‘বাংলাদেশের হৃদয়’ : প্রামাণ্যচিত্র-নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের সাক্ষাৎকার

 

1

বাংলাদেশের বিভিন্ন সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে তৈরি ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল অটোয়ার এক থিয়েটারে। তার ভিতর একটা ছবি, ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ অন্যভাবে চোখে পড়ে। শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি। ছবিটির নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল থিয়েটারে উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ওনার সাথে দীর্ঘ আলাপ হয়। –মেসবা আলম অর্ঘ্য (ফেব্রুয়ারি, ২০১8)

 

শাহবাগ নিয়েই শুরু করা যাক। আপনি তো পুরা সময়টা উপস্থিত ছিলেন…

এটার শুরু তো হইসে ওই কাদের মোল্লার বিচার নিয়েই। কিন্তু আসলে তো এই তরুণ প্রজন্ম আরো অনেক কিছুই চায়। অনেক পরিবর্তন, নতুন চিন্তা, ইত্যাদির প্ল্যাটফর্মের মতো মনে হইসে শাহবাগকে। বিচারটাই চাইসে। কিন্তু সাথে সাথে আরো অনেক কিছু মিলে একটা কোরাস হইয়া গেছে। ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই ছিল – ওইটাকে সামনে রেখে পিছনে কিন্তু অনেক ছোট ছোট কাজ দানা বাঁধতে শুরু করসিলো। কিন্তু কথা এইটাই যে, এটা এই মুহূর্তে স্থায়ী কিছু না। এইটা এখন আপনাকে কোনো দিক-নির্দেশনাও দিবে না। লাভ হচ্ছে ছোট ছোট লাভ। ওই লাভগুলা পরের জন্য জমা থাকবে। মানুষ অন্যভাবে চিন্তা করতে শুরু করসে। মানুষ শক্তির নমুনা দেখসে। সংহতির নমুনা দেখসে। এবং এগুলা মানুষরে উদ্বুদ্ধ করবে। শাহবাগরে আমরা যদি শুধু বিচার, শুধু কাদের মোল্লা— এইসবে ফেলে রাখি তাইলে তো হবে না।

2

রশিদ তালুকদারের ছবিটা দেখাইছেন ফিল্মে। তার সাথে হৃদয় নামের ওই বাচ্চাটার একটা যোগাযোগ তৈরি করার চেষ্টা ছিল যেন?

ঊনসত্তরের ওই ছবিটা – ওই যে একটা বাচ্চা মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে – অনেক পোস্টারে-টোস্টারে দেখি আমরা। আমরা জানি যে, ঊনসত্তরে একটা ব্যাপক গণআন্দোলন হইছিলো, তখন বাচ্চাটার এই ছবিটা তোলা হইছিলো। কেউ যদি আরেকটু কিউরিয়াস হয় তাহলে জানবে যে বাচ্চাটা, রশিদ তালুকদারের এই ফোটোগ্রাফির পরেই গুলি খাইয়া মারা যায়। তো, আমার ফিল্মের এই ক্যারেকটার যে ‘হৃদয়’ – তার মতো এরকম অনেক মানুষের সাথে অনেক মানুষের পরিচয় হইসে এই শাহবাগের কারণে। যেটা কিনা অন্য কোনো সুযোগে এভাবে হইতে পারে নাই।

কীরকম?  

শাহবাগে এই ইয়াং পোলাপানগুলা যখন এসে ওই ‘রুমী স্কোয়াড’ করে, ‘জাহানারা ঈমাম স্কোয়াড’ করে – ওরা দেশকে ভালবাসার, দেশের জন্য কিছু চিন্তা করার একটা অদ্ভুত রকম উপলক্ষ্য পায়। তারা মনে করে আমিও তো কিছু করতে পারি। রাদার… মানে… আপনার এই ইউনিভার্সিটিতে পড়া, গেম খেলা, ফিল্ম দেখা, প্রেম করা, বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করা – এগুলো ছাড়াও তো অন্য কিছুও করা যায় যেসবে আমরা আগে কখনো এই ছেলেমেয়েদেরকে যুক্ত করতে পারি নাই। ৪২ বছরের একটা বড় ফাঁক থাইকা গেছে। শাহবাগটা সেটা মিলাইছে। শাহবাগ চিনাইছে একটা হৃদয়কে আঠার-ঊনিশ বছরের কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা তরুণের সাথে। তখন তাদের একজনের আরেকজনরে জানার একটা উপলক্ষ্য তৈরি হইসে। যেইটা ঊনসত্তরের ওই ছেলেটার প্রসঙ্গে কেউ চিন্তাও করে নাই হয়তো বা। খালি ছবিই দেখসি আমরা। কিন্তু ওই বাচ্চার জীবনটা কী ছিল, ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী ছিল জানার উপায় নাই।

আবার কাকতালীয় ভাবে, খুবই মজার একটা ব্যাপার ঘটসে যখন শাহবাগের বিপরীতে হেফাজতে ইসলামের একটা ইয়া হয়। হেফাজত হইলো মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের, অর্থাৎ একটা শিক্ষা ব্যবস্থার পোলাপান। আবার এখানকার শাহবাগের তরুণরা মোটামুটি ভাবে, ওই জিন্স-ফতুয়া পড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ঢাকার আশ পাশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদেশেও যেইটা হইসে – মূলত ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মধ্যে হইসে।

তো শাহবাগ এই উপলক্ষ্যটাও দেয় যে, ওই যে হৃদয় – হৃদয়ের ভিতরে যদি আমরা খুঁজতে যাই – দেখা যাবে – ওই দশ বছরের ছেলেটা জানে না সে ভবিষ্যতে মাদ্রাসায় যাবে না প্রথাগত কোনো স্কুলিঙে যাবে – বা আদৌ কোনো শিক্ষা তার হবে কিনা। কিন্তু হৃদয় আবার তার মুক্তি খুঁইজা পায় শাহবাগেই। খুবই সাদামাটা মা-বাবার ছেলে। বাবা একটা জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। মা বাড়িতে কাজের বুয়া। একদমই বিত্তহীন বলতে যা বোঝায় – একটা প্রান্তিক ফ্যামিলি।

ওই কায়েতটুলী ছোট্ট টিনের ছাপড়ার বাচ্চাটা যখন কয়েক মাইল দূরে শাহবাগ চত্বরে আসে ঘটনাচক্রে, তার কাছে মনে হয় এইটাই তার মুক্তি। কেন বলতেছি মুক্তি – কারণ তার বাবা তারে শেকলবন্দী করে। সে বাড়িতে থাকলে তারে বাবার জুতার দোকানে ফুট-ফরমাইস খাটতে হয়। খাবার নিয়ে যাইতে হয় ছোটচাচার জন্য ফ্যাক্টরিতে। তার বাবা চিন্তা করতেছে এই ছেলেকে ভবিষ্যতে হয়তো মাদ্রাসায় দিয়ে দিবে, বা ফুটফরমাইস খাটাবে। তো ওই বাচ্চাটা, তার বাবার শাসনের জন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, অবচেতনে এই ভবিষ্যৎ কামনা করে না। ঘটনাচক্রে সে যখন শাহবাগ আসে, তখন তার কাছে মনে হয় এটাই মুক্তি। এবং এই মুক্তি সে বার বার পাইতে চায়।

আবার এই শহরেরই আরেক প্রান্তে, এই দশ বছরের হৃদয়েরই সাত-আট বছরের পরের হৃদয়গুলিও তো আছে। মানে, হ্যাঁ – শাহবাগ যেহেতু এদের সবার মিলিত হবারও উপলক্ষ্য দেয়, আমি তখন আর শাহবাগকে শুধু ওই বিচারের মধ্যে আটকায় দেখতে পারি না। আমি জানি এই বিচার একদিন নিশ্চয়ই হবে। নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধ যারা করসেন তাদের উপযুক্ত শাস্তি হবে। কিন্তু শাহবাগ কি শুধু এইটুকুই? মনে হয় না।

হৃদয়রে খুঁইজা পাইলেন কীভাবে?

3
হৃদয়

হৃদয় তো রুমি স্কোয়াডের সামনে ঘুমাইতো। এই বাচ্চাটা, অনেক পথশিশুর মতোই একটা পথশিশু। কিন্তু ওর গল্পটা আমরা ছবি করতে করতে জানলাম। সবার খুব আনন্দের কারণ হইছিলো এই বাচ্চাটা। এবং সবাই ওরে ডাকতো – ওই হৃদয় এদিক আয়, ওদিক আয় – আমাদের সাথে ঘুমা। আমি দেখসি ফেসবুকে রুমি স্কোয়াডের একটা ছবিতে ও এক ছেলের সাথে শুইয়া রইছে। তো এই ছবিটা দেইখা আমার কাছে মনে হইসে যে – এই ছেলেটা, নট নেসেসারিলি, বাট হইতে পারে, যে, যেই ছেলেটার পাশে হৃদয় শুয়ে আছে সে হয়তো কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির, সোনার চামচ মুখে জন্মানো একটা ছেলে।

এই হৃদয়কে যখন খুঁজে পাওয়া গেল, জানলাম যে তার মা গৃহপরিচারিকা। মনে হইলো, কে জানে, হয়তো তার মা ওই সোনার চামচ মুখে জন্মানো ছেলেটার বাসাতেই কাজ করে। শাহবাগ এই দুইটা ছেলেকে পাশাপাশি এনে শোয়ায় দিসে রাতের বেলা। এইটা অনেক বড় জিনিস।

আমি হৃদয়রে যেদিন পাইলাম, রুমি স্কোয়াডের অনশন ভাঙার দিন – ওরা সেদিন প্রচণ্ড রকমের হতাশ ছিল। চার-পাঁচদিন টানা অনশনে ছিল। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিছিলো, প্রচণ্ড ইমোশনাল। তারপরে অনশন ভাঙার দিন ভোরবেলা… রাস্তার মধ্যে পাখি ডাকতেছে, নিরিবিলি ফুটপাথে শুয়ে আছে ছেলেমেয়েগুলি। এরা কীসের নেশায়, কীসের মোহে, কীসের সুখে যে শুইয়া আছে এখানে! অনশন ভাঙ্গার পরেও ওখানেই বসে থাকলো। ক্লান্ত। এই কয়দিন অনশনের ধকল, তাও বইসাই থাকলো। সকাল হচ্ছে, দিনের আলো ফুটতেছে, রাস্তাঘাট সচল হচ্ছে আবার। তো, এইরকম একটা পরিস্থিতিতে, ওইখানে হৃদয় বড় একটা লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে দৌড়ায় বেড়াচ্ছিল ওই সকালবেলা। আমার কাছে মনে হইসে যে এখানে এই দশ বছরের হৃদয়ের সাথে, কোনোদিন মিছিলে যেই যুবক যায় নাই, প্রেমিকার টেলিফোন নিয়ে যে ব্যস্ত থাকসে – সবাই একাকার। তখন মনে হইসে আমরা এই যে বৈষম্যহীন এক সমাজের কথা, কোনো অলীক এক জিনিসের কথা বলি, কল্পনা করি, চাই, আমার কাছে মনে হইসে – আজকের এই সকালটা তো সেই বৈষম্যহীনতার সকালই।

সেদিনই প্রথম স্ট্রাইক করলো যে হৃদয়ই আপনার মুভির মেইন চরিত্র?

