১৯৯৭, এপ্রিল

লালমাটিয়ার ডি ব্লকের মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট খেলা শুরু করলাম। স্কুল থেকে ফিরে এক ঘন্টার মধ্যেই মাঠে চলে যেতাম। স্কুল ছুটি হইতো চারটার সময়। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটের। তাও সেটা হেঁটে আসবার। সঙ্গী ছিলো মামাতো ভাই অপু। আমাদের সাথে থাকে। আমার থেকে দুই বছরের বড়। রাইফেলস পাবলিকে ক্লাস ফোরে পড়ে। আমার থেকে এক ক্লাস উপরে। সেই মাঠে যারা যারা খেলে তাদের কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো দ্রুতই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তাদের কারো নামই আমার মনে নাই। এমনটা আমার সাথে কদাচিত ঘটে। স্কুল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেকের কাছেই আমার স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে ভুয়সী প্রশংসা শুনেছি। সেই প্রশংসা অমূলক কিছু নয়। নিজের তো বটেই অন্যদেরও অনেক খুঁটিনাটি মনে রাখতে পারি। বিশেষত তারিখসম্পর্কিত যে কোন কিছু। যাই হোক মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। একটা অতি সাধারণ দৃশ্য আমার হৃদয়ে আজীবনের জন্য খোদাই করা হয়ে গেছে। সেটা হলো মাগরিবের আজান দেওয়া মাত্রই আমি আর অপু মাঠ থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছি।

মাঝেমাঝে খুব ক্লান্তবোধ করলে সামনের কোন দোকান থেকে কোক কিনে খাইতাম। তখন কোকের বোতলগুলার দাম ছিলো দশ টাকা করে। (আমার কোকপ্রীতির বিষয়টা কে না জানে? এটুকুই জানাতে চাই যে সেই প্রীতি বহু আগে থেকেই) মাঠের দুইটা গেটের মধ্যে উত্তর দিকের গেট দিয়ে সেই সময়ে বের হয়ে বাসার দিকে রওনা দিতাম। এখন কখনো মাঠের ভিতরে ঢুকলে কিছু সময় কাটিয়ে অতঃপর যখন বর্তমান নিবাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয় তখন ব্যবহার করতে হয় মাঠের দক্ষিণ দিকের গেট। অদ্ভুত না? আরেকটা জিনিস জানিয়ে রাখি। কখনো যদি মাঠে ঢুকে অতঃপর উত্তর দিকের গেট ব্যবহার করে অপুর সাথে যেই রাস্তা বরাবর তৎকালীন ঠিকানায় ফিরে যাইতাম সেই রাস্তা বরাবর হাঁটা শুরু করি সেই সময়কার অনুভূতির কিছুই আমার সাথে থাকেনা। একে কি বলবো? শৈশবের সেই দৃশ্যটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? বিনাসংকোচে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারলে ভালো লাগতো। মানসিকভাবে এক ধরণের এস্কেপ রুট পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন মাঠে ঢুকবার পরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য আমাকে মাঠের বিপরীত দিক দিয়ে যেতে হয়। সচরাচর মানুষের সাথে ঘটেনা এই অদ্ভুত বৈপরীত্য শৈশবের সেই অনুভূতি থেকে বর্তমান আমার বিযুক্তির একটি প্রতীকি চিত্র হতে পারে। হতেই পারে। আমাদের জানবার, উপলব্ধি করবার পরিসর বরাবরই ক্ষুদ্র, এখনো কি তাই নয়?

