সেই স্কুল বেলার গানে কতশত ব্যথা আর জরাগ্রস্থ বেদনা লিখেছি একটু একটু করে। লিখতে লিখতে শুনি কিংবা শুনতে শুনতে লিখি। বেড়িবাঁধের ধারে ফুটবলের সাথে গান। স্কুলের টিফিনে গান গান খেলা। আর কি ছিলো? আছিলো হয়তো আরো অনেক কিছু। তবে মনে নাই আরকি। হয়তো আর কিছুই ছিলো না। আমার মনে হইতেছে ছিলো। শুরুটা হয়তো মাকে দেওয়া বাবার উপহারে। সেসব অন্য কথা। কানে বাজে এখনো পুরোনো সে গিটারের ঝংকার থেকে তারায় তারায়… মেলা, ফেয়ারওয়েল অ্যাঞ্জেলিনা, কান্ট্রিরোড, মালা, হারিয়ে গেছে অথবা সেই তুমি… তারপর একদিন অফবিট আর ছাড়পত্র নয়তো অনুশীলন অথবা আগন্তুক দিয়ে পালাবদল। কানে আসে কিংবা বাজে-
দূরের ঐ পাহাড় মিশে যাওয়া আকাশ/ আমার ঘৃণা তোমাকে পুড়াবেনা / আমার যাওয়া হলো না, আমার ফেরা হলো না/ তুমি চেয়ে আছ তাই আমি পথে হেঁটে যাই।

ধরেন এসবের মধ্যে ডুব মেরে থাকি। ডুব দিই আর গান শুনি। গান শুনি আর ডুব দিই। ভাসতে ভাসতে হয়তো দূরের কোন আশ্চর্য মেঘদলের লগে এক্কাদোক্কা খেলা আর সারা রাত তারায় তারায় পিরিত উপাখ্যান রটিয়ে দেওয়ার গল্প।
২
এভাবে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগুনো। বিবর্তন মানে বিবর্তন। পুরানোরে খারিজ করা না। বিক্ষিপ্ত কিংবা বিভ্রান্তিকর যে শুরুটা তারে আস্তে আস্তে পরিণতির দিকে যাওয়া। শুরুর দিকে প্রচণ্ড সংশয় এবং সন্দেহ। তারপর গায়ের সাথে গা এবং ভাবের সাথে ভাব লাগায়ে দাঁড়ানো। এভাবেই শুরু আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড মিউজিকের পথে যাত্রা। শুধু শুনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। তাড়না এমন জিনিস, তাড়াইয়া পাহাড়ের কিনারে নিয়া যাইতে পারে। তো ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর প্রথম ব্যান্ড করাকরি। পছন্দের ব্যান্ড ব্ল্যাক এর লগে নামে মিল দিয়া রাখলাম ডার্ক। তো আমরা যেখানে গান শিখতাম মানে মোহিনী সংগীত একাডেমিতে গান শিখতে যাইতাম ২৪ জন ছিলাম। ২৪ জন মিলাইয়া তো আর ব্যান্ড হয়না। আমরা জানতাম ব্যান্ড করতে ৬ জন লাগে। তাই আমাদের ডার্ক আগাইল ডার্ক-৪ পর্যন্ত। এভাবে শুরু এভাবেই সাময়িক শেষ। এমন ব্যান্ড যাত্রা আমরা টিকাই রাখছিলাম ১০ সালের মধ্য পর্যন্ত। কখনো নাম আছিল ‘ওঙ্কার’ তো কখনো আবার ‘ছাড়পত্র’। রোজা রাইখা যখন সিস্টেম অব ডাউনের ‘টক্সিসিটি’ গাওয়ার বৃথা চেষ্টা করতাম। বৃথা এইজন্য যে এই গান কিভাবে গাইতে কিংবা বানাইতে হয় আমরা কেউ জানাতামনা। তবু আমি ভোকাল, যার নাই তাল-সেন্স, নাই শুদ্ধ উচ্চারণে গান করতে পারার ক্ষমতা। চিল্লাইয়া কাহিল তখন না পারি রোজা রাখতে না পারি ভাঙতে। পরে সরে আইসা যখন বেইজ বাজাইতে গেলাম ব্যান্ডে আসলো নতুন ভোকাল। জেনারও রক থেকে আসলো সাইকেডেলিকে – তখন কিছুটা জাতে উঠছিলো। যদিও সেই যাত্রাও আর বেশিদূর আগানো যায়না। মফঃস্বলে ব্যান্ড করার যাবতীয় সমস্যার কাছে আমরা যখন হার মাইনা ফিইরা গেলাম তখন শুধু সাথে অদ্ভুত এই জার্নির অদ্ভুত কিছু দুঃখ এবং সুখের দেয়ালের আস্তরটুকু। এই জার্নির বাকি কথাটুকু হয়তো আমার অন্য কোন বন্ধু বলবে। আমি ঐদিকে আর না যাই।