ওই সকালেই। মানে, আমি তো ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতেছি। আমি বুঝতেছি বড় একটা কিছু ঘটছে। আমার এখানে থাকতে হবে। এই নিয়ে যে আমি ছবি করবো ভাবি নাই। ইচ্ছা ছিল কোনো একদিন হবে। তবে ওই সময় ফিল্ম টিল্মের কথা মাথায় আসে নাই। আমার কাছে মনে হইসে বাংলাদেশে এরকম ঘটনা আমি আগে দেখি নাই। নব্বইয়ের সময় আমি কানাডা ছিলাম। দূর থেকে দেখসি। এইবার একদম ভেতর থেকে দেখলাম।

মানে আপনি ওই সময় শাহবাগের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ আসছিলেন?

না। আমি অন্য একটা ছবির শুটিঙের জন্য বাংলদেশে ছিলাম আগে থেকেই। চার বছর ধরে করছি অন্য আরেকটা ছবি। একটু বাকি ছিল। খুলনার রামপালের ভিতরে একটা জায়গা – সুন্দরবনের কাছে – চিংড়ি ঘের – মানুষ – পানি – লবণ – চাষে সমস্যা – ইত্যাদি নিয়ে একটা ছবি বানাইতেছি চার বছর ধরে। ওইটাই কাজ আমার। ডকুমেন্টারি বানাই।

কতদিন ধরে ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন?

ডকুমেন্টারি আমি প্রথম করি ১৯৯৬-৯৭ সালে। আমার প্রথম কাজ, মানে সেই অর্থে পূর্ণাঙ্গ কাজ করি ২০০৫ সালে – ‘বিশ্বাসের রঙ’(Color of Faith) – ওইটা আমার প্রথম অফিশিয়াল ফিচার ডকুমেন্টারি।

প্রামাণ্যচিত্র – এই মাধ্যমটা নিয়ে কিছু বলেন

ধরেন, একটা মানুষ ক্যামেরা দিয়ে একটা অন্য ধরণের বাস্তবতাকে দেখানোর চেষ্টা করে। খোলা চোখে কিন্তু অনেক কিছুই আমরা দেখি, আবার দেখি না, মিস করে যাই। ধরেন একটা কবিতায়– অদ্ভুত কিছু লাইন লিখলাম, অদ্ভুত কিছু উপমা দিলাম, শব্দের ইয়ে করলাম – ছবিটাও কিন্তু অনেকটা ওই রকমই। আগে অনেক কিছু নিয়ে কাজ করতে হইতো, কিন্তু এখন যা হইসে, এখন টেকনলজিটা এরকম একটা পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গেছে যে ক্যামেরাটা আসলেই এখন একটা কলম হইসে, একটা দূরবীন হইসে, একটা চোখ হইসে।

এখন তো সব ডিজিটাল। ছবি তোলাও ডিজিটাল, ডিস্ট্রিবিউশন, প্রজেকশন সবই ডিজিটাল। এখন ধরেন ইন্টারনেটে দশটা-দশটা শো বিক্রি হয়। কোনো হার্ড কপি নাই। সবাই খুব সহজভাবে এখন যুক্ত হতে পারে। সো, এখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিং অনেক সোজা হয়ে গেছে। সবাই এখন খুব সহজ ভাবে শুরু করতে পারে পারসনাল লেভেল থেকে – অর্থাৎ ডকুমেন্টারি থেকে। এইটা এক রকমের হাত পাকানোর স্টেপ। তবে আমি ডকুমেন্টারিটাকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। কারণ বাংলাদেশে এই মাধ্যমটারে ব্যবহার করে অনেক কিছু বলার আছে। বাংলাদেশের অনেক রকমের কথা, অনেক রকমের ছবি, সারা দুনিয়ার সাথে শেয়ার করার আছে।

এখন আমি চিন্তা করলাম – একটা বাণিজ্যিক ধারার ফিকশন ছবি বানাইলে ওইটার যে আয়োজন দরকার তা আমার নাই। আমাদের পৃথিবীতে হলিউড আছে, বলিউড আছে, যা চলে বাজারে। তার চেয়ে বেশি কিছু আমি দিতে পারবো না। কিন্তু আমি কী পারবো? আমি হয়তো একটা ডকুমেন্টারি বানাতে পারবো। ডকুমেন্টারির যেই মঞ্চগুলি আছে পৃথিবীতে- সবখানে আমি সদম্ভে হাজির হইতে পারবো। আর বাংলাদেশের মানুষের জীবনের যে ব্যাপারগুলি– মানে চমৎকার একটা জীবনযাপন, হাজার বিভীষিকার মধ্যেও অদ্ভুত একটা ছন্দ। মানে এইটা হয়তো সবখানেই আছে। কিন্তু যেহেতু আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি এইসব দেখসি। এখানে অনেক রকমের গল্প আছে যেগুলি বাইরের মানুষের সাথে শেয়ার করলে মানুষ অবাক হয়ে যায়!

বাংলাদেশের সিনেমায় মেইনস্ট্রিম আর বিকল্পধারার জায়গাগুলা কেমন? 

আমাদের মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা এখনো খুবই প্রাথমিক অবস্থায় আছি। টেকনিক্যালিটির দিক থেকে, হলিউড বলিউডের তুলনায়। আমরা চাইলেই বড় রকমের কিছু করতে পারবো না। কিন্তু আমি যেহেতু ক্রিয়েটিভ একটা দিক থেকে চিন্তা করি, আমি ভাবলাম – রাদার দ্যান ফিকশন, আমি ডকুমেন্টারিই করবো। আর আপনি বাংলাদেশে চাইলেই একটা প্রিটি ফিল্ম বানাইতে পারবেন না। কারণ সামাজিক প্রেক্ষাপট যেরকম – আপনি কখনোই এর থেকে বের হতে পারবেন না। বের হতে চাইলে সেইটা একটা নাই-দুনিয়ার গল্প হয়ে যাবে। তো আমি নাই-দুনিয়ার গল্প কাহাতক নিবো? মানে, খুব পপুলার কিছু কথা আছে যে, সারাদিন এত কষ্ট করার পর আমি

4
‘বাংলাদেশের হৃদয়’ শুটিংদৃশ্য

ফিল্মে কেন কষ্ট দেখবো আবার ইত্যাদি। কিন্তু আমি যেই ডকুমেন্টারি বানাই, আমি জীবনের অনেক চমৎকার জিনিস দেখাইতে চাই। মানে, ধরেন এই হৃদয়ের গল্পটাই যদি বলি – শাহবাগ চিন্তা করলেই প্রথমে কী আসে – এই রাজাকার, ফাঁসি, আস্তিক-নাস্তিক, হেফাজত – এই ধরনের কথাগুলিই আসে কিন্তু। যেগুলি আমরা মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে দেখসি – টক শো, নিউজ, পত্রিকা এইসবে।

তো আমার কাছে এক সময় মনে হইসে আমার ছবি তুলতে হবে। আমি ফিল্ম বানাবো নট নেসেসারিলি, বাট আমার সময়টাকে ধরে রাখতে হবে। দশ বিশ পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশের ইতিহাস যখন প্লেব্যাক করা হবে, তখন হয়তো এই ফুটেজগুলি কাজে লাগবে। আমার কাছে মনে হইছিলো এই কাজ আমার করে রেখে যাওয়া উচিত। তো আমি যখন ছবি বানাইছি তখন সকাল বিকাল এই যে ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি, আর সন্ধ্যা হইলেই মশাল মিছিল, আর এক সময় তো এইটা হইয়া গেল পুরা বৈশাখি মেলার মতো – বেলুন আসতেছে, এইটা আসতেছে, সেইটা আসতেছে। আমি কিন্তু শাহবাগের অন্য আরেকটা স্পিরিট ফিল করসিলাম। আমি সেই স্পিরিটের গোড়াটা খোঁজা শুরু করি। আমার কাছে মনে হইছিলো শাহবাগে যেন আরো কিছু আছে। মানে আমি ভিজুয়ালি অনেক কিছুই দেখসি। এই মাথায় ব্যান্ডেনা বেন্ধে, বাংলাদেশের পতাকা বেন্ধে ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই – এইটার বাইরেও শাহবাগ যেন আরো কিছু দাবী করে। এই সাত আট দশ জন মানুষের বিচার হইতে আর কয়দিন লাগবে? এইটা হবেই। পেছনে ফেরার আর কিছু নাই। কিন্তু আমি খুঁজসি এরচে বড়ো আরেকটা শাহবাগ।

আর আমি তো বাংলাদেশে একটা পাখির মতো ছিলাম। দেশে সবারই একটা সেট ব্যাপার আছে – চাকরি আছে সংসার আছে। আমার তো সেরকম কিছু ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই হৃদয় ছাড়াও কিন্তু আরো অনেক পথশিশু আছে যারা ফুল বিক্রি করে। তো আমার এই একটা ব্যাকপ্যাক, ব্যাকপ্যাকে কিছু রুমাল বান্ধা – এরকম ভাবসাব দেখে ওই পথশিশুদের অনেকে আমার পিছে পিছে ঘুরতো । ওদের সাথে আমার সকাল যায় দুপুর যায়। আমি তো একদমই একটা ঘুরে বেড়ানো পাখি ছিলাম। যদিও আমার একটা ছোটোখাটো স্টুডিওর মত ছিল দিলু রোডে, আমি পুরাটা সময়ই শাহবাগের ওই এলাকায় দিনে রাতে সকালে বিকালে থাকার কারণে ওই বাচ্চারা আমার সাথে জুটে ছিল। তো হৃদয়রে দেখে ঊনসত্তরের ওই বাচ্চাটার কথা মনে পড়ার পর এই একটু জানতে চাওয়া, ছেলটা কই থাকে, তার বাপ মা কে সে কোত্থেকে আসছে কোথায় যাবে – এইসব দেখতে চাওয়া থেকেই ছবির সূত্রপাত। বটম লাইন হইলো, শাহবাগ বাংলাদেশের মানুষদের নতুন করে দেখার, তাদের বুঝার একটা নতুন চোখ।

ছবিটার প্রচার হলো কীভাবে?