১৯৯৭, মে
স্কুল মোটামুটি ভালো লাগতে শুরু করেছে। এক ধরণের নিয়মের মধ্যে থাকতে মন্দ লাগছেনা। তাছাড়া স্কুলের পরিবেশ একেবারেই মিলিট্যান্ট নয়। স্কুল ক্যাম্পাস ধানমন্ডি ২৬ নম্বরে, শঙ্কর বাসস্ট্যান্ডের বিপরীত দিকে ছিলো। এখানেও একটি অবাক করা তথ্য দেই। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শঙ্করের ইবনে সিনা হসপিটালের বিপরীতে যেই এপার্টমেন্টে থাকতাম আমার স্কুল ক্যাম্পাসটি একসময় ছিলো ঠিক তার পাশের বিল্ডিঙে। এই ধরণের অদ্ভুত সব ঘটনা আমার জীবনে নিখাদ বাস্তব হয়ে এসেছে। সেই স্কুল ক্যাম্পাস বেশ সময় আগে থেকেই আর নেই। কিন্তু সেটা আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমি প্রায়শই এখনো স্বপ্নে ক্যাম্পাসটিকে দেখি। সারা মাঠময় ধুলো। স্কুলের গেটে প্রবেশ করলে একেবারে সোজা বরাবর শেষপ্রান্তে গাড়ীর গ্যারেজ। তার একটু পেছনে ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে রফিক মিয়া নামের একজন ছিলো। গোলগাল চেহারার। লম্বা দেখতে। আমরা ক্যান্টিন থেকে চার টাকায় সিঙ্গারা কিনে খাইতাম। কলিজার সিঙ্গারা। স্কুলের গেট থেকে সোজা বরাবর যেতে যেতে বামদিক একটা মোড় ছিলো যেখানে প্রতিদিন স্কুল শুরু হবার আগে আমাদের এসেম্বলী হতো। সেই জায়গার ডানদিকে ছিলো তিনটি দোলনা। সামনে গেলে স্কুলের অফিস। বেতন দেওয়ার সময়ে সেই অফিসে স্টুডেন্টরা প্রবেশ করতো। যার কাছে বেতন দেওয়া হতো তার নাম ছিলো মোজাম্মেল স্যার। লম্বাটে মুখ। আমার জীবনে দেখা প্রথম ওম্যানাইজার লোক। এই বিষয়ে উনার ব্যুৎপত্তি ছিলো দেখার মতো। অল্পবয়স্কা ছেলেমেয়েদের মায়েদের সাথে দুর্দান্ত ফ্লার্ট করতে পারতেন ভদ্রলোক। এমনকি আমার ক্লাসের এক ছেলের বোনের সাথে পর্যন্ত।(ছেলের নাম মনে করতে পারছিনা, আমার স্মৃতিশক্তি ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেছে তার আরেকটি নমুনা) নারীগণও মোজাম্মেল স্যারের আকর্ষণে ভালোভাবেই সাড়া দিতেন। সেই বিষয়টি এতোটাই স্বচ্ছ ছিলো যে ক্লাস থ্রিয়ের একজন বাচ্চাও তা তখনই বুঝতে পেরে প্রায় উনিশ বছর পরে এসে তার স্মৃতিচারণ করতে সক্ষম। অফিস থেকে বেরিয়ে বামে গেলে টয়লেট। টয়লেট থেকে সোজা বরাবর নার্সারীদের ক্লাস। আরো সামনে এগোতে এগোতে মাঝখানে যেই বিশাল রুম সেটা ছিলো ক্লাস থ্রি মানে আমাদের ক্লাসরুম। আমাদের ক্লাসরুম বরাবর বামদিক ঘেঁষে সোজা বরাবর ছিলো ক্লাস ফোরের ক্লাসরুম। এখনো পর্যন্ত আমি যতোগুলো ক্লাসরুমে ক্লাস করেছি (স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়) সবগুলোর মধ্যে এই ক্লাসরুম আমার সবচেয়ে প্রিয়। ক্লাস ফোর, ক্লাস ফাইভ, ক্লাস এইট এই তিনটি বছর আমি এখানে ক্লাস করেছি। সেই তিন বছরের নানাবিধ স্মৃতি পরবর্তী পর্বগুলোতে বলা হবে। যাই হোক এভাবেই এখনো বহু বছর আগেই একটি জায়গা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তা অন্তত একজনের হৃদয়ে রয়ে গেছে। মাঝেমাঝে স্বপ্নের মধ্যেই তীব্র বাথরুম পেয়ে যাওয়ার কোন দৃশ্য দেখলে সবার আগে এই ক্যাম্পাসের বাথরুমটাই স্বপ্নের মধ্যে চলে আসে। উনিশশো সাতানব্বই সালে আমার ক্যাম্পাসটির সাথে পরিচয় ঘটেছিলো। স্বপ্নে আমি প্রায়শই এখনো ক্যাম্পাসটিকে দেখতে পাই। স্বচ্ছস্ফটিকভাবে। ক্যাম্পাসের সাথে প্রথম পরিচয়ের সতেরো বছর পরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যের সাথে পরিচিত হই। ইলিয়াসের গদ্যের সাথে পরিণয়ের পরে দেখি তার লেখার পরতে পরতে স্বপ্নময়তার ছড়াছড়ি। অতঃপর আমি নিজের স্বপ্নময়তাকে আরো তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরি। সে আরো বেশী আমার নিকটবর্তী হয়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর সময়? জানুয়ারির চার তারিখ, সাল? উনিশশো সাতানব্বই। হ্যা, ঠিকই পড়েছেন সকলে। ‘উনিশশো সাতানব্বই।’
[আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট ‘, ‘এপিটাফ’। ]