(রিচার্ড ক্লেইন ও ব্লেইক এডগার সাব’এর “The Dawn of Human Culture” বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় Bipedal Apes– এর অনুবাদ, প্রথম কিস্তি। অনুবাদে প্রত্যাশা প্রাচুর্য – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)

The Dawn of Human Culture (Chapter 2, Part 1): “শার্লকের বাপ এবং আমরা”
মানব জাতির বিবর্তনের দৃশ্যপট আজও পরিবর্তিত হচ্ছে। কবে, কীভাবে এর শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কি না তা আমরা এখনও ঠিকঠাক জানি না। এই কাহিনীর শুরুর দিকের দৃশ্যগুলি মোটামুটি একরকম গড়ে নেওয়া গেলেও, ফোকাসটা যেন এখনো ঠিক পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি। শুধু স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা হয়েছে। আফ্রিকার প্রায় পেট ফুঁড়ে যেদিক দিয়ে বিষুব রেখা চলে গেছে, তারই আশেপাশে কোথাও সেই স্থান। আর সময়টা – আজ থেকে প্রায় ৫-৭ মিলিয়ন (৫০ থেকে ৭০ লক্ষ) বছর আগের কথা। সে সময়টাতেই মানুষের বিবর্তনের ধারা শিম্পাঞ্জির বিবর্তনের ধারা থেকে আলাদা হয়ে নিজের পথে চলতে শুরু করে। এই শিম্পাঞ্জিরাই জীবিত আত্মীয়দের (জেনেটিকালি) মাঝে আমাদের সবচেয়ে কাছের (শিম্পাঞ্জিরে আত্মীয় কইতে গায়ে লাগলে, দূরে যাও হে তুমি ‘স্বর্গচ্যুত আদমের ছাও’)। মানব বিবর্তন ধারার একদম শুরুর দিকের প্রতিনিধিরা কিন্তু দৈহিক গঠন এবং আচার-আচরণের দিক দিয়ে অনেকটাই ‘এপ’দের মত ছিল। অমনোযোগী পর্যবেক্ষকের পক্ষে আমাদের পূর্বসুরিদের শিম্পাঞ্জি বলে ঠাহর করা মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার হত না। তবে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য অবশ্যই ছিল। আমাদের এপ-সদৃশ পূর্বপুরুষরা যখন মাটিতে বিচরণ করত, তখন দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটাই তাদের বেশি পছন্দ ছিল। টেকনিকালি, দু’পায়ে হাঁটাতে সক্ষম এই এপদের আমরা এখন ‘অস্ট্রালোপিথেকাইনস’ (Australopithecines) হিসেবে চিহ্নিত করি। তবে বাহ্যিক চেহারা আর আচরণের কথা মনে রেখে এদের ‘দু’পেয়ে বা দ্বিপদী এপ’ বললেও ভুল হবে না তেমন। মানব সংস্কৃতির ঊষালগ্ন সম্পর্কে জানতে এই ‘অস্ট্রালোপিথেকাইনস’দের ভূমিকা কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই দু’পেয়ে এপরাই আমাদের অসহায়, অকিঞ্চিৎকর শুরুটার সাক্ষী। ওরা আমাদের বলে দেয় কত অল্প সময়ের মধ্যে আমরা বিবর্তনের কতটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি! ব্যক্তি মানুষের আয়ুর সাথে তুলনা করলে মানব জাতির বিবর্তনের ৫-৭ মিলিয়ন বছরের ইতিহাস অত্যন্ত লম্বা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুলনাটা যদি হয় বানর আর এপদের ২৫ মিলিয়ন বছরের ইতিহাসের সাথে, কিংবা পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের ৩.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসের সাথে, তাহলে সময়টা অল্পই বলা চলে।

