(১)
ক-উবাচ
একটি তরল রাতের গভীর চেতনার কথা। একটি বৃষ্টিবহুল রাতের ক্ষীণতেজা স্ট্রীটল্যাম্পিয় ছায়ানিবাস। একটি অকস্মাৎ পুরুষের অদৃশ্য অভিকর্ষাধীন একটি নারীজন্ম। যে ভোরের স্বপ্নগুলি স্নায়ুর ভেতরে রচনা করে এক গভীর বৈপরীত্য। একটি পাহাড় যা প্রামাণ্য হতে পারেনি বাস্তবতার। জলের গভীরে মৃত্যুমুখী বরফচেতনাগুলির ক্রমবিকাশ। টুপ্ করে খসে পড়া ডায়ালঘড়ির নিদ্রাবিলাসে আঁচিয়ে নেওয়া একটি নারীহৃদয় আয়নাময় হয়ে ওঠে। বৈপরীত্যের কল্পনাময়তা তার আঁচল চাপা রাখে বালিশের নিচে।

(২)
ক-উবাচ
কখনো কঠিন হয়ে আসে নিরক্ষরেখার অভ্যেস। কখনো দুর্লভ হয়ে আসে দারুচিনিদ্বীপের সুবাস। একটি নন-লিনিয়ার পথের লিনিয়ার এপ্রক্সিমেশনে রাধা হয়ে ওঠে বামপায়ের নূপুর। সময় বড় কঠিন ছিল তার। এ অচেনা ভূমিরূপের লাবণ্যতা নারকেল কোরা বঁটির ডগায় অপেক্ষা করতো আততায়ীর মতো। যে প্রজ্ঞা প্রজ্জলিত রাখতো একটি সহজ প্রেমের কুশীলবদের, তার দূরত্বময়তা নীড় বেঁধেছিলো কিশোরীর জমানো পালকদেশের বিষণ্ণ নোঙরে। কিশোরের চুল আঁচড়ানোর প্রহর এসেছিলো।
(৩)
খ-উবাচ
প্রথম ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। অবশ্য এ পাহাড় এ অববাহিকা কিছুই ভালো লাগছে না। মনে পড়ছে সেই বেগুনী সাইকেলের কথা। যার পিঠে বসে কখনো দুজনে পুষ্পক ভেবেছি। কখনো কালবৈশাখীর মতো জটায়ুরা রেখে গেছে কাঁচা আমের অলংকারসম প্রেমের তালব্য শীতগুলি। দুই সরল ব্যঞ্জনবর্ণ ছিলাম আমরা। সময়ের পাকচক্রে কখন যে যুক্তাক্ষরে প্রবেশ করেছি বুঝতে পারিনি। জানিনা কোন গুরুচন্ডালি দোষে একটি সাইকেল রয়ে গেলো ন্যুব্জ দুয়ারের নিসর্গ অতীত রোমন্থনে। নিবিড় হয়ে আসে দিন। প্যাডেলের শব্দ শুনতে শুনতে আমি তার আলুলায়িত বিকেলকণা মেখে নেবার দৃশ্য দেখতে পাই। খুব ইচ্ছে করে এই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তার শিয়রে মাথা রেখে আরো কয়েকটি সোঁদা মুহূর্ত ভরা কোটালে ছেয়ে যাক আমাদের নাতিশীতোষ্ণ হারেম।

