..)


 


 

F1.medium
রিচার্ড ক্লেইন; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.pnas.org/content/101/16/5705.figures-only

রিচার্ড জি. ক্লেইন – প্যালিওঅ্যানথ্রপোলজিস্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। লেখক।

ব্লেইক এডগার – বিজ্ঞান লেখক।


 


 

10978531_10155195923150065_8789721575989286426_n

[ প্রত্যাশা প্রাচুর্য – বুয়েটে পত্তেন, অহন উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে। বই পত্তে ভালবাসেন। ভবিষ্যতে মাছ চাষ করার  (গোপন) ইচ্ছা রাখেন। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]