দু’পেয়ে এপদের অস্তিত্ব আবিষ্কার শুধু নৃতত্ত্ববিদ্যাই নয়, সমগ্র বিজ্ঞানের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সালটা ১৯২৪। স্থানটা দক্ষিণ আফ্রিকা। আবিষ্কারক হলেন জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারস্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of the Withwatersrand) এনাটমির এক তরুণ অধ্যাপক। তাঁর নাম রেইমন্ড ডার্ট। তিনি তখন সবেমাত্র ব্রিটেন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছেছিলেন মেডিকেলের ছাত্রদের এনাটমি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে। এর আগে থেকেই ডার্টের মধ্যে বিবর্তন নিয়ে এক গভীর, অদম্য আগ্রহ কাজ করত। ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি যাদুঘরের জন্য ফসিল সংগ্রহ করে এনে দেওয়ার জন্য তিনি ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন খুব। তো ১৯২৪ সালে এক ছাত্র একটা বেবুনের মাথার খুলি এনে তাঁকে দেখালো। খুলিটির উৎস ছিলো জোহানেসবার্গ থেকে ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত টাউং (Taung) নামের এক চুনা পাথরের খনির মধ্যে পাওয়া একটা গুহা। এই গুহা আর এর আশেপাশের জায়গা থেকে পরবর্তীতে ডার্ট আরো প্রায় দুই বাক্সভর্তি ফসিলসমৃদ্ধ শিলা সংগ্রহ করেছিলেন। শিলাগুলি ছিল মূলত বালি আর হাড়ের মিশেল, হাড়ের অংশটা ‘ব্রেকিয়া’ (breccia) নামক এক বিশেষ ধরণের পাথরের সাথে ক্ষারীয় আঠা দিয়ে আটকানো। বাক্সগুলি খুলতেই ডার্ট দেখলেন এক গাদা ‘ব্রেকিয়া’খণ্ডের গায়ে আটকানো বেশ কিছু বেবুনের ফসিল। কিন্তু ডার্টের খুশির সাথে বিস্ময়ের মেল ঘটার তখনও একটুখানি বাকি ছিল। ষোলকলা পূর্ণ হল যখন তিনি বেবুনের ফসিলের ভিড়ে ভিন্ন রকমের ফসিলওয়ালা একটা ব্রেকিয়ার খণ্ড দেখতে পেলেন। এটা ছিল বেবুনদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক এক ‘প্রাইমেট’-এর মাথার খুলির ফসিল। খুলির ছাঁচে চুনের তলানি জমে জমে ভরে গিয়ে ভেতরে মগজের আদল নিয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটা খণ্ডে সেই আদলের সাথে হুবহু মিলে যায় এমন একটা বসে যাওয়া অংশের দেখা মিলেছে। একটু পরীক্ষা করতেই দেখা গেল সেই বসে যাওয়া অংশের ভেতরে খুলির পেছনের অংশের হাড়ের অস্তিত্ব বর্তমান(*১)!

হাতুড়ি, বাটালি আর তীক্ষ্ম সেলাই করার সুচ নিয়ে এরপর ডার্ট উদ্যত হলেন ব্রেকিয়ার কারাগার থেকে খুলিটিকে মুক্ত করতে। কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি সত্যিই এক অল্প বয়স্ক এপ-সদৃশ প্রাণীর মুখ আর খুলির সামনের দিকের বেশ অনেকটা অংশ উন্মুক্ত করলেন শক্ত পাথরের ভেতর থেকে (ব্যক্তিগতভাবে ঠিক এইখানে এসে আমার মনে এক রকম ‘AWE’ তৈরি হয়। এই একাগ্রতা তুলনাহীন। সদ্য পরিচিত একজন কবির ধার করা লাইনে, “বাইসন গাবে মানবের জয়গান”)। মৃত্যুর আগে প্রাণীটির মাড়ির দাঁতগুলি সবেমাত্র গজাতে শুরু করেছিলো। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসাব অনুযায়ী প্রাণীটি তার চতুর্থ জন্মদিন পর্যন্তও বেঁচে থাকতে পারে নি। তাই ধরে নেওয়া যায় জীবদ্দশায় সে শিশুই ছিল। তবে ডার্ট আরও হিসাব করেছিলেন যে, ‘যদি’ এই প্রাণীটি মৃত্যুর আগে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েও থাকে, তাহলেও এর মগজের আকার ছিল শিম্পাঞ্জির তুলনায় অল্প একটু বড় আর আধুনিক মানুষের মগজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তিনি