উত্তরের গান
স্টেশনে বাচ্চা কোলে কাঁদো কাঁদো মেয়েটা। বয়স কতই বা হবে! বিশ কি একুশ! না জানে সুইডিশ, না জানে ইংলিশ! সাথে দুনিয়ার বাক্স প্যাটরা-লটবহর। বড়-বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ চারটা, সুটকেস দুইটা, ছোট-ছোট ব্যাগ আরো তিন-চারটা। অনেকেই তার বাক্স-প্যাটরার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আজই ব্রাসেলসে বোমা হামলায় ৩৪ জন মারা গেছে। মেয়েটার হাতে দু’টা কাগজ ধরা। একটা কাগজ ট্রেনের টিকিট অন্যটায় সুইডিশে লেখা: ‘আমাকে দয়া করে সাহায্য করেন’! তাকে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করলাম চিন্তার কিছু নাই, ট্রেন ১০ মিনিট দেরি হবে। কে শোনে কার কথা! সে একাধারে বলেই যাচ্ছে ‘অ্যারাবিক, অ্যারাবিক, অ্যারাবিক..’! ‘না, আমরা অ্যারাবিক বুঝিও না বলতেও পারি না।’ আকারে ইঙ্গিতে তাকে বুঝায় একটু শান্ত করা গেল। মনে হয় অ্যারাবিক না জানায় খুব একটা কাজে দিলো না, ৫ মিনিটেই সে আবার অশান্ত হলো। আমরা, মানে আমার ছোট বোন অনো আর আমি, যাচ্ছি সুইডেনের সব থেকে উত্তরে যেখানে ৬ মাস দিন, ৬ মাস রাত, আর সারা বছর হাড় কাঁপানো শীত।

অনোকে গত কয় মাস ধরে নানা রকমের মূলা ঝুলাইসি। একবার ঠিক করলাম বলকানের বিভিন্ন দেশে(রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া) যাবো। অনোর সেঙ্গিয়ান বর্ডারে একবারই ঢোকার অনুমতি আর বলকান দেশগুলো সেঙ্গিয়ানের বাইরে হওয়ায় সমস্ত প্ল্যান ভন্ডুল হলো। তারপর ঠিক করলাম ইউরোপের দক্ষিণের দিকের কোন দেশে যাবো। এবার হুঁশ হলো আমার নিজেরই সেঙ্গিয়ান ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে, তাই ওই আশা বাদ দিতে হলো। শেষ পর্যন্ত ‘লাপল্যান্ড’ যাওয়ার টিকিট করলাম। সূর্য না, বরফ আর অন্ধকার দেখব। কপাল ভাল হলে অরোরা দেবীর দেখা মিলতে পারে।
কানে সোনার ঝুলানো দুল পরা সিরিয়ান মেয়েটা অ্যারাবিক ভাষায় পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের এক ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলতেসে। মা ভরসা ফিরে পাওয়ায় তিন কি চার বছরের বাচ্চা মেয়েটা কান্না থামায় গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বিস্কিটের গুড়া দিয়ে জামা কাপড় মাখামাখি। টুপিটা এমন ভাবে চোখ ঢেকে আছে যে কিছু না দেখে আন্দাজে হাঁটছে আর এর-ওর পায়ে গুঁতা খাচ্ছে। পিচ্চির মাটাকে আর অ্যারাবিক স্পিকিং ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কঙ্কনা সেন আর রাহুল বোসের মিস্টার এন্ড মিসেস আয়ার। মিস্টার আয়ার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলতে পারে। সে লিবিয়া থেকে আসা শরণার্থী। মিসেস আয়ারের সাথে এই মাত্রই তার পরিচয় হলো। সূর্যতপ্ত মরুভূমির দেশের মানুষগুলোকে সুইডিশ সরকার উত্তরে আর্কটিক সীমানার কাছে আবাস গড়তে পাঠাচ্ছে। এমনকি আইস ফিশিংও শেখাচ্ছে। ছেলেটার সাথে সুইডিশ-ইংলিশ মিলায় টুকটাক কথা বলতে বলতেই ট্রেন এসে গেল। সবাই দ্রুত জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেনে উঠতে থাকে। আমিও আগে আমার সিট খুঁজে ব্যাগ রেখে, মিসেস আয়ারের খোঁজে যাই। মিস্টার আয়ার খুব বিরক্ত হয়ে মিসেস আয়ারের বাক্স-প্যাটরা টানতে থাকে। পুরাটা করিডোর জুড়ে বাচ্চা মেয়েটা হাঁটছে, ব্যাগগুলোর মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, একটুও কানছে না। ট্রেন চলতে শুরু করে দিলো। মিসেস আয়ার বাক্স প্যাটরা উঠানো হয়ে গেলে নিজের সিটে আরামে বসে গেল। সেই অস্থিরতা সেই কাকুতি-মিনতি, অসহায়ত্ব সব উবে গেল এক নিমেষে। মিস্টার আয়ারের সিট অন্য বগিতে, সে তার রাস্তা মাপলো। আমিও আমার বগিতে ফিরতে ফিরতে রেস্টোরেন্ট থেকে এক কাপ কফি কিনবো ভাবলাম। একটা পার্টটাইম কাজ পাওয়ার কথা ছিল, পাই নাই। পাব মনে করেই দুই হাতে খরচ করে, এখন পুরা ব্যাক্কল হয়ে বসে আছি। কফি কেনার বিশ টাকা অ্যাকাউন্টে আছে কি নাই ভাবতেসি। পায়ের তলে ট্রেনটা দুলতেসে।

********************************
রাতের ট্রেনে চেপে আর্কাদি গাইদারের গল্পের খুদে যমজ দুই ভাই চুক-আর-গেক মস্কো থেকে সাইবেরিয়াতে যাচ্ছিল মার সাথে ওদের বিজ্ঞানী বাবার কাছে ছুটি কাটাতে। রাতের ট্রেনে ঘুমের ঘোরে পানি খেতে উঠে চুক যায় হারিয়ে। আর গেক জানালা দিয়ে দেখতে থাকে বরফে ঢাকা রাশিয়ার বার্চ বন, খরগোশ, জনমানুষহীন গ্রামের ছোট্ট স্টেশন। আমার এখানে বার্চ বনের উপরে ঝকঝকা রোদ হিমাঙ্কের ১৫ ডিগ্রি নীচে তাপমাত্রা। ট্রেনের সাথে সাথে ধুলার মতন সাদা বরফ উড়তেছে। নতুন পড়া তুষারের উপর হাঁটলে পচপচ আওয়াজ হয়। বহুদিন বালিতে হাঁটি না, সেন্টমার্টিনের বালির নিচেও কি পা ফসকে পচপচ আওয়াজ করে? মনে পড়ে না! নতুন বরফে জুতার চিহ্ন দিতে একরকমের আনন্দ হয়। ক্ষণস্থায়ী চিহ্ন রাখার আনন্দ। সমুদ্র পাড়ের বালিতে যেমন আঁকিবুকি করতে মজা লাগে। নতুন জায়গার বনে-জঙ্গলে-নদীতে-রাস্তায় আমি আমার ঝরেপড়া চুলগুলো ফেলে আসি আর বলি ‘তোমাকে আমার কিছু ডিএনএ দিয়ে গেলাম’। সুইডেনের উত্তরের শহর কিরুনাতে এত বরফ! এত বরফ যে উপরে সদ্য পড়া তুষারের পাতলা চাদর আর নিচে সারা বছরের জমে থাকা-গলে যাওয়া-আবার জমে যাওয়া বরফে পিচ্ছিল। চিহ্ন রাখতে গিয়ে পা পিছলে যায়। কিরুনাতে অনেক বড় লোহার খনি আছে একটা। আরো আরো লোহা তোলা হবে ভবিষ্যতে তাই পুরা শহরটাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে সরানো হচ্ছে। ট্রেন স্টেশনটা সরানো হয়ে গেছে। এখন একে একে ঘরবাড়ি, অন্য সব কিছু সরানো হবে। কেমন করে এত তুলকালাম হবে আমি জানি না। লোহা বিক্রির লাভের থেকে শহর সরায় ফেলার কাজে ক্ষতি বেশি না কম, এসব হিসাব আমার ‘কমোনসেন্সহীন’ ছোট মাথায় ঠিক আটে না। আমি বরং পরের বার এখানে আসলে পুরান শহরের চিহ্ন পাবো কিনা, নতুন শহরটাকে ভাল লাগবে কিনা, পুরান শহরের কতটুকু মনে রেখে দিবো, তা নিয়ে ভাবতে থাকি।

