জমানা কেয়া কহেগা / তদোগেন গিরতে


এখনকার ব্যাপার জানি না, তবে সাবেক সোভিয়েতে কাজাখ, কসাক, ইউক্রেন, বেলারুস -নির্বিশেষে যাদের বাল্য বা কৈশোর কেটেছে, তাদের সংগে কথা চালাতে হলে গোগোল খুব ভালো স্টার্টিং পয়েন্ট ছিল– অবাক হয়ে যেত– তারাই তুলে আনত রবীন্দ্রনাথ, মেরা নাম জোকার, ডিস্কো ড্যান্সার–জিমি জিমি জিমি, তারপর ব্রামস, প্যাগানিনি, সালসা, ট্যাঙ্গো হয়ে ব্যক্তিগত পরিসর। সোভিয়েত টিভিতে প্রোপাগান্ডা এদের টানত না, ফলে, সন্ধ্যে হলেই কেউ পিয়ানো, কেউ রবীন্দ্রনাথ…। এদের আগের জেনারেশানকে সতীন্দ্রকাকু (ভৌমিক) বলত ‘চাষা’–দূরত্ব বজায় রাখা, রাফ। আলী সায়েবের আলাপ ‘মোর ইকুয়াল দ্যান দাও’- দের সংগে– সে অভিজ্ঞতা ডিপ্লোম্যাটিক সার্কল ছাড়া বিরল।

পাত্রিক মুলার খুশি হত, এদিকের এডুকেশনাল রিফর্মে– আদতে জার্মান, ৫’৭” -র পাত্রিক ততদিনে প্রায় চল্লিশ, মাথার ৮০% টাক– আর্টস পড়ে, ট্যাক্সি চালিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স বাগিয়ে ভাবল সায়েন্স করবে–মাস্টার্স করে যখন পি এইচ ডি-তে ঢুকেছে সদ্য, সে’বছরই আমি পোস্ট ডক হিসেবে জয়েন করি। পাত্রিক আমাকে কেন মিস্টিক ভেবেছিল জানি না। হয়ত ‘লাভগুরু’ দেখে। প্রতি সপ্তাহে সে ভিন্ন ভিন্ন ন্যাশনালিটির ২০-২৫ বয়স্কা মেয়ের প্রেমে পড়ে আর উপদেশ চায়। ডেট ভালো কাটলে স্নিকার্সের বার, সকালে কাফে-ও-লে ইত্যাদি। ডেটিং বাদ দিলে পাত্রিক পাড়ার পিসিমা-গোত্রীয়–ব্রহ্মার মত যার অগোচরে কুটোটি নড়ে না, চড়াই পাখির হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার ওঠে না।

পাত্রিক একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে– ইউ নো, এনাদার ইন্ডিয়ান হ্যাজ জয়েনড দ্য জেনোমিক্স ল্যাব অ্যান্ড হার নেম ইজ সেম অ্যাজ য়ু। শি ইজ কিউট, বাট হোয়াই হার নেম ইজ সেম? বলি, বৎস, ট্রাই নিতে পারো, তবে আমার ওয়াইফ আর কী। ওটা সারনেম। গল্প পাত্রিককে নিয়ে নয়, কারণ পাত্রিক আমার অফিস মেট নয়।


‘সেম নেমে’র কল্যাণে রোমাঞ্চকর কিছু ঘটনা ঘটে, যা চরম ডিপ্রেসড মুহূর্তে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট– সেলেনিয়াম, মলিবডেনাম, আর কী কী জানি সব। তখন এমএসসি– সেমনেমের দাঁতে ব্যাথা, প্রচন্ড। আমি হস্টেল থেকে তুলে সাইকেলে বসিয়ে দুই দাঁতের ডাক্তারের আস্তানা (১ নং বাড়ি নেই, দ্বিতীয়; চীনা হাতুড়ে) পেরিয়ে তৃতীয়ের কাছে নিয়ে যাই। তিনি, টার্টার দূর করে, অ্যান্টিবায়োটিক (খাওয়ার) ও মেট্রোনিডাজল ক্রিম দেন, ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী চেম্বারে আসেন, আলাপ হয়, এবং সেমনেম তাঁদের দুজনেরই পাদপদ্মে দুটি প্রণাম ঠোকে। ব্যাপার এখানে শেষ৷ হতে পারত। তবে সন্ধ্যে সাতটায় বাড়ির দরজার কড়া নড়ে, এবং সস্ত্রীক দাঁতের ডাক্তার ঢোকেন। তাঁদের অতীত নিবাস বিক্রমপুর জানা যায়, মা চা দেয়, তাঁরা সেমনেম সম্পর্কে জানতে চান– জানান– ডাক্তারের ভাই, যে কি-না একদা ফার্স্ট ডিভিশান ফুটবল প্লেয়ার, এবং এখন তমতমা ইনশিওরেন্স এজেন্ট– পাত্রী চাই। দাবি-দাওয়া নেই– সেমনেমের সংস্কারই যথেষ্ট। মা-র মুখ হাঁ হয়ে যায়। আমি সামাল দিতে বলি– এ তো সৌভাগ্য, মেঘ না চাইতেই রসকদম্ব– কালই কথা বলি, এখন হস্টেলে তো, পাঁচ মাইল, ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ার শেষ– সেমনেম পাত্রী হিসেবে আলবাৎ চমৎকার, তবে বোঝাতে একটু সময় লাগবে, মানে এই মুহূর্তে তার আমাকে নিয়েই প্ল্যান-প্রোগ্রাম তো। ডাক্তার প্লেট থেকে বিস্কুট তুলতে যান, ডাক্তারভার্যা সে’হাতে চাপড় দিয়ে– আরে ছিঃছিঃ, কী কান্ড! কী কান্ড! — ডাক্তার তবুও বিস্কুট। তাঁর মনোঃকান টেনে চেয়ার থেকে তুলে ডাক্তারভার্যা বলেন– আচ্ছা আসি, নমস্কার। আমায় সেমনেম ( যে তখনো আলাদা নেম) -কে বোঝানোর কোনো সুযোগপত্র না দিয়ে। অবশ্য এ গল্প সেমনেমকে নিয়েও নয়। কারণ সে আমার অফিস মেট নয়।


ফোন আছড়ে ভেংগে অ্যানেট চিৎকার করে–ফ্যান! ফ্যান! (শিট)! হাউ হাউ করে কাঁদে মেকাপের তোয়াক্কা না রেখে। অ্যানেট ৩০, সুইডিশ ব্লন্ড–হাজব্যান্ড ইজ চিটিং– সার্টেনলি–ফোনে প্রাইভেট আই! জিং হং (স্ত্রী, চীনা; ৪০-৪৫), জারা মেরজাই (স্ত্রী, ৪৫-৪৬, ইরানী), দিদিয়ে বুতোঁ (পুং, ৩০-৩১, ফরাসী) এবং আমি (পুং, ৩০, ইন্ডিশ)। সামলানোর চেষ্টা করি। অ্যানেট খামচায়, বিজাতীয় গরগর, করিডোরে মানুষ ভরে যায়…। সে রাত্রে সবাইকে খেতে ডাকি, তন্দুরী, লেগপিস (জারা আসেনি)। অ্যানেট এক কৌটো আইস্ক্রিম একাই। জিং হং ও অ্যানেট রাত্রি ১১টায় বেরোয়। দিদিয়ে, বোতলের সামনে বসে থাকে, নিষ্পলক। জানা যায়, দিদিয়ে, আমার গত জন্মের ভাই, অবশ্যি গতজন্ম যে ফরাসীরা বিশ্বেস করে তাদের সুবাদে, ফরাসডাঙায় নেহাত অ্যাক্সিডেন্টে না জম্মাতে পারা, সে কাঁধে মাথা রেখে, খুকখুক কাঁদে, কারণ– বস চায়, সে পারীতে পাস্তুরে মাস-ছয়েক কোলাবোরেটিভ কাজে যায়, অথচ তার সবে ডান্স লেসনের তৃতীয় মাস, ডমিনো ডান্স, সদ্য সে শিখেছে কী’ভাবে কেবল মাত্র ভরসায় ভরসা রেখে বডি আলগা করে পাশের ড্যান্সারের গায়ে ঢলে পড়তে– ছ’মাসে তার লেসন…রামভরোসা। পান্ডে। সেমনেম বারে বারে চোখ পাকায়। বলি, বাড়ি যা দিদিয়ে। দিদিয়ে বলে–থুঃ বাড়ি! জীবনেরই কিছু রইল না, আর চার দেয়াল! রাত দুটো বাজে, শেষ বাস চলে গেছে। দিদিয়ে সোফাতেই, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমোয়।