আরো লক্ষ্য করেছিলেন যে, এর ‘মিল্ক ক্যানাইন’গুলি শিম্পাঞ্জিদের তুলনায় বেশ ছোটই ছিল (‘মিল্ক ক্যানাইন’ হচ্ছে দুধ দাঁত, সামনের অপেক্ষাকৃত চ্যাপ্টা ‘ইনসিসরস’ আর মাড়ির শুরতেই মোটা ‘প্রিমোলার’ দাঁতের মাঝে অপেক্ষাকৃত কোনাকৃতির দাঁতটিই হচ্ছে ক্যানাইন) । তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক পর্যবেক্ষণ ছিলো, খুলির পেছন দিকের ‘ফোরামেন ম্যাগনাম’-এর অবস্থান, যা ঠিক আধুনিক মানুষদের সাথে মিলে গিয়েছিলো! এই ‘ফোরামেন ম্যাগনাম’ দিয়েই মগজ আর মেরুদণ্ডের মধ্যে স্নায়ুর যোগাযোগটা স্থাপিত হয় (অন্যভাবে বললে এই ছিদ্র পথেই মেরুরজ্জু মেরুদণ্ডে প্রবেশ করে)। মানুষের ক্ষেত্রে এপদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দেহের সামনের দিকে আর নিম্নমুখী অবস্থানে থাকে এই ছিদ্রটি। কারণ, খুবই স্বাভাবিক। একমাত্র মানুষের পক্ষেই স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মেরুদণ্ডের ওপর সোজাসুজিভাবে মাথাটা রেখে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। ১৯২৫-এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ডার্ট বিখ্যাত ‘Nature’ জার্নালে এই শিশুর খুলিটির একটি বর্ণনা প্রকাশ করেন। সাথে “জীবিত এন্থ্রপয়েড (এপ) আর মানুষের মধ্যবর্তী” একটা নতুন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে একে মানব বিবর্তনের ইতিহাসে একটা বেশ পাকাপোক্ত জায়গা করে দেন। তিনি নতুন এই প্রজাতিটির নামকরণ করেছিলেন ‘অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানুস’ (Australopithecus africanus) বা ‘দক্ষিণ আফ্রিকান এপ’। নামে ‘এপ’-এর উল্লেখ থাকলেও ডার্ট কিন্তু এই প্রজাতিকে মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। অনেক পরে অন্যরা ‘আফ্রিকানুস’ আর তাদের কাছাকাছি প্রজাতিকে এক সাথে নির্দেশ করার জন্য ‘অস্ট্রালোপিথেকাইনস’ নামটির চল শুরু করেন। মূল লক্ষ্য ছিলো আপেক্ষাকৃত আধুনিক মানব-প্রজাতিগুলি থেকে এদের আলাদা করে চিহ্নিত করা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই সীমারেখাটা শেষ পর্যন্ত খুব স্পষ্ট করে বেঁধে দেওয়া সম্ভব হয় নি। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নামটিকে আরো একটু কাঁট-ছাঁট করে ‘অস্ট্রালোপিথস’ (Australopiths) হিসেবে ব্যবহার করেন।

সমালোচকরা অনেকেই ভাবলেন ডার্ট মশায় বুঝি খুব তাড়াহুড়া করে ফেলছেন। অনেকে এও মত দিলেন যে, শিশুটি আরো কিছু বছর বেঁচে থাকলে পূর্ণাঙ্গ এপে পরিণত হতেও পারত। অনেক সমালোচক তো তাঁকে বেশ এক হাত দেখে নিলেন। কারণ, ডার্ট মাথার খুলি থেকেই এই দ্বিপদী আচরণের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, পা কিংবা পায়ের পাতার হাড় পর্যবেক্ষণ করে নয়। পায়ের হাড়ের গঠন থেকেই সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যাওয়ার কথা একটা প্রাণী কীভাবে হাঁটে বা দৌড়ায়। সমালোচকদের এই আপত্তির পেছনে আরো একটা বিশেষ কারণ ছিলো। ‘পিল্টডাউন হোক্স’! ১৯১১-১২’র দিকে ইংল্যান্ডের পিল্টডাউন নামের এক জায়গায় অন্যান্য প্রাণীদের সত্যিকার প্রাচীন ফসিলের সাথে একটা মানুষের মাথার খুলি আর নিচের চোয়ালের হাড় পাওয়া গিয়েছিলো। ১৯৫৩-তে এই জোচ্চুরি প্রকাশ পেলেও, ১৯২৫-এর অবস্থাটা সহজেই বোধগম্য। ‘পিল্টডাউন ম্যান’ যেখানে হাতে-নাতে প্রমাণ দিচ্ছে যে, বড় আকারের মস্তিষ্ক শুরু থেকেই মানুষের সঙ্গী ছিল, সেখানে ডার্টের ‘অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানুস’ আমাদের বলছে আগে মানুষ দুই পায়ে হাঁটতে শিখেছে। মাথার আকার বড় হয়েছে আরও অনেক পরে(*২)। এছাড়াও ১৮৯১-৯২ এর দিকে জাভাতে যে সব ফসিল পাওয়া গিয়েছিলো সেগুলি আফ্রিকাকে নয়, বরং এশিয়াকেই মানব জাতির আঁতুড় ঘর হিসেবে ঘোষণা করে ফেলেছিল ততদিনে। জাভার ফসিলগুলিতে কোন রকম ‘ব্রিটিশগিরি’ ছিলো না, সেগুলি আসলেই প্রাচীন ছিল। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, জাভার ফসিলগুলি আফ্রিকানুসদের চেয়ে ভূতাত্ত্বিক বিচারে অনেক তরুণ। এদের বর্তমানে ‘হোমো ইরেক্টাস’ নামক অপেক্ষাকৃত পরিণত প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবশেষ সমস্যাটা ছিল, ডার্ট ‘টাউং খুলি’টা আসলে কত পুরানো সেটা ঠিক ঠিক হিসেব করে উঠতে পারেন নি। এর প্রাচীনত্বের সীমা আজও কিছুটা অস্পষ্ট থেকে গেছে। তবে অন্যান্য যে সব জায়গায় ‘অস্ট্রালোপিথ’ ফসিল পাওয়া গেছে তাদের বয়স আমরা জানতে পেরেছি, প্রায় ২ মিলিয়ন বা ২০ লক্ষ বছর!

‘টাউং খুলি’ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেছিলো প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। অবশেষে ডার্টকে উদ্ধার করতে হাত বাড়িয়ে দেন তার সহকর্মী, সঙ্গী রবার্ট ব্রুম। ব্রুম জন্মসূত্রে স্কটিশ, পেশায় চিকিৎসক এবং সরীসৃপ ফসিল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সে সময়টাতে তিনি বাস করছিলেন জোহানেসবার্গ থেকে ৯০ কিলোমিটার উত্তরে প্রেটোরিয়া (Pretoria) নামের এক স্থানে। ব্রুম ছিলেন প্রথম দিকের সেই কয়েকজন বিজ্ঞানীদের একজন যারা ডার্টের ‘টাউং খুলি’টিকে নিজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছিলেন। পরীক্ষার পর ব্রুম ডার্টের সিদ্ধান্তকে বেশ দ্রুত মেনেও নিয়েছিলেন। তবে সেখানেই থেকে না থেকে ব্রুম আরো ফসিল খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেন। তাঁর সেই উদ্যোগ সাফল্যের দেখা পায় ১৯৩৬-এ এসে, যখন তিনি জোহানেসবার্গের ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ক্রুগার্সডর্প (Krugersdorp) শহরের কাছাকাছি স্টের্কফন্টেইন (Sterkfontein) নামের এক ফার্মের গুহায় পূর্ণাঙ্গ আফ্রিকানুসের খুলির ভগ্নাংশ খুঁজে পান ব্রেকিয়া আবৃত অবস্থায়। একই গুহা থেকে আরও উদ্ধার করেন হাঁটুর দিকের উরুর অস্থিখণ্ড (ফিমার)। কাছাকাছি আরেকটি গুহা ক্রোমড্রাই (Kromdraai) থেকে পান দ্বিতীয় আরেকটি পরিণত খুলি আর গোঁড়ালির হাড় (ট্যালাস বা এস্ট্রাগ্যালাস)। ১৯৩৯ সাল নাগাদ ব্রুম প্রমাণ করে ছাড়েন যে, প্রাপ্ত বয়স্ক ‘অস্ট্রালোপিথস’রা ডার্টের টাউং শিশুটির চেয়ে কোন অংশেই একটু বেশি এপের মত না। প্রাপ্ত বয়স্ক ‘অস্ট্রালোপিথ’দের পায়ের হাড়ে স্পষ্ট প্রমাণ রয়ে গেছে তাদের দ্বিপদী বৈশিষ্ট্যের। এর মধ্যে দিয়েই শেষ পর্যন্ত মানব বিবর্তনের ইতিহাসে ‘অস্ট্রালোপিথ’রা একটা স্থায়ী স্থান দখল করে নিল!

