অতন্যা আর্তোর কবিতা – অনুবাদ মাহীন হক

[অতন্যা আর্তো’র জন্ম ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের মার্সেই’তে। পরবর্তীতে প্যারিসে চলে যান। সেখানে স্যুরিয়ালিস্ট আর্টিস্ট, কবি ও নতুন ধারার থিয়েটারের লোকজনের সাথে পরিচিত হন। রাজনৈতিক অভিমতের ভিন্নতার কারণে স্যুরিয়ালিস্টদের থেকে সরে যান একসময়। থিয়েটার নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। সুজান সোন্টাগ বলেন, “থিয়েটারে আর্তো’র প্রভাব এতটাই বেশি যে ইউরোপ ও আমেরিকার থিয়েটারকে দুই যুগে ভাগ করা যায় – প্রাক-আর্তো এবং আর্তো-পরবর্তী যুগ।” শেষ জীবনে আর্তো প্রায় নয় বছর মানসিক হাসপাতালে কাটিয়েছেন। কিন্তু তখনও লেখালেখি ছাড়েননি। এবং জীবনের শেষ তিন বছরেই মূলত আর্তো’র কবিতা লেখার শুরু – তাঁর সমস্ত সৃজনীশক্তির এক ভয়াবহ উদগীরণ! এইখানে অনূদিত এই চারটি কবিতা তাঁর তিন খণ্ডের একটি রচনাসমগ্র হতে পাওয়া।]

কৃষ্ণ উদ্যান

তারা ফুটেছে মৃত্যুর কালো মাটি হতে,
এইসব ফুলেরা যাতে বহুকাল ধরে বোনা এক স্বপ্ন
ঢেলে দিয়েছে ছাই আর হাসনাহেনার
ঝরে পড়া পাপড়ির অপার্থিব বাষ্পসমেত
এক এক করে, অন্ধকার সময়ের মত,
গত ঋতুর জোয়ার-ভাটার বিচ্ছিরি ওঠা-নামা হতে
কুচকুচে কালো জলে। আলোকিত ঘটিকার
মন্থর হীরকচূর্ণ জ্বলজ্বল করে ওঠে,
বানচাল সূর্যের অদ্ভূত প্রতিভাস।
সেই মিষ্টি বাগান, যাকে সমুদ্র থেঁতলে দেয় বারেবারে,
তার সমস্ত আঁধার ঝাঁক ধ্বংস করেছে পদ্মফুলেরা
আর তোমার পবিত্র সারির শক্ত ধাতুর বেষ্টনী
আজ হয়েছে কম্পিত, ওগো বৃন্তমালা!
দ্যাখো এই রাত, করেছে অর্পণ সেই চাবি
যা দিয়ে খুলে যায় তার শৃঙ্গের দরোজা
নিষ্কৃত আত্মাদের উদ্গমে।

‘Antonin Artaud’ by Jean Dubuffet (artnet.com)

ভার্লেইন পানীয়

রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেশ্যারা দাঁড়িয়ে রবে চিরকাল,
নিখোঁজ ঝিনুক অসহায় পড়ে রবে নীলাভ গোধূলির
তারাময় তটে, যা এইখানের নয়, নয় পৃথিবীরও
যেখানে হতভম্ব পোকাদের মত ঘুরপাক খায় ট্যাক্সি

তবুও ততটা নয় যতটা খায় আমার মাতাল মগজে।
গেলাসের গভীরে নিমজ্জিত এ্যাবসিন্থের সবুজ মণি
নরকবাসে আমি পান করি তা, আর ঈশ্বরের শেষবিচারের
বজ্রবাণে দগ্ধ করে নেই নিজের উলঙ্গ আত্মারে।

আহা এইসব সড়কের জটবাঁধা চড়কি কীভাবে
ঘুরিয়ে বদলে দেয় নারী আর পুরুষের গড়ন,
যেন এক মাকড়সা বুনছে তার জালা
আবিষ্কৃত আত্মাদের সুতায়।

রহস্যতরী

সেই প্রাচীন জাহাজ হারিয়ে যাবে সাগরের অতলে
যেই সাগরে স্নান করে আমার মরিয়া স্বপ্নেরা;
আর তার সুউচ্চ মাস্তুল মিলিয়ে যাবে কুয়াশায়
এক পৌরাণিক স্তবগানরত আকাশে।

উলঙ্গ গাছের সারিতে যে বাতাস তোলে রহস্যের সুর,
সে বাতাস কখনো হবে না রাখালের গীত;
আর এই পবিত্র জাহাজের দুর্লভ পণ্য
বিক্রি হবে না কোনো দূরদেশে।

এই পৃথিবীর সদয় বন্দরে এক আগন্তুক,
চেনে শুধু ঈশ্বর আর চিরন্তন একাকিত্ব
অসীমের জাঁকালো ঢেউয়েরে করে বিদীর্ণ।

তার খুঁটির আগা ভেদ করে চলে যায় সকল অজানারে।
প্রতিটি রাত তার আঁধারাচ্ছন্ন মাস্তুলের ওপর কাঁপায়
ওই পোলার তারকার শুদ্ধ নিগূঢ় রূপালি।

ক্ষয়হীন প্রেম

তৃষ্ণার্ত জলের এই ত্রিভুজ
এই অলিখিত পথ
আর জনাবা, আপনার মাস্তুলের এই দৃশ্য
এই সাগরের বুকে যাতে আমি ডুবে যাই

তোমার কেশরাজির গোপন বার্তা যত
তোমার ঠোঁট হতে ছোঁড়া বন্দুকের গুলি
আমারে আঁকড়ে ধরে আছে যে এই ঝড়
তোমার দু’টি চোখের জাগরণে।

অবশেষে, নদীর তীরের এই ছায়া
যেখানে জীবন আর বাতাস দেয় ওড়ার অনুমতি
আর ওই জঘন্য ভিড়ের ভীষণ পায়ের আওয়াজ
যখন আমি তাদের যাচ্ছি পাশ কাটিয়ে।

যখন আমি আমার দু’চোখ তুলি তোমার পানে
তুমি ভাববে বোধহয় কাঁপছে পৃথিবী
আর স্বয়ং প্রেমের পবিত্র আগুন
হবে তোমারই প্রেমিকের অনুরূপ।


মাহীন হক – কবি, পাঠক, অনুবাদক। মিরপুরে বাস করেন। দশম শ্রেনীর ছাত্র।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s