উবাইদুল্লাহ রাফী’র কবিতা

হাইপোথিসিস

কিছুর উপর দাঁড়ায়ে না থেকে রয়েছি আমরা দাঁড়ায়ে— এমন অ্যাবসার্ড দৃশ্যের পর, ভাবাই যায়, শক্তিবিযুক্ত কোনো গতির কথা এই পৃথিবীর ক্লান্ত ক্ষীয়মান নিবাসে, করে দিবে আমাদের গতি।

সামর্থের অধিক কিছু মানুষ করে ফেলবে। যদিও পারে না মানুষ। এমন যে কোনো হাইপোথিসিস ধ্বসে পড়ার শব্দে হয়তো কেঁপে উঠবে একটা গ্লাসের পানি—
আর পানির ছিটকে যাওয়া পরিভাষা
কারো হাতে লেগে সহসা
বিকীর্ণ করবে সূর্যের নতুন একটা কিরণ।


রুটলেস

নীহারিকারাও জন্ম আমার করছে অস্বীকার।
তপ্ত বালুর মাঠে,
দালানের ছায়ায় এখন,
আমার বোধ হলো মাধ্যাকর্ষণ থেকে ছিটকে পড়া
সৌর অণুর ব্যথা।

ছায়াপথ থেকে সরে,
মহাশূন্যে
ক্যানো কোনো তারা
জ্বলতে পারে না একা?

মাতৃস্তনের নিচে

আমাদের বয়স হওয়ার পর মায়ের স্তন গেছে শুকায়ে। স্তনের তো আরো কাজ আছে। স্নেহের প্রতীক হয়ে থাকবে না কেনো সে ফুলায়ে আপনারে? সদা তপ্ত এই ভূভাগে তার ছায়ার নিচে আমরা তো নিদ্রার ভাবনা ভাবতে পারতাম, পারতাম তার বেদনা নিয়ে আরো কিছু ভাবতে।

আসলে কে ছিলো তোমার উৎস, এতো বিশদ হৃদয় কি তারই প্রবাহ?— এইসব অনুসন্ধিয়া মা, যাচ্ছে না ঘুমায়ে পড়া, তোমার শুকনা বুকের শক্ত কোলে, অতীত অরণ্যে।

ঊর্মি

আমার হারায়ে ফেলা বউ, তুমি কোনো ঊর্মি তোমার অনিচ্ছায়,
তুমি কোনো ঊর্মি আমার ম্লেচ্ছতায়—
তুমি সাগরের চিৎকারগুলির বোন নাকি সন্তান, তোমার সাথে কথা বলতে এসে দিয়েছি ধরা নিজেরে আমি, যেনো উপকূলবাসী পাখি।
তুমি আসো, কথা বলি,
খাই দাই, পান করি, দরকারে তোমার থেকে,
আর তোমার খাওয়ানোর ইচ্ছা আমি পূরণ করি।

আমার অভিজ্ঞানহীন মাথা জানে না, আমার চলাচল না থেমে থাকার,— আমার না থেমে থাকা চলাচল তোমারে করে দিবে ঊর্মি, কূলে বাড়ি খেয়ে একক বোঁটা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তুমি, আর তোমার পার্টসের কণায় কণায় গেঁথে থাকবে জীবাণু আমার।

প্রচুর চিৎকারের সাথে মিশে জীবাণুরাশি গঠন করবে নতুন নতুন ঢেউ— একটা ঢেউয়ের পার্টস অন্য কারো হয়ে যেতে পারে নাকি যাবে না, আমরা নিশ্চিত না।
আমার জীবাণু দ্বন্দ্বে পড়বে অন্য কারো ঠোঁটের, এমন ভাবলে আমি নিশ্চয়ই আসতে চাইবো তীরে, বিধ্বস্ত করে ভ্রমণ, নিজেরে করে স্থির।

জঙ্গলে যেতে যেতে

বসে থাকি সুষম ঋতুর অপেক্ষায়, যখন মনে হলো, ওইদিকে ঘন জঙ্গলে ঘেরা শুকনা কূপ নিয়ে ধীর দুলতে রয়েছে মানুষ;— তারে নারী বলে চিনি; তারে পুরুষ বলে চিনি,— তার ভেতরে পানি সৃষ্টি করতে পারি।
মরুলোকালয়ে এতোকাল হিজড়া থাকার পর, মরুদ্যানে; জঙলের নিকট, এসে শুনি হঠাৎ, ভেতরে আমাদের ফুটছে জলজ গন্ধ।
কাদার শরীর রেখেছে সুবাস গেঁথে,— আমাদের ভেতরে আমাদের পথিক পেয়ে অকস্মাৎ খোঁজ, দেহের এলাকায় প্রচার করেছে বাণী।

পানির প্রবাহ, ওই মরুদ্যানে, আমরা তো পারি দিতে,— করা যায় প্রাণের সঞ্চার পাইপ বসায়ে।
সুষম ঋতু আসলে সকল দিকে, আশা আমরা করবো জঙলের কূপ; সেখানে আসবে পানি— বয়ে যাবে কূপ ভেঙে জঙলের গায়ে, অদূরে মরুদ্যানে।
আমরা জলজ প্রাণী, আমরা মাটিভিত্তিক, আমরা থাকবো জল ও স্থলে, থাকবো প্রসারিত কূপে, দাবী করবো মরু ও জঙল সকলই শুধু কূপের অধিকার— যেনো জমজম সেইদিন আর বন্ধ হয় নাই বাঁধে, যেনো জমজম প্রসারিত গোটা ধরণীমাতার দেহে।                                                                    

