অনাহূত – ইউসুফ হিরণ

(এর আগে এই বড় গল্পটি কিস্তিতে আপলোড দেয়া হচ্ছিল, পাঠকের সুবিধার্থে পুরো গল্পটি একটি পোস্টে দেয়া হল। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ)

অনাহূত

আলিফ

মোজাম্মেল যখন হাতে পায়ে গলায় সুতা পেঁচাচ্ছিল তখন কেউ দেখে নাই। সবুজ সুতায় সে তার হাতের কব্জি থেকে কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত শক্ত করে পেঁচিয়ে বাঁধল। কায়ান মেয়েদের গলার পিতলের কুণ্ডলীর মত তার সমস্ত টুটি জুড়ে সবুজ সুতার শক্ত কুণ্ডলী। হাটুর নীচ পর্যন্ত একইভাবে। ব্যাপারটা এমন না যে সে জানে না যে কি করছে, সে খুব ভালো মতনই জানে। সে এও জানে যে লোকে তাকে বদ্ধ উন্মাদ বা লালসালু গোছের কিছু ভাবতে পারে। কিন্তু তাতে তার কোন আফসোস নেই। ভাবুক না, তাতে কি আসে যায়? সহী মৌলবাদীর মত আর সব লোকের বিশ্বাস ভাবনায় নির্বিকারই থাকে বলে আমাদের ইশারা দেয় সে। মনে করি, সে স্বপ্নের ভিতর দিয়েই যাচ্ছিল, অনেক চেষ্টা করেও সে তার হাত দুটোকে থামাতে পারে নাই। এ কথা ভুলেও তার সামনে বলবেন না যেন, সে তার হাত থামাতে চায় নাই। সে জেগে উঠার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে বলে আপনারা মনে করছেন, কিন্তু সে জানে যে সে ঘুমিয়ে নাই। সুতার প্রত্যেকটা পাকে সে যন্ত্রণা অনুভব করছিল, কিছু জায়গা কেটেও গেছে। সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। আমরা চাইলে আড়ি পেতে শুনতে পারি। তাকে কেউ তো তখন দেখে নাই, কিন্তু তারপরও আমরা ফিসফিস কথাগুলা শুনতে পারি। চৌকোণ ফোঁকল দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখে যে কারো চোখ ছলছল করতে পারে; কলজে শুকিয়ে যাওয়া দুপুরে তার চোখ ভিজে যাওয়ায় সে কিছুটা আশ্চর্য হয়। নাহ, যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছু না, অনেক আনন্দ নিয়েই সে কাজটা করছে। তবে আমাদের খুব জানতে ইচ্ছা করে তার অতীত ও বর্তমানের বিচ্ছেদের এই চোখ ধাঁধানো মুহূর্তে সে কি ভাবছে, কেমন অনুভব করছে। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলল নাকি খুঁজে পেল, এই ভাবনায় আমরা নিমজ্জিত হতে পারি।

মোজাম্মেলের কোনকিছুতেই উচ্ছ্বাসের অভাব ছিল না। তাবলীগিদের এখন গাট্টিওয়ালা বললেও সে কোন একদিন বাবরী চুল নিয়ে হাজির হয়েছিল বাসায়। টিভি দেখা বন্ধ, টিভির সামনের লাল পর্দা আর কেউ উঠাবার সাহস পায় না। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের আগে সেও বাড়ি বাড়ি ঘুরে রীতিমত জোরজবরদস্তি করে ছেলেপেলেদের মসজিদে নিয়ে যায়। তার বাপ বা মা তাকে কি করতে বলল বা কি না করতে বলল তাতে সে কোনদিন কর্নপাত করেছে বলে কেউ মনে করতে পারবে না। কিন্তু আর সব লোককে সে না বলতে পারে নাই। ওই না বলতে গেলে কেন জানি অনেক হিসেব নিকেশ করতে হয়, এর চেয়ে বরং হ্যাঁ বললে কেমন জানি হালকা হালকা লাগে। যখন তার বন্ধু তাকে তাবলীগে যাওয়ার কথা বলল সে এক বাক্যেই রাজি হয়ে গেল। বাসায় কেউ জানে না সে কোথায়, তিনমাস পর সুন্নতি লেবাস নিয়ে সে হাজির। বেন্দা শাহ হওয়ার আগে সে তাবলীগি ছিল, তার আগে ছিল পাংক। তারপর দেখা যায় সে পুরোদমে ন্যাচারালিস্ট হয়ে যায়, সুতো বাঁধা আর মুখে কালি মাখার সাথে সাথে তার চুল দাঁড়ি গোঁফ আর ভদ্রলোকরা যেটাকে বলে পাবলিক হেয়ার সেটাকেও আপন বৃদ্ধিতে ছেড়ে দেয়।

ব্যাপারটা খুব একটা সহজ হয় না তার জন্য। মোজাম্মেল আনন্দপাড়ার জন্য বিছুটিপাতার মত হয়ে দাঁড়ায়। ইমাম সাহবের যেমন আপত্তি আছে তাকে নিয়ে, আপত্তি আছে দেওয়ানবাগী মুরিদ জাকির মিয়ার, ঠিকাদার, ইশকুলের মাস্টার, সর্দারেরাসহ আরো অনেকের। ইমাম সাহেব মোজাম্মেলকে তার শৈশব থেকেই চিনে; মাসে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে মোজাম্মেলের কায়দা পাঠের হাতেখড়ি ইমাম সাহেবের কাছেই। বেশ কিছুদিন যখন মোজাম্মেল তার পায়জামা ছাড়াই শুধুমাত্র কালো পাঞ্জাবী গায়ে রাস্তায় তার লাঠি হাতে আসমান জমিনের ব্যবধান ঘুচাচ্ছিল, তখন কোন একদিন ইমাম সাহব মোজাম্মেলের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় মৃদু বিদ্রুপের শিকার হয়। মোজাম্মেল ইমাম সাহবকে বলে, কি মিয়া দোজখরে ডরাও? ইমাম সাহেব ব্যাপারটা আর সব গণ্যমান্যরে জানায়। জাকির মিয়াও মোজাম্মেলের মায়ের কাছে এসে বলে যে, জাকির মিয়ার পীরবাবারে নিয়া মোজাম্মেল আজেবাজে কথা বলেছে- দোকানদার বা ওইরকম কিছু একটা বলেছে। অনেকে এলাকার শ্রীহানির অভিযোগ আনে। মোজাম্মেল ওই বেশ কিছুটা দিন শেষে কি জানি মনে করে পায়জামা তার নিম্নাঙ্গের পরশে নিয়ে আসে।

বাসার গেইটের সামনে রাস্তায় মোটা লাঠি হাতে মোজাম্মেলকে দেখে কানু মিয়া জিজ্ঞেস করে, কি মিয়া এই লাঠি কোনখান থেইকা নিয়া আসলা?

মুদি দোকানদার কানু মিয়ারে এলাকার লোকজন তাকে গরুগাড়িওয়ালার পুত বইলা ডাকলেও সে এখন বেশ টাকাকড়ির মালিক। আগে আশেপাশে সব ছিল ধানক্ষেত। কম পয়সার এই জমি গুলো নগরায়নের প্রভাবে বিস্তর দাম পায়। সেও বেশ ভাল জমির মালিক। আগে দোকানদারির সাথে সাথে চাষবাস করত। জমির দাম বিস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সে জমি কিছু বিক্রি করে এখন পাঁচতলা বাড়ির মালিক। দোকানদারিটা এমনিতেই করে। মোজাম্মেল কানু মিয়ার কথায় পাত্তা দেয় না। সে কিছুক্ষণ রাস্তায় লাঠি আঘাত করে তার খুপড়িটাতে চলে যায়।

তারমানে এগুলা কিছুই তুমি বিশ্বাস করো না? মোজাম্মেল বিড়িটা একবার মুখে নিয়েই আধেক শেষ করে টকটকে লাল চোখে তাহেরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসিটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল। সচরাচর এমন আখাম্বা মনে হয় সে দেখে নাই। তার এই একটা ব্যাপার, সে কখনো চোখ নামিয়ে কথা বলে না। তার চোখে কর্তৃত্বের আভাস জ্বলজ্বল করতে থাকে, যতক্ষণ না অপরজন চোখ নামাবে সে তাকিয়েই থাকবে উদভ্রান্ত খুনির মতন। তখন হৃদস্পন্দন বেড়ে গলা পর্যন্ত ঠেকে।

ভর দুপুরে যখন রাস্তায় ভেজা মরীচিকা ভেসে উঠে মোজাম্মেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার স্বভাব ভঙ্গিতে একটানা পাকা রাস্তায় বিরতিহীন লাঠির আঘাত করে। চোখে মুখে কোন অভিব্যক্তি তখন তার থাকে না। এই রাস্তায় তো হাজার হাজার লোক প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে। সবাই একবার করে তার দিকে তাকায়। পুরান পাগলের ভাত নাই আবার নতুন পাগল, কেউ তামাশা করে বলে। কেউ বা করুণার একটা চাহনি দেয় – আহা। মাঝে মাঝে এলাকায় যখন পুলিশ টহল দেয়, এক দুইজন অতি উৎসাহে এগিয়ে এসে বলে, বাইড়াইয়া পাগলামি ছাগলামি সব ছুটাইয়ালামু। কিন্তু মোজাম্মেলের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হয় না। তামাশার আলাপটা হয়ত তার কান পর্যন্ত পৌছায় না, পৌঁছালেও হয়ত পাত্তা দেয় না। তাদের ভীতি আর সাহসী বচনের অদ্ভুত মিশ্রণটা সে উপভোগ করে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশের হয়ত মনে হয় সে কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে, কিছু একটা যা কেউ দেখার কথা না, তেমন কিছু একটা। তারা হম্বিতম্বি করে চলে যায়। এমনই এক দুপুরে সে তার ঘরে বসে আছে, তাহের চৌকাঠের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে।

