রিডিং প্রোভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ অব দীপেশ চক্রবর্তী: পর্ব ২ – ইলিয়াছ কামাল রিসাত

জগদীশ গুপ্তের ‘চন্দ্র-সূর্য যতদিন’ এবং দীপেশ এর ‘শূন্যস্থান পূরণ’ (পর্ব ২)

১। 

জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬ - ১৯৫৭)
জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬ – ১৯৫৭)

জগদীশ গুপ্তের গল্প পড়ছি গত কয়েক দিন ধরে। অনেক ভাললাগা একজন সাম্প্রতিক কবি পিয়াস মজিদ ভাইয়া এবং কলেজ জীবনের ক্যারিশমাটিক সাহিত্যের শিক্ষক সামসুল আলমের কাছ থেকে শুনেছি তাঁর কথাসাহিত্যে নাকি শুধু তৎকালীন বাঙালি জীবনের সামাজিক সমস্যাগুলিই ফুটে উঠেনি বরং মানস চরিত্রের গভীর অন্তরাত্মা নিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়েছেঃ শুনেই তো আরেক কাণ্ডারি জীবনানন্দের কথা মনে হতে লাগল। অতঃপর পড়া শুরু করলাম।

আবদুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায় সেই শ্রেষ্ঠ গল্প বইয়ের প্রথম দুই লাইন পড়েই বুঝলাম ‘আমি তাহাকে ঠিক পাইয়াছি, বটে’। আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখছেন –

“আজকের যে অর্থে জীবনানন্দ দাশকে প্রথম আধুনিক কবি বলা হয়, সেই আজকের অর্থেই প্রথম আধুনিক গল্পকার জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। দুজনই এমন অভিনব আধুনিকতা এনেছিলেন যে, জীবদ্দশায় দুজনকেই অনেকখানি আচ্ছাদিত-অস্বীকৃত থাকতে হয়”।

কথা বলছি, তাঁর ‘চন্দ্র-সূর্য যতদিন’ গল্পটা নিয়ে। সহজ ভাবে গল্পটা এমন – দীনতারণ নামক এক হিন্দু দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তার প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকা অবস্থায়ই। এবং সেই দ্বিতীয় স্ত্রী হল প্রথম স্ত্রীর ছোট বোন। বড় বোন ক্ষণপ্রভা’র বয়স ১৯, ছোট বোন প্রফুল্ল’র বয়স ১৫। প্রথম স্ত্রী ক্ষণপ্রভা একটি পুত্রসন্তানও জন্ম দিয়েছে এর মধ্যে।

গল্পের ছলে এটুক আমরা জানতে পারি যে, দীনতারণের শ্বশুর মশাই তার অঢেল সম্পত্তি এদিক ওদিক যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তাই এক ঘরেই দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সম্পত্তির বংশানুক্রমিক ধারাটা নির্ভেজাল রাখতে চাইলেন। অপরদিকে সম্পত্তির লোভ আর নিশ্চিত ভবিষ্যত এর সুযোগ কোন রকম হাতছাড়া না করে শ্বশুরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল দীনতারণ।

ড্রামা’র শুরু এর পরেই। মায়ের পেটের বোন প্রফুল্লকে তার ভালবাসা ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধে মনে মনে শাপান্ত করতে লাগল বড় বোন ক্ষণপ্রভা। নিজের মনের মধ্যে চলতে থাকল নানা রকম যুদ্ধ। এই পুরো ঘটনাকে ক্ষণপ্রভা বিচার করল তার বয়সের বুড়িয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে।

এই লেখার স্বার্থে জগদীশের লেখকগত অবস্থানটা গল্পের কয়েক লাইন দিয়ে প্রকাশ করে দিচ্ছিঃ

‘ক্ষণপ্রভার বয়স উনিশ।

কী কারণে কে জানে, মানুষে এক হুজুগ তুলিয়া দিয়াছে যে মেয়েমানুষ কুড়ি পেরুলেই বুড়ি।

কথাটা কোন প্রকারেই সত্য নয়। মানুষের দুষ্ট কল্পনা যে কতদূর বেয়াদবি করিতে পারে, এটা তাহারই নিদর্শন।

যদি এমন কেহ থাকে যে কথাটা বিশ্বাস করে না তাহাকে দিয়া আপাতত এ-গল্পের প্রয়োজন নাই; যাহারা বিশ্বাস করে তাহাদেরই একজনের কথা বলি-

সে ক্ষণপ্রভা’।

গল্প, শ্রেষ্ঠ
গল্প, শ্রেষ্ঠ

বয়সের এই ‘দুষ্ট’ ধারণার কাছে মানসিক ভাবে হার মেনে নিয়ে সে তার বোন প্রফুল্ল’র কাছে নিজের সুপিরিয়রিটি দাবি করে তার মাতৃত্বের ব্যাপারটা নিয়ে। সে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে, মাতৃত্বের স্বাদ নিয়ে সে দিব্যি উচ্চাসনে অবস্থান করছে। সুতরাং প্রফুল্ল’র সাথে মনের লড়াইয়ে সে নিজেকে আপাতত এগিয়ে রাখছে।

এভাবে জগদীশ নানা মোচড় দিয়ে গল্প এগিয়ে নিতে থাকেন। একটা মুহূর্ত হাজির হয় যখন স্বামী দীনতারণ তার ইচ্ছা প্রকাশ করে প্রফুল্ল’র গর্ভে সন্তান ধারণের।

সেই অনাকাঙ্খিত মানবিক সংসারের জন্য ক্ষণপ্রভা’র সেলফ-আইডিয়ালাইজড ‘মন’ একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা।

এবার শেষ দৃশ্যে প্রবেশ করছি। যে রাতে দীনতারণ-প্রফুল্ল মিলন হয়েছে বলে সে মনে করে সে রাতেই শিশু ছেলেকে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে পড়ে ক্ষণপ্রভা। সারারাত খুঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেলনা।

অবশেষে-

‘ভোরবেলা একজন তাহাকে ধরিয়া আনিয়া হাজির করিয়া দিয়া মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল, সবাই মুখ ফিরাইল। এখন সে নগ্নদেহ—

সম্পূর্ণ উন্মাদ; কিন্তু ছেলেটি বুকে আছেই’।

গল্পটা একটু মনযোগ দিয়ে পড়লেই দেখা যায়, ক্ষণপ্রভা তার শরীর কেন্দ্রিক বা উৎসারিত বয়স বিচারে এবং সন্তান বাৎসল্যে নিজের জীবন তার স্বামীর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এই কারণে উন্মাদিনী হয় নাই। সে যখন উন্মাদিনী হইল তার কিঞ্চিত আগেই সে বুঝে গেছে প্রফুল্লের ‘অদৃষ্টও তো তাহারই মত’ যে কিনা ঊর্ণনাভের (মাকড়সা) তন্তুকেই প্রেমের বন্ধন বলিয়া ভুল করিতেছে’।

এক দিকে ক্ষণপ্রভার কাছে এই নিয়তি শাসিত সমাজ কাঠামোর নির্মমতা স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার। অন্য দিকে সে এও বুঝে গেছে এ নিয়তি শাসিত কালেক্টিভ মাইন্ড ভাঙার ক্ষমতা অন্তত তার হাতে নেই।

২। 

প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইয়োরোপের মলাট
প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইয়োরোপের মলাট

সোশ্যাল জাস্টিস-এর প্রসঙ্গটা এখানে দীপেশ চক্রবর্তী’র History 2-এর ভাগ্য বরণ করেছে। History 2 বলতে দীপেশ কি বুঝাচ্ছেন তা পরের অন্য একটি পর্বে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। উন্মাদ হয়ে যাবে, কিন্তু নগ্ন হলেও সত্য যে, এই যে বাংলার সমাজ কাঠামোয় পারিবারিক অতীত কাঠামো এমন আষ্টেপৃষ্ঠে আছে যে enlightenment শাসিত সমাজের ‘আইনের শাসন’ এই নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত সমাজে প্রবেশ করতে পারেনা। বা প্রবেশ করতে গিয়ে ‘ডিসঅর্ডার’ তৈরি করে, উন্মাদিনীর মত।

