ভালোবেসে দেখা
১
আমার বাবা৷
তাঁর বয়স প্রায় ছিয়াশি৷ এখন আর কথা তেমন বলেন না৷ চুপচাপ সবার কথা শোনেন৷ একটা সময় ছিল, তিনি আত্মবিশ্বাসে ঋজু একজন মানুষ ছিলেন৷ যখন তিনি কথা বলতেন তখন অন্যদের চুপ করে শুনতে হত৷
আব্বাকে আমার মেঝোভাই জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বা কিছু বলেন না কেন উত্তরে! তিনি বলেছেন, বাবা, বয়স হয়েছে, সব কথা মেপে বলতে পারিনা, কার কখন মনে লাগে, তাই কথা বলিনা৷ কি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত!
আমার বাবা এখন আর কারো কাজে লাগেন না৷
সারা জীবন তিনি ছিলেন খুবই আত্মসম্মান সচেতন একজন মানুষ৷ অবসর নিয়ে নিজের টাকায় একটি বাড়ি তৈরী করেছিলেন৷ সেই বাড়িকে তিনি নিজের মত গুছিয়েছিলেন৷ একটা পুকুর, অনেক গাছ, একফালি উঠান৷ তিনি সেখানেই বাস করতেন৷ শারীরিক কারনে তাঁকে এখন আর একা রাখা যায়না৷ আমি যখন মৌলভীবাজার থেকে চলে আসি, তখনি আমি বুঝেছিলাম শেষ দিনগুলো আমার বাবার মন ভার করে কাটাতে হবে৷
এখন তিনি ঢাকায় আমার বড়বোনের কাছে থাকেন৷ সারাদিন তাঁর অপেক্ষায় কেটে যায়৷ তাঁর ছেলে, নাতি নাতনিরা যদি আসে৷ আমরা প্রতিদিন তাঁর কাছে যেতে পারিনা৷ অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি৷ তারপর হঠাৎ তাঁর ফোন আসে, আজকে আসবি না? অথবা আমার ছেলেরা আমাকে বলে, দাদার কাছে যাবা না? তখন আমি লজ্জিত হই৷ বাবার কাছে যাই৷ তাঁর কাছে যেয়ে বসে থাকি৷ কখনো তাঁর জন্য বই কিনি৷ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’৷ একটা সময় ছিল, শহরে গেলেই তিনি আমার জন্য বই নিয়ে আসতেন৷ কি অপেক্ষা করে যে থাকতাম৷ হায়, সময়ের হাতে আছে ক্ষুরধার ছুরি৷ ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ কেটে ফেলে সব৷
ছবির মেয়েটি আমার মেঝোভাইয়ের বড় মেয়ে, নিয়ন্তা৷ মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে৷ তারা ইংল্যান্ড প্রবাসী৷ এই বয়সের ইংল্যান্ডে বড় হওয়া একটি মেয়ে, তার নিজের জগত আমাদের মতো হওয়ার কথা নয়৷ কিছু দিন আগে তারা এখানে এসেছিল ছুটিতে৷ মেয়েটিকে আমি দেখতাম বাইরে গেলেই আব্বার গালে একটা আদর দিয়ে যেতো, ফিরেই আবার তাঁকে আদর করে আসতো৷ এবং ফ্রেস হয়ে একটা বই আর এক বোতল পানি নিয়ে আব্বার ব্লাংকেটের নীচে ঢুকে পড়তো৷
আব্বার তাকে কিছু দেয়ার নেই৷ তিনি তার জন্য কোনভাবেই গুরুত্বপূর্ন নন৷ কি নিখাদ তার মমতাটুকু!