আচ্ছা আমারে বলবা তুমি কি বিশ্বাস করো? তুই একটা ভন্ড। হাতের লাঠি একনাগাড়ে মেঝেতে আঘাত করে সে। রাজদণ্ডের মত তার লাঠিতে ঐশ্বরিকতা বা তেমন কিছু ভর করে। এই লাঠিই তার হয়ে জিকিরের কাজ করে, কখনো লানত দেয়। তার লাঠি দুনিয়া আর বেহেশতের মাঝামাঝি থাকে। এইটারে আলিফ বলতেও এলাকার লোকজনে শুনেছে। আলিফ, যেখান থেকে দুইনিয়ার সবকিছু সকল কোণ থেকে দেখা যায়, ভানটিজ। এই রকম কিছু একটাই হতে পারে। তাবৎ দুনিয়া এইটার শাসনে চলে আসে, বা খোদ দুনিয়া এখানে আত্মপ্রকাশ করে; দুনিয়া আলিফের ভিতর বা আলিফ দুনিয়ার ভিতর। গত পাঁচ-ছয়দিন সে সিঁড়ি ঘরে ঘুমিয়েছে। ডানহাতে একটা জখম আছে। পুঁজ বের হচ্ছে তা থেকে। মলম ওষুধের বালাই তার নাই। শীর্ণ দূর্বল হাতে সে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। লাঠির নীচের ধুলো রুষ্ট হয়ে উড়তে থাকে।

তোমারে বলি নাই। এটা অন্য কাউরে বলছি। সে সান্ত্বনা দেয়।

কারে বলছেন? আশেপাশে আর কেউ তো নাই। তাহের বিরক্ত হয়।

সেইটা তুমি বুঝবা না। আচ্ছা যেটা তোমারে বলতেছিলাম, তুমি তো কিছুই বিশ্বাস করো না। তাইলে, আমার সাথে যে ফালতু তর্ক করতে আসলা সেটা কি জন্য? মানে আমারে কিছু একটা বুঝাইতে তো আইছ। দেখো আমি কিন্তু পাগল না। আমি দোকানের বাকির খাতার হিসাবটা নিজেই করি। দাঁড়াইয়া আছো কেন, বসো। চা খাইবা? দুধ নাই, রঙ চা? আচ্ছা কিছু বলা লাগব না, আমি বানাইয়া লইয়া আইতেছি। সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করেই সে চা বানাতে চুলোর কাছে গেল। একটা রুমে ছোট দেয়াল তুলে রান্নাঘর, টয়লেট আর থাকার জায়গা। একটা রুমই, টয়লেটে কোন দরজা নাই। বিছানা বলতে ইট, সিমেন্ট দিয়ে রুমের এক কোণায় উঁচু করে দেয়া, সেটাতে তোষক আর নোংরা চাদর। বোটকা গন্ধে নাক চেপে ধরতে ইচ্ছা করে। তাহেরের সাহস হয় না।

সে একচুমুকেই গনগনে তপ্ত এককাপ চা গিলে ফেলল, দুই বা তিন সেকেন্ড। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো কালো পাঞ্জাবী, পাজামা আর কনভার্স ধরণের শু পায়ে কালি মাখা বদনের মোজাম্মেলকে অনেকেই দেখেছে জিভ পুড়ে যাওয়ার মত উত্তপ্ত চা এক চুমুকে খেয়ে নিতে । তাহের অবাক না হওয়ার ভান করে। সে যে অবাক হয়েছে সেটা বুঝানো যাবে না, যদি তাকে পেয়ে বসে!

কাল নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার সাথে আমার দেখা হইছে। সে আমার কাছে আইছিল। দুইজন একসাথেই চা খাইলাম। সে যাওয়ার সময় আমারে দশটা টাকা দিয়া গেছে। এই যে টাকাটা। তাহের টাকাটা হাতে নিয়ে আবার ফেরত দেয়।

আমি জানি তোমার এয়াকিনে আইতেছে না। এত বছর আগে মইরা যাওয়া লোক আমার সাথে কিভাবে আইয়া দেখা করে। কিন্তু সে আইছিল, আমরা চা বিড়ি খাইছি। সে নিজেই নিজের পরিচয় দিছিল আর আমি দেইখাই চিন্নালাইছি।

মৃত কুতুবেরা তার সাথে প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ করে। সে শহর কুতুব। ডাবল মার্ডার কেইসের আসামী আবদুলও হয়ত মনে করে- ভাইয়ের মধ্যে একটা জিনিস আছে, আপনেরা পরিবারের লোকজন সেইটা বুঝনে না কিন্তু আমি বুঝি। তারে তার মত থাকতে দেন। প্রত্যেক যুগে একজন কইরা কুতুব আসে। বুঝলেন, আপনের ভাই হইল শহর কুতুব। তার লগে উপরওয়ালার কানেকশন আছে, নইলে এমনে একটা মানুষ থাকতে পারে না, এমনে থাকতে কার ভাল লাগে! আপনে পারবেন থাকতে? পারবেন না। তার মধ্যে কিছু একটা আছে, সেইটা আমরা বুঝি না।

তার প্রয়োজন এই শহরের আছে, সে না থাকলে এই শহর থাকবে না। মোজাম্মেল যেমন তা দাবি করে, আবদুল বা আরো অন্য কেউ সে দাবি জোরদার করে। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ মানুষ যখন জিভের ডগায় প্রাণ আটকে বলে যে সে আর বাঁচবে না, তখন মোজাম্মেল ঘাম আর ধুলোয় লেপ্টে থাকা একরঙা কালো পাঞ্জাবি গায়ে সারা শহর হেঁটে বেড়ায়। লোকে যখন কড়া রোদ্দুরের দাহ থেকে একটু বাঁচার জন্য পারলে নিজের ছায়ায় নিজেই আশ্রয় নেয়, মোজাম্মেল ঠিক তার বিপরীত সূত্র ধরে তার সাদা চামড়াকে তামাটে থেকে আরো তামাটে করে। শহরের সব পয়েন্টে সে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে আসে, কারণ সে শহর কুতুব। একদিনও সে তার ডিউটিতে গাফলতি করে নাই। এই তো কয়দিন আগেও নাকি কুতুবেরা বৈরাগ্য সাধনে পাহাড় জঙ্গলে আশ্রয় নিত। পাহাড় আর জঙ্গল এখন তার শহরে দাওয়াতি মেহমান। তার জন্ম দূর পাহাড় জঙ্গলে হবে না। বাদামের খোসার মত ছোট কামরায় সে অনন্ততার সন্ধানে নামে- মোজাম্মেল ও একাকিত্ব।

কাল তুমি দেখলাম শফিক মিয়ারে দেইখা সালাম দিলা। সেইটা কি জন্যে দিলা? মোজাম্মেলের গলায় বড্ড বিতৃষ্ণা।

মুরুব্বী মানুষ তাই সালাম দিছি। এটা তেমন কিছু না। তাহের কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।

উত্তরটা মোজাম্মেলের মন মত হয় না। এলাকায় তো আরো মুরুব্বী আছে। তাদের তো দেও না। শফিক মিয়ারেই দিলা। কেন? সে সর্দার বইলা?

নাহ, তেমন কিছু না। আমার সামনে দিয়া হাইটা যাইতেছিল। আমার দিকে তাকাইল। মনে হইল একটা সালাম দেই। তাই দিয়া দিলাম।

সে একটা ক্রিমিনাল, সবাই জানে। তুমি লেখাপড়া করা মানুষ। তুমি কেন দিলা? তারে ভয় পাও বইলা? মোজাম্মেল মেঝেতে একদলা থুথু ফালায়, খুব ঘৃণা নিয়া ফালায়।

আপনে আজাইরা প্যাচাইতেছেন। তাহের কপালে বিরক্তির ভাঁজ আরো তীব্র হয়।

দেখ আমি কিন্তু কাউরে ডরাই না। শফিক মিয়া যখন আমার সামনে দিয়া হাইটা যায় আমি হাতের লাঠি দিয়া জোরে জোরে রাস্তায় মারতে থাকি। সে বুঝে মাইরটা যে আমি তারে দেই। আমার এই এক সুবিধা। আমি এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউরে কেয়ার করি না। তোমার আল্লাহ-রাসুল নাই। তুমি ভীতু মানুষ।

সে তাহেরের দিকে লাল চোখে আবার তাকিয়ে রইল। এবারের দৃষ্টিটা অন্যরকম, তাহেরকে বাগে পাওয়ার দৃষ্টি। শফিক মিয়ারে সালাম দেয়াটাতে সে কিছু একটু আবিষ্কার করে যা এতক্ষণ অস্পষ্ট ছিল।

তাহের আমতা আমতা করে, কালো সরের মত একদলা অস্বস্তি জমে তার কপালে। তার কপট সালামে সে তার ইহজাগতিকতা নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়। তাহেরকে সবাই বলতে শুনেছে যে কাউরে চোদার টাইম তার নাই। তাহেরের নৈরাশ্যের মুহুর্তে মোজাম্মেল আচমকা হানা দেয়। শফিক মিয়াকে দেয়া তার সালামকে রিচুয়াল বলে মোজাম্মেলকে আশ্বস্ত করার ব্যার্থ চেষ্টা শেষে আর কিছু না বলে সে বাসার দিকে হাটা শুরু করে। মোজাম্মেল লাঠির ধাক্কায় দরজাটা আস্তে করে ভিরিয়ে দেয়।

 

বেলুন ও ভালবাসা

এই মাগিরে আজকেই মাসের টেকা পয়সা দিয়া বিদায় কইরা দেওন দরকার, মোজাম্মেল গোঁ গোঁ করতে থাকে। বাড়িতে কাজ করতে আসা ছুটা বা বাঁধা মেয়েদের প্রতি তাচ্ছিল্যের কমতি কখনো সে দেখায় না। এই মাগি আমারে দেইখা হাসে, তাই হাসব কিল্লাইগা, আমি কি তাইর হাই লাগি? মোজাম্মেল বক বক করতে করতে সারা বাড়ির কানে খিল লাগিয়ে দেয়। আমরা অনুমান করি যে মোজাম্মেল কোহিনূরের প্রেমে পড়ে। কোহিনূরের বক্র দৃষ্টি আর হাসি দুটোই মোজাম্মেলের হৃদয়ে ঢেউ তোলে, তবে প্রথম ধাক্কায় সে মেনে নিতে পারে না অথবা তার ঐ বক্র দৃষ্টি আর হাসির পেছনে শধুই মোজাম্মেলের বাসনা উত পেতে থাকে ভেবে সে রুষ্ট হয়। তার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ তাই ঘটে ক্রোধের বিস্ফোরণে। এই শ্রেণীভেদ অতিক্রমণের প্রথম খেয়াল তার মাথায় হানা দেয় খোয়াবে। কোন এক সকালে মোজাম্মেল তার মাকে জানায় যে সে কোহিনূরকে বিবাহ করতে চায়। কারণ সে খোয়াবে দেখে যে সিরাজী বাবা স্বয়ং মোজাম্মেল আর কোহিনূরের বিবাহ পাঠ করায়। আর তার প্রমাণ হিসাবে সিরাজী বাবা বারান্দার দরজার বাহিরের পিঠে সাদা রঙ দিয়ে কোহিনূরের ছবি এঁকে রেখে যায়। পরে অবশ্য কয়েকদফা আলোচনা আর পর্যালোচনায় আবিষ্কার হয় যে ওই এবড়োথেবড়ো চিত্র মোজাম্মেলের ছোট ভাগ্নিটা সাদা কারেকশন ফ্লুইড দিয়ে অঙ্কন করে। তার বিবাহের বাসনাটা বালকের হাত থেকে ফসকে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে যায়। পরবর্তীতে অবশ্য সে বেশ কয়েকবার জানায় যে বিবাহ তার জন্য ফরজ হয়ে গেছে আর নানা ঘটকের কাছে সে তার ছবিও পাঠায় জীবনবৃত্তান্ত সমেত। কতিপয় আত্মীয় আর অনাত্মীয় তাতে আপত্তি জানায় এই বলে যে মোজাম্মেলের এখন ভাদ্র মাসের কুকুরের দশা, যেকোন কিছুতেই তার চলবে। সাবধান!!!

রহমতিয়া রোডে ঐ রাতে খুনি অন্ধকার নীরবতার মেলা বসে, আর মোজাম্মেল তার মত করেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাঠি ঠুকে অন্ধকার চিড়ে মারফতি ভালবাসার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। সে ঠিক কি ভাবছিল আমরা জানি না। হয়ত সে কোন নারীমূর্তি নিংড়ে সাবাড় করছিল, কিন্তু তার লাঠি অনবরত প্রার্থনা করে চলছিল। সে জানে যে তার জবান বন্ধ করে দিলেও এই হাত সাক্ষী। দুই একটা জোনাক সবিরামে মিটমিট করে জ্বলছিল ঝোপঝাড়ে। পুরা শহরে বিদ্যুৎ না থাকায় রাস্তার সরকারি বাতিগুলোও ঘুমিয়ে পড়েছিল। এতরাতে কয়েক প্রকরণের লোক জেগে থাকতে পারে- ছিঁচকে চোর, পরীক্ষার্থি, নবদম্পতি আর রাতের পেশাদারী। মোজাম্মেল এই জায়গায় নতুন একটা আবেদন সৃষ্টি করলো, তবে তার পেশা আর নেশা সম্পর্কে আমরা এতোটা ওয়াকিবহল না। লাঠি ঠুকে ঠুকে সে যখন অন্ধকারের নিরাকার সঙ্গম উপভোগ করছিল, পুলিশের একটা টহল গাড়িটা তার পাশেই ব্রেক করলো।

রোগা এক দারোগা তার হাতের লাঠি দিয়ে মোজাম্মেলের লাঠিতে চোট দিয়ে নির্দেশ দেয় তাকে গাড়িতে তুলতে। মোজাম্মেল ভাবে যে সে কখনো কোন রোগা দারোগা দেখে নাই। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে সে তার মতই রোগা শরীরের দারোগা দেখে পুলকিত হয়। সাথের এক কনস্টেবল অবশ্য তাতে অনীহা প্রকাশ করে এই বলে যে মোজাম্মেলকে থানায় নিয়ে গিয়ে বিশেষ সুবিধা নাই। কারণ তাকে কেউ নিয়ে যেতে আসবে না, তার পরিবার বরং খুশিই হবে কিছুটা। এই কনস্টেবল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মোজাম্মেলের মা এই তো মাস দুয়েক আগেই এসে অনুনয় বিনয় করে দশ হাজার টাকা ওসি সাহেবের হাতে দিয়ে বলেছিল মোজাম্মেলকে যেন হাজতে আটকে রাখে। ওসি সাহেব মোজাম্মেলের পারিবারিক নিদানের কথা শুনে ঝামেলা ছাড়াই কিছু পয়সা উপার্জনের রাস্তা দেখে তাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে। তবে কনস্টেবলের ভাষ্যমতে জানা যায় যে, মোজাম্মেল কিছুদিনের মাথায় হাজতকে বিশাল শৌচাগারে পরিণত করে। এখানে সেখানে তার বিষ্ঠা আর মূত্রের নৈরাজ্য শহরের পেটোয়া দূর্গকে আরো মলিন করে তোলে। ওসি সাহেব নিতান্ত বাধ্য হয়ে মানবের শরীর জাত আবর্জনার তীব্রতায় বিহবল হয়ে সাধের মহীয়ান আবর্জনা তথা হাতের ময়লার মায়া ত্যাগ করে মোজাম্মেলকে ছেড়েই দেয়। তো দারোগা সাহেব এই বৃত্তান্ত শুনে মোজাম্মেলকে লাঠি দিয়ে গুতা দিয়ে তার নাম জানতে চায়। মোজাম্মেল কোন সাড়া দেয় না, লাঠি ঠুকা বন্ধ করে কিছুক্ষণ নীরবতাকে সময় দিয়ে আবার লাঠির নীচের ধূলায় রুষ্টতা সঞ্চার করে জবাব দেয়- আযাযিল। হাউয়ার পোলা তুই এত রাইতে রাস্তায় লাঠি নিয়া খাড়াইয়া আছস কেন? দারোগা মোজাম্মেলের দিকে তেড়ে আসে, তোর কোন আব্বায় তোরে এই চাকরি দিছে খানকির পোলা?

কোন ধমকাধমকির পরোয়া মোজাম্মেল তখন করে নাই। সে একবার ভাবে যে জিজ্ঞেস করবে কিনা হাউয়ার পোলা কে না, বরং পোন্দের পোলা গালি হিসাবে মানানসই। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার লাঠি ঠুক ঠুক করতে থাকে। আপনারা যেমন ভাবছেন তেমনটাই হলো। হ্যাঁ, অলৌকিক। মোজাম্মেলের ক্ষমতার মধ্যে যা নাই তা হয়ে যাওয়ার নামই তো অলৌকিক। পরদিন দুপুরে ঐ অফিসার এসে তাকে চা নাশতা করিয়ে বিদায় নিল, সে তার বদলি অর্ডার পায়। সে রাতে অলৌকিক কিছু একটা ঘটেছিল। হয়ত অফিসারের অপরাধবোধটাই অলৌকিক ছিল। মোজাম্মেল এর আগে কখনো এতটা ক্ষমতা অনুভব করে নাই।

আমরা ভাবতে পারি যে মোজাম্মেল তাতে খুব আনন্দ পায়। অশরীরি কোনকিছু তার শরীরে এসে ভর করে। আমাদের মনের সমস্ত কল্পনা অসংলগ্ন কল্পনা জুড়ে দিয়ে মোজাম্মেলকে একটা পিশাচ বানাতে পারি। পৈশাচিক কোন কিছু যে মোজাম্মেলের ভিতর আছে তা প্রথম দেখে রাফিদা। রাফিদা মোজাম্মেলের বড় বোন। তিনতলার বারান্দায় দাঁড়ানো রাফিদা মোজাম্মেলকে দেখে এক জগ ভর্তি রক্ত নিয়ে আসতে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে মোজাম্মেল ওই রক্ত নিয়ে আসে বেশ কয়েকবার মুরগীর দোকান থেকে। ঐ রক্ত দিয়ে সে কি করে তা আমরা জানি না। রাফিদা তা জানে এবং জানায় যে ঐ রক্ত মোজাম্মেল পান করে, সে হয়ত মানুষের রক্তে তৃষ্ণা মেটাতে চায়। অবশ্য তারপরের সংবাদ আমরা জানি না। মোজাম্মেল হয়ত আরো অনেকবার রক্তের সন্ধানে যায় অথবা আর কোনদিন যায় নাই। কিন্তু আমাদের কল্পনায় মোজাম্মেলের মুখমণ্ডলে রক্ত জমাট বেঁধে থাকে। মোজাম্মেল এখন সবার আলোচনা আর কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। সে কমিউনিটি চর্চার একটা উপাদান হয়ে থাকে। শফিক মিয়া বলে যে মোজাম্মেল একটা খারিজী পিশাচ, ওরে এলাকা থেইকা বাইর কইরা দেওন দরকার। আশেপাশের সাধারণেরা তাতে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে হেসা কতা কইছেন। ইমাম সাহেব বলে যে মোজাম্মেল শিরকি কথা বার্তা কয়, ওরে ন্যাংটা কইরা বেতানি দরকার। সাধারণেরা বলে হেসা কতা। জাকির মিয়া বলে ওরে মাথা বেল কইরা আলকাতরা দেওন দরকার। হেসা কতা। কানু মিয়া বলে পাগলা গারদে দেওন দরকার। হক কতা। কিন্তু আমরা জানি যে মোজাম্মেলকে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না, জাকির মিয়া হয়ত তার সাথে আড়ালে সহবত করে। মোজাম্মেল কমিউনিটি চর্চার উপাদান হয়ে টিকে থাকে।

খুনি অন্ধকার নীরব সে শেষরাতে মোজাম্মেল লাঠি হাতে রেল স্টেশনের অদূরে কবরস্থান সংলগ্ন মসজিদের পুকুরঘাটের দিকে যায়। দু একটা কাক শব্দ করে নীরব অন্ধকার ছেদ করার অপচেষ্টা চালায়। মোজাম্মেল শান্ত ভঙ্গিতে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে থাকে। সে হয়ত পুকুরের সাথে কথা বলে, কিছু কচুরিপানা তার দিকে ঠেলে দিয়ে শান্ত পুকুর জবাব দেয়। মোজাম্মেল ফিক করে হাসে। অন্ধকার ছিদ্র করে এক লোক মেসওয়াক হাতে পুকুরঘাটে এসে মোজাম্মেলের পাশে এসে দাঁড়ায়। কতক্ষণ দাঁত ঘসে সে কুলি করে ওজু করতে বসে। মোজাম্মেল আচমকা তার পাছা বরাবর লাথি কষায়। হুড়মুড় করে ঐ লোক পুকুরে উল্টে পরে। সে কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের কত মোজাম্মেলের দিকে তাকিয়ে উঠে এসে মোজাম্মেলের পায়ে সালাম করে চলে যায়। সেই নীরব শেষরাতে সে মোজাম্মেলের চেহারা দেখে নাই, মোজাম্মেলও তার চেহারা দেখে নাই।

পুকুরের মৃদু ঢেউ ছড়ানো জলে কম্পমান অস্পষ্ট তার প্রতিবিম্বে মোজাম্মেলের এলোমেলো ভাবনারা একটু সুস্থিতি লাভ করে। হ্যাঁ আমরা এখন আবার মোজাম্মেলের প্রেমময় সময়ের প্রতি তাকাবো। কারণ মোজাম্মেল তখন ভাবে কান্তার কথা। কান্তা নামটা তার দেয়া। সে কান্তার নাম কোনদিন জানে নাই। এই তো মাস ছয়েক আগেই তার দোকানের সামনে দিয়ে কলেজ পড়ুয়া কান্তা মৃদু আভা ছড়িয়ে হেঁটে যেত। মোজাম্মেল আশ্চর্য হয়ে খরিদদারের সাথে কথা বলতে বলতে কান্তার চলার পথের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে তীর্যকভাবে মুগ্ধতার পুরোটা ঢেলে দিয়ে তাকাতো। ঐ তীর্যক চাহনিতেই কান্তার আভা মোজাম্মেলের কাছে ধরা দেয়, সরাসরি দেখলে হয়ত কান্তা প্রতিদিন তার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া শত শত মানুষের কেউ একজন থেকে যেত। নাহ, জলের মত কান্তার মৃদু স্বচ্ছ হাসি মোজাম্মেলের হৃদয়ে হাওয়া দিয়ে চলে গেল। একদিন দুইদিন তিনদিন, সকালে মোজাম্মেল বাসার সামনে লম্বা করিডোরে একটা টুলে আর্টপেপার বিছিয়ে তাতে পেনসিল দিয়ে কোন কিছু চিত্রায়নে মশগুল হলো। আঁকা শেষে চিত্রের অংশটুকুতে আইকার হালকা প্রলেপ দিয়ে নানা রঙের জরি বিভিন্ন অংশে ছিটিয়ে দেয়। রোদে কিছুক্ষণ শুকিয়ে আর্টপেপারটা আঙুলের মৃদু টোকায় ঝেড়ে কাঠের ফ্রেমে তা বাঁধাই করে। অনেক মমতা নিয়ে সে তার শিল্প সম্পন্ন করে। পরের দিন কান্তা যখন মোজাম্মেলের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে কলতলা ব্রিজের অপর পাশে যায়, মোজাম্মেল তার সাইকেলে চেপে কান্তার পথ রুদ্ধ করে ব্রেক কষে। সে কান্তাকে বলে যে কান্তার নাম সে জানতে চায় না, কোথায় থাকে পড়ে কিছুই সে জানতে চায় না, সে চায় যে কান্তা মোজাম্মেলের এই ছোট উপহারটুকু গ্রহণ করুক। এই উপহার গ্রহণই মোজাম্মেলের জন্য প্রাপ্তি। কান্তা কিছু না বলেই চিৎকার করে আশেপাশে  মানুষ জড়ো করে ফেলে। অতি উৎসাহী জনতার কয়েকজন হয়ত মোজাম্মেলকে দু চার থাপ্পড় দেয়, কয়েকজন আবার মোজাম্মেলকে চিনতে পারে বিধায় তাকে ছেড়ে দিতে বলে। কান্তা চলে যায়। মোজাম্মেলের সমস্ত কল্পনা নর্দমায় চলে যায়। সে হয়ত ভেবেছিল কান্তার সুডৌল বুকের ওড়না যখন বাতাসে সড়ে যাবে তাতে কাঁপা কাঁপা চোখে তাকাবে, কাতুকুতু দিতে গিয়ে দৈবক্রমে বুকে হাত চলে যাবে, নানা অঙ্ক কষে কথা বলতে গিয়ে গরু-ছাগল বা কেরোসিন-পেট্রোল বা আবহাওয়া নিয়ে কথা বলবে, আর কতো কি। কিন্তু তার সবটাই নর্দমায় চালান হয়ে যায়।

মোজাম্মেল ঐদিনের কথা ভেবে ফিক করে হাসে। সারা শহর জুড়ে মোজাম্মেলের খোঁজ সেদিন পাওয়া যাচ্ছিল না। মোজাম্মেলেরে মা সাহানারা কেঁদে কেটে বেহাল। সারা শহর জুড়ে পুলিশ নিয়ে ঘুরে যখন মোজাম্মেলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, সাহানারা তখন সন্ধ্যার শেষে শেখজাবালের মাজারে আশ্রয় নেয়। গরম মাজার বলে সুপরিচিত। মাজারের তাজাল্লিতে কেউ সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারে না। তার অবশ্য বাস্তব কারণ আছে। জঙ্গলা কবরস্থানের ভিতর জানালা ও পাখাবিহীন বদ্ধ এই মাজারে দুইমিনিট অবস্থান করলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। শেখজাবাল বাবার আশ্রয়ে সাহানারা যখন কেঁদেকেটে বেহাল তখন তার ফোন বেজে উঠে, সে সাথে সাথেই বাসায় ফিরে গিয়ে দেখে যে মোজাম্মেলের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা আর কয়েকজন ষাঁড়সদৃশ বৃহদাকার লোক ড্রয়িংরুমে বসা। লম্বা উঠোন শেষে গেইটের বাইরে কয়েকজন উৎসুক এলাকাবাসী দাঁড়ানো। ষাঁড়সদৃশ কয়েকজন লোক জানিয়ে যায় যে মোজাম্মেল যদি আর দ্বিতীয়বার তাদের ভাগ্নির পিছু নেয় তাহলে সম্মানসহকারে আর মোজাম্মেলকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে যাবে না। মোজাম্মেল ফিক করে হাসে।

 

মুরগী, ডিম, আর নানান সব উপঢৌকন

দুনিয়ার সবকিছুই দ্বৈত- ভাল/মন্দ, আলো/অন্ধকার, ন্যায়/অন্যায়, খাদ্য/অখাদ্য- এর মধ্যে যেকোন একপক্ষ তোমার বাইছা নিতে হইব। আমরা যখন আল্লাহর আউলিয়ার বায়াত হই তখন সরাসরি আল্লাহর বায়াত হই, আলোর পথ ধইরা তখন হাঁটি। আল্লাহ কয় আমি আমার দোস্তের কান হইয়া যাই, চোখ হইয়া যাই, মুখ হইয়া যাই, হাত হইয়া যাই, পা হইয়া যাই, কারণ আমি তারে ভালবাসি। আল্লাহ তার গাউস-কুতুবের মধ্য দিয়া হাজির। আমার নবী জিন্দা নবী, হাজির-নাজির নবী, গায়েবের নবী, সর্বগুণে নবী, কিন্তু মুর্দা নবী না। মোজাম্মেল চোখ বন্ধ করে ঢুলতে ঢুলতে বলতে থাকে। তার সামনে একটা থালায় পোলাও আর গরুর মাংস। এমন সময় তার দরজায় কেউ একজন টোকা দেয়। সে দরজা খুলে দেখে দুই মহিলা। কোন অভিব্যক্তি ছাড়া জিজ্ঞেস করে কি চান।

দরজার সামনে দাঁড়ানো মহিলা বলে, বাজান আমার পোলাডা হারাইয়া গেছে, হেরে গত দশ বারো দিন হইল খুইজা পাই না। বাজান আপনে কিছু একটা করেন।

