পবিত্র নৃশংস : চার্লস বুকোওস্কি – আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

তবুও বুকোওস্কির কথা বলছি কেন? এত ধ্রুপদ-প্রেমের পরেও কেন বুকোওস্কি?

জানিনা, জানিস! এটাই জানিনা। আসলে দ্বন্দ্বসমাসের একটা সংক্রমণ আছে যার থেকে নিজেকে আমি বোধহয় বাঁচাতে পারিনা।সেখান থেকেও বুকোওস্কি। না না, শোন…

সহজ কবিতা। তাই তো? তারপর বলবি বিবৃতিমূলক কবিতা, ভাষা সম্বন্ধে ক্যালাস এক ধরণের উদাসীন কবিতা। তার ওপর সুসজ্জাহীন, রূপকবিহীন এক বিরক্তিকর, ভনিতাহীন সোজাসাপ্টা, নাঈভ কবিতা। এই সব বলবি, না? নিশ্চয়ই বলবি। তোর সব কটা বিশেষণই ঠিক। ঐ ভাবেই চার্লস বুকোওস্কির কবিতার বর্ণনা করা যায়। অবশ্যই যায়। তবু কেন আমি মজি? ওর কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রুচি, ভাবনা ও কবিতাবিশ্বাস নিয়েও কেন চার্লস বুকোওস্কি? তাই তো? সবটা আমিও বুঝিনি। বুঝি না। চেষ্টা করবো। এক সময়ে আমাদের সকলকেই দড়ির উপর হাঁটতে হয়। আর তখন স্ববিরোধ আমাদের দেয় ঐ হাতের আনূভূমিক বাঁশটা। সেটাই ভারসাম্য দেয়, ডানদিকে হেললে বাঁদিকটা ঠিক ক’রে দেয়।

শুরু? তাহলে শোন। মন দিয়ে শোন। আমি একটা কথাও বানিয়ে বলছি না। পিছিয়ে যাই একটু। ধর, ১২ বছর, ১৯৯৫-এ। সে বছর সেপ্টেম্বরে আমেরিকা এসেছি। সেই জীবনে প্রথমবার। সবে মাত্র, মানে, তৃতীয় দিন। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের উত্তরে, ধর নিউ জলপাইগুড়ির মতো একটা ছোট শহর। স্কেনেকটাডি। স্বর্গে ধান ভাঙার মতোই কবির অন্য কবি খোঁজা। জয়ন্ত একটা সারপ্রাইজ দেবে ব’লে বর্ডার্স-এর বইয়ের দোকানে নিয়ে গেল। বিদেশে বাঙালী এসেই যেমন দেশের গন্ধ খোঁজে, সেই রকম আর কি! ও দোতলায় নিয়ে গিয়ে দেখায় এশীয় গানের আইল-এ নির্মলেন্দুর সি ডি। তখনও ‘সি ডি’ শব্দটা কলকাতায়, ঢাকায় পৌঁছয়নি তেমনভাবে। একটা শস্তার মোটেলে থাকতাম তখন। সেখানে চোর জোচ্চর বেশ্যার খামতি নেই। প্রায় প্রতি রাতে পুলিশের গাড়ির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত। একদম পাশের ঘরে একটা ভাড়াটে বেশ্যা রোজ রাতে ঘর ভাড়া নিতো। তার বচসা আর শীৎকার – দুটোর অডিও কোয়ালিটি একই রকমের। চির-সশব্দ কলকাতার ছেলে আমি, তবুও আওয়াজের চোটে প্রথম প্রথম একটা রাতেও ঘুমাতে পারতাম না। তাই স্বভাবতই মোটেলে ফেরার তাড়া ছিলো না – এক তলায় নেমে এসে খুঁজে বের ক’রে নিলাম – বেস্ট আমেরিকান পোয়েট্রি ১৯৯৪। তখনো ৯৫-এর সংকলনটা বেরোয় নি। A.R Ammons ছিলেন সে বছরের সম্পাদক। তাতে জন অ্যাশবেরীরও কবিতা ছিল। বইটা তখনই কিনলাম। দোকানে দাঁড়িয়েই পড়ি একটা কবিতা। শীর্ষক – ‘me against the world’। শীর্ষক ছোট হাতের। সরল গদ্য ভাষায়(বা কথ্যভাষাও বলতে পারিস) লেখা একটা কবিতা। একটা ছোট ছেলের মনস্তত্ব নিয়ে, ভাবনা নিয়ে, তার বিশ্বাস ও মনোভঙ্গি নিয়ে। সেই ছেলেটাকে তার বাবা নিগ্রহ করে। পেটায় ভয়াবহভাবে। নির্দয়, নির্মম যন্তণাময় একটা সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসা একটা কবিতা – মাইরি বলছি আমি এমন কবিতা তখনো পড়িনি। কবির নাম চার্লস বুকোওস্কি। এর আগে নামও শুনিনি। অনুবাদ? করতাম রে, খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ৯৪-এর সেরা মার্কিন কবিতার সংকলনটা জোগাড় করতে পারলাম না কিছুতেই। ও হ্যাঁ আমি তো সেদিনই কিনেছিলাম, কিন্তু সে বইটা কলকাতার বাড়িতে ফেলে এসেছি।এখানে নেই। পরে এক সময়…..। ঠিক তাই, তুই ঠিক বলেছিস, – হ্যাঁ, সন পেন(বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা) প্রায়শই বুকোওস্কির এই ধরণের কবিতার কথা বলে। গল্পের কথা, উপন্যাসের কথা বলে। অর্থাৎ এই বিষয়ে ওঁর অনেক লেখা। আগ্রহটা এখান থেকেই শুরু হয়। এদিকে তখনো আমি জানিনা যে বুকোওস্কি আর বেঁচে নেই। আমি ওর কবিতা পড়ার প্রায় এক বছর আগে ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৯৫-এ মারা গেছেন।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে চার্লস বুকোওস্কি

