(রিচার্ড ক্লেইন ও ব্লেইক এডগার সাব’এর “The Dawn of Human Culture” বইয়ের প্রথম অধ্যায় Dawn at Twilight Cave – এর অনুবাদ, তৃতীয় /শেষ কিস্তি। অনুবাদে প্রত্যাশা প্রাচুর্য – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)

The Dawn of Human Culture (Chapter 1, Part 3): “And the rest, as they say, is history!”
কেনিয়ার লেক নাইভাসা আর দক্ষিণ আফ্রিকার পাদদেশে অবস্থিত ক্লাসিয়েস নদীর মোহনা। ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’ আর ‘ক্লাসিয়েস রিভার মাউথ সাইট’(*১)। এই দু’য়ের মধ্যে স্থানিক দূরত্ব ৪ হাজার কিলোমিটার আর কালিক দূরত্ব প্রায় ৭০ হাজার বছর! পৃথিবীর বুকে ‘আধুনিক’ মানুষের আবির্ভাব কীভাবে, কখন, কোথায় হল এটা বুঝতে এই দু’জায়গার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই গুহাগুলি থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক টুকরোগুলি মোটামুটি জুড়ে দিয়ে যে জটিল (এবং অসম্পূর্ণ?!) চিত্র তৈরি করা যায় তার মর্ম বোঝাও খুব একটা সহজ কাজ না। কিন্তু চেষ্টা যে করতেই হয়, বোঝার তাগিদটা যে বড্ড জোরালো! ‘ক্লাসিয়েস রিভার মাউথ সাইট’সহ সমসাময়িক অন্যান্য আফ্রিকান সাইট আর আফ্রিকা থেকে বের হওয়ার ঠিক মুখেই ইসরায়েলের সাইটগুলিতে যেসব মানব ফসিল পাওয়া গেছে, তার প্রায় সবগুলোই প্রমাণ করে যে, আমাদের সাথে ‘এনাটমিক্যালি’ সদৃশ মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর পূর্বে। কিন্তু ‘আধুনিক’ দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, তাদের রেখে যাওয়া জিনিসপত্র আর পশুপাখির দেহাবশেষ দেখে বোঝা যায়, আচরণগত দিক দিয়ে এরা তখনও ততটা আধুনিকত্ব অর্জন করেনি। আচরণগত বিবর্তনে মানুষের সময় লেগেছিল আরও প্রায় ৫০ হাজার বছর!
আজ থেকে ৫০ হাজার বছরেরও আগের সময়টাতে মানুষের শরীরিক আর আচরণগত বিবর্তন বেশ ধীরে-সুস্থেই এগিয়ে যাচ্ছিল। একে অপরের সঙ্গে অনেকটা সঙ্গতি রেখে, তাল মিলিয়ে। ৫০ হাজার বছরের গণ্ডি পার হতে হতে শারীরিক কাঠামোগত বিবর্তন যেন প্রায় থেমে যায় বললেও চলে। উল্টোদিকে আচরণগত বিবর্তন সে তুলনায় এগিয়ে গেছে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে। সে সময়টাতেই মানুষ সর্বপ্রথম সাংস্কৃতিক বিবর্তনের জন্য সবরকমভাবেই প্রস্তুত হয়েছে। সাথে সঙ্গী হয়েছে অসীম উদ্ভাবনী ক্ষমতা। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এবার মানুষ আর তার শারীরিক কাঠামোর সাহায্য নিচ্ছে না, বরং শরণাপন্ন হচ্ছে সংস্কৃতির। সেই সাংস্কৃতিক বিবর্তন এক সময় শারীরিক বিবর্তনকে পেছনে ফেলে তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল, এবং বলা বাহুল্য সে গতি ছিল অত্যন্ত দ্রুত। যার ফলে গত ৫০ হাজার বছরে আমাদের শরীর যদিওবা পরিবর্তিত হয়েছে যৎসামান্য, সে তুলনায় আমাদের সংস্কৃতির বেগ আশ্চর্যরকম ত্বরান্বিত হয়েছে।
এই বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ৫০ হাজার বছর আগেকার মানুষের জৈবিক ও আচরণগত বিবর্তনের প্রমাণ যা কিছু এ যাবত পাওয়া গেছে সেগুলিকে যথাসম্ভব একটা ছকে ফেলা। সেই সাথে আরো থাকবে পরবর্তীকালে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটেছিল তার পটভূমি খোঁজার চেষ্টা। এই করতে যেয়ে, সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটার সামনে আমাদের মুখোমুখি হতেই হবে, সেটি হচ্ছে- এই বিপ্লবের সূচনার কারণটা কী? দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই প্রশ্নের