**************************



আমরা একটা ছোট্ট গ্রামে গেলাম। গ্রামটার আকর্ষণ দুইটা: সামিদের মিউজিয়াম আর আইস হোটেল। আইস হোটেলের টেবিল-চেয়ার, বিছানা, প্লেট-গ্লাস সব বরফ কেটে বানান। নান্দনিক, কিন্তু সে বিছানায় শুয়ে অন্যকিছু করা তো দূরে থাক ঘুমানোও সম্ভব না। দুইদণ্ড বসলে পাছা জ্বলে ঠান্ডায়।


মোবাইল দিয়ে ছবি তুলতে এমন কি হাতও জ্বলতে থাকে। তবে বরফের ভাস্কর্যগুলি দেখে সত্যি পয়সা উসুল হয়। এছাড়া আর সবকিছুতে গলাকাটা দাম। আইস হোটেল দেখে ছোট্ট গ্রামটা হেঁটে দেখি। হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই মনে মনে কানাডার মন্টট্রমলার ছোট্ট গ্রামটার সাথে একটা তুলনামূলক চিত্র আঁকা হয়ে যায়। মন্টট্রমলার গ্রামটাও ছিল ইয়াভলো গ্রামের মতই বরফে ঢাকা। পাশে ঘুমায় থাকা বরফ লেক, কাছাকাছি বরফে ঢাকা পাহাড়, দূরে দূরেও পাহাড়। মন্টট্রমলায় লোকজন যেন ছিলই না! বাড়িগুলো সব পোড়ো-বাড়ির মতন, গাড়িগুলোতে মোটা স্তরে বরফ জমে ছিল। তাই হরিণ পরিবার সাহস করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আঙ্গিনায়-রাস্তায়। ইয়াভলো সেই তুলনায় প্রাণবন্ত। লোকজন সব বরফের স্কুটার চালায়। হরিণ পরিবার দূরে পাহাড়ের জঙ্গলে লুকায়, লোকালয়ে বেড়াতে আসে না। সুইডেনে মানুষ সাধারণত ঘরের পর্দা টানে না। ইয়াভলোতেও তাই। ঘরে কে টিভি দেখে, কে গান শুনে, কে বই পড়ে, কে রান্না করে, কে ব্যায়ামের যন্ত্রে মেদ ঝরায়, জীবনকর্ম জানালায় উঁকি দিলেই টিভির চলন্ত চিত্রের মতন দেখা যায়। নিজেকে একা লাগে না, এলিয়েন লাগে না। আবার এলিয়েন লাগে। আমি তো এই চলচ্চিত্রের অংশ না। তবে সবটা মিলে আরো ব্যাপক কোন চিত্রের অংশ হতেও পারি। এসব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাই সামিদের চার্চে। চার্চটা আপাদমস্তক কাঠের। খুব অন্যরকম। যিশু নাই কোথাও। যিশুর যেখানে থাকার কথা অর্থাৎ ঠিক মধ্যেখানে একটা হাতে আঁকা ছবি – বনের মধ্যে ঐশ্বরিক আলো এসে পড়ছে। কেমন একটা আপন-আপন ব্যপার আছে ছবিটায়। যেন ‘কচি কাঁচার মেলা’র বাচ্চাদের আঁকা ছবি। সামিরা হলো লাপল্যান্ডবাসি: নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যন্ড ও রাশিয়ার নর্থে থাকা আদিবাসি জনগোষ্ঠি। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে, পতাকা আছে, সংস্কৃতি আছে।

তাদের পোশাকের কাপড় আমাদের বান্দরবানের আদিবাসীদের বোনা কাপড়ের মতন তাঁতে বোনা মোটা জমিন, রংটাও লালের মধ্যে হলুদ-সবুজ-নীল বেশ চড়া আর হাসিখুশি। আমার এক সিনিয়র বন্ধু আছে সামি-ফিনল্যান্ডের দিকের, তার কাছেই আমি প্রথম সামিদের সম্পর্কে জানতে পারি। দিনদিন সামিদেরকে আমি আরো ভালবেসে ফেলতেসি। ওদের সাখে কোথায় জানি আমি মিলে যেতে পারি মনে-মনে। সামি মিউজিয়ামটা বন্ধ ছিল। পেছন দিকে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতে এক সামি বুড়ারে পায়ে গেলাম। অনুরোধ করতেই আমাদের দুইজনের জন্যই মিউজিয়ামটা খুলে দিল। ভিতরে সামিদের বাদ্যযন্ত্রে বাজান অদ্ভুত এক উদাস করা সুর বাজছিল সিডিতে, আর কিছু টুকিটাকি জিনিস সাজানো। চোখ বন্ধ করে সুরটা শিরায় শিরায় টেনে নিলাম। সামিদের আরো কাছে যেতে চাই আমি। আগুন পোহাতে পোহাতে কাঠ পোড়া গন্ধে তাদের কারো একটা নাক দিয়ে সর্দি পড়া বাচ্চাকে কোলে বসায় শুনবো এই গান। নিশ্চয়ই কোন একদিন।