৩
তো এই যে ব্যর্থ যাত্রা সেই যাত্রা তো আর মিথ্যা না। সফল না হইলেই তো আর কোন কিছু মিথ্যা হয়না। এই গায়ে গা লাগায়া দাঁড়ানোকে কেউ যদি পাগলামি বলবার চায় তো বলবার পারে। তয় এই তাড়না কিংবা প্রবণতা এমনে এমনে তৈরি হয় নাই। সেই গানের যুগ তো এখনো চলমান। এখনো আমরা অপেক্ষা করি আর্টসেল কবে স্টেজে ফেরত আসবে তার দিকে। আবারো রাহুর গ্রাস কিংবা অন্য কোন সময়ের দিকে গিয়া স্মৃতিস্মারক গড়ে লীন হয়ে যাওয়ার এই পথচলা নিতান্তই দুঃখ বিলাসী কোন যাত্রা নয়। এটা আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড রক মিউজিকের দিকে যাত্রা। অনেকটা ডলু নদীর তীর থেকে ভূতের গলি কিংবা দক্ষিণ মৈশুন্দি অথবা হাইকোর্টের মাজারের দিকে যাত্রার মতো। এতে আমাদের কত যে স্যান্ডেল ছিঁড়ছে তার হিসাবও মেলা।
৪
তো যেদিন ছাড়পত্র কিংবা অনুশীলন অথবা স্বপ্নচূড়ার গানগুলা শুনতে শুরু করি। তারও কিছু পরে কিংবা সমসময়ে ধ্রুবক (অর্থহীনের এই অ্যালবামটা বাকিগুলার আগে আমার হাতে আসে), জাহাজী, আমার পৃথিবী, অন্যসময় কিংবা সেই সময়ে আচানক সামনে আসা ওয়ারফেজের পুরোনো কিছু গান। অবাক করা বিষয় হইল ওয়ারফেজ নিজেদের সময়ে প্রায় অনালোচিত থাকার পর এই সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হইয়া উঠে। অবাক ভালোবাসা, অসামাজিক, বসে আছি এই গানগুলোর সমসায়িকতা পরে এই গানগুলো আবার রিমেক করার পর ওয়ারফেজ যে জনপ্রিয়তা পাইছিলো তার খোঁজ নিলে বুঝা যায়।

সত্য কিনা জানিনা, আর্টসেল এবং ওয়ারফেজ যখন ২০০৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কনসার্ট করে, শুনেছিলাম ওইটা ছিলো চট্টগ্রামে তাদের প্রথম কনসার্ট। সেখানে আর্টসেলের সাথে গেস্ট হিসেবে ছিলো বেইজ বাবা সুমন। আমার সে কনসার্টটা দেখার সৌভাগ্য হইছিলো। সেটা ছিলো আমার প্রথম কনসার্ট যাত্রা। সারাদিন চট্টগ্রামের প্রায় ২০ টার উপর ব্যান্ড সেদিন পারফর্ম করছিলো। এইসব আন্ডারগ্রাউন্ড রক সংস্কৃতি পরে আর আন্ডারগ্রাউন্ড থাকতে পারে নাই ক্যাবলের তাগাদা আর বাজারের চাহিদা তাদের সেই সুযোগ দেয় নাই। সেই প্রভাব টিভি চ্যানেলের উপরে গিয়াও পড়ছিলো। অফবিট নাটকটা তার প্রমাণ। পুরা ব্ল্যাক ব্যান্ড ভালোবাসা দিবসের সেই নাটকে অভিনয় করছিলো। আর নাটকটার জনপ্রিয়তার কথা বিশদ বলাটা বাহুল্য মনে হবে।
![Onno Shomoy [Front-Back]](https://noynumberbus.files.wordpress.com/2016/07/onno-shomoy-front-back.jpg?w=394&h=189)
৫
সে সময়ের গানগুলোতে এমন কি ছিলো যে সেগুলোর পিছনে এইভাবে ছুটছিলাম? লিরিক, সুর, কম্পোজিশন কিংবা প্রেজেন্টেশন সবমিলিয়ে গানগুলো ছিলো একদম নতুন। যদিও অনেক সময় গানগুলার কথা উচ্চকিত স্লোগান, রাজনীতি ও ঢলঢলা আবেগে পূর্ণ ছিলো। তাই সব সময় লিরিক মানোর্ত্তীণ ছিলোনা। আবার হার্ড রক কিংবা ট্রাশ মেটাল গানগুলার যে ভাব তাতে লিরিক অতো গুরুত্বপূর্ণ কিছুও আছিলোনা। বরং লিরিকের চেয়ে গানের কম্পোজিশন ও ইনস্ট্রুমেন্টের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারপরও ব্ল্যাক, আর্টসেল কিংবা শিরোনামহীনের বেশকিছু গানের কথা বাংলা গানের পথে নতুন একটা আঙ্গিক তৈয়ার করছিলো। যেমন অনিকেত প্রান্তর, লীন, ছায়ারা সরে যাবে, জাহাজী কিংবা গুটি – এই গানগুলার কথার মইধ্যে ক্ষত তৈয়ার করার একটা প্রবণতা আছিল যেটা বাংলা ব্যান্ডে নতুন একটা স্বর হিসেবে দেখা দিছিলো। মূলত মেটালিকা, মেগাডেথ, সিস্টেম অব ডাউন, ল্যাম্ব অব গড, আইরন মেইডেন কিংবা ড্রিম থিয়েটারের অনুপ্রেরণায় গড়া এই গানগুলো কি শুধুই অনুকরণ ছিলো? নাকি অনুকরণের বেশি কিছু ছিলো। অবশ্য এইসব অভিযোগ খুব একটা পাত্তা পায় নাই। কারণ আর্টসেল কিংবা ব্ল্যাকরা যখন এইসব গান করতে আসে তাদের পিছনে ছিলো আজম খান, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদদের এক লড়ায়ের দীর্ঘ ইতিহাস। এই সময়ে এসে এই রক সংস্কৃতি কিন্তু আর সরলরৈখিক ধারায় ছিলোনা। অল্টার্নেটিভ এবং প্রগ্রেসিভ রকের পাশাপাশি সাইকেডেলিক এবং সহজিয়া ব্যান্ডের ধারাও সামনে আসে। বিশেষ করে পরবর্তী সময়ে আমরা কলেজ জীবনের শেষদিকে মেঘদলের প্রথম অ্যালবাম “দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা” আমাদের হাতে এসে পড়ে। মেঘদলের গানের ধাঁচটা আমাদের আরেকটি বাঁকের সামনে দাঁড় করায়। গানগুলা ঘোরগ্রস্থ কবিতার মতো।

