স্মৃতিচারণ ১৯৯৭ (এক) – আল-বিরুনী প্রমিথ

১৯৯৭, জানুয়ারি

নোয়াখালীতে আসলাম, শুধুমাত্র মাকে নিয়ে। বাবা কিংবা বোন কেউই যায় নাই। বাসে যাইতে যাইতে ভোরের কাগজ পত্রিকায় দেখলাম ব্রায়ান ম্যাকমিলান, ক্লুজনার সেঞ্চুরি করে একাকার অবস্থা। ভারতের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার তখন টেস্ট সিরিজ চলতেছিলো। ভারত সিরিজটায় লেজেগোবরে হেরে যায়। যাই হোক আমি বাসেই দক্ষিণ আফ্রিকার এই রমরমা অবস্থায় সম্ভবত অতি আনন্দেই বমি করে ভাসাইয়া দিলাম। দুঃখজনকভাবে সেই বমির একটা বড় অংশই পাশের সিটে বসা এক মহাসুন্দরীর পোশাকে গিয়ে পড়লো। সেই সুন্দরী আপুর সালওয়ার কামিজের রঙ ছিলো নেভি ব্লু। স্টাইল করে সানগ্লাস কপালের উপরে তোলা। হাতে সুনীলের কি একটা উপন্যাস ছিলো। উপন্যাসের নাম মনে নাই। আমার গোলগাল মোটাসোটা চেহারা দেখেই সম্ভবত কনামাত্র বিরক্ত না হয়ে আমার প্রতি উনি সহানুভূতি প্রদর্শনে উঠে পড়ে লাগলেন। মাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন যে আমি বাসে উঠলেই বমি করি কিনা, এরকম অভ্যাস অনেকেরই আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিসের দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্দান্ত খবর কিসের কি? তখন ফেসবুক ছিলোনা। এখন আছে। তাই ফেসবুকের একটা বহুল জনপ্রিয় ফটো দিয়েই নিজের সেই সময়কার অনুভূতি প্রকাশ করি, “খোদা আমার লাইগা দড়ি ফালাও। আমি দড়ি বাইয়া উপরে উডি যাই।”

120124
ব্রায়ান ম্যাকমিলান (ডানে), (বায়ে, গুচ, বাই দ্যা ওয়ে); প্রাপ্তিসূত্র – http://p.imgci.com/db/PICTURES/CMS/120100/120124.jpg

নোয়াখালীতে সময় কাটলো বেশ ভালো। নানাবাড়ির সামনের উঠানটায় ক্রিকেট খেলতাম মন ভরে। সঙ্গী ছিলো দিপু আর নিপু। আমার ছোট মামার দুই ছেলে। আমার থেকে বয়সে ছোট। রাতের বেলায় শীতের মধ্যে নানাবাড়িতে ছমছম করা এক ধরণের পরিবেশ ছিলো। অসম্ভব নিস্তব্ধ থাকতো চারপাশ। সামান্য একটা শব্দ হইলেই গা চমকে যাইতো। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলোনা। সামান্য শব্দেই আমার মনে হইতো নানাবাড়ির আশেপাশের বিভিন্ন ঝোপঝাড় থেকে এই বুঝি বাঘ-সিংহ চলে আসবে। এখনো সেই দৃশ্যের স্মৃতি পরিষ্কার মনে আছে। রাত দশটার মধ্যে সমগ্র গ্রাম ঘুমে কাদা হয়ে যাইতো।

নোয়াখালী থেকে ফেরার কিছুদিন পরেই ধানমন্ডি ১৯ নম্বরের বাসা ছেড়ে লালমাটিয়া ডি ব্লকে আসলাম। এপার্টমেন্টের নাম: বসতি ছায়ানীড়। তিন তলার বাসিন্দা হইলাম আমরা। প্রথমেই যেই তথ্যটা জানতে চাইছিলাম সেটা হইলো আশেপাশে খেলার মাঠ আছে কিনা। বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই খেলার মাঠ এই কথা শুনে আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু কিভাবে নাচতে হয় সেই সম্পর্কে কোন ধারণা নাই বলে রিস্ক নিলাম না। সম্ভবত আমি সেই সময়ে ‘হিরো’ হইলে বা হইতে পারলে কোন রিস্ক ছিলোনা!!! আরেকটা তথ্য জানলাম। সেটা হইলো জিনডিয়ান থেকে শুরু করে ধানমন্ডি এলাকায় থাকা বড় বড় সব চাইনীজ রেস্টুরেন্টের মালিক আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। মানে আমাদের প্রতিবেশী। সেই মহা এলেমদার লোকের নাম জসীম। তবে নায়ক জসিমের সাথে তার কোন প্রকারের মিল ছিলোনা। হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। যতোদূর তার চেহারার কথা মনে পড়ে বাপ্পা মজুমদারের সাথে মিল ছিলো। তবে জসিম আঙ্কেলের স্ত্রী ছিলেন বেজায় সুন্দরী, ‘এক কথায় চমৎকার’।