ব্রুমের এই অবদান নিঃসন্দেহে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ‘অস্ট্রালোপিথ’দের আরো অনেক ফসিল আবিষ্কারের পথের দিশা দেখিয়েছিল। সেই পথে এগিয়ে সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বত্রিশটির বেশি সম্পূর্ণ বা আংশিক মাথার খুলি, প্রায় একশ’র কাছাকাছি মাড়ি বা মাড়ির ভগ্নাংশ, শ’খানেক দাঁত আর ত্রিশের অধিক পা, মেরুদণ্ড বা শ্রোণীর হাড় সংগ্রহ করা গেছে। যে তিনটি জায়গার কথা বলা হয়েছে (টাউং, স্টের্কফন্টেইন এবং ক্রোমড্রাই) সেগুলি ছাড়াও ক্রুগার্সডর্পের কাছে পুঞ্জীভূত সোয়ার্টক্রান্স (Swartkrans), গ্লাডিসভেইল (Gladysvale), ড্রিমোলেন (Drimolen) ইত্যাদি আর ৩০০ কিলোমিটার উত্তরে মাকাপান্সগাট (Makapansgat) নামক চুনাপাথরের খনির গুহা থেকে এই সব ফসিলগুলি জোগাড় করা হয়েছে। সামনে হয়তো আরো এমন অনেক গুহার সন্ধান পাওয়া যাবে আর সাথে পাল্লা দিয়ে ফসিলের সংখ্যাও বেড়েই চলবে।
টাউং, স্টের্কফন্টেইন, গ্লাডিসভেইল আর মাকাপান্সগাট থেকে যে ফসিলগুলি পাওয়া গেছে সেগুলিকে ‘অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানুস’ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ক্রোমড্রাই, সোয়ার্টক্রান্স আর ড্রিমোলেন প্রাপ্ত ফসিলগুলিকে দ্বিতীয় আরেকটি প্রজাতির বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রজাতির নাম হচ্ছে ‘অস্ট্রালোপিথেকাস রোবাস্টাস’ (Australopithecus robustus) বা ‘প্যারান্থ্রোপাস রোবাস্টাস’ (Paranthropus robustus)। ‘প্যারান্থ্রোপাস’ নামটা ব্রুম সুপারিশ করেছিলেন ক্রোমড্রাই-এর ফসিলগুলির জন্য। শব্দটির অর্থ- ‘মানুষের সহচর বা সমান্তরাল মানুষ’ (“alongside man”?) আর যারা এই নামটি ব্যবহার করেন তাদের চোখে আফ্রিকানুস আর রোবাস্টাসের পার্থক্য যেন একটু বেশিই ঠেকে।
দক্ষিণ আফ্রিকান গুহাগুলিতে ফসিলের বয়স নির্ধারণ করার মত নির্ভরযোগ্য কোন কিছুর হদিস পাওয়া যায় নি (যেমন, আগ্নেয়গিরির লাভা বা ছাই, এই অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আছে)। ফলে এদের ভূতাত্ত্বিক প্রাচীনত্ব মাপতে হয় একই সময়ে পূর্ব আফ্রিকায় পাওয়া অন্যান্য প্রাণীদের ফসিলের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে। পদ্ধতিটির ইংরেজী নাম- ‘faunal dating’(*৩)। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বের করা গেছে যে, ‘আফ্রিকানুস’রা পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নিয়েছিলো ৩ থেকে ২.৫ মিলিয়ন বছর আগ পর্যন্ত। এরপরে হয়তো আরও অর্ধ-মিলিয়ন বছর (৫ লক্ষ) এরা বেঁচে-বর্তে ছিল। কিন্তু এই দাবির সপক্ষে কোন প্রকার রেকর্ড নেই দক্ষিণ আফ্রিকার গুহাগুলিতে। অন্যদিকে ‘রোবাস্টাস’রা সম্ভবত ২ থেকে শুরু করে ১ মিলিয়ন বছরের অল্প আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখেছে!