৬

মেঘদলের গান তখন গানের রাস্তা পেরিয়ে আমাদের কবিতার রাস্তায় নামায়। চেনা-অচেনা আলো আঁধারে বাসের ভিতরে আমরা মুঠোফোনে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে শুরু করি। এর আগে আমরা গান শুনতে শুনতে অনিকেত প্রান্তরে এসে বিভক্ত মানচিত্রের অব্যক্ত যন্ত্রণার রূপকের মুখোমুখি হয়েছিলাম। শিরোনামহীন কোন সাইকেলের ডানায় উড়ে উড়ে ইচ্ছে ঘুড়ির গল্প শুনেছিলাম। এমনকি কথকতা এবং ঘড়ির কাঁটায় ঘুমায় যাওয়া নাগরিক জাহাজীর যন্ত্রণাও বুঝে গেছিলাম। একদিন হইলো কি, যে নদী নাই হয়ে গেছে অথবা শুকিয়ে ধানক্ষেত হয়ে গেছে তার গল্প বুঝতে বুঝতে হঠাৎ নেফারতিতি কিংবা এক ফোঁটা রোদের সামনে এসে দাঁড়ায় পড়ি। অতঃপর গান শুনতে শুনতে আমরা ফেরা না ফেরার গল্পের দিকে আগায় যাইতে শুরু করি। লগে আমাদের মেলানকোলিক স্মৃতিগুলা সুর হইয়া উড়তে শুরু করে। আমরা জামালখানের বেথেলহাম চার্চ কিংবা সদরঘাটের জাহাজের দিকে পাশ ফিইরা দাঁড়াই। মুখোশের আড়ালে মুখের গল্প আরো আড়ালে যাইতে থাকে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের জুতা দোকানীর কাছ থেইকা জুতা কিনতে কিনতে হেড ফোন দিয়া ভাইসা আসে আজো আমি ভবঘুরে কি কারণে? পুলিশের তাড়া খাইয়া নিউমার্কেট পার হইয়া যখন মুসলিম হলের সামনে আইসা খাঁড়াই সন্ধ্যা তখন পার হইয়া গেছে। মাথার উপর সারি সারি চে গেভারা এবং গেঞ্জির পিছনে গানস এন রোজেস লইয়া ঘুরতে ঘুরতে আবার নেভালে আইসা দাঁড়াই। লুসাই ভবন তখন বহুত দূরে। ডেভিলস হর্ন এবং হেড ব্যাঙ্গিং করতে করতে চিক্কুর দিইয়া গাইয়া উঠি রোদের ভিতরে রোদ, ক্রোধের ভিতরে ক্রোধ। হেরপর ঈদ যায়, পূর্ণিমা যায় আর দুর্গাপূজা আসে নবমীর রাতে আমরা এ কে খান পাহাড়ের উপর গিয়া উঠি। পাহাড়ের ভিতর দিয়া শাটল আসে। আমরা কলার ঝুপড়িতে গিয়া বসি। শাটলের ভিতরে ঘামতে ঘামতে মাগনা শুনাই অদ্ভুত সেই ছেলেটার জোছনা যাত্রার কথা। শুনতে শুনতে রাজনীতি করি। গাইতে গাইতে রাজনীতি করি। পরে বাসায় আইসা নানারে শুনাই ছয় তারের গিটার চাইর তারে কেমনে বাজে। নানাজান ভাবে চাইর তারের ভিতরে কি কোন মধুবালা থাকে।

[হাসনাত শোয়েব – কবি ও গদ্যকার। চাঁটগায়ের পোলা। একমাত্র কবিতার বই ‘সূর্যাস্তগামী মাছ’। রক মিউজিক, ফুটবল এবং মাস্তানি-তে আগ্রহ আছে। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ]