খাজুইরা
সাইকেলটার গিয়ারে সমস্যা। ব্রেকটাও শক্ত-শক্ত। নিয়ে গেলাম বাসার কাছের বড় রাস্তার উপরে সাইকেলের দোকানটায়। খেজুর দেশের এক লোক দোকানের মালিক। সাথে সাইকেল সারাইয়ের কাজও করে। দেখলে মনে হয় সাইকেল বিক্রির চাইতে সারাইয়ের কাজেই তার ইনকাম বেশি। দুনিয়ার খাজুইরা আলাপ শুরু করল। কোন দেশের আমি, এইখানে কি করি, কই থাকি, যত্তসব ফালতু প্রশ্ন। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া পছন্দ করি না দেখে, ব্যাটাকে দোকান নিয়ে, সাইকেল নিয়ে টুকিটাকি কথা জিজ্ঞেস করলাম। সারিসারি সাজান সাইকেলের মধ্যে ছোট সাইজের গুলিতে হাত রাখলেই ব্যাটা বলে: “তোমার জন্য ৩০% দাম কমায় রাখবো…খুব ভাল সাইকেল! ব্লা ব্লা ব্লা।”
আমি মনে মনে বলি, ‘ব্যাডা, খাজুইরা আলাপ বন্ধ কর’। মুখে বিনীত ভাবে বলি: “ভাইজান, এইবার না হয় আমার সাইকেলটা একটু দেখেন। আমি নতুন সাইকেল কিনতে পারব না। ৩০% কমেও না।”
লোকটা সাইকেলের নাড়িটিপে বলল, “দুই দিন সময় লাগবে। এক্ষনি হবে না।”
আমার তখন টানাটানি অবস্থা, একটুকরা মুরগির মাংস দিয়ে ঢিপি করে ভাত খাই। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কত দিতে হবে!”
ব্যাটা বলে: “কিচ্ছু না। নাথিং।”
ঘাবড়ায় গেলাম – কয় কি ব্যাডা! ফাইজলামি করতেসে নাকি! সাইকেল সারাইয়ের দাম যদি ৩০% কমে কেনা সাইকেলের থেকে বেশি হয়, তাইলে তো বিপদ! স্কুলে যাইতে হবে হাঁইটা-হাঁইটা তিন কিলোমিটার! – ভাবতে ভাবতে বলি, “না না প্লিজ ফাইজলামি না করে ঠিকঠাক দাম বলো। আসলে আমি ২০০ ক্রোনারের ($২৫) বেশি দিতে পারব না। ওইটাই আমার বাজেট। তাছাড়া এই ছোট্ট সাইকেলটা আমার খুব প্রিয়, বাসে করে চেক রিপাবলিক থেকে সাথে করে নিয়ে আসছিলাম!”
ব্যাটা বলে “না না আমি মোটেও ফাজলামি করতেসি না। তোমাদের দেশের রান্না খুব ঝাল হয় – মজা হয় আমি জানি, তুমি খালি আমাকে একদিন বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবা।”
প্রথমে বিশ্বাস করতে পারতেসিলাম না একদমই। তারপর ব্যাটাকে বললাম: “আচ্ছা! তবে তুমি খুবই আশাহত হবা। আমার নিজের রান্না নিজের গিলতে কষ্ট হয়। কিন্তু ঠিক আছে তুমি যেহেতু এত করে বলতেস।”
মনের মধ্যে খচখচানি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
খচখচানি থেকে মুক্তি পাইতে আমার এক ‘মুসকিল আসান’ বান্ধবীরে ফোন দিলাম। মুসকিল আসান বলে, “তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আর হইব না। ব্যাডা তোমারে ইঙ্গিত দিসে, বুঝো নাই!”
আমি বলি, “কী ইঙ্গিত দিসে! ইঙ্গিত দিবে কেন! সরাসরি কয় নাই কেন!”
“আরে বেকুব ব্যাডা তো বাসায় আইসা ঝাল খাইতে চাইসে! ব্যাডার সাথে শোয়ার ইচ্ছা না থাকলে, বলো যে বাড়িওয়ালি বুড়ির কঠিন নিষেধ। কাউরে ঘরে ঢোকান যাবে না।” – ‘মুসকিল আসান’ সবসময়ের মতন মনটারে শান্ত করল। শান্ত হয়ে আমি গেলাম বাজারে সদাইপাতি করতে।
বাজার করে এনে দুইদিন পর, মাথার তাল্লু গরম করা ঝাল দিয়ে ঝোল করে মুরগি রানলাম। মটর পোলাউ রানলাম। ফুলকপি ভাজলাম বেসন দিয়ে। জয়ার কাছ থেকে শেখা বেগুন চাটনি করলাম। একটা কোকের বোতলও কিনলাম। ব্যাটার কাছে গেলাম। ব্যাটার তো আমাকে দেখে টম-এন্ড-জেরী’র টমের মতোন গদগদ অবস্থা। বলল: “সাইকেলটা খুব ভাল করে সারায় দিসি। আবার কিছু হইলে আমি তো আসিই”।
“হ্যাঁ, সত্যিই অনেক ধন্যবাদ। কত টাকা দিব বলতো!”
“তোমাকে তো বলসিই তুমি আমার বন্ধু। তোমার থেকে টাকা নিবো না। খালি সঙ্গ দিলেই চলবে। হেহ হেহ হেহ!”
আমি মনে মনে বলি – ‘ব্যাডা বদের লাঠি বদ, আমি তোর কোন কালের বন্ধু লাগি!’
ব্যাটাকে বলি, “হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই, তোমার খুবই দয়ার শরীর। আর তুমি তো খেতে খুবই পছন্দ করো, তাই না! ওই যে পরশু দিন বলসিলা!”
গদগদ হয়ে ব্যাটা বলে, “হ্যাঁ। তাই তো তাই তো। কবে খাব! কবে তোমার বাসায় যাব?”
– “আজকেই! এখন”
চোখে-মুখে ঝিল্লিক দিতে দিতে ব্যাটা বলে, “এখনই! দাঁড়াও দোকান বন্ধ করি, তাইলে!”
“না না, দোকান বন্ধ করতে হবে না। আমি সব খাবার রেঁধে এই ব্যগে করে নিয়ে আসছি। নাও ধরো।”
“কিন্তু আমি তো তোমার সাথে.. মানে তোমার বাসায়…”
“আমার বাড়িওয়ালি অচেনা লোক বাসায় ঢুকতে দেয় না। আর আমি নিজেও রাস্তার (ফাউল) লোকদের বাসায় ঢুকাই না! স্মকলি মলতি (তোমার খাওয়া আনন্দময় হোক)। তবে খাবারে জম্মের ঝাল!” – বলতে বলতে সাইকেলে প্যাডেল মারি।
[ নন্দিতা ফরহাদ – উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে আছেন। আইলসা। ভাত পুড়াইয়া কটকটি বানিয়ে চামচ দিয়া খান। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]