Film_star_Jashim.jpeg
চিত্রনায়ক জসিম(মাঝে); প্রাপ্তিসূত্র – https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0:Film_star_Jashim.jpeg

মার্চ, ১৯৯৭

ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হইলাম। স্কুলের নাম: জুনিয়র ল্যাবরেটরী হাই স্কুল। বহুবিধ কারনেই আমার স্কুলের সবচাইতে স্মরণীয় সব সময় কাটছে এই স্কুলে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি আমি সর্বমোট পাঁচটা স্কুলে পড়াশোনা করছি। যাই হোক স্কুলে ভর্তি হইলাম। প্রথমেই যার সাথে বন্ধুত্ব হইলো সে আমার ক্লাসমেট ছিলোনা। স্কুলের এক স্টাফ ছিলো। তার নাম আসাদ। প্রথম দিন থেকেই আমি তাকে আসাদ ভাই ডাকা শুরু করছিলাম। মজার বিষয় হইলো প্রায় উনিশ বছর পরে এসেও তার সাথে আমার প্রায়শই দেখা হয়ে যায়। দুই বছর আগে যখন আবার লালমাটিয়াতে আসি তখন থেকেই আবারো নিয়মিত তার সাথে দেখা হয়। এই লোকটা ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে যেভাবে আমাকে ‘বিরুনী’ নামে ডাকতো এখনো তার সেই ডাক অবিকৃত আছে। আমার কানে একইরকম হয়ে বাজে। যাই হোক স্কুলে যাওয়া আসা করার তিনদিনের মাথায় ইংরেজি সেকেন্ড পেপারের স্যারের কাছে স্কেলের বাড়ি খেয়ে আস্ত স্কেলই ভেঙ্গে গেলো। স্যার হতভম্ব। অন্য পোলাপানেরাও তব্ধা। কি রিএকশন হবেই কেউই বুঝতে পারতেছেনা। আমি চারপাশের পরিস্থিতি দেখে ভ্যাবলার মতো হাসতে থাকলাম। স্যার থেকে শুরু করে অন্য পোলাপানদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম যে দেখো আমার কিছুই হয়নাই। তোমরা কেউ টেনশন কইরোনা। আমার সেই ভ্যাবলার মতো হাসি চারপাশের পরিস্থিতিকে আরো বিহ্বল (শাহাদুজ্জামান সাহেবের অন্যতম প্রিয় শব্দ ব্যবহার করলাম, তার গল্পে এই শব্দ একাধিকবার আসে) করে ফেললো।

একদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে খবর শুনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১২০ রান চেজ করতে গিয়ে চতুর্থ ইনিংসে ভারত ৮১ রানে অলআউট। খুবই মজা পাইলাম খবরটা শুনে। আরো মজা পাইলাম যখন জানতে পারলাম যে ভারতের চতুর্থ ইনিংসে ধস নামাইলো ফ্রাঙ্কলিন রোজসেই টেস্ট ম্যাচটাই তার ডেব্যু টেস্ট ম্যাচ ছিলো। যাই হোক পত্রিকায় খবরটা পড়ে কি মনে করে নিজের ঘরের পাশে অতিথিদের ঘরে ঢুকে গেছিলাম। দেখি যে আমার সেঝো মামা- সেঝো মামী অতীব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন। (অতি আগ্রহীদের হতাশ করতে হচ্ছে কারন দেয়ার ওয়াজ নো ন্যুডিটি) তারা আমাকে অকস্মাৎ ঢুকতে দেখেও বিচলিত হলেন না। সম্ভবত তাদের ধারণা ছিলো যে আমার ‘চেতনায়’(আওয়ামী লীগার যারা লেখাটা পড়বেন তারা প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন, তখন বয়স ছিলো অল্প, সেই বয়সে চেতনা দাঁড়ায়না।) সেইসব ব্যাপার স্যাপারের কিছুই ঢুকেনা। আমিও তাদের ভুল ভাঙ্গানোর পিছনে কোন যুক্তি দেখলাম না। সেঝো মামীকে (তাকে আমি ডাকি পপি আন্টি নামে। আমার সেঝো মামা- সেঝো মামী পরস্পরের কাজিন, চাচাতো ভাই-বোন।) জিজ্ঞেস করলাম যে ৫০ এ ৩৪, ১০০তে কতো? পপি আন্টি সাবলীলভাবে জবাব দিলো ৬৮। আমি হৃষ্টচিত্তে সেই উত্তর শুনে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমাদের ক্লাস টেস্ট হইতো ৫০ নম্বরের। তো আমি ইংরেজী ফার্স্ট পেপারে ৫০ এ ৩৪ পাইছি এবং সেদিনই খাতা দিছে। নিজের ঘরে যাইতে যাইতে মনে হইলো নাম্বার তো ভালো পাইছি। ১০০ তে হিসাব করলে ৬৮, খারাপ কি?

01953-zoom
ফ্রাঙ্কলিন রোজ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.sporting-heroes.net/content/thumbnails/00021/01953-zoom.jpg

12484807_10156609092230556_1629571184923976794_o

[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট ‘, ‘এপিটাফ’। ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s