সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬
পরিবারসহ নোয়াখালীতে আসলাম। নানার বাড়িতে এসে উঠলাম। গ্রামের নাম বৈকুন্ঠুপুর। আমার নানা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন। আমার নানাকে ১৯৭৪ সালে জোরপূর্বক অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। যাই হোক নানার ঘরের সামনে দুই পাশে ছোট একটা বসার মতো জায়গা ছিলো। জায়গাটা খুবই ভালো লাগতো আমার। একেকবার একেক সাইডে গিয়ে একাই বসতাম। পিছনে সব বিশাল বিশাল খেজুর গাছ ছিলো। যেহেতু যুগটা ব্লগ ফেসবুকের কাজেই এই তথ্যটি জানিয়ে রাখা জরুরি বলে মনে করছি যে বড় বড় সব খেজুর গাছ আমার নানার কিংবা নানাবাড়ির সদস্যদের ছুপা সৌদি আরব প্রীতির ফসল ছিলো কেউ এমন কিছু ভেবে বসলে সেই দায়ভার আমার নয়। তো ছিয়ানব্বই সালের সেই শরতে পরিবার সমেত নোয়াখালী গিয়ে আন্দোলিত হলাম। চারিদিকে শেখ মুজিবের তুমুল বন্দনা। তখন আওয়ামী লীগের শাসনামল। একুশ বছর পরে তারা ক্ষমতায় এসেছে মাত্রই চার কি পাঁচ মাস হলো। নানাবাড়ির সদস্য থেকে শুরু করে যারা নানাবাড়িতে কাজ করতো প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের তুমুল বন্দনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো। চারপাশে সারাদিন মুজিবকে নিয়ে গাওয়া দেশাত্মবোধক গানগুলো অবিরাম চলতো। “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ……” গানটি শুনলেই এক ধরণের প্রবল কাঁপন অনুভব করতাম। রাজনীতি সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও ছিলোনা। তবুও গানটি শুনলেই শেখ মুজিবকে প্রশ্নাতীত হিরো বলে মনে হতো এবং আট বছর বয়সের কাঁচা সেই আবেগ তীব্রতার সকল স্তর অতিক্রম করে যেতো। সেই সময়েরও পনেরো বছর পরে এবং তার পরের থেকে সেই সময়কার ভাবনাগুলোর সাথে নিজেকে অনেকাংশেই আর মেলানো সম্ভবপর হয়ে উঠেনা। তবু নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতার কারনে মনে হয়েছিলো যে বাংলাদেশে একটি শিশুর দেশপ্রেমের জন্মস্থল জাতীয়তাবাদ হতে বাধ্য। নোয়াখালীতে ছিয়ানব্বইয়ের অক্টোবরের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার আঠারো বছর পরে মোহাম্মদপুরে মিশু ভাইয়ের বাসায় একদিন তার মেডিকেলের নানাবিধ ঘটনা শুনতে শুনতে অতঃপর জানতে পারলাম একসময় মিশু ভাইও আট বছরের আমার মতো করেই ভাবতো। তার এবং আমার সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা বেশ কাছাকাছিই ছিলো।
বাংলাদেশ এসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হলো। দুপুরবেলাতে রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনছিলাম। চিৎকার করতে করতে উত্তেজনায় টিউবওয়েলে চাপ দিয়ে পানি তুলতে লাগলাম আর সেই পানি নানাবাড়িতে একটা ঘর ছিলো কাছারিঘর তার আশেপাশে ছিটাতে লাগলাম। সেই জায়গাটায় তখন কেউ ছিলোনা। যতোদূর মনে পড়ে সাইফুল ফাইনালে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলো। বাতাস বইছে, কাছারিঘরের উপরে গাছের পাতা দোলে (কি গাছ তা মনে নেই), কাছারিঘরকে সেই দুপুরে রহস্যময় লাগে আর আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ে মনের আনন্দে টিউবওয়েলে চাপ দিয়ে পানি তুলে তুলে সেখানে ছিটাই। তুচ্ছতম কাজেও নিয়মিত আনন্দ খুঁজে পাওয়ার ছেলেমানুষী বড়বেলাতেও থাকাটা বড্ড প্রয়োজন।

নভেম্বর, ১৯৯৬
শারজাতে ত্রিদেশীয় ট্যুর্নামেন্ট হয়েছিলো। নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের। এক দুপুরে কোন একটা জোকসের বই পড়তে পড়তে টিভিতে নিউজিল্যান্ড – শ্রীলংকার খেলা দেখছিলাম। নিউজিল্যান্ড ১৬৯ রান করেছিলো। শ্রীলঙ্কাও ১৬৯ করে অলআউট হয়ে যায় বলে ম্যাচ টাই হয়ে যায়। এখনো মনে আছে শ্রীলঙ্কার শেষ উইকেট পড়ে যাওয়ার সময়ে একটা জোকস পড়ছিলাম বইতে, সেটা হলো –
শিক্ষক – সম্রাট হুমায়ূন কোথায় পরাজিত হন?