যে কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী বৃদ্ধ মানুষকে ভালবাসে আমি তাদের খুব পছন্দ করি৷ তারা মানুষ হিসেবে অসাধারণ৷ তাদের হৃদয় অসামান্য৷
২
মাকে মনে পড়ে…. আমার মায়ের প্রিয় ফুল.. নীলকণ্ঠ
৩
‘ব্লু লাইট’ ৷
শ্রাবণ শেষ হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল৷ কিন্তু এই শহুরে হাওয়ায় এখনো তার ছাপ পড়েনি৷ মাঝে মাঝেই বৃষ্টি এসে রাস্তায় জল কাদা জমিয়ে রেখে যাচ্ছে৷ আজ আগষ্টের শেষ দিন, কাল থেকে প্রিয় সেপ্টেম্বর৷ দীর্ঘ জীবনে আমার সাথে অনেকবার এই মাসটির দেখা হয়েছে৷ আমি তাকে ভালবেসেছি৷ মফস্বলের পৃথিবী এই সময়ে পুরোপুরি পাল্টে যায়৷ গরমের হাঁসফাঁস শেষ হয়৷ দুপুরগুলো ছোট হয়ে যায়, আর দীর্ঘ ছায়া নিয়ে আসে দীর্ঘতর বিকেল৷ সন্ধ্যার হাওয়ায় পাওয়া যায় অজানা কোন গাছের গায়ের মিষ্টি গন্ধ৷ সেই গন্ধ মনে করিয়ে দিয়ে যায়, পৃথিবীতে আমি বেঁচে আছি বহুদিন হয়ে গেল৷ শরতের আকাশের কথাতো আপনাদের সবারই জানা ৷ দুপুর বিকেলের নীল আকাশ আমরা সবাই দেখেছি৷ কিন্তু কখনো কি চোখ মেলে দেখা হয়েছে শরতের রাত আর রাতের যাদুকরী আকাশ? কৃষ্ণপক্ষের রাতের অযুত লক্ষ নিযুত কোটি তারার মেলা৷ আর শুক্লপক্ষের আকাশ? তখনতো চাঁদ আসে আমাদের বাড়ি বেড়াতে৷ মনে পড়ে ছোটবেলায় যখন রূপকথারা সত্যি ছিল তখন সেইসব রাতে আমরা চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা দেখতে পেতাম৷ চাঁদেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলে বেড়াতো৷ শোনা কথা নয়, এসব আমাদের একেবারে নিজের চোখে দেখা৷ (৩১ আগস্ট, ২০১৫)
৪
যখন পথে পথে আলো আর বৃষ্টির ঝরে পড়া..
৫
সেই না রে দেশেতে বন্ধু ভ্রমরে ভ্রমরে, প্রাণেরো কথা হয় নিগূঢ় গুমরে….
৬
“সারঙ্গ, যদি ঝর্না ফোটাই তুমি আসবে কি তুমি আসবে কি
সন্তর্পণ পল্লব দোলে এত অজস্র বন্ধু হাওয়া
গাছের শিরায় ফেটেছে নূপুর অমন নূপুর জলে ভাসবে কি।
পাহাড়খণ্ড পাহাড়খণ্ড ওর নৃত্যের দোষ নিয়ো না হে।”
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৭
যতনে থেকো, যতনে রেখো…
৮
যতনে থেকো, যতনে রেখো…
টুটা ফাটা ছাতায় আমি সেলফ পোর্ট্রেট দেখি, নিজেরে পাই।
৯
দোলন…
১০
কাবাডি
১১
মহান হাকালুকি’র আকাশ। আমি সিলেটের পথে ছিলাম, তাড়া ছিল, সাথে ক্যামেরা ছিল না, শুধু মোবাইল ফোনখানা। কিন্তু এই দৃশ্য না তুলে তো উপায় ছিল না..
১২
আর কিছু মনে নেই
শুধু সেই অবাক সময়
আর এই পথটুকু….
বিজনে ঘেরা এই পথটুকু….
…..একটা বিষয় এখনো আমাকে আনন্দ দেয়, এর(ফটোগ্রাফির) কঠিন টেকনিক্যাল নলেজ নয়, এর সহজ আনন্দটুকু প্রাণ ভরে উপভোগ করি৷ গভীর জ্ঞান আমার জন্য নয়৷ আমি সব ব্যাপারেই প্রায় মূর্খ৷ তবে আমি জ্ঞানী মানুষকে প্রকৃতই শ্রদ্ধা করি৷ তাদের লেখা বই টই পারলে অল্পসল্প পড়ি৷ পৃথিবীতে জ্ঞানীদের দরকার ভীষণ, অনেক কারণে৷ তবে আমার মত মানুষও দরকার৷ যারা তেমন কিছু জানে টানে না, সেটা নিয়ে একটু ম্রিয়মাণ থাকার কারণে নিজের একটা পৃথিবী বানায়, সেখানেই থাকে৷ হঠাৎ কখনো আকাশের দিকে তাকায় হয়তো, দুপুরের মেঘে ভারী আকাশ দেখে, দেখে আলো হারানো বিকেলের মনমরা আকাশ কখনো, কখনো পথের দিকেও তাকায়, সেই পথ কোথায় কোথায় যায়৷
কতকিছুইনা আমার ছবিতে ধরতে ইচ্ছে করে, বনের সবুজ, নদীর চলা, রাতপাখির ডাক, বাউলের গান, হাসিমাখা চোখ, কান্নার ঠোঁট, আরো কত কি! আমি পারিনা৷ অনেকেই পারে৷ আমি তাদের তোলা ছবি গভীর আনন্দ নিয়ে দেখি ৷
আজ আমি সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই, যারা আমাকে জানিয়েছে, ছবিতে কত অসম্ভবকে ধরা যায়৷ জয় হোক মানুষের বিষ্ময়কর জ্ঞানের৷ – শাহজাদ হোসেন মাসুম, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

[শাহজাদ হোসেন মাসুম – চিকিৎসক, ফটোগ্রাফার। বাড়ি মৌলভীবাজার। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ]