আর্বান সাইকি (পর্ব-৪) – ইলিয়াছ কামাল রিসাত

শহর উড়ে যাচ্ছে : লিফটম্যান আর আমি যেভাবে দূরে

এই শহর ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার মৃত্যু হোক! এই শহর না বাঁচলে আমার বাঁচার কোন অর্থ নেই হয়তো।
এমন নৈরাশ্যবাদ আমার চারপাশে তেলাপোকার নিম্ফের মত কুঁকড়ে কুঁকড়ে আবাসকে করে তুলছে নিস্তেজ। এক-একটা সেকেন্ড কেঁপে কেঁপে আমার কানের কাছে বিগ বেনের বিকট ঘণ্টার আওয়াজের মত শুনাচ্ছে। কে বলবে আমি এমন নগরী চেয়েছিলাম?
আমার হৃদয় তো অনেক বড় বড় শহর দেখে, যাপন করে অভ্যস্ত। জীবনানন্দের ‘শহর’ কবিতা থেকে ক’টি লাইন সেদিন ঘুমের ঘোরে আমার মনে বাজছিল :

“হৃদয়, অনেক বড় বড় শহর দেখেছো তুমি;
সেইসব শহরের ইটপাথর,
কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু
আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে”।

এক লিফটম্যানের সাথে দেখা কিছুদিন আগে এক হাসপাতালে। বয়স হবে ৫০-এর মত। দিন রাত আমি যতবার উঠানামা করেছি ততবারই উনাকেই লিফটম্যান হিসেবে পেলাম। আমার লিফট ভ্রমণের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বারেই তাকে প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম কারণ, তার যে বয়স, বেশভূষা, কথাবার্তা, আচার আচরণ এসব অন্তত দেখে মনে হবেনা শ্রেণীগত দিক থেকে তাকে এই প্রায় বুড়ো বয়সে এমন একঘেঁয়ে একটা প্রহরীর চাকরি করতে হবে। ভুল বুঝবেন না, আমি কাজটাকে ছোট করছিনা। আমার কষ্ট বা চিন্তা তার বয়সের সাথে এই কাজের একঘেঁয়েমিতে যে একটা শরীরি-মানসিক সংঘর্ষ বাঁধতে পারে, তাই নিয়ে।
তাকে প্রশ্ন করলাম: আপনি কি একমাত্র লিফটম্যান, আর কেউ নেই?
তিনি বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বললেন : হ্যাঁ, আমিই একমাত্র লিফটম্যান।
উনার এই দৃঢ়তা দেখে আমি পরের প্রশ্ন গুলো না করার ইচ্ছার দিকে ঝুঁকে পড়ি। তারপরেও জিজ্ঞেস করলাম : আপনার টায়ার্ড লাগেনা?
তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন : না, আমার খুব ভাল লাগে।

এর পরেই আমাদের কথোপকথন শেষ। কি জানি, আমার অনুধাবনে হয়তো সমস্যা আছে। আরবান মার্জিন বা প্রান্তিক গোষ্ঠী ভেবে একাট্টা সমাজবৈজ্ঞানিক ক্যাটাগরি দিয়ে উনাকে আমার বিচার করা ঠিক হয়নি।

লিফটম্যান নামক এই চাকরিটা আমার কাছে খুব বিরক্তিকর এবং একঘেঁয়ে মনে হয়। ব্যাপারটা আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম আমার বোনের বিয়ের সময়। আমার বোনের বিয়েতে গ্রাম থেকে যত আত্মীয় স্বজন সবাইকে ঢাকা থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম একটা হোটেলে। তো তাদেরকে রুমে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সব আমার কাঁধেই পড়েছিল। এক এক গ্রুপ করে সবাইকে রুমের ব্যবস্থা করে দিতে আমার প্রায় দুই ঘন্টার মত লেগেছিল। পুরো সময় আমাকে লিফটের মাধ্যমে উঠানামা করতে হয়েছে। আমি সেই দুই ঘণ্টার lifeless boredom-এর ক্লান্তি এখনো ভুলতে পারিনা।
আমি বুঝে উঠতে পারছিনা অবাক কেন হলাম। সে প্রান্তিক এক লিফটম্যান যে প্রায় বুড়ো বয়সে সংসারের ঘানি টানার জন্য এই বিরক্তিকর কাজ করছে সেই জন্যে নাকি আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা তার মাঝে সঁপে চিন্তা চিন্তা করে করেছি সেই কারণে?

