OUT 1, প্রকৃত সময় অথবা অস্তিত্বের বেঁচে থাকা
এখানে অপর এক কোলাহল আছে- শূন্যতা
জীবনের অর্থহীন উদযাপনে আছে- উৎসব

এপ্রিল ৬। বুধবার.২০১৬।
রাত ১১ টা বেজে চল্লিশ। OUT1 এর তিন নম্বর এপিসোড শেষে কীবোর্ডে আঙ্গুল চালাচ্ছি। থেকে থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জানালা বন্ধ থাকলেও বাতাসের শব্দ কানে আসছে, সাথে মেঘের চিৎকার। পড়ালেখায় মন বসলেও ডিপ্রেশন কাটেনি। বাস্তবতা হল, পড়ালেখা গোছের ক্লান্তিকর কোন কাজে ব্যস্ত থাকলে বিবশ বিষণ্ণতা উদযাপনের অবসর পাওয়া যায়না; তবে, মন খারাপ হয়,হঠাৎ হঠাৎ কষ্ট লাগে। হঠাৎ শব্দটা অভ্রতে লিখতে বেশ কসরত করতে হয়। প্রথমে ‘হঠা’ টুকু লিখে পরে আলাদা করে খন্ডত্-ত কে বসাতে হয়। মা ঘুমোচ্ছিলো, উঠলো , আবার ঘুমোবে। মায়ের ভীষণ কষ্ট; এবং- অভ্যস্ততা। লেখাটা শুরু করার আগে দুটো মানুষকে ভাবছিলাম- আমার সৌম্য ভাই আর নদী আপুকে। রিন্টোদা আজকাল ভীষণ বিক্ষিপ্ত,ক্ষুব্ধ; – কারণে। আমাদের সিনেমা করার কথা- অথচ প্রত্যেকে একেকটা জালে জড়িয়ে আছি; প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা মেটাচ্ছি। শেষ সিনেমা দেখেছিলাম বোধয় মার্চের ১২ কি ১৫ তারিখে- টারান্টিনোর হেইটফুল এইট। মাঝখানের কিছুদিন জীবনযাপনের দায়ভার মিটিয়ে কাল শুরু করলাম জ্যাক রিভেতের Out 1:Noli me tangere । পরিচালক- জ্যাক রিভেত। সিনেমার নাম OUT 1 হওয়ার পেছনে উইকি অনুসারে রিভেতের বক্তব্য হল-
“I chose ‘Out’ as the opposite of the vogue word ‘in’, which had caught on in France and which I thought was silly. The action of the film is rather like a serial which could continue through several episodes, so I gave it the number ‘One’.”

আর সাথের লেজটুকু (Noli me tangere) এর মাজেজা হল- ‘আমারে কেউ ছইওনি না গো সজনী’ ; “touch me not”। অর্থাৎ, এই ১৩ ঘন্টার সিনেমাটাই রিভেতের কাজের অরিজিনাল ভার্সন, রিভেতের ম্যাডোনা, যেটাকে ‘ছোঁয়া’ মানে রি-এডিট করা বড় ধরণের অন্যায়, ভীষণ রকম পাপ। যদিও পরে সেই পাপ হয়েছে, Out 1: Spectre নামে চার ঘন্টার একটা ভার্শন আছে এই সিনেমার; ছোট ভার্শন।
রিভেত মারা গেলেন কিছুদিন আগে, সম্ভবত মার্চে বা ফেব্রুয়ারিতে। এর আগে রিভেতের কোন কাজ আমি দেখিনি, পড়েছি কেবল। সুতরাং, OUT 1 ই আমার প্রথম রিভেত-অভিযান। সিনেমা দেখাদেখি, সিনেমা লেখালেখি, সিনেমা পড়া, সিনেমা গড়া এবং সিনেমা-যাপনের এই পর্যায়ে এসে একটা প্রশ্ন বেশ দুর্বোধ্য, হালকা এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে আমার কাছে, সেটা হল- “কেমন লাগলো?”