আমার কিছুই করার নাই।

বাজান, আপনে দোয়া না দিলে আমি যামু না।

পুলিশের কাছে যান। গুমটুম হইয়া গেছে কিনা দেখেন।

এডি কি কন বাজান? আপনে কুনু একটা উপায় দেন।

আমার দেয়ার মত কিছুই নাই। আমি খাইতে বসছিলাম। আপনে চাইলে এক টুকরা গোস্ত খাইতে পারেন। ঐ মহিলার দিকে এক টুকরা গোস্ত সে তার ময়লা হাতে তুলে এগিয়ে দেয়। মহিলা শ্রদ্ধাভরে ঐ গোস্ত হাতে নিয়ে মুখে পুরে দেয়। ঐ মহিলার ছেলে ঘরে ফিরে কিনা তা আমাদের জানা নাই। মোজাম্মেল বেশ কয়েকবার এই ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, আর ততবারই সে জানায় যে তার কিছুই করার নাই। মানুষের অসহায়ত্বের প্রকোপে সে নিজেই আক্রান্ত হয়। সে এও আবার দর্প নিয়ে তার মায়ের কাছে বলে যে সে চাইলে বিশাল ধান্দা খুলে বসতে পারে, তার চোখের সামনে কড়িকড়ি পয়সা কামানোর নানান উপায় আপনাতেই উন্মোচিত হতে থাকে। কিন্তু তা করবে না বলে সে সাফ জানিয়ে দেয়।

সাহানারাও ছেলেকে নিয়ে ধন্দে থাকে। তার এক সখি তাকে বলে, আফা আপনে রত্নগর্ভা। আপনের অন্যান্য পোলা মাইয়া হয়ত দুনিয়াবি কাম হাসিল করতেছে। কিন্তু আপনের এই পাগল পোলা আপনেরে পাড় কইরা নিয়া যাইব। ঐ দুনিয়ার টিকিট হইল আপনের এই পোলা। এ যে সাধনায় নামছে আপনে আটকাইয়েন না। কোনদিন শুনি নাই সে কারো কাছ থেইকা দুই টেকা নিয়া খাইছে। আফা, আমি মুরাকাবা কইরা দেখছি যে মোজাম্মেল ফানাফিল্লাহতে চলে গেছে, সে মরার আগে মরে গেছে, আল্লাতে বিলীন হইয়া গেছে। কিন্তু তারপরেও সাহানারার ধন্দ কাটে না, কখনো ভাবে যে মোজাম্মেল একটা ভণ্ড। সে পয়দা হওয়ার পর থেকেই সাহানারার কলিজা খাওয়া শুরু করেছে, মরার আগ পর্যন্ত এই খাওয়া থামবে না। আবার সাহানারা এটাও ভাবে যে যেহেতু তাদের পীরবাবা মাওলানা গাজী আলী সিরাজি নিজে মোজাম্মেলকে স্নেহ করে সেহেতু কিছু একটা আছে তার ভিতর।

আধো অন্ধকারে মোজাম্মেল নগ্ন দু হাত মুঠো করে বসে আছে। কয়েকটি মশা তাতে শুঁড় ডুবিয়ে রক্তপান করে। মশার রিজিকের উৎস হয়ে বেশ আনন্দিত সে। মশার জায়গায় কয়েকটা মৌমাছি অথবা একটা কুকুর হলে ব্যাপারটা কেমন হত, সেরকম ভাবনা তার মাথায় আসে না। কারণটা আবার এমনো হতে পারে যে এখন তার গভীর চিন্তায় প্রবেশের বিশেষ মুহূর্ত, ছোটখাট চিত্তবিক্ষেপে চিত্তনিবেশ করা চলবে না। নানান ভাবনা আর ছবিতে তার মাথা গিজগিজ করে।

*

পাঞ্জাবীর পকেটে যত ট্যাকা আছে তা এক থাবায় এগুলা কোন এক রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দেওন যায়। ভালবাসা অন্তরের ভক্তি না, মুখের এক নলা ভাতের ভাগার নাম। এই ভাগা যারে তারে দেওন যাইব না। হিন্দুদের তো অবশ্যই না। ঐসব দোকানের মিষ্টি খাইতে ভালো, কিন্তু বাসায় আইনা শুদ্ধ কইরা খাইতে হয়। প্রথমে আগরবাতি ধরাইতে হইব, তারপর এক হাতে আগর ও অন্যহাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়া কতক্ষণ জিকির চালাইয়া যাইতে হইব। তাহলেই না হইব শুদ্ধ। অবশ্য এক হিন্দু বাড়ির বিয়াতে দাওয়াত খাওয়া হইছে, ছাগলের মস্তক এক কোপে আলগা করা হয় নাই, জবেহ করা হইছিল। এমন হিন্দু হইলে বিবেচনা করন যায়। বাঙালি মুসলমান আর যাই হোক আরবি মুসলমান  না। অনেক হিন্দুই তো মাজারে ভক্তি নিয়া আসে। নাহ, ভাত ভাগ তাইলে করন যায়।

*

বাড়িতে কুকুর পালা হারাম। ফেরেশতারাও ঐ জিনিসটারে অপছন্দ করে। জিবরাঈল তো একবার নবীজির ঘরের পাশে কুকুর ঘুরতাছে দেইখা সাক্ষাতে বাধা আসে। কিন্তু আমি নিজে তো কুকুর, কুকুরের মত জিভ লিক লিক বাইর কইরা হামাগুড়ি দেই। আমি গাজী আলী সিরাজির কুকুর, নিজেরে নিগ্রহ পরাজিত আর বশ্য করেই তো মানুষের জন্ম লয়, নানান ডাকে নানান নামে সে সাড়া দিতে থাকে। আয়, আয়, আয়।

*

সত্য হইল বিশ্বাসের বস্তু, আর জ্ঞান হইল বিশ্বাসের শত্রু। সত্য জিনিসটা গতরে অনুভব করতে হয়। এই যে হাজার হাজার লোক কোন এক নেতার আদেশের সামনে মাথা নত কইরা ফেলে, সেইটা কেমনে? জ্ঞান তো কইব নত না হইতে। লোকে তাদের রক্ত মাংসে ঠিক কোন জিনিসিটা অনুভব করে? কে বেশি বিশ্বাসী, যে সরাসরি প্রবক্তার সঙ্গ পাইয়া ধন্য হইছে, নাকি যে হাজার বছরের দুরত্বে নির্জন হইয়া খাঁটি বিশ্বাসের সাক্ষী হইতেছে? ওয়াইজ আল-কারনি বিশ্বাসীদের মধ্যে সেরা, তার বিশ্বাসের মূলে পানি ঢালনের লাইগা নবীর সাথে সাক্ষতের প্রয়োজন হয় নাই। সিরাজি মাওলার লগে আমারো আর সাক্ষাতের প্রয়োজন নাই।

*

প্রত্যেকদিনের বিরক্তিকর রুটিন থেইকা আমি বাইর হইয়া আসছি। আট দশটা শিক্ষিত মানুষ থেইকা আমি আধুনিক। আমি নিয়ম না মানা লোক, নিজের নিয়ম নিজেই লিখি। সরকারের বন্দেগী আমি করি না, না করি সংস্কৃতির বন্দেগী। মাইনসের নানান এজেন্ডায় ঘেন্না আসে, ওয়াক থু। নিঃসঙ্গতার মর্ম বুঝতে হেরা অক্ষম। লোকে আমার স্বাধীনতারে হিংসা করে, তারা তাদের মতন কইরা আমারে ফিরাইয়া নিতে চায়। অথবা আমি একটা আবর্জনা, তাদের ভিতরকার দগদগে আবর্জনা, যেইটা থেইকা তারা পালাইয়া বেড়ায়। তারা কোনদিন তাদের আস্তাকুড়ে গিয়া দুই মিনিট দাঁড়াইয়া নিঃশ্বাস নেয় নাই।

*

আমি তো এই নিয়তি নিয়াই আসছি। অন্যকিছু হইবার কি উপায় ছিল? ভীত সন্ত্রস্ত মলীন এক লোক হযরত সোলেমানের দরবারে আইসা হাজির। তার দুর্দশার আকুতি দেইখা হযরত সোলেমান জিগাইলেন, কি সমস্যা তোমার? হুজুর আজরাইলের সাথে আজ আমার সাক্ষাৎ হইছে। এমন এক দৃষ্টি কোন মানুষের পক্ষে নেওন, তা সম্ভব না। হুজুর, আপনে বাতাসরে হুকুম দেন আমারে যেন দূর হিন্দুস্তানে পৌঁছাইয়া দেয়, আমারে আজরাইলের কবল থেইকা রক্ষা করেন হুজুর। হযরত বাতাসরে হুকুম দিলেন তারে হিন্দুস্তানের একবারে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাইয়া দিতে। হযরত পরেরদিন আজরাইলের সাথে সাক্ষাতে জিগাইলেন, কেন সহজ সরল ভাল লোকটারে সে দেশ ছাড়া করল? আজরাইল কইল, আমি তো মিথ্যা কমু না হযরত। ভিড়ের মধ্যে লোকটারে ঘুরঘুর করতে দেইখা আমি অবাক হইলাম। কারণ খোদা আমারে জানাইলেন, আজ এই লোকের মৃত্যু হবে হিন্দুস্তানের একবারে দক্ষিণ প্রান্তে। সে দূর হিন্দুস্তানে না হইয়া এই বাজারে কি করতেছে? খোদার লগে টাল্টুবাজি সম্ভব না, খোদা আমার নিয়তি এমনেই লিখছে। আমার অতীত জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমারে আজকের পরিণতির দিকে ঠেইলা দিছে। এর অন্যথা সম্ভব ছিল না।