টীকা –
*১ – বিষয়টা আরো একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার এখানে। মানে দাঁড়ায় যে, প্রথমে খুলির ভেতরে চুন জমে জমে মগজের জায়গাটা পূরণ করে আস্তে আস্তে শক্ত হয়েছে। কাস্টিং করে আমরা আজকাল যে রকম ধাতুর জিনিসপত্র বানাই, প্রক্রিয়াটা ঠিক সেরকমই। এক্ষেত্রে খুলিটা মোল্ডের কাজ করেছে। তারপর কোন এক কারণে যে ব্রেকিয়াখণ্ডের ভেতরে এই ফসিলটা তৈরি হয়েছিল সেটা ভেঙে গিয়ে দুই টুকরা হয়ে গেল। প্রথম খণ্ডের ভাগে এল খুলির সামনের অংশের হাড়সহ চুনার তৈরি মগজটা। আর অন্য খণ্ডে আটকে রয়ে গেল খুলির পেছনের দিকের হাড়। সৌভাগ্যক্রমে ডার্ট মশায় এই দুইটি খণ্ডই হাতে পেয়েছিলেন।

*২ – এখানে কিছু বাড়তি কথা না বললেই না। নৃতত্ত্বের ইতিহাসে এই ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে একটা কালো অধ্যায়! তবে এই ঘটনার উল্লেখ মোটেও এড়িয়ে যাওয়া উচিত না। ঘটনা যেটা ঘটেছিলো, তা হচ্ছে কোন এক ব্রিটিশ চুরা একটা মানুষের মাথার খুলি, ওরাংওটাং-এর মাড়ির একটা হাড় আর শিম্পাঞ্জির কিছু দাঁত নিয়ে ক্রোমিক এসিড আর আয়রনের দ্রবণে চুবিয়ে বেশ একটা পুরান পুরান রঙ আর চেহারা দিয়েছিলো। ক্রিয়েটিভিটির কী লেভেল! দাঁতগুলির উপরে ফাইল দিয়ে ঘষাঘষির দাগও পাওয়া গেছ। কী দারুণ পরিশ্রম!! তবে অনেকগুলি কারণে এই পিল্টডাউন ম্যান অনেকটা সময় জুড়েই খাঁটি বলেই বিবেচিত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইউরোপজুড়েই বেশ একটা স্বস্তি ছিল যে ব্রিটেনে, মোদ্দা কথা ইউরেশিয়াতেই ‘আধুনিক’ মানুষের ফসিল পাওয়া গেছে। কিন্তু কত দিন আর শাক দিয়া মাছ ঢাকা যায়! বাকি পৃথিবীর সাথে সঙ্গতি রেখে চলা পিল্টডাউন ম্যানের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিলো না। ১৯৫৩-এর পরে তাকে লজ্জায় মুখ ঢেকে বসে পরতেই হলো। যদিও এর মধ্যে ১৯৩৮-এর দিকে ‘পিল্টডাউন’ স্মৃতিস্তম্ভ-টম্ভ তৈরি করে একদম একাকার অবস্থা! একটা বাড়তি তথ্য দেই। এইটা আমার নিচু মনের প্রমাণ। কোন ব্রিটিশ এই জোচ্চুরিটার হোতা সেটা নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও, কিছু নাম যে উঠে আসবে এইটাই স্বাভাবিক। দুঃখজনক হইলেও সত্যি এদের মধ্যে একজনের নাম আমরা কম বেশি সবাই জনি। তিনি আর কেউ নন স্বয়ং শার্লক হোমসের বাপ, মিস্টার ডয়েল! চিন্তার অবকাশ আছে এখানে অনেক কিছুর। যাই হোক, আমের চেয়ে আঁটি বড় করার কোন মানে নাই।
*৩ – বিজ্ঞানের কিছু বৈশিষ্ট্য আমাকে বারবার মন্ত্রমুগ্ধ করে। কোন কিছু ব্যাখ্যা করতে যেয়ে জলের মতো সহজ যুক্তির ব্যবহার যেমন, বিপরীতে আবার জটিল বিষয়বস্তুকে একটা ক্যানভাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধরে রাখার চেষ্টাও তেমন। Faunal dating-এর পেছনের যুক্তিটাও দারুণ! স্কুলের পাঠ্যক্রমে শিলাস্তরের কথা কম বেশি আমরা সবাই একটু পড়েছি। ভূতাত্ত্বিক সময়কালের সাথে শিলাস্তরের প্রকারভেদের একটা সম্পর্ক আছে। মানে যে শিলাস্তরের বয়স যত বেশি (বা এর গঠনকাল যত আগে), তার অবস্থান ভূ-পৃষ্ঠের সাপেক্ষে তত গভীরে। ফলে কোন একটা সময়ে পৃথিবীতে বিচরণকারী প্রাণীকূলের ফসিলের বয়সের গাছ-পাথর হচ্ছে এই শিলাস্তর, ভার্টিকাল ক্যালেন্ডারের মত আরকি। পৃথিবী জুড়ে একই শিলাস্তরে যেসব প্রাণীর ফসিল পাওয়া যাবে, তারা একই ভূতাত্ত্বিক যুগে পৃথিবীর বাসিন্দা বলে ধরে নেওয়া যাবে। উইকিতে একটা খুব ভালো উদাহরণ দেওয়া আছে। যেমন, যে শিলাস্তরে ‘মেগালোসোরাস’-এর ফসিল পাওয়া গেছে, সেই একই স্তরে নিয়ান্ডার্থালদের ফসিল পাওয়া অসম্ভব। কারণ, এই দুই প্রজাতির বিচরণকালের মধ্যে মিলিয়ন বছরের ফারাক। আর মেগালোসোরাসের চেয়ে নিয়ান্ডার্থালদের ফসিল যে অপেক্ষাকৃত ওপরের দিকে পাওয়া যাবে সেটা বলা বাহুল্য। এবার ধরা যাক, পূর্ব আফ্রিকার কোন এক গুহায় কোন বিশেষ একটি শিলাস্তরে এমন কিছু প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেলো, যাদের বিচরণকাল সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই জ্ঞাত। দক্ষিণ আফ্রিকার গুহাগুলিতে সেই একই স্তরে যদি আফ্রিকানুসদের ফসিল পাওয়া যায়, তাহলে তাদের জীবৎকাল সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায় বইকি! ভেরি সিম্পল প্রিন্সিপাল! কি একটা ফেইসবুক গ্রুপ আছে না, আই ফা** লাভ সায়েন্স! – অনুবাদক (মূল টেক্সটের অধিকাংশ বন্ধনীবদ্ধ আইটালিক শব্দসমূহ অনুবাদকের)
(চলবে..)

রিচার্ড জি. ক্লেইন – প্যালিওঅ্যানথ্রপোলজিস্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। লেখক।
ব্লেইক এডগার – বিজ্ঞান লেখক।
[ প্রত্যাশা প্রাচুর্য – বুয়েটে পত্তেন, অহন উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে। বই পত্তে ভালবাসেন। ভবিষ্যতে মাছ চাষ করার (গোপন) ইচ্ছা রাখেন। (আগ্রহী কেউ চাইলে, তার অন্যান্য লেখা টেখা পত্তে পারেন) – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]
[…] ‘নয়নম্বর বাস’ থেকে ২য় অধ্যায়ের ১ম অংশ – এখানে […]
LikeLike
[…] দ্বিতীয় অধ্যায়, ১ম কিস্তির লিঙ্ক […]
LikeLike