বাংলার যে রেনেসাঁসকে আমরা বুঝে থাকি, মানে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র এবং সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র সেইসব তথাকথিত আলোকায়নের কাল নিয়ে দীপেশ আমাদের সামনে হাজির করছেন ভিন্ন ভিন্ন বয়ানের দৃষ্টান্ত। দুইভাগে ভাগ করে নেইঃ নারী’র মুক্তি বুঝার ক্ষেত্রে।

রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র এবং অন্য গ্রুপে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। ১ম দুই জনের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন এবং বিধবা বিবাহ আন্দোলনে শেষমেষ প্রাধান্য পায় নারীর বঞ্চিত তরুণী-শরীরের উচ্ছ্বলতা’র প্রতি করুণা। যা পারিবারিক বিশুদ্ধতা কাঠামোর নিগড়ে বন্দি, নিষ্পেষিত।

আবার রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র যে নারীর আইডিয়ালাইজড ফিগার দাঁড় করান, তা শরীরের নিগড় উতরে অন্য এক সুপিরিয়র মাইন্ড লেভেলে প্রবেশ করে। নারী সেখানে পবিত্রতার অন্য এক আসনে হাজির হয়। দীপেশের ভাষায় –

“Purity or Pabitrata emerges in Bengali fiction as a set of techniques of interiority, the use of which could make one’s innermost emotions (such as love) “pure” and thus help them transcend anything that was external to the subject’s interior space—the body, interests, social conventions and prejudices.”

এই সাহিত্যিক ‘পবিত্রতা’র নারীকে দীপেশ এভাবে চিত্রায়িত করছেন – ‘the category of pabitrata, tied to an idealization of kinship and the patriarchal extended family, obviated the emergence of a category such as ‘sexuality’ that could have mediated physical and psychological aspects of sexual attraction.’

রামমোহন-ঈশ্বরদের কাছে নারীর শরীরটা করুণার পাত্র আবার সাহিত্যিকগণের কাছে ‘শরীর’ হল marginal।

দুইয়ের মাঝামাঝি এনকাউন্টার কোথাও হাজির হচ্ছেনা। মডার্ণ সাবজেক্ট এই বঙ্গীয় কনটেক্সট-এ আলোচনা করতে গিয়ে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ এবং শেষমেষ কল্যাণি দত্তের ‘বৈধব্য কাহিনী’র অবতারণা করছেন কারা বলছে এই নারী মুক্তি বা নারীর সাবজেক্টিভিটির কথা? বা একে কারা কিভাবে রিপ্রেজেন্ট করছে?

এই রিপ্রেজেন্টেশনে বারবার family, kinship – এসব ভারতবর্ষীয় ব্যাপারগুলি এসে তথাকথিত ‘ইউরোপীয় মডার্ন সাবজেক্ট’-এর সাথে পুরোপুরি মিলমিশ খাচ্ছেনা বুঝাতে চাইছেন।

লেখার প্রথম দিকে জগদীশ গুপ্তের গল্পটার অবতারণা করেছি, কারণ দীপেশের কথিত ‘ক্রাইসিস’ বা মিলমিশের ফাঁড়াটা হয়তো তিনি অসাধারণ ভাবে রূপায়িত করেছেন।

দীপেশকে এভাবে খণ্ডিত ভাবে ব্যাখ্যা করার কারণে অনেকে হয়তো বেশ ‘নিয়তিবাদী’ বলে উঠতে পারেন! কিন্তু নির্মম সত্যটা নির্মম ভাবেই বলাটা বুদ্ধিজীবিতা। এর রাজনীতি সব দিক উন্মোচন করে। এবং দীপেশের আরও মূল বিষয় নিয়ে সামনে আলোচনা হবে। (চলবে)

[পর্ব ১-এর লিংক। বাসে যান্ত্রিক কলকব্জা বিকল থাকায় প্রায় এক বৎসর আগের দেয়া লেখাটা, প্রকাশ করা গেলো।  – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ]


ক্লিক - শান্ত মহাসেন
ক্লিক – শান্ত মহাসেন

[ইলিয়াছ কামাল রিসাত : সিনেমাখোর, প্রবন্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষ করে বর্তমানে চাকুরিরত।  – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ] 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s