। প্রশ্নটি দার্শনিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই; তবে যোগাযোগের আকালে এই প্রশ্নের কিছু সোজাসাপ্টা সরল উত্তর পেতেই আমরা অভ্যস্ত – ‘ভালো’, ‘চলে’, খারাপ না’ এবং… ইত্যাদি। কিন্তু, আমার যে অত অল্প বলে, হাল্কা বোলে মন ভরেনা, আঁশ মেটেনা হাজার শব্দে হারিয়ে গিয়ে। বিশেষ একটা সিনেমা নিয়ে কথা বলার মানুষ তো সাকুল্যে ঐ সৌম্য ভাই আর নদী আপু। ওরা না থাকলে বাইপোলার আমার এই ক্ষ্যাপামির দায়টুকু কে সামলাতো শুনি? সৌম্য এবং নদী! তোমাদের সাথেই তো সময় হারায় কথার ফাঁকে কথা বুনে, হরেক কথার কথা শুনে। হু, সরল উত্তরে আমিও তৃষ্ণা মেটাই বটে, তবে ঐ ‘কেমন লাগলো’টার উত্তরটা কি সবসময় এক কথায় দেওয়া যায়? যায়না; তাইনা? আর এই টাইপের প্রশ্নের উত্তর বিবিধ কারণেই ভীষণ রকম আপেক্ষিক। আর তাই, অনেক কথা মাথায় চলে আসে- প্রায়শ প্রাসঙ্গিক, অহরহ অপ্রাসঙ্গিক; -নিজের জীবনের, জীবন যাপনের। যাপিত জীবনের কষ্টিপাথরে এবং স্বয়মের আয়নায় একটা সিনেমাকে কত আঙ্গিকেই না দেখি আমরা, কত ভাবেই না তাকে বোঝার চেষ্টা করি। সেখানে হাজির হয় শিল্পের বহুমুখিতা, তার দার্শনিক মানচিত্র, ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা আর সংশ্লিষ্ট বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চা। সেই বিচারে OUT 1 ক্রমশ বিপুল মনোযোগ ও অধ্যবসায় দাবি করে চলেছে। তবে, এরূপ নানাবিধ বোঝাপড়ার পরেও একটা ব্যাপার আমার জন্য সবচেয়ে জরুরী হয়ে ওঠে; সেটা হল – সিনেমাটাকে সত্যি সত্যি অনুভব করা; অনুভব করা আত্মার সবটুকু দিয়ে। নাহলে আর মানুষ হয়েছি কেন? অনুভব আর অস্তিত্বেই তো, তাইনা?
||এপিসোড ১||
“Cogito Ergo Sum”
আমি চিন্তা করি তাই আমি অস্তিত্বশীল। পাশের বাসার পাপ্পু আর আমার চিন্তা আলাদা। পাপ্পুও অস্তিত্বশীল। পাপ্পু আমাকে নিয়ে একটা শব্দ বলে- ‘কুতাইল’। শব্দটি কুঁতা শব্দের অপভ্রংশ। বাংলা একাডেমীর অভিধান বলে- কুঁতা অর্থঃ ১। কাতরতা বা ক্লেশ প্রকাশক ধ্বনি ২।মলাদি ত্যাগের জন্য দম বন্ধ করে বেগে বা জোরে চাপ দেওয়া। এই একশব্দে পাপ্পু আমার চিন্তাভাবনার রূপরেখা বাৎলে দিয়ে ব্যাপক আনন্দ পায়; আমিও কৃতার্থ হই। কৃতার্থ হই এটা আবিষ্কার করে যে- ডি সিকার বাইসাইকেল চোর কিংবা বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে’ হচ্ছে আপাত প্রস্তাবে কুতাইল; প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্প। টের পাই, কুতাইলের বিপরীত অবস্থার জন্য লাগসই শব্দটা হল- চিন্তাশূন্য। লেখার শুরুতে দুটো শব্দের উল্লেখ আছে- যোগাযোগের আকাল। এই যোগাযোগের আকালটাই বড় প্রকট আমাদের জীবনে। শৈশবে আপন ঘরে বড়ভাইকে পেয়েছিলাম। চোখ মেলে তাকাতে শিখেছিলাম ঐ জুনাইমনের কাঁধে ভর করেই। কাঁধে ভর করা মানে আক্ষরিক অর্থেই কাঁধে ভর করা। তখন ভাইয়া খুলনা থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পড়ালেখা চুকিয়ে আমাদের কাছে সিলেট চলে এসেছে। আর আমি, মাকে সাথে নিয়ে কুষ্টিয়ায় ছেড়ে এসেছিলাম ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের শৈশব। এসেছিলাম বাবার কাছে- বটগাছের কাছে। তখন ভাইয়ার একটা কালো ট্রাংক ছিল, বাবারও ছিলো। আমি ছোট- তাই আমার ট্রাংক নেই, স্কুলব্যাগ আছে। ভয়ে ভয়ে ভাইয়ার সেই ট্রাংকে উঁকি দিলে পার্থিব দেখা যেতো। শীর্ষেন্দুর পার্থিব- ভাইয়া বিছানায় বসে পড়তো, আর আমি ভাইয়ার কাঁধে বসে পড়তাম। ভাতালিয়া, আনা মিয়ার বাসায় থাকতাম আমরা। তিন তালায়, দুই রুমের ঐ বাসায় আমাদের রুমে একটা জানালা ছিলো। জানালার কাছে ছিলো কয়েকটা বরই গাছ, আর ছিলো কাঠবিড়ালি; একটা না, অনেকগুলো। ঘরের ভেতর জানালার কাছের ঐ প্যাসেজের মতন জায়গাটুকুই ছিলো আমার মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড। সেখানে বসেই সমরেশের উত্তরাধিকার গেলা, কালবেলায় প্রবেশ আর কালপুরুষে উত্তরণ। তখন পুলিশ লাইনে পড়ি; অতশত না বুঝলেও এটুকু বুঝতাম রড লাইট জ্বালালে কারেন্ট বিল ওঠে। আর এই বোধের থেকেই ভাইয়াকে মধ্যবিত্ত করে তোলার চেষ্টা চালাতাম। কিছুতেই রাত জেগে লাইট জালিয়ে, গণ্ডা গণ্ডা কারেন্ট বিল তুলে, ভাইয়ার ঐ বই পড়ার অন্যায়টা মানতে পারতামনা। বাধ্য হয়ে বড়ভাইয়া নোকিয়া সেই আমলের আইফোন নোকিয়া ১১০০’র হ্যাজাক বাতিতে নিজেকে লুকাতো; আমি ঘুমিয়ে যেতাম, স্বপ্নে দেখতাম জলদস্যুরা আমার দ্বীপে আক্রমণ করেছে, হাত পা ছুড়তাম স্বপ্নের মাঝেই, ভাইয়ার গায়ে লাগতো। আমার একটা দ্বীপের শখ ছিলো বাবুরা, বড্ড শখ ছিলো। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, পুলিশ লাইন ছোট স্কুলে, রোক্সানা ম্যাডামের ক্লাসে।
রাত ১ টা ৪৫ বাজে। ভাইয়া একটু আগে তার ঘরের লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে গেলো। অন্ধকার কেটে গেলে ঘোর চলে যায়। আমি তাই আলো জালিয়ে রাখি। সেকেন্ড টাইমার মেডিকেল পরীক্ষার্থীর ঘোর… মানায়না।
[পুনশ্চঃ এখনো আমার এস্কিলাসে ডুব মারা হয়নি, ন্যূনতম সফোক্লিস পড়া আছে। জ্য পিয়েরে ল্যিউ কথা না বলা পর্যন্ত কেন জানি শান্তি পাচ্ছিনা। কবে আমার বালজাক পড়া হবে? কবে? ম্যোপাসা এখনো অবশিষ্ট। ওহ খোদা, আমি কেন এত মূর্খ? পৃথিবীতে যখন পাঠালে তখন আরেকটু আকল আর আরো বেশি সময় কেন দিলেনা? কেন আমি মেসিয়াহ কিংবা মোহাম্মদ নই, কেন আমি ত্রুফো কিংবা লিয়াকত নই? আমি সোহান বলে তাই? জন্মের অলৌকিকতা ধারণ করা যায়, নামের লৌকিকতা? ভাষা-ই প্রকৃত জ্ঞান; জ্ঞান-ই :সময়।
