কিছু বৃষ্টিপাত ও মোহাম্মদপুর — আল-বিরুনী প্রমিথ

সিএনজি থেকে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের সামনে এসে নামলাম। তখন বাজে রাত পৌনে দশটার মতো।

বন্ধু যাবে হাউজিং সোসাইটিতে, নয় নাম্বারে। আমি রাতের খাওয়া সারতে যাবো মোস্তাকিমে। নূরজাহান রোড দিয়ে আগাইতে যাবো, থেমে গেলাম।

নিউ বছিলা রোড, মোহাম্মদপুর। ছবি – লেখক।

বৃষ্টিস্নাত অনেক সন্ধ্যা কিংবা রাতের স্মৃতি আমার স্মরণে আছে। সেগুলার বেশীরভাগই আটপৌরে। এরকম তিনটা স্মৃতির কথা পরপর মনে পড়ে গেলো। প্রথমটা ২০১৬ সালের। তখন বর্ষাকাল হবে , মোহাম্মদপুরের হাউজিং সোসাইটি থেকে বাসায় ফিরতেছি। বছিলা দিয়ে। সেই সন্ধ্যায় বছিলার দৃশ্যাবলীকে লাগতেছিলো ছবির মতো। সরাসরি না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব না, এমন এক ছবি।

দ্বিতীয় স্মৃতি ২০০৮ সালের। তারিখ হবে সম্ভবত ৮ কী ১০ ফেব্রুয়ারী। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঝুম বৃষ্টি। ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টিই বলা যায় সেদিনকার বৃষ্টিকে। রাইফেলস স্কোয়ারে যাওয়া লাগছিলো তারপরেও, ইমার্জেন্সী মোবাইল সারাইতে। বিকাল বেলায় গেছিলাম। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে, রিকশার হুড ফেলে দেওয়ার পরেও শীত পোষ মানতেছিলোনা। ঠিক আজকে যেরকম শীত লাগতেছিলো একইরকম। রাইফেলস স্কোয়ারে কাজ সারতে সারতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জিগাতলায় প্রচুর যাওয়া হইতো। সেখানে অনেকগুলা পুরি’র দোকান ছিলো। যারা বহু বছর ধরে জিগাতলায় বসবাস করেন, তাদের সবচেয়ে ভালো জানার কথা যে সেই সময়ে জিগাতলার পুরি’র দোকানগুলা কতোটা রমরমা ছিলো। ২০০৮ সালে জিগাতলায় যে পরিমাণ পুরি খাওয়া হইছে, তার স্বাদ আজও ভোলা যায় নাই। জিগাতলার যে কয়েকটা বড়মাপের পরিবর্তন হইছে এই কয়েক বছরে, পুরি’র দোকানের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যাওয়া তার একটা।

তৃতীয় স্মৃতির সময়কাল সবচেয়ে পুরনো। ২০০৪ সালের। এপ্রিল মাস হবে, তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। এক স্কুল বন্ধুর বাসা ছিলো শংকর, বিকালে তার বাসায় গেছিলাম। বন্ধুর বাসা থেকে নামার পরপর শুরু হয়ে গেলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি তো বৃষ্টি, নিমেষের মধ্যে হাঁটুপানি হয়ে গেলো। বিশাল সাত মসজিদ রোডে হাঁটুপানির মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে কেমনে ধানমন্ডি ৯/এ তে (তখন সেখানে থাকতাম) পৌঁছাবো, তখন সেই নিয়েই যতো চিন্তা। ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে পা ফেলতে ফেলতে আগাইতেছি আর ভাবতেছি; রাতে নির্ঘাৎ জ্বর তো আসবেই, সাথে যেই ঠান্ডা লাগবে তাতে আগামী এক সপ্তাহ শরীরের উপর দিয়া যা তা অবস্থা যাবে। তো হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবাহনী মাঠ অতিক্রম করে একটু সামনে আগাইতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। আমার থেকে চার কী পাচঁ বছরের বড় এক মেয়ে (আমার অনুমান সেই মেয়ের বয়স তখন বিশ কী একুশ হবে) মাউথ অর্গান বাজাইতে বাজাইতে হাঁটুপানি ভেঙ্গে সামনে আগাইতেছে। চারপাশের মানুষজনের বিস্মিত চাহনি তোয়াক্কা না করে । তখন তো মনে হইছিলোই; তার পনেরো বছর পার হয়ে এই ২০১৯ সালেও আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, ঢাকা শহরে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলার মধ্যে এইটা একেবারে উপরের দিকেই রয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁধে ব্যাগ বইতে বেশ কষ্ট হইতেছিলো। নূরজাহান রোডের উল্টাদিকে একেবারে সামনে যে বেকারীর দোকানটা আছে, সেখানে গিয়ে ফাঁকা রিকশা পাইতেই মোস্তাকিমের দোকানে যাবো বলতে না বলতেই রিকশাওয়ালার তৎক্ষণাৎ সম্মতি পেয়ে উঠে পড়লাম।

শিয়া মসজিদ থেকে নূরজাহান রোড পর্যন্ত হাঁটতে অনেক সময় লেগে গেছিলো। দুই পা ফেলি এবং চারপাশে তাকাই। উপরে যে তিনটা স্মৃতির কথা উল্লেখ করলাম, প্রতিবার এমনটা হইছিলো। অকস্মাৎ হামলাই শুধু হয় এমন না, অকস্মাৎ সৌন্দর্য্যও আমাদের কাছে এসে ভিড় করে।

সেরকম সময়ে যদি রাস্তায় থাকি, হাঁটতে হাঁটতেই বারবার থমকে যাই।


আল-বিরুনী প্রমিথ – গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘এসকেপিস্ট’ , ‘এপিটাফ’।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s