মেসবা’র গল্প, পাঠকের সাইক্যাডেলিক ঘোর – মুরাদ নীল

মেসবা আলম অর্ঘ্য নামের লোকটাকে আমি কিছুটা হিংসা করতাম। সেটা অন্তত এখন থেকে বছর ছয়েক আগের কথা, যখন প্রথম এই লোকের লেখা পড়ি একটা অনলাইন ম্যাগ/ ব্লগজিনে। যদিও ঐ সময়টাতে আমি শুধুই একজন পাঠক। দিন রাত অফলাইন, অনলাইনে যা পাই তাই পড়ি। পড়ার নেশা তখনো প্রবল ছিলো মাশাল্লাহ। তো, ঐ সময়ে যদিও আমি নিজে একটা ফেসবুক পোস্ট পর্যন্ত লিখি নাই, কিন্তু এই লোকের সাদামাটা স্টাইলে গল্প বলার যে ক্ষমতা, গল্পের শেষ পর্যন্ত একটা সাইক্যাডেলিক ঘোরে আটকে রাখার ক্ষমতা, এইগুলাই ছিলো জেলাসির কারন। গল্প পড়ার পর কিছুটা আক্ষেপ কাজ করে, আরে! এই গল্পতো আমারই! আমার গল্পটাতো আমি এইভাবে লিখতে পারতাম, এমন স্টাইলে গল্প বলে অন্তত কাউকে না কাউকে তো হিপনোটাইজড করতে পারতাম! কিংবা ঘোরগ্রস্থ করা যেতো / যায়। এই ব্যাপারটা সম্ভবত শুরু হইছিলো নয় নাম্বার বাস, লাল জিপের ডায়েরি থেকে।

দ্বিতীয়বার এই লোকের গল্প পড়ে একদম ভিন্নরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়াইলাম। কারণ এই গল্পগুলো যখন পড়তেছি, তখন পৃথিবী বছরকাল ধরে ঝিমাচ্ছে। কমলকুমারের ভাষায় আধেক হাসি আধেক কান্নার গৃহস্থিত চিনিপাতা জীবন আমার। শোপেনহাওয়ার, কেরুয়াক, মিকেলেঞ্জেলো আন্তিনিওনি আর সমস্ত নিহিলিজমের মাঝে ডুবে আছি। সাথে সোস্যাল ড্রপআউট, দুই বছরের একটা ব্যর্থ প্রেম, বিবিধ হেরে যাওয়া নিয়া ঘরে বসে থাকা। তো, কেমনে কেমনে যেন আবার মেসবা’র গল্পগুলো পড়া শুরু করলাম। পারুল, রুখসানা, কবুতর তারপরে আরো কয়েকটা। ওহ, এইখানে খোলাসা করা ভালো, আমি আসলে মেসবা’র গল্পের কাঁটাছেড়া কিংবা অধ্যাপকপক স্টাইলে গল্পের মেকানিজম নিয়া আলাপ করতেছি না। গল্প হইছে কি হয় নাই এই নিদান দেয়ার জন্য এই আলাপ না। পাঠক হিসাবে যেহেতু নিদান দেওয়ার এখতিয়ার আমার হাতে নাই, আমার দৌড় ভাল্লাগছে / ভাল্লাগে নাই পর্যন্ত। তাই এইখানে গল্পগুলা পড়ে আমার ফিলিংস কেমন ছিলো, সেইটাই শেয়ার করার ইচ্ছা।

কবুতর গল্পটার কথাই ধরা যাক। একটা সাদামাটা গল্পের সাদামাটা শুরু। গল্পের প্রথম অংশের সেটিং হাতিরপুল নামের একটা মহল্লা কিংবা গলি। সেই মহল্লার ভেতরে একটা টিপিক্যিল আরবান মিডলক্লাস পরিবারের আর আট দশটা কিশোরের মতোই কবুতর গল্পের প্রোটাগনিস্টও কৈশোরে কবুতরের প্রেমে পড়ে। কবুতর পোষে। কিন্তু আপাত সাদামাটা গল্প আর সাদামাটা শুরুর এইগল্পটা শেষ হয় একটা ঘনায়মান উত্তেজনা বা থ্রিল নিয়ে। শেষটা হয় কিছুটা শকিং আর আনএক্সপেক্টেড ঘটনার মধ্য দিয়ে।কৈশোরে যে লোক কবুতরপ্রেমী ছিলেন, দেশ / চেনা প্রতিবেশ ছাড়ার পর, কৈশোর পার করার পর দেখি কবুতরের প্রতি এই প্রেম আর নেই। খুবই নরমালি কবুতর জবাই করে খাচ্ছে প্রোটাগনিস্ট। খুবই ফিট বা নরমাল থাকা, স্বাভাবিক আচরণ করা প্রোটাগনিস্টের মানসিক অবস্থা জানার জন্য কৌতূহল কাজ করে তখন পাঠকের মনে।

মানব মন যে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন চিন্তার স্টেজে থাকে, একই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন বয়সে ভিন্ন ভিন্ন পার্সপেক্টিভে দেখে, তার ভালো একটা ইন্টারপ্রিটেশন, এক্সাম্পল কবুতর গল্পটা।এক্ষেত্রে মানুষকে প্রভাবিত করে সারাউন্ড বা চারপাশ, চাহিদা।

ছবিঃ মহসিন রাহুল

চিন্তার আর আকাঙ্খার ট্রানজিশন ঘটতে থাকে বয়সের সাথে সাথে। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছেলের কবুতরের প্রতি অবসেসন আর ইন্টারমিডিয়ট / ভার্সিটি লাইফে না থাকাটা স্বাভাবিক। আবার এই স্টেজটা পার করে লেখক যখন চেনা পরিবেশ, চেনা জীবন থেকে সরে গেলেন হয়তো সেল্ফ এলিয়েনেশনও হতে পারে। তখন একই সাথে কবুতরের প্রতি ক্রুয়েলটি আর অবসেসন দেখলাম আমরা।এই খানে লেখক সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, যেটাকে প্যারাডকক্স বলা যায়।

মানে স্মৃতি না স্বপ্ন কোন দিকে যাবে এটা যেন বুঝতে পারতেছে না।

স্মৃতির দিকে গেলেও কবুতর, স্বপ্নের দিকে গেলেও কবুতর।

স্বেচ্ছা নির্বাসন বা সেল্ফ-এলিয়েশনের ফলে লেখককে বেঁচে থাকার জন্য কিছু একটা আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন ছিলো হয়তো। সেটা কবুতরও হতে পারে। এখান থেকে অবসেসন বা ইলিউশনের ফলে হয়তো লেখক সব জায়গায় কবুতর দেখতে পান। এইটা কিছুটা হয়তো ফ্রয়েডের লুসিডিটির মতো।

ভিন্ন রঙের একাধিক নদী একটা আরেকটার ঘাড়ে চেপে থাকা। গাঢ় প্রেমের মাঝে সূর্য ডুবে থাকা,পাখির ওড়াউড়ি।

এই গল্পের পোয়েটিক মেটাফোর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কবিতা পড়ার ফিল হয়।

গল্প শেষ হওয়ার পর পাঠক আমি দাড়িয়ে থাকি ম্যাজিক আর স্যুররিয়ালজমের মাঝামাঝি। আসলেই কি এইসব ঘটেছিলো? ঘটে? শহিদুল জহীরের নারিন্দা/ ভূতের গলি, মার্কেজের মাকান্দো,মুরাকামির আন্ধার জগৎ নিয়ে যেরকম কৌতূহল হয়, সেইরকম কৌতূহল নিয়ে আমার হাতিরপুলের দিকে রওনা দিতে ইচ্ছা করে। দেখতে ইচ্ছা করে কানাডার কোন একটা বিষণ্ণ শহরের মৌন ষোলতলা বাড়ি।

এই গল্প পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে টেস্ট অব চেরি। বিষণ্ণ ছুটে চলা বাদিকে। কিয়ারোস্তমিকে। কবুতর কি কিয়ারোস্তমির সেই রূপকবিদ্যা? অসুখী হওয়াই কি আমাদের একমাত্র পাপ? মানুষ অসুখী হলেই কি অন্যকে আঘাত করে? আঘাত করে সুখ পায়? কবুতরের প্রোটাগনিস্ট কি ভেতরে ভেতরে একজন অসুখী লোক? ফিট সাইকোপ্যাথ? কবুতরগুলোকে জবাই করে খেয়ে কি আদতে নিজের স্মৃতিকেই খেয়ে ফেলতে চাওয়া লোক?

মেসবা’র গল্পের ভাষা সরল। সহজ, ঝরঝরে। কোথাও থামতে হয় না, খটকা লাগে না। রুখসানা তেমনই, একটানে পড়া যায় এমন একটা গল্প। এই গল্পও শেষ করতে হয় একরকম উত্তেজনা নিয়ে। কিন্তু তাঁর প্রায় সমস্ত গল্পই যেহেতু সাইকোসিস সংক্রান্ত, প্রটাগনিস্টকে সাইকোপ্যাথ হিসাবে সহজে অনুমান করি পাঠক হিসাবে। রুখসানা পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় প্রোটাগনিস্ট আসলে একটা ইলিউশনের ভেতরে আছে। রুখসানা নামে হয়তো কেউ নাই, কিংবা রুখসানা হয়তো দূর অতীত। রুখসানার থাকা না থাকা নিয়া আমি চিন্তা করি না, কিন্তু কৈশোরের নস্টালজিয়াগুলো কিভাবে ফিরে আসে এইটা আমার কাছে কবিতার মতো। স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুই হাজার বছরেও সব মনে রাখে।

ছবিঃ মহসিন রাহুল

কিংবা রুখসানা প্রোটাগনিস্টের ইমাজিনারি ফিগার, প্রোটাগনিস্টের হয়তো আরেকটা নিজস্ব বিশ্বের চরিত্র রুখসানা।

মুরাকামির প্রোটাগনিস্ট যেমন একটা অন্ধকার জগতে ঘুরে আবার আমাদের চেনা পৃথিবী বা রিয়ালিটিতে ফিরে আসে, রুখসানার নায়ক তেমনেই। স্মৃতি আর ঘোরের ভেতর দিয়ে একটা স্বপ্নময়, কিছুটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসা নায়ক দেখতেছে আসলে রুখসানা বলতে কেউ নাই।

রুখসানা হয়তো প্রোটাগনিস্টের কৈশোরকাল, রুখসানা হয়তো অবসেসন।

রুখসানাকে অনেকটা জেন দর্শনের সাথেও মিলিয়ে পড়া যায়। চুয়াং জু’র প্রজাপতি বিষয়ক স্বপ্নটার মতো।

প্রোটাগনিস্ট যখন ঘোরগ্রস্থ, বা স্বপ্নে বা আধোচেতনে রুখসানাকে দেখলো। অন্য একটা মেয়েকে যখন রুখসানা হিসাবে দেখলো, সেইটা বাস্তব, নাকি ঘোর কেটে যাওয়ার পর, স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর যা দেখলো, সেটা বাস্তব? কিংবা কিম কি দুক এর সেই জিজ্ঞাসার মতো, এই পৃথিবীতে যে আমরা বাস করি, এইটা স্বপ্ন না বাস্তবতা?

পারুল গল্পটা পড়ার কেমন একটা বিষণ্ণতা ভর করে। মেলানকোলিক মুড নিয়া বসে থাকি। এইটা কি সত্যিই আমার মতো একজন সুইসাইডাল মানুষের গল্প? এই গল্প একজন প্রেমিকের। একজন লোনারের। কিন্তু কোনভাবেই লুনাটিক মানুষের গল্প না। প্রেমিকার চলে যাওয়ার পর কিংবা আরো পরিস্কারভাবে প্রেমিকার আত্মহত্যার পর কোন প্রেমিক যখন সবখানে প্রেমিকার অবয়ব দেখতে পায়,দেখতে চায়, প্রেমিকাকে চিঠি লেখে সেই মানুষকে লোনার বলতে পারি। কখনোই লুনাটিক বলতে চাই না। যদিও মেসবা’র এই গল্প পড়ে গল্পের নায়ককে পাঠক মেন্টালি আনফিট হিসাবেই ধরে নেবে।

“কিন্তু সরলতা আদি বিধায় যে কোন একটা বিশ্বাসের ভেতর ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করে।”

কিন্তু বিশ্বাসের ভেতর ঢুকে পড়লেই মনে হয় আস্তে আস্তে সমস্তকিছু কম্পলিকিটেড হতে থাকে। মহিমার ফিগার আস্তে আস্তে বিচূর্ণ হয়ে যায়। মহিমা জগৎ, মহিমা বস্তু, মহিমাই বিশ্বাস।

বিশ্বাস আমাদের কী শেখায়?

খাইতে থাকাটাই সফলতা! এইটা কি শুধু অভিজ্ঞতা, প্র্যাকটিস? বিশ্বাস না?

কবিতার মতো চোখের সামনে মহিমাদের শরীরে মহাজাগতিক ন্যাংটা রোদ এসে পড়ে!

বলতেছিলাম মহিমা শিরোনামের গল্পটার কথা। মহিমা পড়ে ফিলোসফিক্যাল প্যারাডক্সের ভেতরে ঢুকে পড়তে হয়। গল্প কথক আসলে আমাদের কিসের মুখোমুখি দাড় করাতে চান?

মেসবা’র গল্পগুলোর মধ্যে ঘাসফড়িঙ কিছুটা কম্পলিকেটেড। “তিন্নির সাথে” গল্পটার কমিকাল সংলাপের জন্য কিছুটা হুমায়ুন আহমেদ এর ছাপ আছে বলে মনে হতে পারে। যেহেতু আগেই বলেছি মেসবা’র গল্পের ভাষা, বাক্য নির্মাণ একবারেই সরল, ঝরঝরে। যাহোক, মেসবা’র গল্প পড়ার আগে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি রাখা দরকার বলে মনে করি। প্রথম পাঠের পর কিছুটা অর্থহীন মনে হতে পারে। মেলানকোলি ভর করতে পারে। গল্পগুলা পাঠককে নিয়ে যাবে একটা বিষাদময় প্যারালাল দুনিয়ায়। এবং নিশ্চিতভাবে সেই দুনিয়া ঘুরে আসার পরেও আচ্ছন্ন থাকতে হয় একটা পোয়েটিক ঘোর, সাইক্যাডেলিক ফিলিং এর ভেতর।

তবুও এইসব গল্প আমার। আমাদের। স্বপ্নে বা রিয়ালিটিতেই ঘটে যাওয়া কাহিনি। মেসবা’র গল্পের নায়িকারা, পারুল, রুখসানা আমাদেরকে তাড়া করে স্বপ্নে, জাগরণে।

মেসবাহ’র জন্য শুভকামনা, তিনি তাঁর দেখা, না দেখা প্রেমিকাদের নিয়ে বৃহৎ পরিসরে, বৃহৎ আয়োজনে গল্প ফাঁদবেন। আমরা সেই ফাঁদে পা দেয়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে আছি। সেই ফাঁদের ভেতরে বাইরে তাঁর নায়িকারা আমাদের তাড়া করবেন। আমরা কিছুটা বুঝতে চাই,যাপন করতে চাই তাড়া খাওয়া প্রেমিকের জীবন।



মুরাদ নীল। উত্তরবঙ্গে জন্ম। নব্বই এর দশকে শৈশব আর কৈশোর কাটানোর ফলে গর্বিত, কিছুটা নস্টালজিক। আধা এ্যানার্কিস্ট, আধা নিহিলিস্ট।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s