ইমিগ্রেন্ট? অভিবাসী? হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু আমেরিকা নতুন বিশ্ব। দেশের ৫০% লোকই গত একশো বছরের মধ্যে ওদেশে এসেছে।আগে ছিল অন্য দেশের বাসিন্দা। চার্লস বুকোওস্কির জন্ম ১৯২০ সালে আদেনার্খ, জর্মনিতে। যখন ওর তিন বছর বয়স, বাবা-মা আমেরিকায় চলে আসে। বড় হয় আমেরিকায়। ঠিক, অনেকটা চার্লস ওলসনের মতো। তবে কি, ওলসনের পরিবার সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখতেন। বুকোওস্কির মূলত খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলে। ঠিক, বাবা – বাবাই ওর জীবনটা নষ্ট করে – নাকি, কবি/লেখক বুকোওস্কিকে গড়ে তোলে – কোনটা বলবো? শোন শোন সত্তর দশকে একটা সাক্ষাৎকারে বুকোওস্কি বলছে – বাবা আমায় মারতো। কোন প্রশ্নের উত্তরে বলছে জানিস? বেলজিয়াম টিভি ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। ততোদিনে বুকোওস্কির পরিচিতি বেড়েছে। সে প্রায় সেলেব্রিটি। তাকে লিটল ম্যাগাজিনের রাজা বলা হয় – এমন কোনো লিটল ম্যাগাজিন নেই যারা ওর লেখা ছাপে না। তখন ১৯৭০ দশক। গিন্সবার্গ-করসো-কেরুয়াক ও বিট প্রজন্ম যতোই নাম করুক, বুকোওস্কির আলাদা জগৎ রয়েছে।

তা বেলজিয়াম টি ভি জিজ্ঞেস করছে – কেনো আপনার কবিতার এক নিষ্ঠুর মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়? বুকোওস্কির বলেছেন – “আমার বাবা আমায় লিখতে শিখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ সাহিত্য শিক্ষক। তিনি আমায় শিখিয়েছিলেন যন্ত্রনার মানে।আমায় মারতেন বিনা কারনে। ৬ থেকে ১১ বছর বয়স অব্দি প্রতি সপ্তাহে বাবা আমায় মারতেন – সপ্তাহে ৩ বার, একটা কাঁটা চামড়ার বেল্ট দিয়ে মারতেন। ৩ বার প্রতি সপ্তাহে ৬ থেকে ১১ কতগুলো মার হয় – গুনে দেখুন তো!”। অবাক হ’লি নাতো!…..কি? প্রেমাঙ্কুর আতর্থী! বাবা মারতো? ‘মহাস্থবির জাতক’ তো? হ্যা ঠিক ঐরকম। দেখ, প্রেমাঙ্কুরও কিন্তু বাড়ী থেকে পালান, বয়সে বড়ো বিধবার প্রেমে পড়েন, শারীরিক সম্পর্কের ইঙ্গিতও আছে। খুব এলেমেলো জীবন। সুতরাং ঐ প্রেমাঙ্কুরের গল্পটা তুই ১৯৩০ সালে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে ফ্যাল। আমি একটা তথ্য চিত্রের কথা বলি। John Dullaghon এর ছবি Born into This’। চার্লস বুকোওস্কির ওপর। প্রায় ৩০ বছরের ফুটুজের সমন্বয়ে তোলা তথ্যচিত্র। দেখলে উচ্চকিত হতে হয়। আমি একটা গোটা সন্ধ্যা বুঁদ হয়ে বসেছিলাম ঐ ছবি দেখে। বলতে পারিস আজ যে তোকে এত সব বলছি, ঐ ছবিটাই তার প্রেরণা।

দ্যাখ আমায় ভুল বুঝিস না… ঐ যে বললাম ১৯৯৫-তে ঐ যে কবিতাটা পড়ি, তার মধ্যে এমন একটা নৃশংস চিত্র ছিলো, এমন একটা নৃশংস অনুভূতি, সদ্য ছাড়ানো একটা রক্তাক্ত মুরগীর থিরথির ক’রে কাঁপাতে থাকা মাংশের মতো। সেই একটা মাংশ রেফ্রিজারেটরে রেখে, পরের দিন লেবুর রস দিয়ে মেরিনেট ক’রে, শত মশলা মাখিয়ে, তেলে চুবিয়ে ভেজে, সাতঁলে, গরম মশলা ছড়িয়ে, তাজা ধনেপাতা দিয়ে যখন তোর পাতে দেওয়া হচ্ছে – তুই একটু করে মুখে দিয়ে – বা!  বা!  তাইতো? সেই একই মাংশটা বুকোওস্কি ঐ ঈষদোষ্ণ রক্তমাখা অবস্থায় সরাসরি তোর প্লেটে ছুড়ে দেন – তুই আঁতকে উঠিস। পড়া হয়ে গেলে হয় বমি করবি না হয় বিরক্তবদনে বলবি এটা কি কবিতা! শোন এবার দুটো কবিতা শোনাইঃ

আরেকটা বিছানা 

আরেকটা বিছানা 
আরেকটা মেয়ে 

আরো পর্দা 
আরেকটা বাথরুম 
আরেকটা রান্নাঘর 

অন্য চোখ 
অন্য চুল 
অন্য 
পা, গোড়ালি। 

সবাই মজে আছে 
সেই চিরখোঁজে। 

তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো 
ও উঠে পড়ে, কাজে যাবে 
জামা পরে, তুমি ভাবো 
আগের মেয়েটার কী হলো 
বা তার আগের মেয়েটার… 
এই গোটা ব্যাপারটা এত আরামের - 
এই শরীরে শরীর সেঁধানো, প্রেম করা 
এক সঙ্গে ঘুমানো 
এই আদর, লালা, এত মমতা, এইসব… 

ওর হয়ে গেলে তুমিও উঠে পড়লে 
ওর বাথরুম ব্যবহার করলে 
সমস্তই এত ঘনিষ্ট, এত অচেনা 
তুমি বিছানায় ফিরে গেলে 
আরো এক ঘণ্টা ঘুমালে। 

যাবার সময় মন খারাপ হয় কিছুটা 
কিন্তু আবার দেখা  হবে ওর সাথে 
সে প্রেম থাকুক বা কেটে যাক। 
তুমি গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের ধারে গেলে, 
বসে থাকলে একা  
তোমার গাড়িতে। বেলা প্রায় বারোটা। 

- আরেকটা বিছানা, অন্য কান, অন্য কানের দুল
অন্য হাঁ-মুখ, অন্য চটি, অন্য পোশাক

এমনকি রঙ, এমনকি দরজা, টেলিফোন নম্বর অন্য 

একদা তোমার জোর ছিল, তুমি একাই থাকতে পারতে। 
এখন প্রায় ষাট, এসময় তোমার আরো চেতনা হওয়া দরকার। 

উচিৎ গাড়ি স্টার্ট করে, গিয়ার দিয়ে ভাবা 
জিনী ফিরলেই ওকে ফোন করবো, 
সেই শুক্রবারের পর ওকে দেখিনি। 

 
আমি যেমন পাগল চিরটাকাল 

মাতাল, কবিতা লিখছি
এখন রাত তিনটে 

এখন কেবল একটা জিনিস 
পেলেই হয় - 
টানটান দুটো উরুর মধ্যে 
টানটান, নিভাঁজ একটা যোনি 

সম্পূর্ণ অন্ধকার 
না হওয়া পর্যন্ত 

তুমুল মত্ত, কবিতা লিখছি
রাত তিনটে চোদ্দ 

কেউ কেউ বলে 
আমার নাকি বেশ নামডাক হয়েছে 

একি করছি আমি 
বেহেড মাতাল, কবিতা লিখছি
এই এখন, তিনটে আঠারোয়? 

আমি যে এই রকমই উন্মাদ চিরকাল 
ওরা বুঝতে পারেনা ঠিক 
যে আজো আমি চারতলার জানালা থেকে 
স্রেফ পায়ের পাতায় ভর ক’রে ঝুলে থাকা 
সম্পুর্ণ বন্ধ করতে পারিনি - 
ওসব আমি আজো করি 
এই যেমন এক্ষুণি 
এখানে ব’সে

লিখছি এইসব - যে 
আমি ঝুলছি, স্রেফ পায়ের পাতার ওপর ভর 
৬৮, ৭২, ১০১ তলা থেকে 
অনুভূতিটা একটুকুও বদলায়নিঃ 

সেই নিষ্ঠুরতা 
বিজেতার মতো সেই 
প্রয়োজনীয় পরাজয় 

মাল টানছি এখানে বসে আর কবিতা লিখছি 
তিনটে চব্বিশের রাতে। 

অবশ্যই, ইউরোপে আজ বুকোওস্কি, বিশেষত ওর গদ্য/উপন্যাস অসম্ভব জনপ্রিয়। গিন্সবার্গের চেয়ে অনেক বেশী। কেরুয়াকের মতোই বলা যায়। এবং শুধু এখন নয়, সত্তর দশকের শেষ থেকেই বুকোওস্কির উপন্যাস নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য কর। এমনতো শুনেছিস অনেক – তাই না, যে প্রথমে কবিতা লিখতো, তারপর উপন্যাসে হাত দেয় – আমাদের সাহিত্যে তো কত উদাহরণ। সুভাষ, সুনীল, শক্তি, শরৎ, জয় গোস্বামী, কমল চক্রবর্তী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইত্যাদি। বুকোওস্কির ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। কবিতা আসে অনেক পরে। প্রথমে কিন্তু গল্প/উপন্যাস। বেশ নিয়মিত ঔপন্যাসিক সে, তখন হঠাৎ কবিতা আসে। এবং লক্ষ্য কর, ওর প্রায় সমস্ত কবিতাই গল্পের বীজে বোনা। সোজা ন্যারেটিভকে নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে নেই। বেলজিয়াম টিভির সাক্ষাৎকারের কিছুটা এই রকম… না সবটা বলা যায় না…. না,  না…বাদ দে, সে বীভৎস খিস্তি-খাস্তায় ভর্তি। এই জায়গাটা শোন –

বেলজিয়াম টিভিঃ আপনার গল্পে/উপন্যাসে ‘প্রেম’ জিনিসটাকে আপনি তুমুলভাবে খাটো করেছেন। শারীরিকতা, যৌনতার বাইরে তাকে রাখতে দেন নি। এই অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে ওঠে।

বুকোওস্কিঃ কে বলছে এ কথা?

বেলজিয়াম টিভিঃ অনেকেই বলেন। আজ আমরা বলছি।

বুকোওস্কিঃ কিছুই বোঝেনি আমার লেখা, মগজের বাইরে দিয়ে সব…

বেলজিয়াম টিভিঃ কি বলছেন আপনি? ‘প্রেম’ জিনিসটার  অস্তিত্ব আছে আপনার লেখায়? ঐ সেক্স আর রক্ত-মাংশের বাইরে সে আছে?

বুকোওস্কিঃ এই ছোঁড়া, তোমার ঐ গু মাখা ধারণা তোমার নিজের কাছে রাখো। শালা, মাদার…এই সব জিজ্ঞেস করতে এসেছো আমাকে? প্রেম কাকে বলে বোঝো? প্রেম প্রতিদিনকার। প্রতিদিন ভোরের। ভোরের ঐ এক ঘন্টা, যখন সূর্য উঠছে, নরম তার আলো, তার তাপ। কিন্তু আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সব। গরম বাড়ছে ,আলো বাড়ছে, সেই প্রেমটা ফিকে হয়ে যায় তখন। মাত্র এক ঘন্টা তার আয়ু, সেই প্রেম, যা আমার সমস্ত লেখার সমস্ত কোণে রয়েছে, আর তোমরা শালা গাধার পোঁঙা, দেখতে পাও না শুয়োরের বাচ্চা….

বেলজিয়াম টিভিঃ আপনার কবিতায় আসা যাক এবার। আপনার কবিতা খুব ন্যাড়া কবিতা। কোন ইমেজেরি নাই। রূপকহীন, চিত্রকল্পহীন, উপামাহীন কবিতা।

বুকোওস্কিঃ রুপক/উপমা ,অতো সব লাক্সারি আমার পোষায় না শালা। অতো জায়গা নেই আমার মধ্যে, ভাই। সময় নেই। কেন না ঐ যে তোমায় বললাম, আমার বাবা ছিলো সাহিত্যিক ট্রেনার। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কারণে আমায় মারতো। পিটতো। রোজ। মারতে মারতে মারতে আমার মধ্যকার সমস্ত ভান-ভনিতার রস-মেদ সমস্ত বের ক’রে দিয়েছিলো। স্রেফ আত্মাটা পড়েছিল। তাই আমার কবিতায় ঐসব স্নেহপদার্থ নেই। আত্মা তার কথা বলে সরাসরি। বলে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। যন্ত্রণার মানে অনেক লেখক জানে না। বেশির ভাগ লেখকই জানেন না। আমাকে আমার বাবা শিখিয়েছিলেন,আমি ঐ বুড়ো ভামটার প্রতি কৃতজ্ঞ।

মধ্যবয়সে চার্লস বুকোওস্কি

জান্তবতার কথা বলছিস? হ্যাঁ? পাশবিকতা? পশু, জন্তু….বেশ। কিন্তু বলতো পবিত্র কে? ঐ পশু নয়? জন্ত নয়? একমাত্র ওদেরই কোন ভান-ভণিতা নেই, বুকোওস্কির কবিতার মতো। প্রকৃতি তাদের যেমন করে গড়েছে তারা তেমনিভাবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমি একটা মেয়েকে চিনি সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখতে পারেনা। একটা সিংহ পরিবার আর দুটো হায়নার বাচ্চা একটা জেব্রাকে কেটেকুটে খাচ্ছে এই দৃশ্য সে নিতে পারেনা। একটা সিংহ পরিবার আর দুটো হায়নার খাওয়া পরিবারের দিনের একমাত্র মিড-ডে মিল। তাও আবার হায়নার বাচ্চাগুলোর সঙ্গে ভাগ ক’রে খাচ্ছে। এভাবে ভাব। কেন পারছিস না? ঐ নিষ্ঠুর লোকটার মধ্যে থেকে একটা সৎ পবিত্র লেখা বেরিয়ে আসতো। বুকোওস্কির প্রায় সমস্ত কবিতায় দেখিস – কোন চালাকি নেই কোথাও, কায়দা ক’রে বলার কথা নেই, চমক দেবার চেষ্টা নেই। অন্য লোকের সমালোচনা, সমাজকে ব্যঙ্গ – এসব নেই, যা আছে যত ঠাট্টা, ব্যঙ্গ আছে সমস্ত নিজেকে নিয়ে, বা নিজের ওপর দিয়ে…. একটা লোক যে অন্য কাউকে ছুরি মারার আগে নিজেকে একবার মারে, মেরে দেখে নেয় ছুরিটা মারা যায় কিনা। মাঝে মাঝে আমরা অবশ্য চমকে যাই তার কারণ ওর নিজের জীবনটা। অপ্রত্যাশিত, অননুমোদিত, আহত একটা জীবন। যার বিবরণ আমাদেরও আহত করে, মনুষ্যত্বের হীন দিকটা কতোটা ঠাণ্ডা হ’তে পারে আমরা টের পাই। এবং কোন উপমার মশলা, ভাষার সর বুকোওস্কি ফেলে রাখেনা তার কবিতার ওপর। শোন একটা গল্প বলি…কোনটা?…ও, সেটা পরে বলছি….এটা আগে শোন না –

অ্যালেন গিন্সবার্গকে একজন প্রশ্ন করেছিল – আপনি প্রায়শই স্টেজে উঠে স্ট্রিপ করেন কেন? করতো না? হ্যাঁ এ কীরে শুনিসনি কখনো? অ্যালেন তো মঞ্চে উঠে মাঝে মাঝে ল্যাংটা হয়ে যেত… তা গিমিক তো বটেই, অ্যালেনের অনেক গিমিক ছিলো। ওকে এক দর্শক জিজ্ঞেস করলো – আপনার কবিতা কি? বুঝিয়ে বলুন। অ্যালেন ল্যাংটো হয়ে বললো এই আমার কবিতা… এতো সুনীল কবে লিখছেন, তুই পড়িস নি? যাক গে শোন। অ্যালেন ওই প্রশ্নের উত্তরে বলছিলো – “যে মেয়েটা স্ট্রিপার, বারে রোজ নগ্ন হয়, তার বিনিময়ে জীবিকা পায়, তার যন্ত্রণা হয়তো আছে, কিন্তু একজন সত্যিকারের কবির যন্ত্রণা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। কারণ সেই লোকটা তার প্রত্যেকটা কবিতা লেখার সময় নিজের শরীর নয়, তার চেয়েও গভীরে যা – তার আত্মকে, ঐ ঘেয়ো আত্মাকে নিয়ত নগ্ন করে। কেবল বারের লোকগুলোর কাছে নয়, গোটা পৃথিবীর সামনে ছাল ছাড়িয়ে রাখে তার আত্মা”। বুকোওস্কির সেই প্রথম কবিতাটা পড়ে আমার অ্যালেনের কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিলো। পরে ওর অনান্য কবিতা পড়েও একই কথা মনে হয়।

এবার তোর প্রশ্নে ফিরি। লেখকের থেকে কি লেখাটাকে আলাদা ক’রে দেখবো? এইরকম ভাবছিস তো? বুকোওস্কিকে পড়তে গেলে সেটা করতেই হবে। কেননা তুই লোকটাকে মেনে নিতে পারবি না। আজকের আমেরিকাও মেনে নেয় না। যে সময়ে বুকোওস্কি আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়, সেই সময়টা প্রতিসংস্কৃতির সময়। তখন ভিয়াতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ ক’রে দেশের সেনাবাহিনী দেশের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মাইক তুলে নিয়েছে। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছে। এখনকার সমাজটা অনেক গোঁড়া, রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। ফলে আজ যে বুকোওস্কির মতো, তার লেখা কেউ পড়ে না। তো, বুকোওস্কি ছিল সেই প্রতিসংস্কৃতির লেখক। সমাজবিরোধী ও বলা যায়। একটা ডাকঘরে সামান্য চাকরি করতো। জীবনের অনেকটা সময়। যা পেত তাই দিয়ে মদ খেতো, সিগারেট খেতো – নিরন্তর, যার-তার সঙ্গে শুয়ে বেড়াতো আর বাকী সময় টাইপ-রাইটারে ব’সে লিখতো। প্রচুর লিখতো। ৫০ পেরোতে না পেরোতে বুকোওস্কি নাম ডাক বাড়তে থাকে। লরেন্স ফেরলিংগেটি ওকে ডাকেন সান ফ্রান্সিকো’তে গিয়ে সিটি লাইটস বুকস্টোর আয়োজিত এক সন্ধ্যায় কবিতা পড়তে। সেই পাঠের আসরে তরুণ ছেলে-মেয়েদের দল উপচে পড়ে। ফিল্ম তোলা হয়। তারও অংশবিশেষ দেখলাম। হাসি ঠাট্টায় গড়াগড়ি যাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। অবিরত বীয়র পান চলছে গল্পপাঠের সাথে। যেমন লেখক তেমন পাঠক পাঠিকা। সিগারেটের ধোঁয়া প্রায় মেঘের মতো। এবং বুকোওস্কি সুযোগ পেলেই খিস্তি করছে। হ্যাঁ?…, বেশ ভালোই খিস্তি শুরু…যাইহোক, দ্যাখ এসব আসরে সাধারণ, সুভদ্র, ভালোমানুষের পোলাপান যাবে না। কিন্ত তারাও তো বুকোওস্কির লেখা পড়ছে। আজও পড়ছে। লাতিন আমেরিকায়, রাশিয়া, জর্মনিতে ওর অসংখ্য পাঠক। এরা তো লোকটাকে দেখছে না। লেখকের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অনুভূতি গড়ে উঠছে তার লেখা থেকে। ফলে লেখাটাকে লেখকের থেকে আলাদা ক’রেই দেখতে হবে – তাই না? হ্যাঁ বল…

ছোটবেলা? লস এঞ্জেলিস শহরে বড় হওয়া, কাছের লোকজন ওকে ডাকতো ‘হ্যাঙ্ক’। সারাজীবনই বন্ধুরা ‘হ্যাঙ্ক’ নামে ডেকেছে। প্রেমিকরা, বউরাও হ্যাঙ্ক। ২০ বছর বয়স, ওর বাবা একদিন ওর ঘর থেকে একটা ফাইল পায় – তাতে ওর গল্প ছিলো অনেকগুলো।সেই বেয়াড়া গল্প পড়ে বাপ খচে মচে, বাগানে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাতাগুলো। বাড়ী থেকে বের ক’রে দেয়। হ্যাঙ্ক কলেজে তখন।জার্নালিজম ও সাহিত্য পড়ছে। কলেজ ছেড়ে দেয়। ১৯৪৩ সালে, তখন ওর বয়স ২৩, সে বারে বসে মদ খাচ্ছে একা একা। পাশে এসে বসে একটা বেশ্যা। হাঙ্কের চেয়ে অনেক লম্বা সে, দশাশই চেহারা, প্রায় ৩০০ পাউন্ড ওজন।তার সাথে সেই রাত্রে প্রথম শোয় বুকোওস্কি – কুমারত্ব হারায় সেইদিন। টুকটাক গল্প বেরোচ্ছে তখন। পরের বছর বাজে সন্দেহে ওকে এফ-বি-আই ধরে নিয়ে যায়। ১৭ দিনের জেল হয়। ২৭ বছর বয়স থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত জেন নামে একটা মেয়ের সঙ্গে বুকোওস্কি ঘুরে ফিরে থাকতো। এফ-বি-আই এর খাতায় তারা স্বামী- স্ত্রী, যদিও ওদের বিয়ে হয় নি। বারবারা ফ্রাই নাম্নী এক লেখিকাকে বিয়ে করে ঐ বছর। ডাকঘরে চাকরি করে। সারারাতের চাকরি। চিঠিপত্র বাছাই করে একটা ঘুরন্ত কনভেয়রের ওপর ফেলা ওর কাজ। অতিরিক্ত মদ্যপানে অবস্থা এমন হলো যে চাকরি ছেড়ে দিতে হলো স্বাস্থ্যের কারণে। কিন্তু লেখা থেকে খাওয়া জোটে না। ফলে আবার দরখাস্ত করতে হলো।