একমাত্র বা অমোঘ কোন উত্তর নেই। তবে বরাবরের মতো এবারও উত্তরগুলি খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা থাকবে। এর জন্য আমাদের অতীতের দিকে তাকানো ছাড়া আর গতি নেই। আমাদের সেই আফ্রিকান অতীত। সেই সুদূর অতীত থেকে উঠে আসা পথের দিকে আমাদের তাকাতে হবে, যে পথ দিয়ে এপ-সদৃশ(*২) পূর্বপুরুষরা আমাদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসেছেন। আসার পথে একটু একটু করে বদলে গেছে তাদের শরীর, তাদের আচার-আচরণ। অল্প অল্প করে বদলাতে বদলাতে পরিণত হয়েছে এই মুহুর্তে এই লেখাটি পাঠরত, মগ্ন, চির-উৎসুক পাঠকে। মানুষের বিবর্তন যে বেশ বিচিত্র পথের পথিক ছিল সে বিষয়ে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই। সে পথ আঁকা-বাঁকা ছিল তো বটেই, এমনকি কখনও কখনও সে পথে ‘ডেডএন্ড’-এর দেখাও মিলেছে। তবে পথের শুরুর দিকের কাহিনী কিন্তু আজও অনেক অস্পষ্ট। যেমন, ঠিক কখন যে এপ-সদৃশ প্রাণীরা স্বাভাবিকভাবে দু’পায়ে ভর করে চলতে শুরু করছে সেটা আজও জানা যায়নি। তারপরও দু’পায়ে হাঁটার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের বিবর্তনকে মোটামুটি তিনটি বা বড় জোর চারটি আকস্মিক কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটা ধারাবাহিক ক্রম হিসেবে দেখা যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মাঝের দীর্ঘ সময়গুলিতে বিবর্তনের পরিমাণ যৎকিঞ্চিতই বলা চলে।
ডারউইনের পর থেকে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই বিবর্তনকে ধীরগতির ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া বলেই মনে করতেন। এ যেন জীবনের ইতিহাসের একের পর এক পরিচ্ছদের ক্রম উন্মোচন। কিন্তু ১৯৭২ সালে তৎকালীন আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’র অধীনে কর্মরত জীববিজ্ঞানী নাইলস এলড্রিজ আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিফেন জে গল্ড প্রথম এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত ফসিলের যে ধারাবাহিক রেকর্ড আছে, তার মাঝে মাঝে বেশ লম্বা সময়ের কিছু শূন্য স্থান রয়ে গেছে। এই দুই বিজ্ঞানীর মতে, শূন্য স্থানগুলি আদতে বিবর্তনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রদান করে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, এই ফাঁকগুলি অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ ফসিল রেকর্ডের দিকে নয়, বরং বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রকৃতির দিকেই আঙ্গুল নির্দেশ করে। এলড্রিজ আর গল্ড তাঁদের এই হাইপোথিসিসের নাম দিয়েছিলেন ‘punctuated equilibrium’। এই হাইপোথিসিসের মূল বক্তব্য হচ্ছে, বিবর্তনের প্রধান নিয়ামকগুলির আবির্ভাব ঘটে আকস্মিক আর অনিয়মিতভাবে। যেমন, আকস্মিক জলবায়ু বা পরিবেশ বা ভৌগলিক পরিবর্তনের ফলে নতুন প্রজাতির বিকাশ শুরু হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ুর পরিবর্তন যে শুধু নতুন নতুন ইকোলজিকাল সম্ভাবনার জন্মই দেয় তা না, পুরোনো প্রজাতিকে সরিয়ে দিয়ে নতুনদের বিকাশের জন্য পথও তৈরি করে দেয়। বর্তমান সময় থেকে ফসিল রেকর্ডের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, হঠাৎ হঠাৎ নতুন প্রজাতির সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভূতাত্ত্বিক সময়ের স্কেল যেহেতু অ-নে-ক লম্বা, তাই সে যুগগুলিকে এক একটি মুহূর্তের মতই মনে হয়। বেশ লম্বা লম্বা বাক্যের মাঝে মাঝে হঠাৎ দাঁড়ি টানার মত কিছুটা। এই বিরামের মুহুর্তগুলি বিরল হলেও নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


