‘তোমার সাথে আক্ষরিক’, মেসবা আলম অর্ঘ্য , প্রকাশকাল ২০১৬
এই বইয়ের কবিতা সম্বন্ধে কথা বলতে দুই একটা আধুনিক শিল্পের স্মৃতি আমি করতে চাই।
কৈশোরে দুঃখের দিনে একদা ইংগমার বাইরম্যানের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম ভিডিও। লোনলিনেস নিয়ে কথা ওঠে । আজ ঠিকঠাক রেফারেন্স ছাড়াই নিরাপদে তাঁকে উদ্ধার করি, যেহেতু আলাপ কবিতার। বাইরম্যান বলেছিলেন, মানুষের বাচ্চাদের কোনো নিস্তার নাই লোনলিনেস থেকে, কোনোভাবেই নাই। এই লোনলিনেস থেকে পালাইতে চেয়ে-ই মানুষ আবিষ্কার করেছে রাজনীতি, ধর্ম, বিয়ে, ঈশ্বর, সাহিত্য ইত্যাদি। কিন্তু, নিস্তার তার— প্রকৃতপ্রস্তাবে— কোথাও নাই।
বাইরম্যানকে ওখানেই রাখি। আশার কথা হলো, নিজেদের বিষয়ে আমাদের ‘প্রয়োজনীয় ভুল-বিশ্বাস’ ( ইংরেজিতে বলা যায়, essential delusion) আমাদের মাথার উপর লোনলিনেসের ল্যাংটার উপর ছাতা হয়ে আছে। তা-ই আমাদের বাঁচায় সত্যের বজ্রপাত থেকে। আমরা বেঁচে থাকি এভাবেই। মানুষের অস্তিত্বের জন্য স্বাস্থ্যকর এসব মিথ্যা বিশ্বাসের বর্মের ভিতর বেঁচে থাকা একেকটা পাঁচ পয়সার লোক আমরা সকলে। একে কি ‘দন কিহোতে সিনড্রোম’ বলে নতুন নাম দিতে পারি আমরা? কেন নয়?
কিন্তু, দুর্ভাগা হয় সেই আদমি যার উক্ত জ্ঞান ঘটে যায়; উক্ত সচেতনতা ঘটে যাবার পরে যে-কিনা আসে কবিতা লিখতে। যে জানে জগত-ভর্তি সকলেই দন-কিহোতে সিন্ড্রোমের মিষ্টিমিষ্টি রোগীদল,— তার কে সহায়, আশমানের তলে? ‘তোমার সাথে আক্ষরিক’ এর লেখক তেমন একজন দুর্ভাগ্য ভাষালেখক। বা, সকল ভাগ্যের বাইরে বসে, রোদের মধ্যে বা ছায়ায়, একলা চারদেয়ালের মধ্যে বসে, বা বারান্দায় কি ছাদে বসে মংগল গ্রহ দেখার চেষ্টা কদাচিৎ করলেও, বাতিকগ্রস্তের মত এই লেখক আমাদের জানাইতে থাকে, নিস্তার নাই, নিস্তার নাই, বন্ধুগণ….

প্রায় ৬০/৭০ টা কবিতা এখানে গ্রন্থবদ্ধ, এবং বাংলাকবিতার উদ্ভিদ-ভক্ত পরিবেশের নরম পাঠক, তোমাকে প্রায় ঝামা ইটের ঘষার মত অভিজ্ঞতা দেয় এর বাক্যভংগি, বক্তব্য-পরম্পরা, আর কাঠালো ঘন বেসুরা শৃংখলা। আশ্চর্য লাগবে যে, সর্বত্রই ঘোরগ্রস্তের মত একটা লোক, অথচ টাল খেয়ে পড়ে যায় না। একটা বারও ছন্দ লিখলো না মাত্রা গুণে, বাংগালির প্রিয় যৌথ-স্নায়ুতে চুলকাচুলকি করেই না প্রায়,— নিজের চারদিকের তুচ্ছ বস্তু-দুনিয়ার মধ্যে ভয়াবহভাবে পতিত থাকলোই, আর সেগুলি মুচড়েটুচড়ে জৈবতা দিয়ে, আলগোছে হামাগুড়ি দিয়ে কমেডিয়ানের মত ঠিকঠাক শুয়ে থাকে।
অসামান্য বিষয়গুলি অর্ঘ্যর কবিতায় খালিচোখে দেখা যায় না। পরদেশে অবস্থান কিংবা ঢাকার হাতিরপুলের পরোটাওলার গমগম কাশি কিংবা বিশশতকী ইউরোপ-আম্রিকান ঘেয়োবাস্তববাদী বিবরণের ঝাপটা বা মুনীর চৌধুরীর বাড়ির জবাফুলের রেণু এগুলির বেধড়ক মিশেলকে বিভিন্ন আলাদা রঙে চিনার উপায় প্রায় নাই। প্রয়োজনও বিশেষ নাই।
খেয়াল করুন, বার্তোলুচ্চির ‘ড্রীমার্স’-এ পাথর ছুঁড়ে মারে বাইরে থেকে, জানালার কাচ ভেংগে শ্বাসরোধিতপ্রায় ৩ জন উদ্ধার হয়, ঘটনাচক্রে। মিছিলে যোগ দেয়।
কিন্তু, অর্ঘ্য’র জানালায় এহেন মহাজগতিক ঢিল মারা…. কী দরকার? কী বা সেই ঢিলের অধিকার?