দৈনন্দিন জীবনের প্রতি মোজাম্মেলের অভক্তি আছে। ফরাসি আভা-গার্দদেরও আছে, ভিড়ের ভিতরে স্বতন্ত্র একাকিত্ব নিয়ে বাস করার মত বিদ্রোহ। তবে মোজাম্মেলের আভিজাত্যপনা তার ক্লাব মেম্বারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ক্লাব মেম্বার মানে তার সীরাজি বাবার ভক্ত মুরিদানগণ, একমাত্র তাদেরকেই সে কিছুটা বিবেচনা করে। তারা সবাই একটা সীমিত সাধারণ সত্যের সাক্ষী হয়ে মরমি সাধনার ক্লাব চালায়। সেই ক্লাবের এক অতীন্দ্রিয় সদস্য সে নিজে। মোজাম্মেলকে পারফর্মেন্স আর্টিস্ট বললেও খুব একটা ভুল হয় না। তার অস্বাভাবিক ও অনাগরিক কার্যক্রমের একটা অলিখিত স্ক্রিপ্ট সে বজায় রাখে। কখন রাস্তায় দাঁড়াতে হবে, ঠিক কোথায় কোনদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে লাঠির আঘাতে ধূলি উড়াবে, ঠিক কোন নাগরিকদের উদ্দেশ্যে সবকিছুরই একটা স্ক্রিপ্ট আছে। তাহের যখন তাকে জিজ্ঞেস করে তার মুখে মাখানো কালো রঙের কথা সে তখন অকপটেই জবাব দেয়, ভিতর আর বাইরের দূরত্ব ঝাপসা করতেছি। এই কালিমা খোদ তুমি, তোমার চাইতে বেশিকিছু! আর সবের কালিমা আমি আমার মুখে লেপ্টে দিছি। লোকে তখন আমার দিকে আতঙ্ক নিয়া তাকায়।

মাওলানা গাজী আলী সিরাজীর সামনে কুকুরের ভঙ্গিতে মোজাম্মেলে হামাগুড়ি দিয়ে থাকে, যখনই দর্শনে যায় সে। দরবার থাকে লোকে লোকে ভরপুর। কারো ক্ষেতের লাউটা, কারো শখের চকচকে পালকের তেলতেলে মোরগটা, কারো এলাকার বিখ্যাত মিঠাই, একজন তো মাওলানা সাহেবকে গাড়ির চাবি দিয়ে বসে আছেন। টোট্যাল সিচুএইশনটাই ইন্টারেস্টিং। মোজাম্মেল ভাবে কিনা বুঝা যায় না। তবে তাহেরের কিছুটা মনে আসে, এই হযরতের মুরিদ হওয়ার আগে তারা পুরো পরিবার আরেক পীরসাহেবের মুরিদ ছিল। ঐ পীরসাহেবের নাকি খ্যাতি ছিল, ইংরেজীতে ওয়াজ মাহফিল করতে পারতেন, তার উপরে আবার একটা পিএইচডি ডিগ্রীও ছিল, এন্তেকাল ফরমায়েছেন তিনি। তাহেরের খেয়াল আছে, সাহানারা যখন পীরসাহেবের দরবারে যেত, পীরসাহবের পরিবারের জন্য বেশ কেনাকাটা করত, ক্যাশ কিছু টাকাও দিয়ে আসত। মুরিদান হিসাবে সাহানারার পরিবার বিশেষ যত্নআত্তি পেত- আলাদা শোবার ঘর, আলাদা খাবার, ভিতর বাড়িতে আলাদা এক্সেস- যা সাধারণ মুরিদানে পেত না। সাধারণের জন্য ছিল সাধারণ লঙ্গড়খানা। এক ধরণের সাধারণ অস্বস্তি। তাহের আস্তে আস্তে সাবমিশন আর রিডেম্পশনের এই প্রক্রিয়া থেকে বের হতে থাকে, আর মোজাম্মেল তার আরো গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তাহের কখনো এসবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাই, এমনটাও ভাবে সে। মুরগী আগে না ডিম আগের মত ধাঁধা- শুধুমাত্র সত্য জেনেই বিশ্বাস করা সম্ভব, আর শুধুমাত্র বিশ্বাসীরাই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারে। পীরসাহেবের সত্যের রেজিমে তাহের ধরা দিতে চায় না।

তাহেরের মনে আছে, পীর সাহেবের জুতো জোড়া বুকে নিয়ে আবেগে আপ্লুত হওয়ার ব্যার্থ এক প্রচেষ্টায় সে মত্ত হত। এমনকি বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে মানুষজনের যখন প্রবল বাতিকে কান্নাকাটি করত সে তখন স্পিরিচ্যুয়াল মার্জিনালিটিতে পর্যবসিত হওয়ার ভয়ে বহু কষ্টে দু এক ফোঁটা অশ্রুজল প্রবাহে সমর্থ হয়। তবে তা বেশীদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নাই, পরিবারের রেওয়াজ থেকে সে ধীরে বের হয়ে যায়, অথবা এই বের হওয়া তার পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব হয় না, অর্থহীনতায় ডুবে যেতে যেতে সে মাঝে মাঝে ঐ সময়টার প্রতি এক ধরণের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়। অতীত আর বর্তমানের মিলনের মুহুর্তের ঘূর্ণীতে বিবশ থাকে তাহের, মোজাম্মেলও।

 

সূর্যগ্রহণের পরে

রাত এগারটা বা ততোধিক তখন। রহমতিয়া রোড অথবা আনন্দপাড়ার লোকেরা সময়ের হিসাবের প্রতি খুব একটা আগ্রহী হয় না। রাত যতই গভীর হতে থাকে লোকজনের ভিড়, ফিসফিসানি, চাপা হাসি ততই বাড়তে থাকে। একটা উৎসবের আমেজ। এরকম মাঝে মাঝে দু চার ঘটনা তাদেরকে সুখ জুগিয়ে দুঃসহ বেঁচে থাকা আরেকটু সহনীয় করে। মোজাম্মেল অনবরত লোহার দরজায় আঘাতের পর আঘাতে চিৎকার করতে থাকে, ‘ভাইয়েরা আমারে বাঁচান, আমার ভাইবোনেরা ষড়যন্ত্র কইরা আমারে পাগল বানাইয়া রাখছে। আমার সম্পত্তির ভাগ এরা লুইটা খাইতে চায়, আমারে বঞ্চিত করতে চায়। আপনেরা এর একটা বিহিত করেন।’ দেউড়ির বাইরে উৎসুক মানুষের ভিড় থেকে কেউ কেউ বলে, ‘আহারে, এমনে একটা জীবন নষ্ট কইরা দিল। কত কষ্ট, ইশ!’ কেউ আবার বলে, ‘ভং ধরছে হালায়, দুই চাইর গদা খাইলে ঠিক হইয়া যাইব। আটকাইয়া রাখছে যে ঠিকই আছে, পুরা এলাকা দূষিত কইরা দিছে, ল্যাংটালুংটা খাড়াইয়া থাকে হালায়, মসজিদেও যাওন যায় না নজরটারে ঠিক রাইখা।’ রাত যত বাড়ে দরজায় আঘাতে শব্দের তীব্রতা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। কেউ কেউ ঘুমে হাই তুলতে তুলতে উৎসব ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যায় দৈনন্দিন রতিক্রিয়া শেষে হাত পা ছেড়ে ঘুমাবে বলে। ঐ কর্মটা করলে ঘুমটা জমে ভালো, অবসাদ আর উৎফুল্লের ভারে চোখ আপনাতেই বুজে যায়।

এরকমই একটা আগ্রাসী উৎসবের আমেজ জমেছিল বারো কি তেরো বছর আগে। সূর্যগ্রহণ দেখবে বলে মানুষজন এক্স-রে ফিল্ম অথবা গাঢ় রঙ মেশানো জলের বোল নিয়ে ধীর স্থবির হয়েছিল, একটু নড়লেই যেন শেষ হয়ে যাবে সব। বাড়ির মা মেয়ে বউরা বটি নামিয়ে রেখেছিল, মাছ কাটা যাবে না গ্রহণের সময়টাতে, অনাগত সন্তানের নয়ত কোন না কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। ছোট ছেলে মেয়েরা বরং একটু অস্থির। কখন শেষ হবে গ্রহণ, হাতের তালুতে নোনতা বিস্কুট অথবা কমলার কোয়া সদৃশ ক্যান্ডি খাওয়ার তর যে আর সইছে না। এই কিছুটা সময়ের জন্য হাতের বিস্কুট অথবা ক্যান্ডি সাক্ষাৎ বিষ। ঘটনাটা ঘটল তখনই। এলাকায় উৎসব বাহানায় দু চার পয়সা কামাইয়ের ধান্দায় নিয়োজিত এক চাঁদা ফরিকের ঘাড় পিঠে মনের সুখ মিটিয়ে কষিয়ে কিলঘুসি লাগায় মোজাম্মেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ্যের মানুষ হাজির হয় মোজাম্মেলকে দু হাত দেখে নেয়ার খায়েশে। কেউ কেউ এক খাবলা করে গোশত তার গা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ও প্রকাশ করে। মোজাম্মেল তখন ঘরের ভিতর আবোল তাবোল বকে হাত পা ছুড়ে নেচে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা কোনরকমে গোশত খুবলে নেয়ার আয়েশে মত্ত গুটিকয় লোকের হাতে কিছু টাকা পয়সা আর চিকিৎসা বাবদ খরচ দিয়ে তাদের বিদায় করে।

জমাট একটা অস্বস্তি সমেত মোজাম্মেলের উদ্ভট আচরণ সবাইকে বিভ্রান্ত করে। একবার ওয়্যারড্রবে মাথা ঠুকে তো আরেকবার কলম দিয়ে বুক আঁচড়ে ক্ষত তৈরী করে। এমনও হতে পারে যে এসব ক্ষত আগেই ছিল, মোজাম্মেল একটা আঁচড়ও দেয়নি, বরং তা আরো ক্ষুধার্ত বলে লালাভ বর্ণ ধারণ করে।