স্তব্ধ ধ্যান

স্তব্ধ যেসব ধ্বনিভাণ্ডার
ঝিনুকের ঠোঁটে কান ঠেসে ধরে
আমরা পেয়েছি টের,
সেইসব বিলাপ কতোটা তীক্ষ্ণ
এবং অপ্রতুল—
বুঝতে চেয়ে যখন আমি
গভীর করছি ডুব,
ফাইটার প্লেইন আমারে তখন বললো, ডিসটিউনড।
এই নিঃশ্বাস, এইসব শিস
শুনবে না কোনো কান।
মুমূর্ষুদের কাতর দোয়ায়
দয়াপরবশ বোমারু বিমান
পাঠাবেই শেষ ত্রাণ।

আর আমি একজন কবির বাচ্চা, গভীর করবো ধ্যান।
দেহহীন কোনো উড়ে আসা হাত
দুই হাতে ধরে রক্তসমেত,
এক বাচ্চা দাঁড়ায়ে আছে।

আমি ভাববো, এই হাত কোনো আসমান থেকে নাজিলকৃত ফুল,
শুঁকতে যাকে, গেছে পরাগ লেগে,
শিশুর মুখ আর দেহে।

আমরা কেহ রক্ত দেখলে
এসব ক্যাওয়াজে নিজেরা ঢুকলে
গভীর হবে না
বধির হবে না
চোস্ত হবে না ধ্যান।


পার্সিভ্যাল হিল ও সন্ধ্যা

জনতা ও জনতার অন্তস্থ বহু তরঙ্গ নিয়ে থাকে চকবাজার। কিছুদূর ডানে বঙ্কিম রাস্তা ধরে গভীরে যুদ্ধসমাধি; মৃত লোকেদের এই মসজিদ দাঁড়ায়ে আছে সেখানে বিস্তীর্ণ বছর।
অন্যপাশে কোচিঙ,— ছেলে ও মেয়েরা সন্ধ্যায় এখানে বেরোয়; জমায় আড্ডা।
আমি জানি, উচ্ছ্বাস রূপ হারাতে, বামে চলে যেতে তাদের কতো ক্ষণ আর। তারা কবে শুনবে স্বীয় স্তব্ধতার ভেতর, যূথ ভেঙে, ঝিঁঝিঁ ও ক্লান্ত এক বিশেষ কাকের ডাক, এবং ক্যানো, আমি জানি।

নিজেকে এসবে নয়, আমি জড়িয়েছি পাহাড়ের গায়ে; জীবন ও মৃত্যুর বহির্বিশ্ব নিয়ে যে আছে দাঁড়ায়ে। পতন ও উড়নরহিত মানুষেরা আসে এইখানে। তবু জীবন ও মৃত্যুর স্মৃতি ও ব্যথা তাদের, ব্যথা ও স্মৃতি আমার আছে, বিশ্বের পরিবেশে পাওয়া।

অন্তরে অঙ্গার, কিভাবে, কী রহস্যে, যেনো অঙ্গারই আলো, মুখে মানুষের দীপ্ত করেছে হাসি! ছায়া যদিও দেখায় শ্রান্তি; মাটির দিকে ঢলে পড়ে যাওয়া রূপ,—
তারা উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে।
ঢেকে অঙ্গার ও ছায়া, হাসি নিয়ে মানুষ ডেকেছে চূড়ায় উঠে, দূর থেকে হাত নেড়ে, আত্মা ও আত্মীয়দের। এরাই পাহাড়; বহুভাবে মানুষ আহত হয়েছে যেথা, কাছে যেতে গিয়ে, এবং পেরিয়েছে তারা তবু পাহাড় ও পাহাড়।

…যে স্থান আছে পার্সিভ্যাল হিল নামে, শান্তি কি সে?
এই পাহাড় ও আত্মা ব্যতীত, পেরুনোর আর কোনো ঢিবিও আমার নেই। এই উঁচা থেকে, আমার স্মৃতি ও বেদনা থেকে ভার, ধীরে ছুঁড়ে দেই নিচে, পৃথিবীর গায়ে।
অতপর আমার আত্মা ও থেকে যাওয়া যা কিছু, হিল রোড দিয়ে নেমে আসে নিচে, নেমে আসা পানিদের সাথে, ঢলে পড়া ছায়া সাথে সাথে নিয়ে।

ক্রমশ হর্নের শব্দে ধরণী ক্ষীণ হয়ে যায়, ক্রমশ হলুদ হয়ে যায়;
রাস্তায় দেখি, ব্যথা আর হর্ষের সংঘাতে ধরণী হতে চেয়ে কালো অন্ধকার, যেনো আর পারে নাই।  


উবাইদুল্লাহ রাফী : কবি ও কাবজাবিদ। চাঁটগাইয়া, নৃবিজ্ঞানের ছাত্র।

 

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s