(৪)
খ-উবাচ
এখন বিকেল যুগ। মনে হয় লোহার ব্যবহার ভুলতে বসেছি। একটা ক্যাফেতে বসে পাহাড়ি আলো চুষতে চুষতে আমার আর্দ্রতার কথা মনে পড়ে। যার মেদুর উপচ্ছায়ায় একটি নেশাখোর উপগ্রহ বসবাস করতো। যার দৃষ্টিক্ষেত্রের বাম কোণে রাখা ছিল এক চিলতে দ্বীপ-মন। তির্যক যার বরিয়েলিস। মাংসাশী পাখিদের পরিত্যক্ত হাড়-কাঁটা দেখে যাকে কখনো পর্তুগীজ কলোনি মনে হতো। অথবা কখনো মনে হতো তোমার ঢেউয়ে ফসফরাস মেশানো ছিল বলে সে রাত্তিরে ফেরানো যায়নি আর ভুলে আসা নৈর্ব্যক্তিক উল্কাগুলিকে। কিছুটা কফি ছলকে ওঠে আটপৌরে সাজপোশাকে যেন ইলিশ মাছের তেল হানা দিলো তোমার দারুচিনি অপাঙ্গে।
(৫)
খ-উবাচ
সে বড় সুখের সময় ছিল। সে ছিল বড়ই নিবিড় ইস্কুল পালানো। অথবা ড্রোনের মতন জন্মদাগ ছিল বলে পাড়া পড়শীরা ভীনগ্রহীতার দোহাই দিতো। তুমিও ছিলে। বারান্দায়, দোলনায়, চেতনা ও হসন্তে। ধূমকেতু আসার মতো ঘটনাগুলি জমিয়ে রাখা ছিল খুব প্রাচীন কোনো ক্যালেন্ডারে। কোনো অপঘাতে মৃত্যু হওয়া জ্যোতিষীর বারোমাস্যার একটি দিনে গোল করে রাখা ছিল বলে কালবৈশাখী এসেছিলো তোমার সাইকেল উল্টে যাবার ঘটনাগুলিতে। তারপর সেজো বৃষ্টি এলো উঠোনে। একটি গাভীর মতো উপমাহীনতা মুখ ভার করে বসেছিল সোঁদা ফুটছিল না বলে। আমি দূরবীনের মাথায় বসে তোমার এন্টেনায় অভিমান পাঠিয়ে দেব ভাবছিলাম। একটি প্রৌঢ় কিভাবে জাগতিক সম্প্রচারের নিম্নচাপের খবরে ভ্রুকুঞ্চিত হতে হতে কিশোরীর টোল-দ্বীপে নাবিকের প্রথম ঘামের নিদ্রাময়তা উপেক্ষা করছিলো।
(৬)
ক-উবাচ
অনেকদিন গেছে। লেখার অভ্যেস অথবা তাগিদ হারিয়েছি। হারিয়েছি উপচীয়মান গলার কাছে অস্তমিত কষ্টগুলির নদীমাতৃকতা। তবু আজ একটি মৃত্যু-নিরক্ষনদীর দেখা পেলাম আজ। তৃতীয় অক্ষে টের পেলাম একটি অর্বাচীন ডিটেকটিভের গন্ধ। যে তোমার গলাবন্ধ সোয়েটারে বাম দিকচক্রবাল খোঁজে আর ডান দিগন্তে সাজিয়ে রাখে আমার রুগ্ন হয়ে আসা বিনুনী। তার কনক্লুশানের সুবাস এলো আজ একটি নিশীথ ব্যালকনিতে । তৃতীয় মানুষটি বলে গেলো যেন, অনেক হয়েছে। ক্লান্তির একটি পরিধি থাকে। একটি স্পর্শক থাকে ক্ষুৎপিপাসার। যে অপেক্ষা কাব্যের বোঝা বাড়ায়, তা যতই সুচারু হোক না কেন, যে সেফটিপিনে মরচে ধরেছে অবহেলে তার উপস্থিতি চেতনায় ট্রমা তৈরী করে। অতএব এ বেদনাবিথীর মরুনিশি শেষ হওয়াই শ্রেয়। ঘুম ভাঙলো। দেখলাম মেজো বারান্দায় এক চিলতে পাখির বাসায় দুটি ডিম ভাস্মর হয়ে আছে।

(৭)
ক-উবাচ
ধূসর হতে হতেও মাঝে মাঝে ফর্সা হয়ে আসে ঈশান বারতাগুলি। যেভাবে জলের অবিশুদ্ধতা ঢেকে দেয় বরফ। যেভাবে বেলা অবেলায় তোমার ঘোলাটে হয়ে আসে মুখ। নিভু নিভু হয়ে আসে মাজুলি দ্বীপের পিদ্দিমগুলি। তোমার পাড়ায় তুষারপাত নামে, আমার পাড়ায় হবিষ্যান্ন। তোমার পাড়ায় পপলার ফোটে, আমার পাড়ায় একটি স্বপ্ন নিদবর হতে চায়। দুটি বয়স সমান্তরালে বাড়ে। দুটি পিটুইটারি প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে চলে একে অপরকে। পথিমধ্যে আসে পত্রহীনতা, ল্যান্ডসাইড, ফ্লাইট ক্যানসেল হবার মতো মাণবক উপসর্গগুলি। একটি বরফ গলতে গলতে উদ্বায়ী হয়ে ওঠে একটি মানুষ। মনে হয় পাহাড়-তোমাকে চিনতে পারবেনা আর এই তটিনী মেয়েটি।
(৮)
খ-উবাচ
কখনো দাড়ি এমন লম্বা হয় যে নিশি সারমেয়রা সন্দিহান হয়ে ওঠে। একটি দিগন্তব্যাপী সমুদ্র পেরিয়ে যেমন একটি প্রজাতির গায়ের রং এ বদল আসে, তেমনি নিজেকে কখনো অনাত্মীয় প্রজাতি মনে হয়। সকালের কফিতে শহীদ হয় একটি কবন্ধ সিগারেট। দুপুরের ডালে সোনার মাছি। একটি জলপ্রপাত উপলে যে প্রতিফলন ঘটায় শীকরের, সে দূরত্বে একটি রামধনু হয়ে ক্রমশঃ এক অদম্য ভার্চুয়ালিটিতে মিশে যাও তুমি। তোমার বাসনকণাগুলি পাবো বলে আমি একটি জায়মান খনির প্রতীক্ষা করি। ধূলিময় হয়ে আসে অপাঙ্গ। মনে হয় যে ফুলেল মেয়েটি আমায় হাতছানি দিতো পরশু-সমাজে, আজ সেও অন্ধ হয়ে যাবে এমন নক্ষত্রহীন আকাশ দেখে। যে আকাশের তারা থাকেনা, তার গায়ে কোনো নারী সেই প্রাগৈতিহাসিক কুঁড়িগুলি রোপন করে গেছে। আশা রাখি, সে নারী তোমাকে চিনতে পেরে তোমার নখে গতজন্মের রুমাল রেখে আসবে।