*************************

আত্মোপলব্ধি হলো, বরফ আমার পছন্দের। দিগন্ত বিস্তৃত সাদা অথবা সন্ধ্যার দিকের নীলাভ সাদায় অদ্ভুত একটা কিছু আছে। সামার আমার ভাল লাগে না, কারণ আশাহত হতে হয়। সামারের সময় বৃষ্টি-ঠান্ডা রেইন জ্যকেট-টুপি-গ্লাভস পরতে হলে প্রকৃতির প্রতারণা মনে হয়। তেমনি বরফ গলে প্যাচপ্যাচা কাদা, স্যাঁতসেঁতে ধূসর মাটি, পাতাহীন গাছ, মানে সামারের প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা বিরক্তি ধরায়। সাথে আছে অপ্রতুল গ্রীষ্মের আক্ষেপ, অথবা দু-চার দিন যদিওবা গরম একটু পড়ে, নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসে তখন! আম-জাম-লিচুর জন্য মন কেমন করে।
ট্রেনে উঠে পাশাপাশি দুইটা খালি সিট পেলে কুড়িমুড়ি হয়ে জ্যকেট মুড়ি দিয়ে ঘুমানো আমার আদ্দিকালের অভ্যাস। এক সিটে কাত হয়ে পা তুলে দিলাম। ঘুম। কখন জানি টিকিট চেকার এসে খোঁচা দিয়ে ঘুম ভাঙ্গায় বলে: ‘তোমার সিট কই? তুমি তো এই জেন্টলম্যানকে দাঁড় করায় রেখে তার সিটে দিব্বি ঘুমাচ্ছ!’ আমার কিছু সময় লাগে আমি কোথায় আছি, কেন আছি, ‘স্থান-কাল-পাত্র’, এসব জটিল বিষয় বুঝে উঠতে। ট্রেনে অন্যের সিট দখল করে হাত-পা ছড়ায়ে ঘুমাচ্ছি, এটা বোঝার পর অসংখ্যবার সরি বলে আবার অন্য দুটা খালি সিট খুঁজে নিয়ে আবার দ্বিতীয় দফায় ঘুম দিলাম। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকেও বিতারিত হলে নিজের জায়গায় ফেরত আসলাম। ট্রেন বাঁশি দিচ্ছে। শুনসি রেইন ডিয়ারের পাল রেল লাইনের উপর দাঁড়ায় থাকলে অথবা পারাপার করলে তাদের তাড়াতে ওরকম আওয়াজ দেওয়া লাগে। ঘুমে তলায় যাইতে যাইতে টিংটিং টিংটিং ঘণ্টা বাজতে শুনি। ছোট্ট স্টেশন পেরোলে ওমন ঘণ্টা বাজায়। কোন দেশের কোন অজানা শহরে কত অজানা মানুষের বাড়িঘর আর তাদের কত কত গল্প পেছনে ফেলে যাচ্ছি ঘুমের ঘোরে। মেঝেতে কি যেন একটা গড়াগড়ি দিচ্ছে! তাকায় দেখি একটা খালি প্লাস্টিকের পানির বোতল গড়াচ্ছে ট্রেনের তালে তালে।
(এই পোস্টে প্রাপ্তিসূত্র উল্লেখ ছাড়া যতগুলি ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো তুলেছেন লেখক ও তার যাত্রাসঙ্গী অনো – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)
[ নন্দিতা ফরহাদ – উচ্চশিক্ষার্থে বিদাশে আছেন। আইলসা। ভাত পুড়াইয়া কটকটি বানিয়ে চামচ দিয়া খান। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]