বই আলোচনা : অতনু সিংহ’র ‘ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয়’ / মহসিন রাহুল

‘ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয়’, অতনু সিংহ, প্রকাশকাল ২০১৮, বেহুলা বাংলা , ঢাকা


১.
অতনু সিংহের কবিতার আগে অতনু সিংহকে প্রথমত কৌতূহলের সংগে খেয়াল না করলে, কবিতাগুলি পড়তে নানান ব্যঘাতের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক যেকোনো পাঠকের।

এই কথার অর্থ হলো, বাংলা কবিতা গত ২/৩ দশকে প্রধানত যে-যে অভিমুখের যাত্রী, বিস্ময়করভাবে সেসব এড়িয়ে অতনু প্রায় আন-ফ্যাশনেবল হয়ে পড়া রাস্তায় ও ঘুম-নাই রাত্রিদিনের প্রকৃতির মধ্যে, ধরা যাক, একটা ধানের চারার বা টিনের চালে এক ফোঁটা বৃষ্টির সাংস্কৃতিক ইতিহাস বলতে, বা ‘প্রেম’ ‘ঘাম’ ‘নারী’ ‘কামনা’ এসবের স্থির মহা-ধারণায় (বাংলার পাঠক, আপনি হয়ত বলবেন: বোকা, তাই বাতিকগ্রস্ত প্যাশনেইট…) ঈমান রেখে এ নিয়ে কবিতায় প্রচুর কথা বলতে অক্লান্ত ও দ্বিধাহীন।

অতনু পশ্চিমবংগের লেখক। কিন্তু কলকাতার নয়, তিনি এটা পরিষ্কার করতে পছন্দ করেন,— হাওড়ায় আমার বাড়ি। পশ্চিমবংগে রাজপথের রাজনীতি, জেল, সিনেমা নির্মাণ, নিজের দেশে বাংলাভাষার উপর নেমে আসা সরকারী খড়গের বিরুদ্ধে লড়াই, রাষ্ট্র বাংলাদেশে (পূর্ব বাংলা) ফলে-ওঠা স্পন্দিত ভাষা ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণের দিকে কৌতূহলী অতনু সিংহ, অতএব, যেকোনো গড় সাম্প্রতিক পশ্চিমবংগীয় কবির থেকে ভিন্ন হয়ে থাকবেন, তা বিস্ময়কর নয় ।

বাংলাদেশের বাংগালীর সাংস্কৃতিক রাজনীতির তদন্ত, ধর্ম-ঐতিহ্য-আধুনিকতা-উপনিবেশবাদের পারস্পরিক সংযোগের বোঝাপড়া, বাংগালির ভাবুকতার ভবিষ্যত অভিমুখ-সন্ধান ও কবিতায় তার প্রকাশের কাজ কয়েক দশক আগে থেকে লেখক ফরহাদ মজহার করে আসছেন। বহুবছর পর, পশ্চিমবাংলার তরুণ একজন কবি আমাদের কৌতূহলের জন্ম দেন এই সিলসিলায় ভাবগতভাবে শামিল হবার মধ্য দিয়ে।

অতনু বলেন, “পুরানো ভাষায়, পুরাতনে ফিরতে চাই। সেই ঘরে ফেরার আলাপই আমার কবিতার নতুন ভাষা। আমি যে ভাষায় কবিতা লিখি,ভাষার পোশাক, সভ্যতা, আলোকগরিমা ভেদ করে যে পরমায়, যে অন্ধকারে সাঁতার দিয়ে ফিরে যেতে চাই যে পরম আলোকে– সেই ভাষায় গোটা পশ্চিমবঙ্গে নব্বই দশক থেকে আজ অবধি কোনো শালা কবিতা লিখছে না। এবং ভাষার মধ্যেকার সেই ঐক্য ও সেই ইতিহাসচেতনার পরারাজনৈতিক অভিমুখ পশ্চিম বাংলায় আমার সমসাময়িক (শূন্য দশক বা প্রথম দশক) কোনো কবির মধ্যেই নাই। কারণ তাদের সুকুমার সেন, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় আছেন, তাদের ইতিহাসে বর্ণবাদী সেন আমল আছে গুরুত্ব সহকারে… কিন্তু সুলতানি যুগের স্বর্ণগরিমা তাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে না। এবং তারা পশ্চিমবঙ্গেরই কবি। কিন্তু আমি বাংলা ভাষার। নিখিল বাংলার। আমার এই বইটা প্রেমের কবিতার বই হলেও, তার পরমার্থে আছে সেই প্রেম যা নিখিল বাংলার ভাষা ও তার ইতিহাসলব্ধ, যা রাধিকার, যা ভোর দিয়ে গাঁথা আযান অর্থাৎ একটি ভূখণ্ডের ভাষার মধ্যে বাস করা মানুষকে একত্রে গাঁথার ডাক, যেভাবে আমি ডাকি আমার মানুষীকে… ব্যর্থ হই। তবু ডাকি। এই ডাক বাতাসে ছড়ায়ে থাকবে আমি জানি।….. “

২.
কবিতাগুলি ৬ টা উপশিরোনামে গ্রন্থবদ্ধ। ইবাদত, প্রাকৃত কবিতারা, অপেক্ষা, ভাষা, নহবত এবং শূন্য তরিকত। উৎসর্গ করা হয়েছে নাদিয়া ইসলাম তিথিকে। কাভারে বলশালী হলুদবর্ণ প্রচুর ধানবীজ ছড়িয়ে রাখা আছে। বাংলার বিখ্যাত অক্ষরবৃত্ত বইটির কাঠামোর তাল, —-যদিও ঠিকঠাক হিসাব-করা পর্বভাগে অনিচ্ছা।

প্রাকরণিক কারিগরিকে গৌণ রেখে, বক্তব্যে ও প্যাশনে ভিন্ন এক সার্বভৌমের যাত্রী বইখানা।

এই বই থেকে এখানে কয়েকটি কবিতা পড়ুন….


মা তারা আসলে পাখির নাম /

এবং ডেসিবেলে
কেঁপেছে চারটে দেওয়াল
ঘুলঘুলি থেকে মারহাবা
আকাশও কী দারুণ খসে গেছে,
বাতানুকূল তছনছ করে
এসেছেন তারা, ভোররাতে,
লাল আকাশের পাশে মুখ রেখে…
জিভ তাঁর রক্তিম,
পায়ের নীচেতে বাঁধা সুরক্ষা-খনির নূপুর,
চুলের অরণ্যে আজও
চাঁদের অন্ধকার, মৃদুমন্দে পাখির আরাম,
তিনি তারা, আমি তার কোহলসন্ধান

তাঁর ত্রিকাল স্বপ্ন থেকে
বুনে ফেলছি রাত, তন্ত্রবিদ্যেরও আগে
সহজ-ফসলের কথা লিখছি স্নানের ঘোরে
তারা পাখি, পাখি-মা তারাটির ডানা থেকে
শিখেছি ভূতল-বিদ্যে আর
চরাচরে ট্রানজিস্টার
সুদূর ব-দ্বীপ থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সংবাদ…
তারা মা মুণ্ডমালা খুলে রেখে
আমাকে শোনাচ্ছেন, নৌকা ভ্রমণের শেষে
মালভূমে মেয়েরা রোজ বাজায় পিয়ানো
গাছের কোটরে কেমনে রান্নাবাটি, আর কীভাবে
বালিতে সূর্য এঁকে সময়ের ওঠানামা,
বোনা হয় শীতের পোশাক,
কেমনে রাঁধতে হয় ত্রিনয়নী-বেরা
কীভাবে হামাগুড়ি, কীভাবে হেঁই-হো
ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আয়না আয়না
কাজল-স্বপ্নে লাগে হকের আযান
আমার পাঁজরজুড়ে সারারাত
পলাশিয়া মেয়ে ও তাহার সে
পরমাপরম, সেই লাল,
আমি তার ডানায় কণ্ঠ পেতেছি, আর
গাইছি ‘সময় তো থাকবে না গো মা
কেবলমাত্র কথা রবে
কথা রবে কথা রবে মা
জগতে কলংক রবে…’

কথায় কথা কেঁপে যাচ্ছে,
চৈতন্য চক্কর দিচ্ছে গ্যালাক্সির তারানায়

আর ভোরবেলায় তারা মা, তারাপাখি
আমার সংগে ছাদে যাচ্ছেন চরাচর দেখবেন ব’লে

কিছুই হারায়ে যায় না /

যা কিছু হারায়ে ফেলেছি
গ্রীষ্মের তটে আর ঝাউয়ের অন্ধকারে
যা কিছু জমানো, রঙিন পাথর,
অংগুরীয়, ত্বক, মসৃণে তার
লিখে রাখা সেতু পারাপার

যা কিছু হারায়ে ফুরায়ে
বসে আছি এইখানে
আবাদ পেরিয়ে আসা
নোয়া নাম্নী এক নাভির দেশেতে
লম্ফের আলোয়, নৌকার খোলে,
পূর্ণিমা আঁশে ঘেরা মৎস্যগভীরে…

সেইসব ঘামের অন্তরায়
মোমের আলোতে আজ
খুঁজে পাই, হারানোরও পরে
প্রিয় এক তৃণভূমি
স্থির ও স্নিগ্ধ পানির ইশারা
হারানোরও পরে কেন
দেহ জেগে ওঠে, তাহার শরীরে
এত গান, এত নৃত্যের ছলাৎ
মনে হয় এই তো আমার স্বদেশ,
আমার আশ্রয়, উপাসনালয়…

হারাবো বলেই আজ এইখানে,
বাদাম অতীত সব ব্লার হয়ে যায়
বসে থাকি, ঢেউয়ে, নেশায়
খোয়াব তীব্র হয়, তট জেগে থাকে

হারানো-ফারানো সব তুচ্ছ আর
নাদান অংকের মতন সরল মনে হয়

ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয় /

নাভির আড়াল খুলে উচ্চারণে এসো
খানিক বসো খানিক জিরাও
তারপর একটিবার ওই আয়না
একটিবার চোখের আকাশ…
দেখবে, শামিয়ানার আড়াল খুলে
কবুতর উড়ে যায়, উড়ে যায়
নূরে নূরে গান আসে,
গানের আযান

জল ঝরে,ভোরের বেলায়
পানি বয়ে যায়
তারপর কৃষিকথা,
উঠানের দূরে দূরে চাষবাদ, লেখাজোকা
সাঁইনামে জালালুদ্দিনের ঘুম ভাঙে,
প্রসাদ সবজি ক্ষেতের দিকে
মেঘে-মেঘে, সাইকেলে
টুংটাং…
মা-তারা বেড়া বেঁধে দ্যান…

মানুষ নিকটে গেলে /

হ্যালো নাদিয়া! আজ বিনয় মজুমদারের জন্মদিন! মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় যদি, কে তবে সারস বলো? কে বা মানুষ! নাকি চাকা ঝলমলে আলোর সন্ধান পেলে গড়ায় ওদিকে! আমাদের মনোরথ, আমাদের ক্যারাভান আবছা আলোকপথে যেন চেয়েছিল কোথা যাপনায় মিশে যেতে! আজ শুধু কবিতারা স্যাঁতস্যাঁতে পড়ে আছে বংগের দুইপাশে ছড়ায়ে ছিটায়ে! কবিতা কি ঘন হলে মানুষীরা উড়ে যান সারসের মতন? নাকি ভিন্ন কিছু কথা ভিন্ন না-কথার মাঝে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতন সীমানা বুনেছে! কথাটুকু শেষ হোক তবে অন্য অন্য কথায় কথায়, কথার আয়নাপুরে… অন্য তিথিতে… কবির জন্মদিনে ধরো ফের ফিরে এলে চিরন্তন কাব্য হয়ে, জয় হয়ে, ক্যারাভানে, সংশ্লেষে, নতুন ডাকের মতো ভোর হয়ে, বিকেলে বিকেলে


মহসিন রাহুল – জন্ম ১৯৮১, সিলেট। পড়াশোনা সিলেট ও ঢাকায়। পেশায় চিকিৎসক। একটি সরকারী জেলা হাসপাতালে কর্মরত।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s