ঘুমোনোর অনেক রকম মানে হয়। লিটারেল, মেটাফরিক্যাল, সেমি-লিট, সেমি-মেটা, ইত্যাদি আর কী। আমি যে ঘুমোনোর কথা বলছি তার অন্টোজেনি হল, ক্যালিফোর্নিয়ার একদা গাভনর, টার্মিনেটর শ্রী শোয়ার-জন্য-ইগার-এর অ্যানালগাস।

দিদিয়ের ঘুমনোর সমস্যা সে আমায় বলে– মানে, এই, নিমন্ত্রণে বেমন্ত্রণে, কারো বাড়ি গিয়ে ঠাঁয় বসে থাকা, অসীম বসে থাকা, কারণ তার আর নাকি যাওয়ার জায়গা নেই, এতই একেলা, আর অনেক সময়ই (কী আশ্চর্য!), কী হইতে কী যে হইয়া যায়– মিরিয়াম একদিন করুণায় শুয়ে পড়ে– মিরিয়াম প্রায় ৪৫, গোট চিজ আর বেকন দিয়ে লাঞ্চরুমে ফিগ সেঁকে ওভেনে– বিচিত্র গন্ধে ঢিঢি! দিদিয়ে, কাঁদে, বলে–করুণা, স্রেফ পিটি, ওনলি পিটি! বলি– বাছা তুই আরেক টুকরো পিজ্জা নে। কিন্তু, সে আবার ফুঁপায়– তোমাকে বলে যে ফেলেছি, সে কথা মিরিয়মকেও জানিয়েছি, গতকাল–আমি কী বলব, বুঝতে পারি না। কিছুদিন মিরিয়ম আমাকে দেখলে মুখ ঘুরায়, ফলে সেধে চেয়ে একদিন ওই উৎকট গোটচীজে মোড়া ফিগ দাঁতে কেটে বরফ গলাতে লাগে। বরফ তো আর মিরিয়াম একলা নয়, পিয়ের রয়েছে– আনসাস্পেক্টিং বর– তবে আমি যে বজ্রকপাট জাতীয় কিছু সে মিরিয়াম জানে। চিলি থেকে আসা প্যাট্রিসিয়া, উজবেক ওতাবেক সবাই জানে। ফলে ইন্ডিশ, পুং, ৩০, নিরাপদ।

আমার সমস্যা হয় মাস চারেক পর। তদ্দিনে জারা মেরজাই বিদায় নিয়েছে, জারা খোমেইনির সময় ইরান ছাড়া, পশ্চিমি প্রোপাগান্ডার বিপক্ষে সে জানায়, যে খোমেইনি নারীদের উচ্চশিক্ষায় এনকারেজই করতেন, পরেও এক্সপ্যাট অনেক ইরানী মহিলাকে চিনি– ডাক্তার, রিসার্চার– জাস্ট উচ্চশিক্ষার্থে, পোশাক-আশাকে বাকী পাঁচজনের মতই, কেউ নম্র, কেউ বেদম ঝগরুটে। ইরাকীদের পাড়ায় অবশ্য অনার কিলিং শোনা যায়, তারা বোরখা পরে কেউ, কেউ, ডেলিক্যাটাসিয়ান, মুদিখানা আর কী, চালায়, বিয়ে শাদিতে, রোববারে ভাড়া করে ভার্সিটির রিসেপশান হল, গান হয়, নাচ, জলেবি, হালভা, আর রোস্ট মাংসের গন্ধ ম ম করে– করিডোর দিয়ে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময়, একদিন বুড়ো এক ডাকে, হালভা খাওয়ায়। জারা বেদম ঝগড়া-পারংগম, আমাকে যদিও বেশ ভালোই বাসে, সে তার পারসিভড ডিসক্রিমিনেশানের কথা শোনায়, এবং একদিন, মাস ইমেলে এডমিনকে যথেচ্ছ গালাগালি করে বিদায় নেয়।