কারেন্ট চলে গেছে। ঝড় উঠেছে। শিলা বৃষ্টি হচ্ছে। মা ঘুমিয়ে আছে। আমি শিল কুড়াবো।]

||এপিসোড ২||
“The sun is the same in the relative way, but you’re older”
নিজেদের ক্ষেতের গম ভেঙে সুজি-আটা বানানো যায়; সেই আটা দিয়ে মা রুটি বানাতে পারে এবং পাকা কলা দিয়ে জড়িয়ে সেই সুজি-আটার রুটি খাওয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে – শান্তি।
৭ এপ্রিল,২০১৬,বৃহস্পতিবার। কোচিঙয়ে ল্যাবরেটরির চ্যাপ্টারের উপর পরীক্ষা ছিল; ৮৩.৫ পেয়েছি; গতবারের সেকেন্ড টাইমারদের তুলনায় কিছুইনা। কোচিং শেষে বন্ধুর বাসায় গেলাম আমার সিনেমাগুলো নামানো হয়েছে ভেবে। শ্র্যাডারের মিশিমা আর আমেরিকান জিগোলো। জিগোলো নেমেছে, মিশিমা নামেনি; পেনড্রাইভ রেখে বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে খেলাম রুটি-কলা আর ময়ামাছ-পুঁইশাকের চচ্চরি।
এপিসোড ২ এ প্রমিথিউস বাউন্ডের থিয়েটার গ্রুপ এপিসোড ১ এর মত আরো একটা নিরীক্ষা চালায় মানবিক সংবেদের গভীরতা নিয়ে। একজন গ্রুপ মেম্বার নিঃশব্দে শুয়ে থাকে, অবশিষ্টরা তাঁকে নিয়ে যা খুশি করে, তাকে চ্যাংদোলা করা, তার শরীরের উপরে উঠে যাওয়াসহ বিক্ষিপ্ত করার নানা কসরত চালায় বাকীরা। তবুও সে বিক্ষিপ্ত হয়না, বরং ধীরে ধীরে এক নির্লিপ্ত মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। সুদীর্ঘ এই নিরীক্ষা শেষে অভ্যাসমত গ্রুপের সব মেম্বার একসাথে বসে নিজেদের নিরীক্ষাকালীন অনুভূতি এবং চিন্তা-ভাবনা ব্যাখা করার চেষ্টা করে। প্রত্যেকেই যার যার মত করে নিজের অনুভূতিকে শব্দে ধরে ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা চালায়। কিছুটা বেরিয়ে আসে, অনেকটা আসেনা। সিনেমা এগোতে থাকে, আমি পিছিয়ে পড়ি।
ছোটবেলা থেকে ভীষণ রকম অনুভূতির অপচয় ঘটে গেছে আমার জীবনে। নিঃশব্দে কত ভালোবাসাকে খুন করেছি প্রথার দায়ে, প্রচলনের ভয়ে। নচি তো বলেছিল “ভালোবাসা আসলেতে একটা চুক্তি জেনো, অনুভূতি টনুভূতি মিথ্যে, কেউ দেবে নিরাপত্তা, কেউ বিশ্বাস, আসলে সবাই চায় জিততে…ভালোবাসা; ভালোবাসা আসলেতে পিটুইটারির খেলা আমরা বোকারা বলি প্রেম!”।
আমি, আমার মা, আমার ভাই- আমরা তো জিততে চাইনি নচি, তাই বুঝি হেরে গেলাম? সেজন্যই বুঝি গর্ভের ঋণ আর ভ্রাতৃত্বের অধিকারকে চুক্তি বানিয়ে দিয়ে কেউ কেউ চলে যেতে পারে? অঞ্জন ঠিক বলেছিল নচি-
“চারটে দেয়াল মানেই নয়তো ঘর
নিজের ঘরেও অনেক মানুষ পর”
হু… আমি রোজ ঝাপসা চোখে শহর দেখি অঞ্জন। চৌহাট্টা থেকে মুন্সীপাড়ার গলি খুব বেশি দূরে নয়; ইয়ারফোনে বিটল্স, ফসিল্স অথবা নগর বাউলকে নিয়ে সহজেই শেষ সিঁড়িতে পৌঁছানো যায়। আল্লারাখার মাস্তানি বুকে নিয়ে কাটানো যায় অগণিত ফ্লিট্উড ম্যাকের রাত্রি। আমি প্রতিদিন ভালোবাসি অঞ্জন,প্রতিদিন পিতার নিকট চেয়ে নিই বিবিধ বৈকল্যের ক্ষমা। আমি বেঁচে থাকি অঞ্জন। আমি বেঁচে থাকি। অনেক ভেঙ্গেচুরে শুরু করি- প্রকৃত সময়ে বেঁচে থাকার কবিতা।
বাবা,
আমি বৃষ্টি দেখেছি।

||এপিসোড ৩||
“নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে, পাহাড় তাকে সয় না”
দুপুর ৩টা বেজে ৪৮ মিনিট। ১১ এপ্রিল, সোমবার। রিভেতের আউট1 শেষে বসে আছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে আট নম্বর এপিসোড শেষ করেছিলাম; তারপর থেকে বসে আছি। মা ও বসে আছে; দুজনে গান শুনছি; মা মাঝে মাঝে কাঁদছে, থামছে, সঞ্চয়িতা পড়ছে, চোখ বুজে শুয়ে থাকছে। আমি লেখছি। ভিভাল্ডি থামিয়ে শিরোনামহীন এর জাহাজি চালু করলাম মায়ের জন্য; -‘হয়না’।
এপিসোড ৩ এ জ্য পিয়েরে ল্যিউ কথা বলে; শান্তি লাগে। ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ থেকেই আমি ভালোবাসি ওকে, উনাকে। ত্রুফো হচ্ছে মুনকার, ল্যিউ নাকির। মা কলা এনে দিল, রিকাবীবাজার থেকে কেনা। এই মুহূর্তে তৃতীয় এপিসোড নিয়ে লিখার জন্য খুব বেশি কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। জড়তা কিংবা ক্লান্তি হবে হয়তো। আসলে, OUT 1 একটা নিখাদ-নিরেট সিনেমা হওয়ার বদলে স্থির অবসর হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। তাই OUT 1 নিয়ে পণ্ডিতি গোছের কিছু লেখার ব্যাপারটা আসলে বাহানা, আমি আদতে আমার কথা লিখতে চাইছি। লিখতে চাইছি প্রকৃত সময়ে বেঁচে থাকার কথা। দ্যা আনবেয়ারেবল লাইট্নেস অব বিয়িং ইন রিয়েল টাইম। OUT 1 ও অন্তত সে কথাই বলে- রিয়েল টাইমে বাঁচার গল্প।
বালজাক পড়া থাকলে নিঃসন্দেহে আউট1 দর্শন আরো অনেক সাবলীল হত। তা বলে OUT 1 কিন্তু দুর্বোধ্য নয়; বরং মনোযোগ দাবী করে। এপিসোড বাই এপিসোডে গড়ে ওঠা সুবিস্তৃত উপন্যাসের মায়া আর ক্রমশ-প্রকাশিত চরিত্রদের বিচিত্র আচরণ OUT 1 কে অবচেতনভাবেই আমার ডেইলি লাইফের অংশ করে তুলেছিল। সিনেমা দেখার থেকে OUT 1 বরং উপন্যাস পড়ার মত কোন কিছু। তারকোভস্কি কি একেই স্কাল্প্টিং ইন টাইম বলতে চেয়েছিল? হবে হয়তো।