তাহেরের হাত ধরে মোজাম্মেল বলে, ‘ভাই তুমি তো আমারে ভালবাস না। আমি তোমারে অনেক কষ্ট দিছি ভাই, মারধোর করছি, আমারে তো এখন কেউ চায় না। সবাই চায় আমি মইরা যাই। কিন্তু আমি মরুম না, তিলে তিলে তোমারারে পিষা মারমু। সবুর কইরা আছো মেওয়া খাইবা। খাওয়ামু তোমারারে মেওয়া।’ সাহানারা ভাবে হয়ত রাহু সূর্যকে গ্রাসের সাথেসাথে মোজাম্মেলকেও গ্রাস করে। নতুবা কেউ তাকে চিলের মাংস খাইয়েছে। মোজাম্মেল আদৌ চিলের মাংস খেয়েছিল কি না জানা যায় না। তবে নিজের কাছে নিজে সে ক্রমে দূর্বোধ্য হয়ে যায়। হয়ত সে বশ্যতা চায়। সাহস, স্বাধীনতা আর সমারোহ শ্বাসরোধী লাগে। আবার এও হতে পারে যে  জীবনের সুদীর্ঘ আটাশটি বছর মোজাম্মেল আদৌ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। এই জীবন দিয়ে কি করা যায় সে সুরাহায় কখনো পৌঁছে নি। সীমিত আয়ুষ্কালের অসীম পার্থিব আর অপার্থিব যজ্ঞের দায়ে দমবন্ধ হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে বেঁচে থাকা তাও তো হয় না। জীবনের জন্য যে তাকে তৈরী হতে হবে তেমন কোন ভাবনাও মনের কোণে উদয় হয় নি কোনদিন। অন্যলোকে যখন যত্ন নিয়ে তার দিকে তাকায় অসহ্য লাগে। মানুষ কিভাবে একটা সদা যন্ত্রণাদায়ক প্রাণীকে যত্ন দিতে চায়। ছোট বোনটা আস্ত একটা শয়তান। যতবারই সে হাসনাকে গালাগাল মারধোর করেছে, দেখা গেল দিন দুই বাদে ঠিকই ভাল কিছু রান্না হলে খেতে দিয়েছে। বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করল, একটুও বদলায় নি। কি যে কুমতলব রান্না করছে মনে মনে কে জানে!

সেই সূর্যগ্রহণের তারিখে মোজাম্মেল হাতে পায়ে গলায় সবুজ সুতো পেঁচিয়েছিল। অতীতের গভীর অন্ধকারের জীর্ণশীর্ণ ভূতুড়ে বাড়িতে বসে এই সময়টার প্রতি সে অভিনিবেশ করে, কোন কূল কিনারা করতে পারে নি। এরপর ১২ বছর কেটে যায়। বাসনার গোড়ার মাটি অসংখ্য নীহারে ভিজেছে, তবুও কোন অবয়ব পায় নি।

উৎসবের আমেজ কেটে গিয়ে উৎসুক মানুষের ভিড়ে ভাটা পরে। পরিবারের আর সকলে গোল মিটিংয়ে বসে দাওয়াই বিবেচনা করতে। আগে পাগলামি কিছুটা সহ্য করার মত ছিল। কি না করলো! সিগারেটের তামাক ফেলে তাতে শুকনো মরিচের গুড়ো ভরে দিব্যি আগুন ধরিয়ে টানা। বাসায় কারো টিকে থাকার অবস্থা ছিল না মরিচের তীব্র ঝাঁজালো ধোঁয়ায়। তারপর তো মোজাম্মেল আলাদা থাকা শুরু করল। সে ঐ ঘরের ভাত ছুঁয়ে দেখবে না। আলাদা একটা ঘর তুলে দেয়া হলো তাকে, আর সাথে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া।

ঐদিন সবকিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। বাঙলা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সে ভূতের মত সন্ধ্যায় বাসার জানালার বাইরে এসে দাঁড়ায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কালো আলখাল্লা আর কালিমাখা অবয়ব ছেদ করে জ্বলজ্বল করছিল রক্তাভ দুই চোখ, ঠিকরে বের হচ্ছিল খুনি জিঘাংসা। লাল চোখ হঠাৎ অসহায়ত্ব আর মায়ায় টইটুম্বুর হয়, চিকন কোমল শিশুসুলভ গলায় তাহেরকে বলে, ‘ভাইয়া, এত সুখ তুমি কেমনে পাও? আমারে একটু সুখ দিবা? আমারো তো খায়েশ হয়। তোমরা লেখাপড়া কইরা সভ্য মানুষ হইয়া গেছ, আমার কি হইব!’ তাহের বলে, ‘সব ঠিকঠাক হইয়া যাইব, আগে এই বেশভূষা ছাড়েন।’ মোজাম্মেলের চোখে আবার জিঘাংসার দৃষ্টি ফিরে আসে, যেন মুহূর্তেই সবকিছু ছাই করে অন্ধকার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তোদের সুখে আমি পেচ্ছাব করি, আমি তোদের মত না। তোরা সুখে থাক, আমি থাকব তোদের মুখে ছেপ মারার জন্য।’ মোজাম্মেল একদলা থু থু ফেলে। মোজাম্মেলের ভাষায় সুখ হয়ে উঠে নির্বোধ মানুষের বস্তু, তাতে থু থু মেরেই যেন সুখ। তীব্র বিতৃষ্ণা আর আকুল আবেদনে সে দোল খায়, ‘সুখ হইছে জানোয়ারের জিনিস, তোরা জানোয়ার। আমি আমার সোনাটারে ইট দিয়া ছেইচা ফালাইছি, পারবি তোরা জানোয়ারের বাচ্চা!’, ‘ভাইয়া, আমি না একটু ভালো থাকতে চাই। তুমি আমারে রাখবা তোমার সাথে?’ অনেকটা সময় মোজাম্মেল বাইপোলার আচরণ করে, তাহের বাতি নিভিয়ে অন্য রুমে চলে যায়। আর শুরু হয় তার তাণ্ডব। একে একে বাসার সব জানালা ভাঙে। ঘরের অন্যান্য সদস্যরা আতঙ্কে যে যার মতো দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করে, আজ বুঝি আর রক্ষা নেই, একটা খুনখারাবি হয়েই যাবে।

হঠাৎ সবকিছু রাতের মৃত জ্যোৎস্নার মত শান্ত। বাড়ির দেউরি থেকে শুরু করে করিডোরের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত মোজাম্মেল হাটে আর গুনগুন সুরে কাঁদে। এক অশরীরী একরাশ গ্লানি নিয়ে পৃথিবীর ছোট এক কোণে একাকি যেন বিচরণ করে। অভিশাপ দেয় ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের তালে। জীবনটা তার অপচয়ে ভর্তি ছিল, অমনোযোগী ছাত্রের মত, পরীক্ষার ঠিক একমাস আগে সিরিয়াসলি টেবিল চেয়ারে আঠার মত লেগে থেকে যেন সব অপচয়ের শোধ তুলে বীরদর্পে আর সব সহপাঠীদের ধিক্কার জানাবে। এমন শোধ তোলার মাতলামিতে সে স্বপ্নেও ভুগে, গভীর ঘুমে হাসে।

মোজাম্মেল ক্লান্ত হয়ে কলাপ্সিবল গেইটের সামনে করুণ সুরে মা মা বলে ডাকে। সাহানারার বুক খণ্ড খণ্ড হয়। খণ্ডিত বুকে সে যখন গেইটের তালা খুলে, আর ঘটনাটা ঘটে। মোজাম্মেল লাঠি হাতে তেড়ে আসে মায়ের দিকে খুনি আবেগে। সে ধরাশায়ী হয়। বাসার আর সব পুরুষেরা তাকে মাটিতে ফেলে তার শরীরে গাছের ডাল ভাঙ্গতে থাকে। মোজাম্মেল যেন এটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে হাসে সবার কানে তালা লাগিয়ে। সবকিছু যখন ব্যর্থ, অন্তত অন্যের হাতে স্বেচ্ছায় মার খাওয়ার সুখটুকু তাকে সার্বভৌমের আনন্দ দেয়।

 

তুমি আমারে এতক্ষণ ধইরা যা কিছু কইলা সব পাগলের প্রলাপ।

জ্বি না, প্রলাপ না। আমি যা দেখি শুনি বুঝি তাই কইতেছি।

নেশা করো?

এখন করি না। আগে ফ্যান্সিডিল, গাঞ্জা এসব খাইতাম। এখন মাঝে মধ্যে কেরু নইলে বাঙলা খাই।

এসব ছাগলামি ভেড়া উঠলে করস?

তুই তোকারি করতেছেন কেন?

মোজাম্মেলের মাথা দুপায়ের মাঝখানে অন্ডকোষের নিচে চেপে ধরে তার পিঠে ইচ্ছা মত কনুই কিল ঘুষি চলে। দুইদিন ঠিকমত নড়তে পারে নাই। এ কোন কুম্ভীপাকে এসে পড়ল সে।

বিয়াশাদি করতে মনে চায় না?

মাঝখানে করত, এখন করে না। জিনিসটা ইট দিয়া ছেইচা ফেলছি।

এখন আফসোস লাগে দেইখা উলটাপালটা করস। তোর জিনিস ঠিকমত কাম করে না এই জন্য?

আমি পাগল না।

স্বীকার কর যে এতদিন তুই পাগল ছিলি। নইলে যে গজব নাজিল হইব, বীচি শুকনা গাঙ হইয়া যাইব। আকামটা কইরা এখন আফসোস লাগে তোর, এইটা স্বীকার কর। পাগল না হইলে কি আর এই আকাম কেউ করে?