ছাত্র – স্যার, ইতিহাস বইয়ের ১২৩ নম্বর পৃষ্ঠায়।
ডিসেম্বর, ১৯৯৬
দীপু নাম্বার টু ছবিটি দেখলাম টিভিতে। আলোড়িত হয়েছিলাম এটুকু বলেও স্বস্তি পাচ্ছিনা। ছবিটির খুব ছোট ছোট বিষয় আমাকে খুব টেনেছিলো। বুলবুল আহমেদের শক্ত সমর্থ নির্মোহ বাবার চরিত্র, ওহ!!! এরকম বাবার চরিত্র বাংলাদেশের নাটকে-ছবিতে বলতে গেলে এখনো দেখাই যায়না। অন্তত আমি দেখিনি। সাঁকো পেরিয়ে দীপুর তারেকের বাড়িতে যাওয়া, তারেকের অপ্রকৃতিস্থ মায়ের পরিচয় জেনে দীপুর মুখাবয়ব, কিভাবে বুলবুল আহমেদ সাহেব ছবিতে দীপুকে শক্তসমর্থ হিসাবে গড়ে তুলেছেন, দীপুর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা ববিতার মুখে সেইসব সংলাপ, দীপুর বাবার এক নাকউঁচু বন্ধু তারেকের মতো ছেলের সাথে দীপুকে সে কেন মিশতে দিচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে বুলবুল আহমেদের স্পষ্ট জবাব এসব কি এতো সহজে ভোলা যায় নাকি ভোলা উচিত? সেই দৃশ্যে বুলবুল আহমেদের সংলাপগুলোর সারবস্তু নিখাদ সাম্যবাদী। আমি মনে করি মার্ক্সের সাথে ন্যূনতম পরিচয় না ঘটিয়েও কোন শিশুর হৃদয়ে তার দর্শনের সারবত্তা জারিত করে তোলা যায়। কাজটা খুব কঠিন কিছু নয়, কিন্তু যথেষ্টই মনোযোগের দাবী রাখে। আমার যতোটুকু মানবিকতা এখনো পর্যন্ত অবশিষ্ট আছে তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলো দীপু নাম্বার টু ছবিটি – এই নিয়ে আমার তেমন কোন সন্দেহ নেই। মানুষের মাঝে মানবিকতা থাকে সত্য, তাকে স্পষ্ট করে তোলার অনুঘটকেরও প্রয়োজন হয়, এ আরো বড় সত্য। আমার জন্য দীপু নাম্বার টু ছিলো সেই অনুঘটক।

মাসের শেষের দিকে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। ক্লাস টুতে পড়তাম তখন। আমি চতুর্থ হয়েছি। ক্লাসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো চারজন। এরপরে অনেকদিন যাবত বাসায় কোন মেহমান আসলে নিজের সেই ‘অনবদ্য’ কৃতিত্বের কথা তাদের হাসিমুখে জানাতাম। তারা শুনে হো হো করে হাসতো। নিজের সেই সেন্স অব হিউমার পরবর্তীতে তেমন একটা ধরে রাখতে পারিনি। রেজাল্ট দেওয়ার দিনে ক্লাস টিচার বাবাকে আমার সামনেই রিপোর্ট কার্ড দিতে দিতে বলছিলো আমার প্রতি যেন অনেক মনোযোগ দেওয়া হয়। আমি অত্যন্ত ক্যালাস টাইপের। ক্যালাস শব্দের মানে জানা ছিলোনা। তবে এটুকু ঠিকই বুঝেছিলাম যে সেটা মধুর কোন সম্ভাষণ নয়। বাবার শক্ত হয়ে যাওয়া সেই মুখের দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। স্মৃতিটা মনে পড়লে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, “বাবা, আমি কি এখনো ক্লাস টুয়ের মতোই ক্যালাস আছি?”
[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট ‘, ‘এপিটাফ’। ]