অর্থহীন প্রত্যয় আর শব্দাংশ জুড়ে দেওয়াটা মানুষের এক্সপ্রেশনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রিভেতো তেমনি আমাদের অনেক স্বভাবজাত অর্থহীন অভ্যাসের ছবি আঁকে গোটা সিনেমায়। আমাদের সকল অ্যাকশনবিহীন নিঃশব্দ চিন্তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকা, আপন মনে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকা, একা একাই ছোট বাচ্চাদের মত গুলি হাতে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা… এসবই রিভেত ১৬ মিলিমিটারে শ্যুট করে আর আমাদের দেখায়। সাধারণের রঙ মাখা অবাস্তব অনভ্যস্ত চোখ সিনেমাতে সাধারণ জীবনের এত বাস্তব অভ্যস্ত চিত্র দেখার প্রত্যশা করেনা বলেই মনে হয়। নাহলে, আমাদের সিনেমায় আমাদের জীবন কোথায়? যত দিন গেছে সবুজ ধানক্ষেত, জনঅরণ্যের নাগরিক-প্রান্তিক মানুষগুলোর রক্তমাংস-ঘামের জীবনের বদলে নেকুপুশু ‘পেমিক-পেমিকা’ আর অট্টহাসির ‘ভিলেন’রা-ই এই অংশের পর্দার মালিক হয়ে উঠেছে; ‘আলোর মিছিল’ এ অংশ নেওয়া চেতনাদীপ্ত স্বপ্নবাজ সন্তানেরা হারিয়ে গিয়েছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’দের মত। এই যে নিজেদের সিনেমা থেকে আমাদের অসংখ্য না পাওয়ার কথা, প্রজন্মের কাছে প্রতারিত হওয়ার বেদনা- এসবও আসলে বহুউচ্চারিত ক্লিশে কান্না হয়ে উঠেছে। সত্যিটা হল- আমাদের সিংহভাগই পূর্ব-প্রজন্মের বেঈমানির শিকার এবং আমরাও সেই বেঈমানিরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছি।… পুনরাবৃত্তি।
||এপিসোড ৪||
“অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?”
লেখাটা এই এপিসোডেই শেষ করা উচিৎ। ইচ্ছে ছিল প্রতি এপিসোড শেষে ডায়েরির মত লিখবো; মোট আটটা এপিসোড থাকবে; সাথে প্রোলগ, এপিলগ। বেশ জমতো ব্যাপারটা- হলনা। অমন অখণ্ড মনোযোগের অবসর কেবল মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পরেই মিলতে পারে, তার আগে নয়। সুতরাং, আত্মরতির অবসান হোক। যুবক দেহে কৈশোরের সংবেদ আর বার্ধক্যের অশেষ দুঃখবোধ এ আক্রান্ত বাইপোলার তরুণের যেকোন লেখাই একটা বিশেষ দশায় ক্লান্তিকর, অপ্রয়োজনীয় এবং নিরেট পার্সোনাল এক্সপ্রেশনে ভরপুর মনোলগে আক্রান্ত হতে বাধ্য। ফিল্ম-স্কলারও নই, খ্যাতনামা মেকারও নই, নিতান্তই বেঁচে থাকার জন্য দেখি এবং লেখি। সিনেমা করার সেই বুনোবিপ্লবের ছিটেফোঁটাও কাজ করেনা; আমার নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন আর অধিকতর নিম্ন শিক্ষাব্যবস্থা আমাকে অবশ করে দিয়েছে। পুরোপুরি ঘায়েল করতে পারলে এই লেখালেখিও থেমে যাবে; বিদায় নেবে আমার অন্তর্গত রক্তের বিপন্ন সকল বিস্ময়; জীবন্ত কৃমির কাজ সেখানে ফুরায়ে যাবে মাথার ভেতর। তখন হয়তো পাল্টে নেবো ক্ষণে ক্ষণে জীবনানন্দকে ‘কোট’ করার বদভ্যাস।
