মৌলিক মৃতদেহ অথবা বিষণ্ণ এপিটাফ – সাব্বির পারভেজ সোহান

১৮ এপ্রিল ২০১৫( এপিফ্যানির সিলুয়েট)

 

এই ঝড়ে ছেলেবেলার বনে

নিহত নিষ্কলঙ্ক পড়ে থাকবে সবুজ টিয়া পাখি।

আমাদের শহুরে জানালার একপাশ ভিজিয়ে

বিদায় নেবে বৃষ্টি;

আহা অনাবিল বৃষ্টি!

আমার চৌকো ঘরে ভাসানো যায়না নৌকো।

 

রবি শঙ্কর, বিনয় মজুমদার আর অসংস্কৃত কফি বিনের

প্রক্রিয়াজাত-বুক নিঙরে উঠে আসা ধোয়া

এঁকে চলে রেখাবিহীন মানচিত্র।

 

কতশত তরুণ কবির চিবুক ছুঁয়ে যায়
অক্ষরবৃত্তের বেদনা পুষে চলা শুভ্র সারস।
বিক্ষিপ্ত গদ্যছন্দেরা মুক্ত হয়
শ তিনেক ডালিমের লালিমা আর তারো অধিক
কলঙ্কধারণকারী কলমের আন্দোলনে।
এই ঝড়ে শীতল হাওয়ার আদিম স্পর্শে
শিহরিত হয় মহাপৃথিবীর সকল

উভকাম,বিপরীতকাম,সমকাম,নিষ্কাম।

গভীর ঘুমের স্বপ্ন ফেরত শিশু দেখে নেয়

আকাশে জড়ো হয়েছে জননীর আয়ত নয়নে জমা
বেদনার তুমুল মেঘ।
আজ আর শিশুটি তৃষ্ণার্ত ক্রন্দনে
ক্লান্ত করবেনা নিজেকে।

টের পাই,
দূরে কোথাও প্রকৃত প্রস্তাবে দলছুট সঞ্জীব নির্বাপিত গাইছে-
“…কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগেনা”

এই ঝড়ে বাইপোলার ডিসঅর্ডার জাগিয়ে দেবে
নিহত অযুত প্রাণে জমে থাকা বিগত বিকেলের ক্ষত।
সবুজ ফসলের দেহে তবু কৃষকের স্বেদকণা ব্যতীত কোন
বৃষ্টি জমা হবেনা; সকল আয়োজনের অন্তে
দ্বিতীয় বৃষ্টি সূচনা করবে নিহন্তা কাকের ডানা।

আমার ক্যামেরায় আটকা পড়লোনা সোনালি বজ্রপাত।
চেনা এক ল্যাম্পপোস্ট আশ্রয়ী অচেতন
ফ্লাশবাল্বের নিষ্প্রভ ঝলক মনে হল তাকে।

 

 

বুকপকেট

 

 

জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে;
এখন বসন্ত নয়,
তবু মৃদু হাওয়াটাকে বসন্তের মনে হয়।
অন্ধকারের বুকে গোলাপের মত ফুটে রয়েছে অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ।
আঁধার জমছে অন্ধকারের অন্তরে।

 

আমি আলো জ্বেলে দিই।
ফ্লোরোসেন্ট নয়, মোমবাতির।
মৃদু শিখার উত্তাপ নিই ঝাপসা ডান চোখে।
বাম চোখে আমার শেষদিন অবধি ডিপ ফোকাসের চাষবাস।
বন্ধ দরজার ওপারে হয়তো মা ঘুমুচ্ছে।
ঘুমাক।

 

কবি ভিন্ন এ শহরে আজ সবাই ঘুমাক।
কবিরা পাক নির্ঘুম রাতের যন্ত্রণা।
কলমে ধরা দিক অমিত্রাক্ষর অথবা স্বরবৃত্ত।
পয়ারের মন্ত্রণা।

 

বারান্দায় যাই,
দেয়ালে প্রেমিক টিকটিকি খুঁজি।
পাইনা।
নোয়া ফিল্মের মায়া নিয়ে তেরছা আলো বরং চুমু খেয়ে যায় গালে।
হলদে-লাল-নীলচে  আলোর উত্তাপটুকু টের পাওয়া যায়।
বৃষ্টি ভেজা কামুক আলো।
ভাবি,
মেক্সিকান স্ট্যান্ডঅফে দাড়াবো।
ডিরেকশনে সার্জিও লিওন নয়, স্বয়ং ঈশ্বর।
আর স্ট্যান্ডঅফে-  আমি ; জন্ম ; মৃত্যু ।

 

ল্যাপটপের পর্দায় স্থির ভেসে আছে অরেঞ্জ লাইট।

 

 

“Loneliness has followed me my whole life, everywhere.
In bars, in cars, sidewalks, stores, everywhere.
There’s no escape. I’m God’s lonely man.”

 

সারাদিন উদ্ধৃত করি একাকীত্বের কাকতাড়ুয়াদের।

 

একা নই, তবু একা।
ভীষণ হত, প্রবল হত, যদি
পাশাপাশি দুজনে দেখে নিতাম এবেলা এইট অ্যান্ড হাফ।
অথবা লা দলচে ভিটা।
কিন্তু, একলা যখন, পান করি চলো পাল্প ফিকশন।
অথবা ব্রেসোর নিবাত মধু।

 

টিলাগড় যাবার রাস্তাটাকে আস্ত একটা লং টেক মনে হয়।
না, তারকোভস্কির নয়; কিয়ারোস্তামির।
রেনোয়া, ওজু কিংবা চ্যাপলিন খুঁজে পাইনা।
গদার এবং ঋত্বিককে বরং সডোমাইজ করে একদল সিনে-পারভার্ট।
ইতি- সিদ্ধার্থ।

 

“হাজার বছর ধরে
দেখছি
ইতিহাস
দারিদ্র্যের ইতিহাস
বঞ্চনার ইতিহাস
শোষণের ইতিহাস
দারিদ্র্য
মালিন্য
আর
মৃত্যুর
ভিড় ঠেলে
আমি পায়ে পায়ে চলেছি
হাজার বছর ধরে”

স্টপ ! স্টপ ! স্টপ !

 

গলির কুকুরটা জানান দেয় সে জেগে আছে।
ঘেউ ঘেউ ঘেউ।
হিচককের প্রেত বুঝি তাড়া করছে থাকে।
শাওয়ারে যাওয়ার সাধ জাগে।
আলো জালবোনা গহনে যদিবা বর্ষণে মাতি আজ রাতে।
অন্ধকারেই পুড়বো জলের আগুনে।
ছুঁয়ে দেখবো রোমকূপ অথবা আপন শূন্যতা।

 

ঘাম শুকিয়ে পীঠ আঠাআঠা।
গিন্সবার্গ কি এই মোহন রাতে এখনো জেগে আছে?
হয়তো পড়ছে শক্তি অথবা আমার থেকেই নেওয়া- সুধীন্দ্রনাথ।

 

সেলফোনের ভাঙা স্ক্রিন জানান দেয়,
ভোর হবে আরো ঘন্টা দেড়েক বাদে।
মেঘের ঘোড়ারা ঘুমিয়ে আছে নীলাভ আস্তাবলে।

 

 

বরখাস্ত প্লুটো এবং,
বুধ,শুক্র,মঙ্গল,বৃহস্পতি,শনি,ইউরেনাস,নেপচুনদের থেকে আলোকবর্ষ দুরত্বে
মানুষ হওয়ার দায়ভার নিয়ে
আমরা ভেসে আছি এই ছোট্ট,শৌখিন, তারাবাতিজলা অ্যাকুরিয়ামে।
নিথর নগ্ন ক্লান্ত দেহে হীরের চাঁদরে মোড়া।

 

 

আশ্চর্য স্বচ্ছ অ্যাকুরিয়াম।

 

 

বুকপকেট (২)

 

কি ভীষণ প্রলয় আমাদের দেয়াল জুড়ে, বারান্দাতে। লোভ, অপেক্ষা , মৃত্যু আর গোটা দশেক বোতলবন্দী আত্মহত্যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ভিসুভিয়াসের গভীরে এখনো কতটা দহন লুকিয়ে আছে।কলমের কালিতে সাদা কাগজের বুক চিরে আমরা থরে থরে বেদনা সাজাই।ভাইয়ের স্নেহ,বন্ধুর রুপক গদ্য আর নিরুপম অস্থিরতায় আমরা সূর্যমুখী ফুলের কাছে নত হই। নত হই পাখির ডানার কাছে। নত হই অস্তিত্বের কাছে। সংক্রুদ্ধ । নত হই ।