ছবি তো খুব পাওয়ারফুল একটা মিডিয়াম। একটা ছবির একটা ফ্রেম যত কথা বলতে পারে, মানুষের নেয়ার ক্ষমতা, শিক্ষা দীক্ষা ইত্যাদি বিবেচনা করলে অন্য অনেক মাধ্যমই সেইটা পারে না। আবার ধরেন, মানুষের ছবি ঘরে এসে পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে নিজের তাগিদে ছবি দেখা হলো এক রকমের ছবি দেখা। আরেক রকমের ছবি দেখা হইলো মানুষের কাছে ছবিকে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে এই ধারাটা শুরু করসিলেন তারেক মাসুদ। উনি নিজেকে বলতেন সিনেমার ফেরিওলা। আমরা চিনি তাঁকে। তিনি তাই বলতেন। সিনেমাকে তিনি মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। আমরা যারা তাঁর পরবর্তী জেনারেশন, অনুসারীই বলি, ওনার ওই ছবির ফেরি করা ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেও আছে। শর্টফিল্ম ফোরাম আন্দোলনের শুরু থেকেই। মেইনস্ট্রিম ছবিঘরের বাইরে পাবলিক লাইব্রেরিতে এবং জেলা শহরগুলিতে গিয়ে গিয়ে ছবি দেখানোর কাজটা এই ফোরামই শুরু করে।

শাহবাগের ছবিগুলি আমাদের মনে হইছিলো জনমানুষের ছবি, জনমানুষের কাছে যাওয়ার ছবি। আমরা যখন শাহবাগকে এযাবৎ কালের সর্ববৃহৎ একটা ডকুমেন্টেড আন্দোলন বললাম, চিন্তা করলাম ইমিডিয়েটলি এই ডকুমেন্টেশন থেকে কিছু ছবি তৈরী করে শো করা যায় কিনা। এত ছবি তোলা হইসে, লেখা হইসে, গান হইসে – তো এই যে আমরা ছবি তুলতেছি, যেহেতু ছবি খুব পাওয়ারফুল একটা জিনিস, তখন – যখন শাহবাগকে খুবই চিহ্নিত করা হচ্ছে নাস্তিকতা, বেলেল্লাপনার উৎস এই-সেই হিসাবে, রাজীব মারা যাওয়ার পর – এপ্রিলের দিকে আমরা ভাবলাম আমরা কিছু ছবি করবো। এইভাবে তৈরি হইলো নয়টা ছবি, যার ভিতর ছয়টা আপনি গতকাল দেখসেন অটোয়াতে। প্রত্যেকটা ছবিই অদ্ভুত রকম মানবিক হইসে।

ধরেন টেলিভিশন, এখন বাণিজ্যিক কারণে হোক, রাজনৈতিক কারণে হোক – শাহবাগের একটা স্টেরিওটিপিক্যাল ইমেজ ক্রিয়েট করে। তাদের বিশাল ক্রেন-ট্রেন লাগাইয়া রিপোর্টিং-টিপোর্টিং করে, মানে ‘শাহবাগ’ বস্তুটা টোটালি টেলিভিশন বাক্সের আলোচনা তর্কাতর্কির এন্টারটেইনমেন্ট হয়া গেছিলো। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়ায় মানুষের জীবনকে দেখা, মানবিক ভাবে দেখার ওই ব্যাপারটা আমাদের ফিল্মের মধ্যে দিয়ে তখন আবিষ্কৃত হয়। এই যে “তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি” যখন স্লোগান উঠতেছে, তখন একটা পাহাড়ি ছেলে এসে বলতেছে “হাজন মার্মা বাঙালি” – সে তার নিজের দাবীটাও নিয়ে আসতেছে। যদিও সে তখন ভয় পাচ্ছে যে, সে তো এখান থেকে এক্সক্লুডেড হয়ে যাচ্ছে। তার এই দাবীটা শুনে মঞ্চ থেকে ওরাও তখন বলার চেষ্টা করতেছে “আদীবাসী বাঙালি” ইত্যাদি। নানাবিধভাবে অরগ্যানিক একটা ব্যাপার। তখনই আমরা বুঝে যাই এই ছবি নিয়ে বাইর হইয়া পড়তে হবে। আর বাইর হইয়া পড়ার আরেকটা কারণ হইলো শাহবাগকে নিয়ে মিসকনসেপশন, ভুল বোঝাবোঝি। ওই সময় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটা আনস্টেবল, কনফিউজড অবস্থায় চলে যাচ্ছে। আমরা তখন বেশ কিছু শহরে শো করি। কিছু কিছু জায়গায় খুব কষ্টও হয়।

5
শাহবাগের এক মধ্যরাতে জামায়াতের ডাকা হরতালের বিরুদ্ধে মশাল মিছিলের প্রক্কালে সতীর্থদের সাথে আলাপরত অবস্থায়

সিরাজগঞ্জের রিমোট একটা জায়গায়, আমাদের এক বন্ধুর খুব পরিচিত, সে নিজেও চলচ্চিত্রকর্মী, বললো চইলা আসেন। আমরা চলে গেলাম। আমরা জানতাম না ঐটা কার নির্বাচনী এলাকা ইত্যাদি। আমি তো শুরুতে খুবই রোমান্টিক একটা ইয়ে নিয়ে গেছিলাম। পরে দেখলাম, আমি আমার বাংলাদেশ আর সিরাজগঞ্জের এই প্রত্যন্ত গ্রামটার বাংলাদেশ মিলাইতে পারতেছি না।