যা বুঝেন না, তা নিয়া কথা কইয়েন না।

মোজাম্মেলকে ফ্লোরে ফেলে, তার উপর কয়েকদফা উত্তম-মধ্যম নাজিল করা হয়। একগাদা থালা-বাসন পাতিল দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয় কলের সামনে। এক দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে যায় সে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তারা তার নিজ সম্পর্কে আরেকটা ফ্যাব্রিকেইটেড গল্প প্রোথিত করার চেষ্টা চালায়।

আফসোস হয় এখন?

হয়।

এতদিন যা যা করতি, একটা ডাণ্ডা হাতে নিয়া যে মাস্তানিটা করতি, ঠিক ছিল না বেঠিক?

ঠিক ছিল।

একদফা ক্রিকেট স্ট্যাম্পের দণ্ড তার শরীরের উপর দিয়ে গেল। স্ট্যাম্পের তীক্ষ্ণ অংশ দেখিয়ে জানানো হলো, কয়েকদিন আগে একজনের পশ্চাৎদেশের ছিদ্র দিয়ে এটার সেলিব্রেশন হয়েছে। ঠিকঠাক আলাপ আচরণ না করতে পারলে তার পশ্চাৎদেশ দিয়েও এই বস্তু ঢুকানো হবে।

আগে ঠিক ছিলি না বেঠিক ছিলি?

বেঠিক ছিলাম

উলটাপালটা করবি আর?

না, আমি ভুল করছি এতদিন।

সাহানারা আর তাহের খাবার নিয়ে স্থানীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রতে গেল মোজাম্মেলকে দেখতে। একমাস বয়সি চুলগুলো সূচালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায়। সাহানারা হটপটের বাটি খুলে থালায় পোলাও, মুরগীর রোস্ট, ইলিশ ভাজা আর গরুর মাংস ভুনা সাজায়। মুখের সামনে লোকমা ধরলে মোজাম্মেল খেতে চায় না। ফিসফিস করে বলে, ‘আমি এই খাওন খাইলে আমারে মারধর করব। খাওনগুলা হেরারে দিয়া দেন। খাইয়া টাইয়া আমারে কিছু দিলে খামু নে। ঐদিন এক পোলারে পিটাইছে, মা-বাপ আইসা যে খাওন দিয়া যায় সব হেরাই খাইয়া ফেলায়।’

রাগ ক্ষোভ আর অভিমানে মোজাম্মেলের মুখ চুপসে আসে। অনেক অনীহা নিয়ে সে কথা বলে। প্রথমে কিছু দিন সে বাসার কারো সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আজ তার বরফ শীতল ক্ষোভ গলে কিছুটা পানি হয়েছে। মহিষের মত দেখতে ভুঁড়ি আর পেশীবহুল একজন এসে মোজাম্মেলের উন্নতির প্রতিবেদন দৃশ্যমান করতে সাহানারার সামনেই দু একটা প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন করে।

মোজাম্মেল ভাই, আমরার সাথে যে আছেন, কেমন আছেন, কি হাকিকতে আছেন, কিছু বলেন। আমরা তো একটা পরিবারই।

আমি এখানে খুব ভালো আছি। আমরা সবাই একসাথে টিভি দেখি, সেশন-ক্লাস হয়, কে কি ভুল করছি সেগুলা বলি, একসাথে খাইতে বসি, খেলি, নামাজ পড়ি। আমি এখানে ভালো আছি, নিজেরে সুস্থ লাগতেছে।

পাগলামি-ছাগলামি সম্পর্কে কিছু বলেন।

আগে যা করছি সব ভুল করছি। আমি অন্ধকারের পথে ছিলাম, এখন আলোর পথে আসছি। আগের কথা মনে হইলে আমার খুব খারাপ লাগে, বাড়ির মান সম্মান নষ্ট করছি। আমি আর এরকম পাগলামি করুম না। আগে পাগল ছিলাম, এখন ঠিক হইয়া গেছি। এখানে না আসলে আমি বুঝতাম না।

মহিষ সদৃশ লোকটা ভিতরে চলে গেলে মোজাম্মেল ফিসফিস করে জলজ গলায় বলে, ‘আমারে এইখান থেইকা নিয়া যান, আমারে খুব মারধর করে, ভারী ভারী কাজ করায়। আমি আল্লাহর কসম দিয়া কইতেছি, আমি অন্য কোথাও চইলা যামু। বাড়ির ত্রিসীমানায় আসুম না। আমারে এইখান থেইকা মুক্ত করেন। আপনেরা যা কইবেন আমি তাই করুম।’

মোজাম্মেলের অভাব বাড়ির কারো ভাবে কোন প্রকার আলোড়ন তৈরী করে না, বরং স্নিগ্ধ শীতল বসন্তের একটা দোলা দিয়ে যায়। বাড়ির স্বস্তি যেন একটা অন্ধকার ভাগাড়ের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে ছিল। চোখ মুখের আতঙ্কের জায়গায় বাসা বাঁধে নিরাপত্তা। হাজার বছরের পুরানো লেপ্টে থাকা কালিমাকে শহরের কোন এক কোণে কোন এক বাক্সে বন্দী করে মানুষ শান্তি পায়। পৃথিবীর গায়ে আগাছার মত গজিয়ে উঠা দগদগে ক্ষত মানুষ তখন অন্য কোন প্রাণীর উপর কেন্দ্রীভূত করে, কি জঘন্য। বলির পশুর উপর তার সহিংসতার সমস্তটুকু ঢেলে রক্তাক্ত উৎসবে শুদ্ধ হয়।

পুনর্বাসন কেন্দ্রে মোজাম্মলের এভাবে কাটে অন্তত এক বছর। ইতোমধ্যে সে অসংখ্যবার তার পূর্বজীবনের প্রতি পূর্ণ অনাস্থা নিয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে সে নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করবে। রাজধানীতে গিয়ে কোন কাজ শিখে বিদেশে পাড়ী জমাবে। দেশ ও পরিবারের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের বন্যা ঘটিয়ে সব কালিমা মুছে দিবে। সে ঢাকা গিয়েই লাপাত্তা হয়। একমাস বাদে ফিরে আসে পুরানো বেশে। শহর থেকে কিছুটা দূরে আস্তানা গাড়ে, যেখানে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে  কুকুরের মত গুটিসুটি মেরে লেপ্টে থাকা যায়। কিন্তু কিছু করে তো অন্নের জোগান দিতে হবে। সে তো আর অনশনকারী না যে দাবি আদায় না হলে পবিত্র শরীর বিসর্জন দিয়ে দিবে। শরীর তার কাছে বরং অপবিত্র জিনিস যা বিসর্জন দেয়া যায় না। অল্প হলেও তাতে শর্করা আমিষের সরবরাহ প্রয়োজন। অপবিত্র শরীরটাকে অত্যাচার করতে হলে যে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরী।

একটা সিএনজি কিনে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে। স্বাভাবিক বেশে কিছুটা রোজগার শেষে আবার আত্ম নিপীড়নের অভিনিবেশে বসে। মাওলানা গাজী আলী সিরাজীর কুকুর সে। আবার নিবিষ্ট সাধনায় সবাইকে অতিক্রম করে মনিব হওয়ার বাসনাও যে খেলা করে মাঝে মাঝে। মনসুর হাল্লাজের মত ‘আনাল হক’ বলতে চায়। কিন্তু সেটা তো একটা চাওয়া, আকাঙ্ক্ষা। সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা বিনাশে একেবারে পরম শূণ্যতার অতল গহ্বরে পৌঁছে শুদ্ধ অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন খেলায় মত্ত হতে সে পারবে না।

রাত দশটা তখন। এয়ারপোর্টে স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। ঘরের ছেলে পরের মাটিতে পা রাখবে ভাগ্যের চাকা একটু ঘুরিয়ে নিবে বলে। একটু ভয়, একটু আশঙ্কা তাদের মুখে পাটি পেতে বসে, সাথে একটু আশা। এয়ারপোর্টে আর নানান সব শ্রমিকদের সাথে সাথে মোজাম্মেলও ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করে। তবে আর সবের থেকে আলাদা। তাকে বিদায় দেয়ার মত কেউ নেই। বিদেশের মাটিতে যান্ত্রিক কোন কারখানার কলকব্জা হওয়ার ভিসা লাগায়। কোন আশায় বসত করে নয়, আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রলোভনে নয়, উৎকৃষ্ট কোন জীবনের আবেশেও নয়। কাউকে কিছু না জানিয়েই সে পাড়ি জমায় বিরূপ কোন ভূমির দিকে। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার মত পয়সা এখানে সুবিধা মত কোন জায়গায় একটা চায়ের স্টল দিলেও জুটে যায়। মাওলানা গাজী আলী সিরাজী বিদেহী হলো আজ তিনমাস। শালীর বেটির জন্য তার মুখটা দেখারও সুযোগ হলো না। ইশ, অসাবধানতায় মেশিনের ক্যাচালে আঙ্গুলটার প্রায় মৃত্যু হয়ে গেল, কোনরকমে ঝুলে আছে। বাসায় একটা ফোন কি দেয়া যায়?

beggar-leaning-on-a-stick-facing-left-1630-jpglarge
রেমব্রাঁ ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.wikiart.org/en/rembrandt/beggar-leaning-on-a-stick-facing-left-1630

 

17192272_1837784333209653_2023798887844222387_o

[ইউসুফ হিরণ – পড়ালেখা করসেন ডাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন চাকরি করেন। দাগায়া বই পত্তে ও সেইটা ভুইলা যাইতে পছন্দ করেন। – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s