জন মার্টিন নামের এক ছোট প্রকাশক হ্যাঙ্কের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। তখন ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আমেরিকায় উদারতার হাওয়া বইছে। হিপিবংশের জন্ম হয়েছে। বীটরা তুমুল জনপ্রিয়। মার্টিন বীট লেখকদের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু বুকোওস্কির লেখা পড়ে ওর মাথা ঘুরে যায়। মার্টিন একটা ঝুঁকি নেন। ওঁর ধারণা হয়েছিলো এই হলো সেই ভবিষ্যতের লেখক ও কবি যে একটা সম্পূর্ণ মার্কিন আইকন হয়ে উঠতে পারবে। দ্যাখ, পাগলামি, বাঁদরামি অ্যালেন গিন্সবার্গ যতোই করুন, সে পুরোদস্তুর কবি ছিলো। তুমুল ইন্টেলেকচুয়াল। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কৃতি ছাত্র ছিলো। পরবর্তী জীবনে অধ্যাপক – সেই অধ্যাপক যিনি ছাত্রদের নিজের কবিতা পড়ান(কবে যে আমাদের দেশে এমন হবে)। কিন্তু বুকোওস্কি? সে বিরাট আঁতেল কেউ নয় ভাই, কিন্তু আঁতেলরা তাকে গুরুত্ব দেয়। মার্টিন এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি বলেছেন যে ওঁর বুকোওস্কি পড়ে মনে হয়েছিলো যে এ’ই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন সাহিত্যের ওয়াল্ট হুইটম্যান। সেই ক্ষমতা এর আছে। ও রাস্তার লোক, এবং ওর গোটা সাহিত্যটাও আসছে জীবন থেকে, রাস্তা থেকে। এক সমালোচক বলেন – “কবিতাকে আকাদেমীচ্যুত করার কথা অনেকদিন থেকেই হচ্ছে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও সেটা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি, র‍্যাঁবো পেরে গেলেন প্রথমেই, কিন্তু ঐ একবারেই, তারপর গেঁয়ো চাষা ওয়াল্ট হুয়াটম্যান আর এবার চার্লস বুকোওস্কি”। ওর বইগুলোর নাম-ধাম লক্ষ্য কর-

Flower, Fist and Bestia Wail(1960)
Run With The Hunted(1962)
Crucifix In A Deathhand(1965)
True Story(1966)
All The Assholes In The World And Mine(1966)
Post office (1971)
Erections, Ejaculation, Exhibition and
General Tales of Ordinary Madness (1972)
Love Is A Dog From Hell(1977)

গ্ল্যামার, ভদ্রতা, সৌজন্য’কে চুরমার করা এক একটা সাহিত্যখণ্ড। এক সময়ে, ১৯৮০-র গোড়ায় বুকোওস্কি বেশ টাকা পয়সা কামিয়ে ফেলেন। হলিউড ওঁর বই থেকে ছবি করে, বেলজিয়ামে ওঁর বই চলচিত্রায়িত হয়, উপন্যাস ও কবিতার বইয়ের ব্যাপক বিক্রি – ফলে জীবনটা রাতারাতি পাল্টে যায় হ্যাঙ্কের।

বোর করছি? বেশ… আচ্ছা, আচ্ছা বলছি। বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিদের ফোরামে বছরখানেক আগে একদিন হঠাৎ বুকোওস্কি’কে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। স্বভাবতই আমি কৌতূহলী হয়ে পড়ি। আলোচনায় যোগ দিই। একটি ছেলে, এক তরুণ কবি – সে বুকোওস্কিকে নিয়ে খুব উত্তেজিত, মানে ওর সাহিত্য ও জীবনের নগ্ন সততায় সে মুগ্ধ। এমন সময় এক অধ্যাপিকা অভিযোগ আনেন যে বুকোওস্কিকে বয়কট করা উচিৎ কারণ সে নারী-নিগ্রহী(misogynist)। ব্যাস যুদ্ধ বেঁধে গেল ই-গ্রুপে। নানা তর্ক, আঁতলামি, ভদ্রভাষার ঝগড়া, যা হয় আর কি। এমন সময়ে সেই তরুণ কবি একদিন নাকে খত দিয়ে কান মুলে স্বীকার করে গেলো যে সে বুকোওস্কির লেখা আর কখনো পড়বেনা কেননা সে প্রমাণ পেয়েছে যে বুকোওস্কি সত্যি নারী-নিগ্রহকারী। সে একাধিক ভিডিও দেখেছে বন্ধুদের কাছে যেখানে বুকোওস্কি জনৈক মহিলাকে পেটাচ্ছে।

করবো না? অব্যশই। করলামও। হ্যাঁ, রিআ্যক্ট করি। সেদিনই…শোন। দ্যাখ, আমেরিকা আধুনিক সভ্যতার পীঠস্থান। কেমন? ফলে লেখক-কবিরা নিজেদের এই সভ্যতার বিবেক ভাবেন। সমস্ত রকম ভণ্ডামী, গোঁড়ামির(bigotry) বিরুদ্ধে এঁদের প্রতিবাদ, সর্বক্ষণ। বুশ কোথাও একটা বেমক্কা উক্তি করলেই এঁরা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। কেউ এদের কথা শুনুক আর নাই শুনুক। সেটা ভালো। মেয়েদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ মহিলা কবি/সমালোচক/গবেষক/অধ্যাপিকার সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, তাঁরা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ফ’লে মুক্ত ফোরামে এক নারী নিগ্রহীর সপক্ষে কথা বলা মানে, বুঝতেই পারছিস – একেবারেই যুগোপযোগী কাজ নয়। কিন্তু misogynist বলে লেখাটাকে অস্বীকার করা – এটা কি গোঁড়ামি নয়, বিগট্রি নয়? আমি এই প্রশ্ন তুলি।আরো একটা প্রশ্ন ছিলো আমার।… হ্যাঁ, ঐ সময়েই পেলাম, ফিল্মটা তো? অনেক চেষ্টা কষ্টে পেলাম রে! সিন্সিন্যাটি সরকারী গ্রন্থাগারে আপীল করে নিউ ইয়র্ক থেকে এলো ঐ তথ্যচিত্র। John Dullaghan এর ছবি ‘Born Into This’ । অসাধারণ এক তথ্যচিত্র। প্রায় ৩০ বছর ধরে তোলা। সাদা কালো থেকে রঙিন ছবি পর্যন্ত। সেখানে পেলাম নারী-নিগ্রহদের একটা ছোট্ট রুপালি খণ্ড। শ্যুটিং চলছে তখন, হ্যাংকের বয়স ৬০ পেরিয়েছে। সারাদিনের শ্যুটিঙের শেষে স্বামী-স্ত্রী মাল টানছে, সঙ্গে বিড়ি। হঠাৎ লিন্ডার সামান্য একটা কথায় বুকোওস্কির অমানুষ বেরিয়ে আসে।…..

ফ্রেম ১ – তরুণী ভার্যার পেটে রাগে উন্মত্ত বুকোওস্কি প্রথমে লাথি চালান; বউ সরে যায়, লাগে না। ফ্রেম ২ – বুকোওস্কি আবার লাথি ছুঁড়ছেন; তাতেও ক্ষান্ত হননি। তৃতীয় ফ্রেমে ধরা পড়েছে বুকোওস্কির ক্রোধে উন্মত্ত মুখ; এরপরেই লাফিয়ে পড়বেন স্ত্রীর ওপর; এবং তথ্যচিত্রকার ও তাঁর সঙ্গী ক্যামেরা বন্ধ ক’রে বুকোওস্কিকে থামাতে যাবেন।

হ্যাঁ, আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো – অপরাধী কে? কে অপরাধীকে চিহ্নিত ক’রে। সমাজ। এক একটা সমাজে অপরাধীর চেহারা আলাদা। আইন আলাদা। তার মধ্যে তারতম্য আছে। বউ মারতে উদ্যত চার্লস বুকোওস্কি অপরাধী। বেশ। লিন্ডা ওর তৃতীয় স্ত্রী। এই ঘটনার পর লিন্ডা বুকোওস্কির সঙ্গে থাকেননি। সেটাও ঐ তথ্যচিত্রেই বললেন। অথচ দ্যখ, বুকোওস্কির প্রথমা স্ত্রীর প্রসঙ্গ ওখানে ঐ কবিদের ফোরাম কেউ তুললো না। কেন? প্রথমা স্ত্রী চাকরি করতেন না। ওদের একটা মেয়েও হয়। মেয়ের যখন কয়েক বছর, বুকোওস্কি হঠাৎ একদিন আচমকা ঠিক করেন তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ চান। বিচ্ছেদ সহজেই হয়ে যায় কেননা স্ত্রী প্রতিরোধ করেন নি। এবং অসহায় স্ত্রী ও বাচ্চাকে ছেড়ে হ্যাঙ্ক অন্যত্র চ’লে যান। অবশ্য মার্কিণ আইন অনুযায়ী স্ত্রী কন্যাকে ভরণপোষণ দিতে হতো। মার্কিন সমাজ এমনভাবে নির্মিত যে একজন একা-মা, ইস্কুল পাশ হলেও ছোট খাটো চাকরি সংসার চালাতে পারেন। সুতরাং এতে বুকোওস্কির কোনো দোষই নেই। আমি ঠিক এখানেই অভিযোগটা করলাম। ভারতীয় সমাজের একটা সমান্তরাল ছবি এঁকে। ওঁদের বললাম – মনে করুন একজন স্বামী – স্ত্রীর সঙ্গে কোনদিন খারাপ ব্যাবহার করেন নি, ৩ ছেলেমেয়ে। সকলেই তাঁর রোজগারের উপর নির্ভরশীল। সেই লোকটি একদিন আচমকা হিমালয়ে চলে গেলো সন্ন্যাসী হ’তে বা লেখক হ’তে গিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেলো। এই পরিবারের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সাহেবদের কাছে এটা সহজ নয়। ওদের বুঝিয়ে বলি – যে আমাদের সমাজে এখনো এত সহজে এক নিম্নবিত্ত পরিবারের স্ত্রীর পক্ষে তিনটে বাচ্চা নিয়ে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। ফলে এই স্ত্রী ও শিশুরা একটা চরমতম জায়গায় গিয়ে পড়ে। তো, এই কদাচিৎও গায়ে-হাত-না-তোলা স্বামীটি কি একটা বউ পেটানোর চেয়ে বড় অপরাধী নয়? ওঁরা আমার কথাটা বোধহয় বুঝতেই পারলেন না কেউ। কেবল একজন ছাড়া। সেই ভদ্রলোক অপূর্ব ভাষায় একটা মরমী চিঠি দিয়েছিলেন। এক misogynist কবির সাহিত্যকে বরদাস্ত করতে পারার মলম বাড়িয়ে দিয়ে, আমার দেওয়া উদাহরণ থেকে নির্মমতার পুর বের করে তৈরী করার চেষ্টা করছিলেন এক সমকক্ষ মতামতের জমি। উনিই চিঠির শেষে বুকোওস্কির শেষ জীবনে লেখা একটা ছোট কবিতা তুলে দিয়েছিলেন। সব জন্তুর মধ্যে একটা পাখি থাকে, জানিস তো?

নীল পাখি

আমার ভেতর নীল রঙের একটা পাখি আছে
কেবল বেরোতে চায় সে
আর তেমনি কঠিন আমি, তাকে বলি-
থাক যেখানে আছিস
আমি চাইনা
কেউ তোকে কোনদিন দেখুক।

                                                                           চার্লস বুকোওস্কির চারটে কবিতা 

ধ্বংস

উইলিয়াম সারোয়ান বলেছিল ‘আমি একই মহিলাকে
দু’বার বিয়ে ক’রে নিজের জীবনটা ধ্বংস করলাম।’

উইলিয়াম, জীবনটাকে ধ্বংস করার মতো কিছু
জিনিস সব সময়ই থাকবে
সব নির্ভর করছে
তাদের মধ্যে
কে বা কোনটা আমাদের আগে খুঁজে পায়,
আমরা সব সময়ই পাকা, টসটসে
টপ ক’রে মুখে ফেলার জন্য তৈরি।

বিধ্বস্ত জীবন খুব স্বাভাবিক
শুধু, শুধু জ্ঞানী মানুষদের জন্য নয়
অন্যদের জন্যেও।

ধ্বংস হওয়া জীবনটা তখনই আমাদের হয়
যখন আমরা বুঝতে পারি
যে ঐসব আত্মহত্যা, মাতালের দল,
পাগল, জেলখাটা, জুয়াড়ি, মাদকাসক্ত
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি
সবাই একটা স্বাভাবিক অস্তিত্বের অংশ
যেমন ধরো ওই লাল গ্ল্যাডিওলা, রঙধনু 
যেমন ধরো ওই ঝড়
আর রান্নাঘরের ফাঁকা টেবিল।


ময়লা ফেলার টিন

এই জিনিসটা দারুণ। দুটো পদ্য লিখলাম
একটাও ভাল লাগলো না।

আমার কম্প্যুটরে একটা ময়লা ফেলার টিন রয়েছে
ট্র্যাশ ক্যান। আমি টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেলাম
কবিতা দুটো
গিয়ে টিনের ভেতরে নিক্ষেপ করলাম।

হয়ে গেলো। তারা খোয়া গেলো চিরতরে।
কোন কাগজ না, শব্দ না, ক্ষোভ নয়
ডিমবাহী অমরা নয়
কেবল একটা পরিষ্কার পর্দা
তোমার জন্য অপেক্ষা করে।

সম্পাদকদের আগে নিজেকে
প্রত্যাখ্যান করা সব সময়ই
স্বাস্থ্যকর।

বিশেষ ক’রে এই রকম একটা বৃষ্টির রাতে
রেডিওতে তখন ভুলভাল সব গান হচ্ছে

এছাড়া, আমি জানি তুমি আর কী ভাবছো -
যে, এই কুজন্মের কবিতাটিকেও
ওখানে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে নিক্ষেপ
করা উচিৎ ছিল, তাই না!

হা হা হা হা

 	
পুস্তকালোচনা পড়ার পর 

এসব মেনে নেওয়া যায় না
আর ঘরের সর্বত্র তুমি খুঁজে মরো সেই লোকটাকে
যার কথা ওঁরা লিখেছেন।

সে কই?
সে তো নেই।
সে তো হাওয়া।

বইটাকে যতদিনে ওঁরা কব্জা করেন
ততদিনে সে বইয়ে আর তুমি নেই।
তুমি তো পরের পাতায়
পরের বইতে।

আর তার পরেও খারাপ ব্যাপার হলো
ঐ পুরনো বইগুলোও ওঁরা ঠিক বুঝতে পারেননি।
যার জন্য তোমায় কৃতিত্ব দিলেন, সেসব তুমি করোনি
যে অন্তর্দৃষ্টির জন্য হাততালি
সেটা আবার কবে ছিল তোমার!

লোকে বই খুলে নিজেকেই পড়ে
নিজেদের প্রয়োজনমতো সব বদলে নেয়
যা ভাল লাগলো না, ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ভালো সমালোচক ভালো লেখকের মতোই বিরল।
আর ভাল রিভিউ পেলাম না খারাপ
তা নিয়ে কারই বা মাথাব্যথা?

আমি তো এখন পরের পাতায়
পরের বইতে।


যে বেশ্যা মাগীটা আমার কবিতা নিয়ে ভাগলো 

কেউ কেউ বলেন ব্যক্তিগত মনস্তাপের জায়গা কবিতা নয়,
বিমূর্ততা চাই, এবং তাদের যুক্তিটা আমি বুঝি
কিন্তু ভগবান; পুরো বারোটা কবিতা হাওয়া আর
আমি কার্বন কপি রাখিনা মাগী তুই জানতিস

ওর মধ্যে আমার আঁকা ছবিও ছিল, সেরা ছবিগুলো;
দম বন্ধ ক’রে দিয়েছিস তুই, বাকীদের মতো আমাকেও কি
চুরমার ক’রে দিতে চাস? টাকা নিলি না কেন?

ওরা তো সাধারণত ওটাই নিয়ে ভাগে, ঘুমন্ত মাতাল প্যান্টের
নোংরা কোণ থেকে বের করে নেয়।
পরের বার আমার বাঁ হাতটা নিয়ে যাস
বা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট,
আমার কবিতা নিস না মেয়ে;
মাইরি, আমার কবিতা নিস না

আমি শেক্সপিয়র নই রে, কিন্তু আমি জানি
একদিন, একদিন আর কিছুই থাকবে না,
এমনকি বিমূর্তও নয়;
টাকা সব সময়ই কিছু না কিছু থাকবে আর তোরা
বেশ্যা আর ঐ মাতালগুলোও থাকবে
শেষ বোমাটা পড়ার আগ পর্যন্ত থাকবে,
কিন্তু ওই যে ভগবান জুত ক’রে পা মুড়ে ব’সে বলেছিল -
আমি দেখলাম, সত্যি, কত কবির জন্ম দিয়েছি
কিন্তু হায়! তত কবিতা হয়নি। 

** উপরের সব কবিতার মূল ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদ – লেখক
** প্রবন্ধটি ‘কবি সম্মেলন’ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত


আর্যনীল মুখোপাধ্যায় কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। জন্ম ২৫শে অগাস্ট ১৯৬৪, কলকাতায়। স্কুল, কলেজ কলকাতায় ও খড়গপুরে। আন্তর্জাল মাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম বাংলা কবিতা পত্রিকা ‘কৌরব অনলাইন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৯৯৬ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী। গোটা পৃথিবীর কবিতাকে শুষে নেওয়া আর্যনীল মুখোপাধ্যায় বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে পনেরোটি গ্রন্থের জনক।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s