এপিসোড ৪ প্রথম তিন এপিসোডের মতই স্বভাবে-আকারে। তবে এপিসোড ৫ থেকেই OUT 1 বেশ রহস্যময় এবং গতিশীল হয়ে ওঠে। মোটামুটি মেজর-ননমেজর সবগুলো চরিত্রই আমাদের সামনে চলে আসে এই এপিসোডে। এরপর বাকী থাকে গল্প বলা। এই গপ্পো বলার দায়টাকেই বেশ মুখ্য মনে করেন অধিকাংশ শিল্পী এবং শিল্প-ভোক্তারা। তবে রিভেতের মত, কাফকার মত, জীবনানন্দের ন্যায়, মরিসনের মত কিছু সংখ্যালঘু আউটসাইডার আছেন বটে। এরা অসম্ভব বিদ্যুৎচমকে গল্প বলেও নিপাট গল্প-বলিয়ে নন। এরা স্বয়ম্ভূ-স্বাধীন-স্বতন্ত্র। আর তাই, কাল যত গড়িয়েছে ইনাদের শিল্পও স্থায়ী হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে বহুমাত্রিকতায়; ডায়ালেক্টে; ডিস্কোর্সে। ডিস্কোর্স শব্দটার সাথে সাথেই বেশ একটা দুষ্টু হাসি ফুটে উঠেছে আমার মুখে। ফেসবুকের মহাপণ্ডিত নিওলিবারাল বুদ্ধিজীবী সমাজের বদৌলতে যেসব শব্দ তাদের সমূহ গুরুত্ব হারিয়েছে তার একটা হল- ডিস্কোর্স। যাকগে, সে এক অন্য গল্প; আমি ছোট, ওসব বললে পাপ হবে। অতএব; কাট টু-সিনেমা।
সিনেমা কেন দেখি?- আসলে সিনেমা দেখার থেকেও বেশি যেটা করি সেটা হল সিনেমায় বাঁচি। বিক্ষিপ্ত হওয়ার মত, বিক্ষুব্ধ হওয়ার মত অসংখ্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, দেশীয়-বৈশ্বিক ফেনোমেনা স্বত্বেও সিনেমা আমাকে একটা তারে বসা পাখির মত মরে গিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে; এস্কেপিস্ট আমি এবং আউটসাইডার। চিলেকোঠার সেপাই আমি। সিনেমা আমার বর্ডারবিহীন বিশ্বভ্রমণের পাসপোর্ট। ওয়েটিং ফর গডো; -বিপ্লবের প্রতীক্ষায়।
রিভেতের OUT1 কে এই লেখায় ধরতে পারবোনা জেনেও লিখতে বসেছিলাম। শুধু যে সিন্থেসিস, এনালাইসিস ই করতে হবে অমন দিব্যি কে দিয়েছে? এই যে আমি একটা মানুষ বেঁচে আছি, মা কে ভালোবাসছি, এস্কেপ করছি, আউটসাইডার হবার বিপ্লব করছি- সেটাই কি একটা আশ্চর্য নয়? আমার আগেও আমি জানি আমি ছিলাম, আমার পরেও জানি আমি আসবো। আমাদের ভিড়ে আমরা আমি হয়ে থাকবো। বিপ্লব আসুক, সাম্য আসুক- কল্যাণকর, মহৎ সকল শুভ’র আগমন হোক। সিনেমা, ভালো থেকো। ভালো থেকো পরিচিত অপরিচিত সকল কবি এবং কৃষক; -আমি কোনটাই হতে পারিনি। একাকীত্বের বিবশ বিষাদে বিচ্ছিন্ন হবার অপরাধে আমি বরাবর দণ্ডিত; এটাই আমার অপরাধ ও শাস্তি।
ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।
[এপ্রিল ২০১৬, সিলেট]
[ সাব্বির পারভেজ সোহান – কবিতা আর সিনেমা ভালবাসেন। সিলেট থাকেন। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ]