‘তৌবা ফুল’ ধারণাটির মধ্যে অসম্ভবের সম্ভবতার একটা ইমেইজ। ‘তৌবা’ আর ‘ফুলে’ জোড়া দিতে দিতে দিতে, শব্দার্থ ফাটিয়ে অর্থ-ঝোঁকের নবজাতকের দিকে লক্ষ্য করতে করতে, বইটির পৃষ্ঠা খুলে এগিয়ে প্রায় খারাপ অভিজ্ঞতা হয় আমার। আপনাদেরও তাই হোক, সেই দোয়া রেখে দুঃখবর্ণনা করি। প্রথমেই, বর্ণনার সরলতার জন্য একটা উইলিয়াম দে কুনিং এর আঁকা মেরিলিন মনরো উদ্ধার করা যাক। তারপর, ওয়াম্যান এন্ড বাইসাইকেল ।

এখানে আঁকার পদ্ধতি, বিশুদ্ধ একশন পেইন্টিং-এর চরমপন্থার থেকে কিঞ্চিত কম। কিন্তু, কিউবিস্টদের আবিষ্কৃত আরামদায়ক জ্যামিতির চেয়ে বেশ পরের পর্যায়। বেইজ ড্রয়িং আছে কিংবা নাই, তৃতীয় দফা রঙ ঘষা দিয়া প্রথম দফার তলপেট ছেঁদা করার পর হয়ত আবার প্রথম দফার একটা রেখা আঁকা হচ্ছে, ইত্যাদি। কমলা কি হলুদ বহে তাহে বক্ষবন্ধনী। এরপর একদফা চারদিকে থ্যাবড়ে দেয়া জায়েজ আছে, অবশ্যই। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে তারপর ‘মনরো’, ‘ওয়াম্যান ও সাইকেলের’ মাংসখণ্ড, হাড্ডি, নাটবোল্টু ইত্যাদি জেগে উঠতে দেখা যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

কবিতালেখক রাদ আহমদ ওই পদ্ধতির ভাষিক সমান্তরাল। চারতলার বারান্দা থেকে দেখা দৃশ্যের বাক্যবর্ণনার স্তরের মধ্যে ধরা যাক লখিন্দরের বাপের দুঃখের স্মৃতি, তলদেশে রিকশা বহে টুংটাং, তার মধ্যে অটিস্টিক শিশু ও লালরঙ বাসের ভিতরে গ্রামের বউ ঝি বমি করতে থাকবে, দাঁড়িকমা উধাও হয়ে যেতে থাকবে, এরপর ঢাকা শহরের কোথাও দুধ চা না রঙ চার দ্বিধার উপর আস্তে করে একটি তৌবা ফুল ঝরে পড়বে… এই বইয়ের যেকোন পৃষ্ঠায় আপনি নির্ভুলভাবে এই পদ্ধতির দৃশ্যের বিপদে পড়তে থাকবেন। যেমন এলোমেলো খুললাম পৃষ্ঠা ৭১:
ভালো তুমি নাটকের মধ্যেখানে শিয়ালের চাষ করা কমলা রঙের ভঙ্গিগুলা।
রোদ যদি আসে জানালাতে ছোটো ছোটো চারকোণা বিস্কিটের গায়ে ঝুরঝুরে গুড়া এত ভঙ্গুর যে তাকে ধরে রাখাটা মুশকিল
তুমি যেন কিলবিলে জিয়ল মৎস্য চাষের সফল প্রক্রিয়া যখন দেশে প্রথম এসেছিল
এত কেন এত কেন ভণিতার স্বাভাবিক সুর কেন লালচে রোদের গায়ে জেগে থাকে
ক্রমান্বয়ে তোমাকে এ ভঙ্গুরতা শেখাবে যে গোকুলে বাড়িছে সে তার ওই তাস ধরা মসৃণ আঙুলগুলা দেখ
আরও একটু সর্বনামে ডাকো তাকে তাকে তুমি যৌনতার গভীর তত্ত্বগুলা সাজাও
সাদা মানি-প্ল্যান্টে জানালার গ্রিল ধরে যারা ক্রমাগত
উপরে উপরে আরো নীলের গহীনে ঘন উড়ে যায় তারা দূরে দূরে – ক্রমাগত একে অপরের থেকে সম্প্রসারণশীল ব’লে কথা
বেলগাছ কাঁটাযুক্ত এই গহীন দুপুর সুপ্ত কথাগুলা জেনে তুমি দাঁড়িয়ে আছ
যেমন, পৃষ্ঠা ৩৪:
ছোট মানুষের শার্ট লুঙ্গি পরিহিত এই সকালের কালে
দুধ চা দিবি না তো রঙ চা দিবি? কেন খাপো লালনের
সমসাময়িক কিংবা আরও আগেকার
কুমারখালির রাজা – হা হা কুমারেরও খালি আর
তারও বা যে রাজা যদি হই আমি কেন
দুধ চা দিবি না রে রঙ চা খেলে পরে
যাত্রা হপে শেষ? কি বা আর হপে যাত্রা হপে নাকি শেষ তয়
দুধ চা দিবি?
কিন্তু, খেয়াল করুন উপরের দ্বিতীয় উদ্ধারে। অক্ষরবৃত্তের তাল ধরা আছে। এমন উদাহরণে ঠাসা। থেকে থেকে মহাপয়ার পাবেন, বা অবহেলে ও অনায়াসে চামড়া ছুলা স্বরবৃত্ত কাৎরাবে (যেমন, সেখানে সব কুকুর কুকুর এমনকি পুরা/পাহাড়টারই নিরস্তিত্ব কেবল অটো/ভাড়া তাদের তিনশ কিংবা তিরিশ পাঁচে/রাস্তাঘাটের জীর্ণ পাগল বৃদ্ধা তারা শান্তিতে নাই।/)। আধা-ভচকানো আধা-বিশুদ্ধ উপায়ে ছন্দের তাল ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে রাখা রাদের প্রবণতা,– ছন্দের ওজনের গরিমা নষ্ট করে করে একে পোষ্যপ্রায় করে রাখা।
প্রশ্ন হলো, এই আলাপের অর্থ কী, যদি বাংলা কবিতায় বেশ পুরানা ঘটনা হয়ে থাকে সিনট্যাক্সের দুর্ঘটনা ( যেমন, জনাব উৎপল কুমার বসু)? বা, কী কাহিনী রাদের ঢাকা শহরের নাগরিকতার?
প্রথমত, রাদের বাক্যের বিপর্যাসের গন্ধ, চেহারা, আওয়াজ ঢাকার যেকোনো রিকশা-টেম্পো-কার-অলংকৃত সৌগন্ধ রাস্তার মত মার্কামারা হয়ে উঠতে চাচ্ছে ।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ঢাকাই নাগরিকতার শহীদ কাদরীয় বা শামসুর রাহমানী অবয়ব যেটা,– তার থেকে রাদ ততটাই দূরে, যতটা দে কুনিং হন জ্যামিতিময় কিউবিস্টদের থেকে,– উপকরণ / উদ্দেশ্য / বিন্যাসপদ্ধতি ইত্যাদি সব বিবেচনায়।
সংযুক্তি : ‘তৌবা ফুল’ বই থেকে কয়েকটা কবিতা
বলতেসিলে চাউল
বলতেসিলে চাউল এই ধানমন্ডির সকালের ঠিক মধ্যখানে
যা যা লাগা যেতে পারে সাধারণ গৃহস্থালির কাজকর্মে সে জিনিসগুলা
সাদা বাড়ি। সামনে দিয়া কাচ নামান সিডান
গাড়িটার জানলা দিয়া এত্ত নীরব যে তাকে কান্নার মত বলতে পারা যায়
তোমার মুখখানা এইসব দিন থেকে চয়িত যদি বা করা যায়
তাইলে দেখবা হাসি ও কান্নার মধ্যে খুব
পার্থক্য নাই আসলে, এই যে লাল বাজারে কাটা মাংস, ঈষৎ গোলাপি পেঁয়াজ
শুক্রবারের বিক্রেতা যারা
অসহায় অসহায় তির্যক আকাশে তাকায়ে দাঁড়ায়ে থাকা বিল্ডিঙের ফলা
এরা কিন্তু সেই কান্না তার সাথে অল্পস্বল্প আনন্দটা বটে
বলতেসিলে চাউল,আমি তার সাথে এক ব্যাগ
খাবার স্যালাইনও নিয়া আসছি
পেয়ারা গাছের পাতা
সব ঠিক আছে
পেয়ারা গাছে পড়ন্ত বালুকাবেলার বেলা
পাঁচতলা থেকে দেখি তাকে
নীচ দিয়ে খুঁটিনাটি দৈনন্দিন
মানুষের স্যান্ডো গেঞ্জির চিকন কাঁধ
কাজ করা হচ্ছে একজন ফেরিওয়ালা এবং
যান বাহনের দূরাগত শব্দ খুব
স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ পাখীদের ডাক বলে যায়
তুমি যদি এ সময়টাকে পাহাড়পুরের পুরাকীর্তি ভাব
লখিন্দরের বিগত স্মৃতির মত ঘুমিয়ে থাকাটা
খুব করে এনে দিতে পার এই বাহুতে সূচাগ্র
বুকের সিনার মাংস জুড়ে কোনো
অধিকারবোধ যদি ছেড়ে
দেওয়াটা কি আসলে সম্ভব? সেটা
ভেবে দেখতে হবে আপাতত
পেয়ারা গাছের পাতা
পাঁচতলা থেকে সুন্দর
তৌবা ফুল
তৌবা একটা ফুলের নাম। তৌবা ফুল।
খুব কষ্টে যা কাদা এবং যাবতীয় পচে যাওয়ার মধ্যে জন্মায়
খুব শিরশিরে অবস্থানটা টের পাচ্ছিনা, কিন্তু এই প্রায়ান্ধকার ঘিঞ্জি বাড়ির
রান্নাঘরে বহুকষ্টে এসে ঢোকা বিকালের আলো
স্টিলের গ্লাস অথবা কাপ, প্লেট
পিরিচের উপরে জন্ম নেওয়া
তৌবা হল সেইরকমের একটা
হুলুস্থুল উদ্দাম নৃত্যের মধ্যে
জীর্ণ কাপড়ে আলো প্রচণ্ড
অবাক বিস্ময়ের মধ্যে মৃদু হাসতে থাকা
স্থির নিশ্চিত এক বৃদ্ধার চোখ
ফ্রিজের ডালা
কেকের ভিত্রে চকোলেট আর এ্যালকোহলের গন্ধ
লুকিয়ে চুরিয়ে জানালা তার দূরের থেকে পর্যবেক্ষণ
অফিস যাবার তাড়নাগুলা মাকড়শা ও মাকড়শাহ
অল্প অল্প গুনে নেয়া যেতে পারে শ্রীমঙ্গল –
শ্রীমঙ্গল শুনলে পরে প্রমোদভ্রমণ অথবা মৃত মানুষটাকে
কত যে ভালোবাসা
লুকিয়ে চুরিয়ে মাকড়শাটা শিশু আঙুলে খেলা করেছিল
মেটে রঙের ঝড় বয়েছিল গাছগুলা সব জলপাই রঙ
টেবিলকে ঘিরে যত আলোচনা সবাই এবং সক্কলে তো
পাড়ি জমিয়েছে বিদেশ গিয়েছে খিন্ন ডানার কবুতরগুলা
বেহালা বাজাল কেকের উপর?
বাসা বাধল দাঁত দাঁত আর সকালবেলার
টুথপেস্ট যার ডাণ্ডাগুলা প্লাস্টিক ঠিক সাতাশ বছর আগেও যেমন প্লাস্টিক ছিল
পেয়ারা ছিল । জলপাই না । পেয়ারা রঙের
লুকানো চুরানো লুকানো চুরানো এইসব কথা
খাবার টেবিলে সন্ধ্যাবেলা গ্রেফতার হলে অকস্মাৎ
নির্দোষ যে তার উপ্রে কিসের দোষের আরোপনে
নির্বাক হওয়াটাই তো স্বাভাবিক তুমি খুলে নিচ্ছ ফ্রিজের ডালা
একটু ঝুঁকে
লুকানো চুরানো তোমার মুখটা পেয়ারা গাছের ডালের পাশে
পেয়ারা বাড়ির পায়রাগুলা তারা তাদের কাজ করেছে
ফিরে গিয়েছে উড়ে উড়ে সাতাশ বছর আগেই তারা
ফ্রিজ খুলবার আগাম খবর
দিতে দিতে ঝরে পড়ল

বইটা পেতে ক্লিক করুণ https://toulot.com/
মহসিন রাহুল – জন্ম ১৯৮১, সিলেট। পড়াশোনা সিলেট ও ঢাকায়। পেশায় চিকিৎসক। একটি সরকারী জেলা হাসপাতালে কর্মরত।