এলড্রিজ আর গল্ড অবশ্য এ প্রসঙ্গে রোলার কোস্টারের উপমা টেনেছেন। রোলার কোস্টারের বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে ওঠানো হয়। সে তুলনায় নিচে নামার অংশটুকু বা বাঁকগুলি থাকে বেশ অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু সেগুলি আবার হয় বেশ আকস্মিক আর দ্রুতগতিসম্পন্ন। বিবর্তনও যেন অনেকটা সেরকমই। ধীরগতির পরিবর্তনগুলি বেশ লম্বা সময় ধরে ঘটে। কিন্তু আকস্মিক ছেদগুলিই যেন সবচেয়ে ঘটনাবহুল আর আকর্ষণীয়।
কোন প্রজাতির মধ্যে নির্দিষ্ট কোন জিনগত পরিবর্তনের ফল (মিউটেশন) প্রকট হওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়; সে পরিবর্তন ইতিবাচক হোক, কি নেতিবাচক হোক! যেমন, হয় প্রজাতির ‘পপুলেশন’টি ছোট হতে হবে অথবা তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। এই পপুলেশন মানে ঠিক জনসংখ্যা না, এটা পরিসংখ্যানের ‘পপুলেশন’। অন্যথায় ‘সম্ভাব্যতা’র সূত্র মেনে সেই জিনগত পরিবর্তনের ফলটি প্রকট হওয়ার বদলে হারিয়ে যাওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কোন ঘটনা হবে না। যে তিন-চারটি মুখ্য পরিবর্তনের কথা ওপরে বলা হয়েছে, এর প্রতিটির ক্ষেত্রেই মানব প্রজাতি আকারে ছিল বেশ ছোট আর বিচরণও করত ভৌগলিকভাবে সীমিত পরিসরের মধ্যেই। প্রত্যেকটি পরিবর্তনই সংঘটিত হয়েছে আফ্রিকায়, এবং এদের প্রত্যেকটিই ‘কাকতালীয়ভাবেই’ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দৈহিক ও আচরণগত পরিবর্তনের মেল ঘটিয়েছে। (এ ধরণের বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা হয়, আমরা এই ‘কাকতালীয়’ শব্দটার গুরুত্বকে কিছুটা অবহেলা করি বলেই আমার ধারণা! এ বিষয়ে বিস্তারিত অন্য কোথাও হবেখন!) এর মধ্যে প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে, যখন ছোট ছোট পাতলা পাথরের যন্ত্রপাতির দেখা মিলতে শুরু করে। এগুলিই মানুষের সংস্কৃতির প্রথম চিহ্ন, যে সংস্কৃতি এরপরে মিলিয়ন বছরের মাইল ফলক পেরোবে। এই পাথরের যন্ত্রপাতির আবির্ভাবের সাথে সাথেই সম্ভবত আরেকটি ঘটনাও ঘটেছিল। কিছু এপ-সদৃশ প্রাণীর মস্তিষ্ক অন্যান্যদের তুলনায় আকারে বেশ বড় হতে শুরু করে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১.৭ মিলিয়ন বছর আগে। এ সময় নাগাদ মানুষের দৈহিক অঙ্গসংস্থানের অনুপাত এপ থেকে অনেকটাই বদলে গিয়ে প্রায়-আধুনিক মানুষের কাছাকাছি এসে গেছে। আর ততদিনে এরা হাতে তুলে নিয়েছে পাথরের তৈরি আরো ‘একটু’ কেতাদুরস্ত রকমের যন্ত্র। এই হাতিয়ারকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এক রকম ‘হাত-কুঠার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই মানুষেরাই সম্ভবত আমাদের আদি-নিবাস আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়েছিল। আর তৃতীয় এবং এ পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্বলভাবে রেকর্ডকৃত ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৬০০ হাজার বছর আগে। এর সাথে যোগ হয়েছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি আর হাত-কুঠারসহ অন্যান্য নানা রকম পাথরের হাতিয়ারের উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ সাধন। চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটির কাল হল আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগের সময়টা। এ সময় থেকেই মানুষ পূর্ণ সামর্থ্য অর্জন করে সংস্কৃতি আবিষ্কার, ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্ধন করার। এ সময়ের গোড়া থেকেই মানুষ এক বিরল, মামুলি আর মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রজাতি থেকে প্রবল ভূতাত্ত্বিক শক্তিতে রুপান্তরিত হতে শুরু করে।