 

নত হই সূর্যের কাছে।

নত হই শৈশবের কাছে।

কলমিলতা আর বুনোফুলের কাছে নত হই।

নত হই কাঠগোলাপ আর চেনা ফড়িঙের ডানার লাল আগুনের কাছে।

নত হই প্রজাপতি অথবা রঙধনুর কাছে।

নত হই বৃষ্টির শব্দ আর বাতাসের কষ্টের কাছে।

দ্বিধারিক্ত খয়েরী পাতার কাছে- নত হই।

সব সুন্দর দমবন্ধ মাছের মত কচুরিপানার রক্ত মেখে
জলের উপর ভাসতে থাকুক, ভাসতে থাকুক, ভাসতে থাকুক!
সব শব্দ শেকল ভেঙে নিয়ন মেখে নিবিড় রাতে
প্রবল ঘণ্টাধ্বনির মত বাজতে থাকুক, বাজতে থাকুক, বাজতে থাকুক।

 

তবুও আমরা কি ভীষণ প্রতীক্ষারত!

প্রতীক্ষায় আছি, ইটের পরে ইট গেঁথে আমাদের দালান উঠবে।মাস্টার বেড, কিচেন , ঝুল বারান্দা আর নির্বাক চিলেকোঠা।সেপাই,সান্ত্রী।কাঁচের বোতলে রাখা কুড়িয়ে পাওয়া মানিপ্ল্যান্টের শেকড় আর বিষণ্ণ ডুপ্লেক্সের ততোধিক বিষণ্ণ সিড়ি আমাদের দুঃখ লুকোবে।লাল কার্পেট ধুলোর গভীরে লুকোবে আটপৌরে ঝগড়া আর গোপন গোলাপ শুকিয়ে যাবে ডায়েরীর ভাঁজে।কিশোরীর বুকের ভাঁজ লজ্জা লিখে যাবে,সংগোপন স্বগতোক্তিতে, সেই বুকের ভাঁজেই। বুকের কর্ষিত জমিন ব্যতীত কিশোরীর যে কোন ডায়েরি নেই; কিশোরের নাহয় থাকে সবুজ ঘাসের সাথে একপেশে সহবাস।

 

কিশোর চল নত হই কাঁচপোকার নীলের কাছে।

জননী চল নত হই জঠরের কাছে।

পিতা চল নত হই মেগালোম্যানিয়াক শুক্রাণুর কাছে।

এই যে,লিখে চলেছো বাক্যের ভূতগ্রস্ত

শুনছো?

চল নত হই নিজের কাছে।

প্রশ্নে।

নত হই।

 

মৌলিক মৃতদেহ অথবা বিষণ্ণ এপিটাফ

 

একদিন বিষণ্ণতাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

মৌলিক মৃতদেহে নিজস্ব আলোকে আঘাত করবে সূর্য।

উন্মুক্ত চোখের কালোয় গাড় নীল অন্ধকার মিশিয়ে

সন্ধ্যে মেটাবে তার বিষাদের খেয়াল।

সমবয়সী দেহের ভীড় ঠেলে

কৈশোরাক্রান্ত কোন যুবকের নিঃশব্দ অভিমানী উচ্চারণ-

‘আমি ছাড়া আমার কোন বন্ধু ছিলনা’- এ

আহত হবে কেবল দলছুট কোন দূর্বা।

 

আঁধারেরও ছিল জানি নিবিড় সংবেদ।

 

 

 

একদিন বিষণ্ণতাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

মৌলিক মৃতদেহে নিজস্ব আলোকে আঘাত করবে সূর্য।

 

bird-1989
‘পাখি’ – রবার্তো আইজেনবার্গ, ১৯৮৯ ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.wikiart.org/en/roberto-aizenberg/bird-1989

 


 

10670214_309987322527371_849993115070076196_n

[ সাব্বির পারভেজ সোহান –  কবিতা আর সিনেমা ভালবাসেন। সিলেট থাকেন।  – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s