ওরা প্রথমে তো মাঠের মধ্যে পর্দা দেখে ভাবসিল সিনেমা দেখবে। কিন্তু যেই শুনলো ‘শাহবাগ’, সেই বললো দেখবে না। সিনেমা মানেই তাদের কাছে এন্টারটেইনমেন্ট – গান বাজনা নাচ। আমরা কিন্তু সেগুলি কিছুই দেখাচ্ছি না। কিন্তু ওই গান বাজনা নাচ বিনোদন হয়তো নিতে পারতো, কিন্তু শাহবাগের ‘হৃদয়ের’ গল্প তারা নিতে পারবে না। ছবিতে যখনই তারা শাহবাগের ইমেজগুলি দেখা শুরু করল, তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে হইলো – সিরাজগঞ্জের এরা যেন ওই মতিঝিলে হেফাজতিদেরই অংশ। আমি তো অন্যরকম একটা আশা নিয়া গেছি, আমরা বুঝতেই পারি নাই এই রকম একটা অবস্থার ভিতর আমাদের পড়তে হবে।

যাই হোক। স্থানীয় সরকারের ইনফরমেশন মিনিস্ট্রি যে ছোটখাটো ফিল্ম দেখায় লোকাল অফিস থেকে, তাদের প্রজেক্টর নিয়ে গেছিলাম আমরা। সরকারি একটা গাড়ি ছিল। দুইজন লোকাল অফিসার ছিল। তো, তারাও অবাক হয়ে বললো ‘শাহবাগ’ কেন দেখাবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমরা কিছুটা প্রটেকশন পাইছিলাম। এর মধ্যেই ইট পাটকেল আসা শুরু করে।

আমাদের ভিতর কেন যেন একটা জেদ চাইপা যায়। আমরা বলতে থাকি যে, ভাই দেখেন দেখেন আপনেরা। খারাপ হইলে বলেন খারাপ, কিন্তু তাও দেখেন। তো কিছু মানুষ দেখলেন – কিছু বয়স্ক এবং কিছু বাচ্চাকাচ্চা, আর বাকীরা চলে গেলেন। হেফাজতিদের যা যা স্লোগান ছিল, দূর থেকে সেরকম স্লোগান দেওয়া শুরু করলেন। এবং মজার ব্যাপার – ছবির সেকেন্ড হাফে যখন মতিঝিল শাপলা চত্তরের হেফাজতের ইমেজগুলি আসা শুরু করলো, যেখানে ওরা বলছে যে “নাস্তিক মুর্তাদদের ফাঁসি হইতে হবে”, তখন ওই প্রজেকটরের সামনে থেকে উঠে যাওয়া, কিন্তু একটু দূরে দাঁড়াইয়া থাকা স্থানীয় মানুষগুলিও চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন যে এই নাস্তিকদের ফাঁসি হইতে হবে।

ওনারা চলে যাওয়ার পরে, যখন ছবি দেখানো শেষ, তখন যাদের প্রজেক্টর – সেই সরকারী অফিসাররাও বেশ বিরক্ত। পরে তাদের সাথে আমরা কিছুটা পথ পার হই। ওখানে একটা রেলস্টেশন আছে, জাতীয় চার-নেতার একজনের নামে- শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্টেশন। আমরা অন্ধকারে, প্রচণ্ড গরম ওইদিন, কাপড়চোপড়গুলি জামাটামাগুলি হালকা করে ফেলি, প্যান্ট গুটায় ব্যাগগুলি একটু সাইডে রেখে, গ্রামের মানুষের মত করে বসে থাকি, ট্রেন আসা পর্যন্ত।

এই ব্যাপারটা কেন হল? মানে, শাহবাগ আন্দোলন কি তাহলে একটা ঢাকা-কেন্দ্রিক ব্যাপারই?  

দেখেন, ঢাকায় আমাদের যে সাজানো গোছানো একটা জীবন, এর একটু বাইরে, পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা গ্রামে, মফস্বলের একটা টাউনে, ওই ছেলেটা বিকালে লুঙ্গি পরে বের হয়। ওর একটা শার্ট, বড়জোর দুইটা শার্ট হয়তো। ওর হয়তো ইন্টারনেটেরও একসেস নাই। ও টিভিতে দেখে যে ঢাকায় জীবন অনেক রঙিন, অনেক চকমকা। কিন্তু ও না পারে ঢাকায় আসতে, না ওর জীবন সেরকম। ও চায় কিন্তু। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ওইটা জুটে না।