প্রত্নতত্ত্ব এই সর্বশেষ পরিবর্তনটির সপক্ষে অনেক প্রমাণ আমাদের সামনে রাখলেও, আমাদের জানতে দেয়নি ঠিক কী কারণে এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। এটাই হচ্ছে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই প্রশ্নের একটা ‘সম্ভাব্য’ উত্তর হতে পারে ‘জেনেটিক মিউটেশন’, যার ফলে মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে। পূর্ব আফ্রিকায় বসবাসরত কোন একটা ছোট পপুলেশনে হয়তো এই মিউটেশন ঘটেছিল। এর ফলে যেসব ইতিবাচক লক্ষণ দেখা দিয়েছিলো, তার জোরেই হয়তো সেই পপুলেশন আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করেছিলো আরো বৃহত্তর ভৌগলিক এলাকা জুড়ে। আকারে অপেক্ষাকৃত বড় আর ‘উন্নত’ মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে এর অধিকারীরা অন্যান্যদের তুলনায় নিঃসন্দেহে পরিবেশ থেকে অধিক পরিমাণে শক্তি আর সম্পদ আহরণ করতে পারত। শুধু শক্তি আর সম্পদ আহরণই শেষ কথা না, সে শক্তি বাকিদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। এর ফলেই হয়তো সম্ভব হয়েছিল দল বেঁধে নতুন আর রূঢ় পরিবেশের সাথেও প্রয়োজনমত খাপ খাইয়ে নেওয়া। তবে সবচেয়ে জরুরি স্নায়বিক পরিবর্তনের কথাটিই এখনো বলা হয়নি। ভাষা! শুধু ভাবের আদান-প্রদান না, ভাষার সাহায্যেই মানুষ সর্বপ্রথম মনে মনেই জটিল থেকে জটিলতর প্রাকৃতিক বা সামাজিক অবস্থা বা ঘটনা অনুধাবন, বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে শিখেছে।
এবার আরো একটি ‘জটিল’ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। ৫০ হাজার বছর আগের এই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে স্নায়বিক পরিবর্তনকে দায়ী করার একটা জটিলতা আছে। এই ‘হাইপোথিসিস’-এর একটা দুর্বলতা হচ্ছে, মানুষের ফসিলের সাহায্যে এই হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঠিক-ভুল প্রমাণ করা সম্ভবপর না! (কার্ল পপারের সেই বিখ্যাত ‘আনফলসিফায়েবল’-এর দোষে ‘কিছুটা’ দুষ্ট!) ৫০ হাজার বছর আগেই মানুষের মস্তিষ্ক ‘আকারের’ দিক দিয়ে আধুনিকত্বের সীমা পেরিয়ে এসেছে। মাথার খুলির ফসিল দেখে এর নিচের মাল-মশলার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা করার উপায় নেই। ৫০ হাজার বছরের ঠিক আগে-পরে অল্প সময়ের মধ্যে যদি মাথার খুলির আকারে কোন তারতম্য দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তাহলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু হাড় যে স্নায়ু পরিবর্তনের কোন সাক্ষ্য বহন করে না! আর আমাদের হাতে যা আছে, সে তো ঠিক হাড়ও না, ফসিল! তবে নিরাশ হওয়ারও কিছু নেই। এই হাইপোথিসিসের একটা অত্যন্ত জোরালো দিকও আছে। সেটি হচ্ছে, এ পর্যন্ত পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটিই সবচেয়ে সরল এবং যুক্তিযুক্ত হাইপোথিসিস। এই ব্যাখ্যাকে হেলায় বাতিল করে দেওয়া যায় না। আর আমাদের হাতে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি যতই অসম্পূর্ণ আর ত্রুটিপূর্ণই হোক না কেন, এগুলিই আমাদের সম্বল। আমাদের পূর্ব-পুরুষরা বিবর্তনের যে পথ ধরে এসেছেন, সে পথের দিশা করতে এই আমাদের একমাত্র ভাঙাচোরা কম্পাস!