পৃথিবী হয় আমাদেরই বুবিট্রাপড্ সার্বভৌম গুলবাগিচা— তদুপরি বিবিধ বিখ্যাত বায়ুরোধক প্রাচীরে ঘেরা, যা অর্ঘ্য ও আমরা কেউ কেউ জানি। এই জ্ঞানার্জন থেকে আমাদের বাঁচাবার কেউ নাই।
এই বই থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ুন।
আধা বাস্তবের কবুতর
আধা বাস্তবের কবুতর
আধা ব্যালকনির কবুতর
মানুষের ফেলে দেয়া প্রেমের জাজিমে বৃষ্টি পড়ছে
স্পার্মের দাগে বৃষ্টি পড়ছে
এ-মেজরে গিট্টু লাগা আঙুল
আমার বাড়ি এ-মেজরে
ভৌতিক বাক্স
ভিজে
কবুতরের জন্য দেয়া পাউরুটি
ভিজে চুবচুবা কবুতর
আমার ছুঁড়ে দেয়া পাউরুটি খায় না কেন?
মঙ্গল গ্রহ
মঙ্গল গ্রহ খুঁজছি আকাশে
কিন্তু সে নাই
তার বদলে আছে কমলা একটা দাগ
আর মেঘ,
মেঘ আর
বিভিন্ন অস্বাভাবিক কল্পনার
বোদলেয়ার
কাটাতে না পারা তোমাকে এসব নিয়ে
কিছুই বলতে না পারার উছিলায়
বন্যার কথা ভাবতে থাকি আমি–
মঙ্গলগ্রহ খুব কাছে আসলে তো জলোচ্ছ্বাস হবে
অনেক মানুষ মারা যাবে পৃথিবীতে
তাও যদি আসতো!
অভিব্যক্তি না
গুজব, ছন্দ ইত্যাদি না
আমি খুঁজছি নিতান্ত স্বাভাবিক একটা গ্রহ
ক্রমে থির হয়ে
পৃথিবীর
একটা বোতলের
পাশে
ক্রমে আর
তোমার প্রিয়
কবিতা লিখছি না বলে, যে
তুমি দেখতে ভালো তাই
কবিতার একটা মান তৈরি হয়ে যাবে
যে তুমি আকর্ষণীয় এবং
অপমানিত – পৃথিবীর এহেন
নানা ধর্মের মানুষের মদের বোতলে
খুব গভীর কিছু কথা
লেখা হয়ে যাবে
চোদ্দই ডিসেম্বর
মুনির চৌধুরীদের সেন্ট্রালরোডের বাসায়
একটা জবাগাছ ছিল
আমি বায়লজি ব্যবহারিকের দিন
ফুল পাড়তে যেতাম
হাতিরপুলে আর কোন জবাগাছ চিনতাম না
মুনির চৌধুরীকে যেই বাসা থেকে জিপে তোলা হয়
সেই বাসার স্বাধীন জবাগাছ থেকে
ফুল তুলে আমি
পরীক্ষাগারে নিশ্চিহ্ন করতাম
পাপড়িগুলি চিরে
গর্ভপত্র আলাদা করে করে সাবধানে
ফুলটার সবচেয়ে তীব্র,
সবচেয়ে প্রেমের জায়গাগুলি খুলতে হতো
পরীক্ষার পর ওরা আর কোথাও থাকতো না
একটা স্বাধীন ব্লেডে
প্রচণ্ড উজ্জ্বল
প্রচণ্ড অর্থহীন কিছু রেণুর দাগ
লেগে লেগে থাকতো কেবল
এবং আমি পাসমার্কের হিসাব করতাম
ছুরি হাতে
ছুরি হাতে বসে আছি তোমার শূন্য ঘরে একা
কখন ফিরবে তুমি কখন কবিতাপাঠ হবে
বৃষ্টি হচ্ছে ধীরে, খুব ধীরে একটা চামচে
তোমার আয়না থেকে আলো এসে পড়ে… আর…
ঠিকরে বেরিয়ে যায়
সন্ধ্যার শহরের উপর – শহরের অবতল পারদে নিকেলে
নিয়ে আসো আয়না পরিধি
মিলিত থালায় রাখো ফালি ফালি কাটা তরমুজ
বৃষ্টি হচ্ছে দূরে, ফুটপাথে বাজিয়ে পিয়ানো
আমার ছুরির ফলা অপেক্ষমান
নুপুর ঝুমুর ক্রুর বস্তুর ক্ষার অক্টেভে
চলে আসো অম্ল হে – নোনাজল বাজারে গড়াক –
কখন ফিরবে তুমি
কখন কবিতাপাঠ হবে?
বৃষ্টি হচ্ছে ধীরে
খুব ধীরে
একটা চামচে
তোমার আয়না থেকে আলো এসে পড়ে

মহসিন রাহুল – জন্ম ১৯৮১, সিলেট। পড়াশোনা সিলেট ও ঢাকায়। পেশায় চিকিৎসক। একটি সরকারী জেলা হাসপাতালে কর্মরত।