(৯)
খ-উবাচ
একটি মৃত্যু-স্যান্ডউইচ এর ভেতর নিষ্পেষিত হতে হতে আজ মনে হচ্ছে অনেকদিন পিছন ফিরে দেখিনি। দৃশ্যতঃ সংখ্যাবহুল ক্যাকটাস গুনতে গুনতে ফিকে হয়ে আসছিলো একটি আবহমান কেকা। যার তরঙ্গে বসে তোরঙ্গ খালি করি। যার ডাবের জলের গাড়িতে একটি রঙিন সুতো বেঁধে এসেছিলাম। সময়ের গতিশীলতাই কি ধূসর আবহবিকার আনে? পরিবর্তনের স্মৃতিহীনতাই কি এনট্রপি? ওই ঘরগুলি মনে পড়ে যার অববাহিকায় কোনো ফায়ারপ্লেস ছিলোনা দুঃখ আঁচানোর মতো। একটি শ্লথ সময়স্কেলে আমার শ্রোণীপাখনার গন্ধ নেমে আসে। তালব্য বর্ণ শিখতে শিখতে তোমার হাই ওঠে। মনে রেখো আমি অপসূর অবস্থানে চলে গেলেও তোমার মতো আফ্রিনের জন্য একটি গজল জ্বালিয়ে রেখে আসবো সড়ক-বাতিগুলিতে। মনে রেখো একটি জলবিষুবের রাতে আমাদের ঠিক দেখা হবে।

(১০)
ক-উবাচ অথবা খ-উবাচ
অবশেষে সেই রাত এসেছে। যখন গ্রেস্কেলে উদ্ভাসিত হয়েছে তোমার মুখ। বুড়ো হয়ে আসা দাড়ির গন্ধ অথবা চাবির গোছায় ন্যুব্জ হয়ে আসা আঁচলের শীত পোহানোর অখণ্ড প্রহর। যে অবচেতনের ডেসিবেল মাত্রা গড় ভালোবাসাকে ছাপিয়ে গেছে অথবা যে মানচিত্রে জুম করতে করতে তোমার বাড়ির চৌকাঠ প্রতিভাত হয়ে ওঠে তেমন সময় এসেছে। একটি আকাশে একটি খ মিশে গেলো। জমিয়ে রাখা বালিশ কণাগুলি তোমার কথা জানে। পাশ ফিরে থাকা ফায়ারপ্লেস দেশলাইয়ের আবেদন জানায়। একটি চুম্বন থাকবে শুধু এই শর্তে জন্ম নেওয়া একটি সিনেমা একটি বেগুনি কুর্তি কেনার টাকা জমায়। তুমি এসেছো তাই সবুজ পাঞ্জাবিও বন্ধক রেখেছি ঈশ্বরের কাছে। এই সেই মহাবিষুব। তোমার মতো দিন আর আমার মতো রাত ভারসাম্য লিখে গেছে একটি দূরবর্তী স্বপ্ন-সাঁকোয়। এভাবে দেখা হয়। যেন পাতার উপর শিশির চিহ্ন মুছে দিয়েছি এয়োতির কথা উঠবে বলে।
আলোকচিত্র : সুদীপ দাস
অর্ঘ্যদীপ রায় — জন্ম ১৯৮৯, মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিক্স অ্যাণ্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক এবং আই.আই.টি খড়গপুর থেকে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে আই. আই. টি বম্বে’তে ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গবেষণারত। প্রথম বই ‘একটি জ্যোতির্ময় শিশু আসে’ (২০১৭)।