মানুষের আধুনিক আচার-আচরণের উৎস সম্বন্ধে অন্যান্য যে হাইপোথিসিসগুলি ‘মৌলিক সামাজিক কাঠামোগত বা নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের’ উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে, সেগুলি কমবেশি একই বৃত্তে ঘুর-পাক খাচ্ছে। সামাজিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তন ‘কারণ’ নয়, এগুলি ‘ফল’। তাছাড়া সেই সামাজিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলি লক্ষ বছর আগে বা পরে না হয়ে কেন ঐ নির্দিষ্ট সময়েই হল, সে সম্বন্ধেও কোন ইঙ্গিত দেয় না। অন্য দিকে, জিনগত মিউটেশন এই ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। প্রজাতির মধ্যে সর্বক্ষণ মিউটেশন ঘটতেই থাকে। এর ফল হতে পারে মারাত্মক, এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে হতে পারে প্রাণঘাতীও। তবে বেশিরভাগ মিউটেশনই নিরপেক্ষ-প্রকৃতির হয়, ইতি-নেতি কোনরকম প্রভাবই ফেলতে সক্ষম হয় না সমগ্র প্রজাতির ওপর। তবে, কিছু মিউটেশন যদি এর ধারকদের নুন্যতম সুবিধারও যোগান দিতে পারে, তাহলে বিবর্তনের পরীক্ষায় তাদের উৎরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বেশ খানিকটা। যেমন, খাবার খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি বা খাবার সংরক্ষণ করার সামর্থ্য তৈরি হওয়া, যৌন মিলনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করার জন্য সঙ্গী পাওয়ার নিশ্চয়তা লাভ কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের যৌন মিলনের সমর্থ হওয়ার বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারার মত সুবিধাগুলি খুব সহজেই প্রজাতির কোন নির্দিষ্ট পপুলেশনের মধ্যে ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মিউটেশনের কারণে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের মাত্রা যত তীব্র হয়, সেটি তত দ্রুত ছড়িয়ে পরে। আর একটি পূর্ণাঙ্গ মস্তিষ্ক পাওয়ার সুবিধা প্রশ্নাতীত তো বটেই।
ফসিল, প্রত্নতাত্ত্বিক, জিনগত এবং ভাষাগত সাক্ষ্য-প্রমাণ সব কিছু মিলে আফ্রিকার দিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যেখানে ৫০ হাজার বছর আগে আমাদের আচরণগত বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, তার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, একমাত্র পূর্ব আফ্রিকাতেই মানব প্রজাতির তৎকালীন সবচেয়ে বড় অংশটি বাস করত। আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে, মাত্রাতিরিক্ত অনুর্বরতার ফলে ৬০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ এই ৩০ হাজার বছরের মধ্যে মানব প্রজাতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে পরে। এজন্যই হতে পারে একমাত্র পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত ‘ইনকাপুনে ইয়া মুতো’র মত গুহাগুলি ছাড়া অন্যত্র মানুষের সংস্কৃতির উষালগ্নের আর কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, প্রথম ভোরের সূর্য ইউরোপে নয় বরং আফ্রিকার আকাশেই লালচে আভা ছড়িয়েছিল। যদিও আধুনিক ‘প্রতীকী’ আচরণের নানা রকম উদাহরণ প্রথম দিকে ইউরোপ জুড়েই পাওয়া গিয়েছিল। যেমন, গ্রোটে শ্যুভে’র দেয়ালে পাওয়া কাঠকয়লায় আঁকা গন্ডার আর ভাল্লুকের চিত্র কিংবা লাস্কো‘র রং-বেরঙের ষাঁড় আর ঘোড়ার চিত্র। কিন্তু এসবই মানুষ পূর্ণাঙ্গ অবয়ব আর সংস্কৃতিধারী হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর পরের কথা। সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশনগুলি যদি ইউরোপে ঘটত, তাহলে আধুনিকতার স্বাক্ষরগুলি সেখানেই মিলত, আফ্রিকায় নয়। আর হয়তো আজকের দিনে বিবর্তন নিয়ে পড়ুয়া নিয়ানডার্থাল শিক্ষার্থীরা, কোন এককালে আফ্রিকায় ঘোরাফেরা করত এমন অদ্ভুত প্রজাতির একদল মানুষদের কথা পড়ে আশ্চর্য হত, যে মানুষেরা হঠাৎ করেই পৃথিবীর বুক থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে!


পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সংস্কৃতি মানুষকে এক অনন্য সুবিধা প্রদান করেছিল। কারণ, সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন জিনেটিক মিউটেশনের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। একটা ভালো ‘আইডিয়া’ যে শুধু একই প্রজন্মের ভেতর দ্রুত ছড়িয়ে পরে তাই না, প্রজন্মান্তরেও এর সার্থক স্থানান্তর সম্ভব। এই সাংস্কৃতিক অভিযোজনই আমাদেরকে আপাত অকিঞ্চিৎকর এক আফ্রিকান স্তন্যপায়ী প্রজাতি থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রজাতিতে পরিণত করেছে। এখন আমরা বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সাথে শুধু খাপ খাওয়াতেই সক্ষম নই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিবেশের ওপর অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতেও সক্ষম। এই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের ওপর ভরসা করেই আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পরেছিল। উত্তরমুখী যাত্রা করে ইউরোপ আর পূর্বদিকে চীন ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছিল আরো অনেক দূরে। কারণ, ততদিনে মানুষ প্রকৃতি থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণের সম্পদ আহরণ, বংশবৃদ্ধি আর লালন করতেও শিখে গেছে। ফলে জনসংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি হতে শুরু করেছে। মানুষ দিন দিন নিত্য-নতুন পরিবেশে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি করতে শুরু করেছে জটিল সব সামাজিক সংগঠন। এসব সংগঠন, ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানের কতকগুলি যেমন আশীর্বাদ বয়ে এনেছে, কিছু আবার বয়ে এনেছে সমপরিমাণ অভিশাপও। আর? আর বাকিটা?
বাকিটাতো, লোকে যাকে বলে, সেই- ‘ইতিহাস’!
টীকা –
*১ – বিস্তারিত জানতে চাইলে কিস্তি এক, দুই দ্রষ্টব্য।
*২ – ‘এপ’ বলতে এখানে ঠিক বানর বোঝানো হচ্ছে না। সেটা করলে বেশ একটা টেকনিকাল ভুল থেকে যায়, যদিও মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ‘এপ’ বলতে এখানে গোরিলা, শিম্পাঞ্জি গোত্রীয় প্রাণীদের বোঝানো হচ্ছে। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য যে, শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জীনগত পার্থক্য আসলে মাত্র ২%। – অনুবাদক

[ অধ্যায় এক (Dawn at Twilight Cave) সমাপ্ত। দ্বিতীয় অধ্যায় আসছে ..]

রিচার্ড জি. ক্লেইন – প্যালিওঅ্যানথ্রপোলজিস্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। লেখক।
ব্লেইক এডগার – বিজ্ঞান লেখক।
[ প্রত্যাশা প্রাচুর্য – বুয়েটে পত্তেন, অহন উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে। বই পত্তে ভালবাসেন। ভবিষ্যতে মাছ চাষ করার (গোপন) ইচ্ছা রাখেন। (আগ্রহী কেউ চাইলে, তার অন্যান্য লেখা টেখা পত্তে পারেন) – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]