এই বেয়াল্লিশ বছরের বাংলাদেশে হয়তো ঢাকা শহরটা এলোমেলো ভাবে বাড়সে, কিন্তু পুরা বাংলাদেশ কিন্তু ঢাকার মতো এইরকম কইরা বাড়ে নাই। ঢাকার এই আধুনিকতা, এই সো-কল্ড প্রগতি অগ্রগতি, এগুলা কিন্তু ঢাকার বাইরে নাই। তো ওই প্রান্তিক ছেলেমেয়েগুলির মনের মধ্যে কিন্তু ক্ষোভ থাকে। ওরা একসেপ্ট করতে পারে না, মিশতে পারে না ঢাকার ছেলেমেয়েদের সাথে। আমার ফিল্মে আছে – গ্রামে একটা স্কুল থাকলে পাঁচটা মাদ্রাসা থাকে। তাহলে নিশ্চয়ই স্কুলে যে পরিমাণ ছেলেমেয়ে যায় মাদ্রাসায় তার চাইতে বেশি ছেলেমেয়ে যায়? তো ওদের ভিতর কিন্তু একটা কমপ্লেক্স কাজ করে। ওই টিভিতে দেখা, বিলবোর্ডে দেখা একটা সো-কল্ড আধুনিকতা ওরাও চায় কিন্তু। ওদের কাছে ওই এক্সেসটা নাই দেখে… যেমন হৃদয়ের একটা চয়েস আছে দেইখা সে শাহবাগে দৌড় দিয়া আইসা পলায়, বাপের হাতে মাইর খায় তারপরেও পলায়। তো ওই গ্রামের ছেলেমেয়েগুলির কিন্তু সেই এক্সেসটা নাই।

সিরাজগঞ্জে শো দেখাইতে গিয়া আমরা নিজেরাই রিয়ালাইজ করি যে, এই যে আমরা যাদের কাছে ফিল্ম দেখাইতে গেছি – তারা ওই গ্রামের ওই অলস দুপুরে বাঁশের কঞ্চির বেঞ্চিতে বসে ষোলগুটি খেলে। ওই ছেলেপেলেরা মনে করে যে, তোমরা শহরের পোলাপাইনরা অনেক ফরচুনেট, তোমরা  বড় শহরে থাকো, অনেক কায়দা কানুন করো। তো ওদের যখন সুযোগ হয় তখন ওরা ঠিকই চেপে ধরতে চায়। এইটা এক রকমের ক্ষোভের কারণেও হইতে পারে। ক্ষোভ মানে ওরা একসেপ্ট করে না। একটা মানসিক দূরত্বের কারণে।

আমাদের বাংলাদেশ তো ধরেন, এমনই মিক্সড একটা ব্যাপার – মসজিদে আজান হয়, নামাজ পড়ে যেরকম, আবার পালাগানে দৌড় দেয়। মানে ওই গরুর গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে কখনো বলে আল্লাহর নামে হেইও, কখনো রসুলের নাম বলে, আবার কখনো পালাগানের ইয়েও করে, মানে অদ্ভুত এক মিক্স…

ধর্ম, লোকধর্ম এই ব্যাপারগুলারে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার আগে মানুষ কিন্তু খুবই সরল সোজা ভাবে দুইটা নিয়েই চলত বা চলে। ওই যাপনটা প্রকটভাবে হতাশা আনে যখন তারা দেখে যে এক শ্রেণির মানুষ খুব বেশি সুযোগ নিয়ে শহরে এক রকমের আইসোলেটেড জীবন যাপন করে, আর সেগুলা টেলিভিশন ইন্টারনেট গান-বাজনা এইসবের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়ায়। ওদের কিন্তু এইসব প্রভোক করে। এই যে বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন – এইসব কিন্তু ওই পর্যন্ত পৌঁছাইসে, মানে গ্রামে ধানক্ষেতের উপরে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড –  ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ থেকে শুরু করে। তো, ওরা তো দেখতেছে ওই চেহারা সুরৎ, ওই স্টাইল। ওদের কাছে তো ওইগুলি পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু ওরা নিজেরা পইরা আছে লুঙ্গি পাঞ্জাবি। ওরা তার থেকে কতদূর বের হতে পারে? তো এখন যখন ওই চেহারা সুরতের মানুষজন শাহবাগ শাহবাগ করে, তাদেরকে ওরা একসেপ্ট করে না। এক শ্রেণির মানুষ হয়তো করে, যারা পোলাপান, ছাত্র ইত্যাদি। কিন্তু আমি দেখসি – যে গ্রামে একটা বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনযাপনের অবস্থা কিন্তু আলাদা।

মানে, এই একসেপ্ট যে করে না, তার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক আদতে নাই

মানে ওইটা মিলা যায়। তখন ওরা মনে করে শাহাবাগীরা উচ্ছন্নে গেছে, ওরা ধর্মহীন, ইত্যাদি। মানে ক্ষোভটারে তো বাইর করতে হবে। গ্রামের মানুষ তো যুক্তিবানের মতো বলবে না এইটা করপোরেট, এইটা রাষ্ট্র, এইটা আগ্রাসন, এইটা এই, ওইটা ওই। আমাদের দেশের বাম রাজনীতির চর্চাও অতদূর পৌছায় নাই। ওখানে হুজুর আছে, মাদ্রাসা আছে, মসজিদ আছে। গ্রামের ওই মাতব্বর আছে। ওই টাউটটা আছে হয়তো। তখন ধর্মের সাথে ওরা এইসব মিলায় ফেলে। হয়তো গ্রামের হুজুর সেইদিন খুৎবাতে একটা কথা বইলা দিছে। পরদিন দুইটা ছেলে নামাজ পড়ে এসে বলতেছে এইটা তো ঠিক না, এইটা বিধর্মী। এই কারণেই গ্রামগঞ্জ থেকে যে মানুষ আসা শুরু করছিলো শাহবাগে, সেই চিত্রটা পরে বদলায় গেলো। রাজীবকে মেরে ফেলার পরে, ওই নাস্তিক ব্যাপার-স্যাপারগুলি যখন প্রকাশ করা শুরু করসে – মানুষ যেহেতু খুবই সাধারণ একটা ইয়েতে বুঝতে চায় – তো তখন – এই যে শুরু হইলো – শাহবাগে নেশা হয়, জুয়া হয়, মদ হয়, সেক্স হয়, নারী পুরুষের এই হয় সেই হয় – নানানরকম চুড়ান্ত কথাবার্তা শুরু হইলো। ধরেন, আমি জাগরণের গ্রুপ হিসাবে না, ফিল্মমেকার হিসাবে আমার ছবির কাজে গেছি ঢাকার বাইরে নারায়নগঞ্জ পার হয়ে, শীতলক্ষা পার হয়ে। তখন ওই গামছা মাথায়, ধরেন, ঢাকার পোলাপাইনের এখন একটা স্টাইল, যে গামছা থাকে মাথায় – তো এই গেটাপ টেটাপের পোলাপান দেখলেই নৌকা পার হইতে গেলেও শুনসি লোকে বলাবলি করতেছে এই যে শাহবাগী। “শাহবাগী” শব্দটা তখন একটা গালির মতো।

ঢাকা শহরের বাইরে গেলেই তো চিত্রটা অন্যরকম। এখনো গ্রাম গ্রামই রইছে। তো পার্থক্যটা বুঝা যায়। চারুকলায় পড়া একটা মেয়ে বা একটা ছেলে, সে ধরেন ফিল্ম বানায়, একটা ডিএসেলার ক্যামেরা নিয়ে ফটোগ্রাফি করে, বা নাটক করে, বা গান করে, বা ধরেন সে পড়ালেখাই করে – সে হয়তো একটু বিজ্ঞানমনস্ক – হয়তো জাফর ইকবাল ভালো পায়। এই ছেলেপেলেদের দেখলেই কিন্তু আলাদা করে ফেলা যায়। মানে পৃথিবীর সাথে তাদের যোগাযোগ আছে। ছবিতে কিন্তু এই কথাগুলিই আসছে। মানে আমি এইভাবে বললে পরে ছবি দেখলে হয়তো মানুষ উদাহরণগুলি পাবে।

6
অটোয়াতে, ‘আমাদের ছবি’ শুরুর প্রক্কালে

অন্য জায়গায়তেও তো আপনারা শো দেখাইসেন…

হ্যাঁ, এরপর আমরা আরো কিছু শহরে যাই। খুলনা, নারায়নগঞ্জ। তারপর ঢাকা শহরের বেশ কিছু জায়গায়। ওইসব জায়গায় স্থানীয় আয়োজকরা ছিলেন, সব ঠিকঠাক ছিল। এই ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের এক বছর পূর্তীতে জাদুঘরের সামনে রাস্তায় আবার দেখানো হইসে। আর উত্তর আমেরিকায় – নিউ ইয়র্কে দেখাইলাম গত ১৬ই ডিসেম্বরে। শাহবাগের বর্ষপূর্তী উপলক্ষ্যে অটোয়াতে দেখাইলাম।

আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভাবে ছয়জনের ছবি মিলায় এই শো গুলার নাম দিছি ‘আমাদের ছবি’। আরো কিছু ফিল্ম তৈরি হচ্ছে। অন্যান্যরা নির্মাণ করছেন, যা ভবিষ্যতে ‘আমাদের ছবির’ গ্রুপ শোতে যুক্ত হবে।

আপনার সাথে অন্যান্য যারা ফিল্ম বানাইলেন, ওনারা কারা?  

এখানে নানাবিধ সেক্টরের মানুষ আছে, কাজ করে। আমাদের রেশমী যে, সে এক্টিভিষ্ট, ফিল্ম মেকার ডকুমেন্টারি ফিল্ম কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিল। মোল্লা সাগর ফ্রিল্যান্সার, ফোটগ্রাফার, আর্টিস্ট, ফিলম মেকার। আমি ডেডিকেটেড ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার, গত বার-চোদ্দ বছর ধরে। তারপর আমাদের ইয়াং দুই তিনজন আছে – নাট্যকর্মী, গায়ক, সাইফুল ইসলাম জার্নাল – খুবই তরুণ। একটা চলচিত্র পুরষ্কার পাইছেন উনি। মোবাইল ফোন দিয়ে তোলা ‘স্টে ইন টাচ’ নামের একটা ছবির জন্য। তারপর একটা মেয়ে আছে জার্নালিস্ট, এক্টিভিস্ট নূসরাত খান। সে প্রথম শাহবাগ প্রোমোর মত একটা জিনিস বানাছিলো যেইটা রাস্তায় রাস্তায় দেখানো হতো। মাহাবুবুর রহমান আছেন একজন, বাংলাদেশে খুবই প্রথিতযশা শিল্পী, নানান মিডিয়াতে কাজ করেন। ভিডিও মাধ্যমেও কাজ করছেন সমান তালে।

‘আমাদের ছবি’ তে প্রদর্শিত প্রামাণ্যচিত্র :

১. জয়েন দ্যা ফাইট: নূসরাত খান
২. গনদাবী: সাইফুল ইসলাম জার্নাল
৩. মাই বোথ হ্যান্ড: মাহাবুবুর রহমান
৪. বাংলাদেশের হৃদয়: সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল
৫. আমার প্রতিবাদ: রেশমী আহমেদ
৬. জয় বাংলা: মোল্লা সাগর


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s