আমার সমস্যা হয়, জারা চলে যাওয়ার সপ্তাহ-দুয়েকের মধ্যে। সেদিন, অফিসে একা– জিং হং ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলে–আই নিড পারমিশান– আমি লিটারেলি আকাশ থেকে পড়লে– জানায়– তুমি দিদিয়ের বড় ভাই, তুমি সম্মতি না দিলে, এগুনো যাবে না, দিদিয়ে আর আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তাকে তুমি কবুল কর কি-না! দিদিয়ে, লছমন ভাই, নাকি লজ্জায় গুটিয়ে রয়েছে। তদ্দিনে, জানি, জিং হং, স্ত্রী, ৪৫, বর চীনে, মেয়ে বছর ১৪র, চীনে। আর সম্মতি নাকি, আমার চাই! বলি–বাছারা তোমরা, যা ইচ্ছে কর, আমাকে টানাটানি কেন? ভবী ভোলে না। সে’রাত্রে আবার দিদিয়ে, জানায়– এইবার জিং হং -এর বাড়িতে ওরিজিনাল চাইনিজ খেতে যেয়ে– আবার সেই তার অফুরন্ত বসে থাকা–এবং ফলস্বরূপ শুয়ে পড়া– তারপর, প্রাচ্য এবং নট-সো-প্রাচ্যে প্যাঁচাল– রিলেশান।

অ্যানেট, জিং হং, জারা, ও দিদিয়ে এরা সবাই আমার অফিস মেট, সে কারণেই গল্প এদের নিয়েও নয়।


শুক্রবার বিকেল ৫টার পর লাঞ্চরুমে পাব বসে, বীয়ার, চীজ-পাফ, চিপ্স, প্যাটি, মাইক্রোওয়েভের পপকর্ন, ফ্রেশ চিংড়ি বাজারে উঠলে তাই, কাঁচা, একটু নুন বা রাই-সরিষা। দুটো বোতল সাঁটিয়ে চুপচাপ যে কেটে পড়ব, তার জো কোথায়! ইন্ডিশ, পুং, ৩০, যে রেসিস্ট সে কথা সব্বাই জানে– ইকুয়াল অপর্চুনিটি রেসিস্ট। ফলে, সেবাস্তিয়ান লেওদানোস্কি পোলিশ জোক শুনতে আসে, ওতাবেক ইমামভ উজবেক, এন্তনিও মিরান্দা ভিজুয়েট, আলবার্তো হিমেনেথ ইস্পাহানি, হুই গাও চীনা, এলিন ও ক্নুট নরওয়েজিয়ান, কার্স্টেন ডাউন-আন্ডার, ইন্দরপ্রীত সর্দার…আনাস্তাসিওস দামদিমোপৌলস গ্রীক। পাওলা কুনিয়া, আইরিশ। ইভান নালভারতে, বাপ রাশান, মা গুয়াতেমালার–তার সবেতেই রুচি।

স্টুডেন্ট প্রফেসর নির্বিশেষে ল্যাবজব থাকে, আমার দায়িত্বে ডার্করুম, যাতে এক পেল্লায় অটো ডেভেলপার– এক্স রে ফিল্ম। মেশিনের মধ্যে বেসিক্যালি পরপর রাখা তিনটে ট্যাংক, ডেভেলপার সলিউশান, জল, ও ফিক্সার সলিউশান যথাক্রমে, আর একটি বেল্ট গীয়ারে লাগানো। এক কোণা দিয়ে এক্সপোজড ফিল্ম ঢোকালে সে ওই বেল্টের মাধ্যমে যথাক্রমে তিনটি ট্যাংকে ঢুকে, শেষে এক এয়ার ড্রায়ার পার করে বাইরে বেরোয়। গীয়ার ও তার দাঁতেদের পরিষ্কার রাখতে হয়, ট্যাংকের সলিউশান সপ্তাহে একদিন বদলান।

সে’দিন দুই উঠতি চীনা বালক পিছনে পড়ে– এক্সপেরিমেন্ট চলছে, তার মধ্যে তারা ভাংগা ইংরেজিতে ক্রমাগত গুঁতোয়– ডেভেলপার খারাপ, আমি দায়িত্ব পালনে অক্ষম, অপদার্থ বিশেষ, এক্ষুণি সার্ভিস চাই ইত্যাদি। হাতের কাজ ফেলে মেশিনের ঢাকনা খুলে দেখি– শালারা এক্স-রে ফিল্মের বদলে মোটা কাগজের প্যাড, যা ফিল্মের প্যাকেটে সাপোর্ট হিসেবে থাকে, তা ঢুকিয়েছে। সেই কাগজ মন্ড পাকিয়ে গীয়ারের প্রত্যেকটি দাঁতে আটকে গুলজার! ঘন্টা তিন ধরে ঘসে ঘসে সমস্ত পরিষ্কার করে, মেশিন চালু করা অব্দি, কোমরে ব্যথা এবং নিজের এক্সপেরিমেন্ট বানচাল। রাগে, চিল্লাই, ও কাগজে টাইপ করে আনি– য়োর নুডল মে বি সামওয়ান’স স্প্যাঘেটি সামহোয়্যার, বাট ইভেন মাংকিস ক্যান টেল দ্য ডিফারেন্স বিটুইন অ্যান এক্সরে ফিল্ম অ্যান্ড আ পিস অফ কার্ডবোর্ড–আর ডার্করুমের দরজায় স্কচটেপে সাঁটি। মিনিট পনেরর মধ্যে, পাত্রিক সে কাগজ খুলে দৌড়ে অফিসে এসে ঢোকে– করেছ কি! রেসিজমের কেস লেগে যাবে, ভাগ্যি আমার চোখে…। পাত্রিক বাঁচায়, আর পাত্রিকই ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে আমার ইকুয়াল অপর্চুনিটি ব্র‍্যান্ড অফ রেসিজমের খবর ফলাও করে– আমি যে উঠতে বসতে বাঙালিদের খিস্তি করি, তা তো আর তার অজানা নয়।

তবে, গল্পটা ইন্ডিশ পুং ৩০ বা রেসিজম নিয়েও নয়, কারণ, নিজের গল্পে নিজের থাকা বারণ।


সোপ অপেরার কথা ধরতে নেই, এস্পেশালি যদি তা শোভা দে’র সংগে সম্পর্ক রাখে। শান্তির মন্ত্র হল গে মিডিওক্রিটি। ফর দ্য মিডিওকার, অফ দ্য মিডিওকার, বাই দ্য মিডিওকার (বিশ্বেস না হলে শংখ ঘোষ পড়ুন)। ফলে আত্মে এক্সেলেন্স আমাকে টানে না, নিজের মধ্যে সে সব নিদর্শন দেখলে, বাই এনি চান্স, যদি অস্থিরতা জাগে! তাই, যারে দেখতে নারি, তার এক্সেলেন্স খুঁটিয়ে দেখি, ভাবি– আহারে, বেচারা!

টেকিল্যা হল এক্সেলেন্স। এমনিতে সব চাইতে ক্যালরি কম, মদের মধ্যে হেলদিয়েস্ট। এক্সেলেন্ট মানুষেরা টেকিল্যা খায়।

অপর জনে এক্সেলেন্স আমার ভারী ভালো লাগে। সমস্যা হলো, অপর তো আর সিধা মানুষ নয় রে বাবা। সে ছাইচাপা থাকে। ছাই খসাতে খর্চা লাগে। ফলতঃ, তখন ইন্ডিশ আমি, পুং, ৩২– চার বোতল প্রিমিয়াম টেকিল্যা কিনে, বারটেন্ডারদ্বয়, পাওলা ও ট্যাসসের হাতে দিই– এক ক্যান বিয়ারে এক শট ফ্রী। ট্যাসস করিতকর্মা, লেবু আনে, নুন। সে পাব, আর্লি নভেম্বর, হ্যালোউইনের ঠিক আগের শুক্রবার। ট্যাসস; উলভেরিন, পাওলা; বাবা য়াগা– হাল্ক আসে, পরী, ইফ্রিত, কাউন্ট ড্রাকুলা, পাতি ভ্যাম্পায়ার–নন রয়ালিটি, এমন কী টোমাটো ক্রুজ ও অন্যান্য। এই প্রথম পাবের মুড রং-চঙে লাগতে শুরু হয়। রাত্রি দশটার দিকে নাচ। পেরিফেরিতে মাতাদোর, ষাঁড়ের গার্লফ্রেন্ড, ক্যাটউম্যানকে দেখিয়ে বলে–আই ওয়ান্ট আ বেবি উইথ হার। ষাঁড় তখন দুই কোরিয়ানকে এক্সরে ভিশনে দেখতে ব্যস্ত। এক সদ্য আমদানিত বেম্মদত্যি, টেবিলে উঠে পড়ে নাচতে, টেবিল ভাঙে, এবং তার চাঁদিতে চড়-চাপড়ের বন্যা। আমি কাউন্টকে বলি, বাবা মন্টেকিষ্টো, নাচো! সে– কার সংগে নাচবে জানতে চাইলে– পরামর্শ দিই–জনে জনে জিগাইতে; উইথ চার্ম, অফকোর্স — মে আই হ্যাভ দ্য…ড্যান্স। আর কী মুশকিল! রাজি হয় ব্লন্ড র‍্যাপাঞ্জেল। এবং শুরু হয় নাগিন ডান্স–খাঁটি ইস্পাহানি। ততক্ষণে বারোটা বাজতে চলল– মাতাদোরের মুহুর্মুহু, –আই ওয়ান্ট আ বেবি উইথ হার, হার, অ্যান্ড হার লক্ষ্য করে, বেগতিক দেখে, কেটে পড়ি।

পরের দিন (শনিবার) ল্যাবে কিছু ছুটকো কাজ সারতে পৌঁছলে, পাত্রিক করিডোর থেকে পাকড়াও করে অফিসে টানে– বলে, ফাক! হোয়াট ডিড য়ু ডু!! বলি– দ্যাখ পাত্রিক, মাথা তুলতে পারছি না, হ্যাং-ওভার, জ্বালাসনে। সে ছাড়ান দেয়, তবে পার্টিং গিফট সমেত– ডু য়ু নো, কাউন্ট অ্যান্ড রাপাঞ্জেল অলমোস্ট এন্ডেড আপ হ্যাভিং সেক্স অন দ্য ফ্লোর!

অলমোস্ট! শালার অলমোস্ট! ছ্যাঃ!! মিডিওক্রিটি, দাই এসেন্স ইজ ‘অল্মোস্ট’!!

মাস চারেক পর রাপাঞ্জেল ও মন্টেকিষ্টো একত্রে আমাকে একবাক্স অ্যাসর্টেড চকলেট আর ‘থ্যাংকিউ’ কার্ড দেয়– সে খুব মিডিওকার ব্যাপার।

গল্পটা উপরোক্ত ঘটনা নিয়েও নয়। জীবন মিডিওকার হলেও গল্পকে এক্সেলেন্ট হতে হয়। আর অলমোস্ট এক্সেলেন্স হলো কাঁঠালের বিল্বতক্র।


গল্পটা, এক কালো প্যান্টের। ট্রাউজার্স, ধরে নেয়া যায়। আমি সে প্যান্ট দেখিনি ঠিক, অন্তত হাতে নিয়ে, ফলে জানতে পারি না–টেরিকট, কটন, গাবার্ডিন, না স্প্যান্ডেক্স, নিখাদ কালো, না গাঢ় নীল স্ট্রাইপ্স না চেকস।

আমি স্যুট পরি না। জবরদস্তি, বিয়ের সময় সেমনেমের পিতা মহাশয় একটি ধূসর পিস গছিয়েছিলেন, খাট আলমারি ইত্যাদি গছাতে না পেরে, ওই স্যুট পিস ও ধুনুরির হাতে বোনা একটি তোষক। মন্ত্রপাঠে বিয়ে হয়নি, আমি ও শ্বশুর মশায় এ’ব্যাপারে সংঘবদ্ধ (দুজনার সংঘ) থাকায়– তবে যথেচ্ছ রবীন্দ্রসংগীত, এবং এক ভয়ানক আবৃত্তিকারের কণ্ঠে জয় গোস্বামী ও মন্দাক্রান্তা– সে রাত্রে কেউ যে খুন হয়নি, এ আমার মিডিওক্রিটি। ব্যাস এইটুকুই।

যাঁরা রাতের আকাশ কালো বলে জানেন তাঁরা সুইডেনে ডিসেম্বর জানেন না। সেদিন, অ্যান ব্যোভনারের থিসিস ডিফেন্স। পিএইচডি। অ্যান ৩৭-৩৮, ৬’২”, ওজন ৯০ প্রায়, আমার পাশের ওয়ার্কিং বেঞ্চ। আমি জয়েন করার দিনসাতেক পর ছুটি থেকে ফেরে, আলাপ ও প্রশ্ন– হাও ডু য়ু ফাইন্ড স্টকহোম? নাইস, আমি জানাই, পিপল আর হেল্পফুল–অ্যান গোঁসা করে– য়া য়া, উই আর নাইস টু ফরেনার্স, বাট নট আস। অ্যান ও আমার সুপারভাইজার এক। কোলাবোরেশানে কাজ হয়। অ্যানের নেগেটিভিটি খসে যায়। তো, সেদিন অ্যানের থিসিস ডিফেন্স– সন্ধ্যার পার্টিতে থাকতেই হবে,–তুমি না থাকলে– জোর করে, তবে ড্রেস কোড। ফর্মাল।

সেদিন সকাল ঝকঝকে আর তীক্ষ্ণ হাওয়ার হলেও দুপুর থেকে ছাইরং আকাশে ধরে, শীতে বেলা তিনটের মধ্যে এমনিতেই সুয্যি পাটে যান, সেদিন দুটো নাগাদ আলো’কে যে রূপে ট্রপিকে চেনা যায়, আলো সেই ড্রেস ছেড়ে ফেলে। কালচে ধূসর অপ্রেসিভ, আর বরফ। যখন, সন্ধ্যে সাতটায় ডাউনটাউনে বাস থেকে নামি, ফুটপাথ প্রায় ১০ ইঞ্চি বরফের নীচে। ভেন্যু, এক ছোট ওয়াইনারির হলে, ওভারকোট খুলে, চাঁদনি চকে সিলানো, সেই ধূসর স্যুটে ( থ্রি বাটন্স) প্রকট হলে, অ্যান হাত ধরে, বলে–নাউ ইউ আর লুকিং লাইক আ প্রিন্স। নাম অনুযায়ী টেবিলে বসা, অনার টেবিলে অস্বস্তি হয়, অন্তত চার পাত্তর না পড়লে সে টেবিলে খেউড় মানা যে। স্কিট হয়, মজাদার সমস্ত টোস্ট। কিছু পেটে পুরে, বারে বসি, একজামিনার স্টিভ (আমেরিকান) কে কনিয়াক অফার করি, নিজে খাই। কথায় কথা গড়ায়। এই করতে করতে কখন রাত ১.০০ টা। উঠি, এবং ট্রেন স্টেশানের দিকে এগুই। রাত দুটোয় শেষ ট্রেন, আমি সাবার্বে থাকি, হুদিংগা।

বরফ পড়া থেমেছে নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ, অন্তত হাঁটার সময় টের পাইনি। পুরো প্ল্যাটফর্মে একা। হঠাৎ উল্টো প্ল্যাটফর্মে একজন প্রকট হয়, মোবাইলে কথা বলতে বলতে। আমার ঠিক অপোজিটে দাঁড়ায়। গলা ওঠে, জড়ানো হিন্দিতে– অগর মেরা কালা প্যান্ট কো কুছ হুয়া, তুঝে নহী ছোড়ুংগা সালী!! চিৎকার করে সে, কখনো অনুনয়, গোঙায়, ডুকরে ওঠে, গলা ভেঙে যায়, কালা প্যান্ট, তার একমাত্র কালা প্যান্ট…।

আমি আকাশে তাকাতে দেখি, দীর্ঘদিন পর, আজ আকাশ কালো, কালপুরুষ দেখা যায়। নক্ষত্র দিয়ে বোনা যার বেল্ট, সেই শিকারি কালপুরুষ– পরনে কালা প্যান্ট।

————————————————————————————————————————-

One comment

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s