যদি প্রথমটা হয় তবে আমি বিশাল ভুল করছি কারণ এরকম জেনারালাইজড চিন্তা দিয়ে সমাজের ব্যাখ্যাই হয়েছে, পরিবর্তন বলতে কোন কিছু আসেনি। আর আমি তাকে প্রান্তিক ধরে নিয়ে যে ক্যাটাগরিটতে ফেলছি তা তো ভুলই প্রমাণিত হল। আমার এক প্রিয় ভাইয়ার কাছ থেকে কয়েক দিন আগে দ্বিতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রীর আত্মহত্যা চেষ্টার কথা শুনেছি। সে থাকে বস্তিতে। সেই মেয়ের আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ ছিল তার বড় বোনের সাথে অভিমান(আমার যতটুকু মনে পড়ছে)।
এই আত্মহত্যা চেষ্টাকে দারিদ্র্য ক্যাটাগরিতে কি ফেলতে পারছি? এমিল ডুর্খেইম-এর সুইসাইড থিওরির সোশ্যাল কোহেশন-এ পড়বে? – না, যেভাবে ঐ পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই লিফটম্যানের কাজকে আমি ক্লান্তিকর মনে করেছি, যেভাবে তার ব্যাপারে আমার অনুধাবন খাপ খায়নি ঠিক তেমনি ঐ বস্তিবাসী মেয়ের সুইসাইডকে আমি তত্ত্বে জারিত করতে পারছিনা।
এই জারিত না করার ফলস্বরূপ আমি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছি, তুমি আলগা হচ্ছ, তোমরা হারিয়ে যাচ্ছ, আমরা উবে যাচ্ছি–নগর পুড়ে ছাই হচ্ছে, রাষ্ট্র উড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দের ‘শহর’ কবিতার শেষ অংশের মতন:

“শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু মিনারের ওপরেও
দেখেছি—নক্ষত্রেরা—-
অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে”।

'পুরান শহরের উপ্রে দিয়া উল্কা' - মেরি ক্যারল উইলিয়ামস; প্রাপ্তিসূত্র- http://fineartamerica.com/featured/shooting-stars-over-old-city-mary-carol-williams.html
‘পুরান শহরের উপ্রে দিয়া উল্কা’ – মেরি ক্যারল উইলিয়ামস; প্রাপ্তিসূত্র- http://fineartamerica.com/featured/shooting-stars-over-old-city-mary-carol-williams.html

ছবি মেলা ৮ এর ভূত বুঝি ওঝা দিয়ে ঝাড়তে হবে : নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ!

১-আর্টিস্ট তুসিকুর রহমান এর আত্মজৈবনিক একটা সিরিজ ফটোগ্রাফি। জীবনের একটা সময় তিনি আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন উপায় দেখেননি, যদিও সেই ভয়ানক পরিণতি শেষমেষ তিনি বরণ করেননি। সেই পিরিয়ডকে পোর্ট্রে করে ভয়ংকর সব ছবি। একটা ছবি আছে যেখানে দেখা যাচ্ছে একটা লাল রঙমতন টিভি ঝির ঝির করছে। মানে ‘জীবনের সম্প্রচার’ নাকি বন্ধ হয়ে গেছে!

২-আর্টিস্ট পাওলো পাত্রিজি ছবি তুলেছেন ইতালিতে আগত সেইসব নারী অবৈধ অভিবাসীদের যারা জীবিকা বেছে নিয়েছেন সেক্স ওয়ার্কার হিসেবে। আকর্ষণটা হচ্ছে, কোন সেক্স ওয়ার্কারের ডিরেক্ট ফেস কোন ছবিতে নেই। আছে শুধু বনে জঙ্গলে বিছানা পেতে যে অস্থায়ী পৃথিবী তারা তৈরি করেছে সেই সব বিছানার।

৩-আর্টিস্ট সাদিয়া মারিয়াম-এর ছবি এবং একটা ভিডিও সমেত একটা সিরিজ আছে যা মেন্টাল রোগীদের এসাইলাম এর মত। পড়ে আমার বন্ধু জুলফিকার সাব্বিরের মাধ্যমে জানতে পারলাম, পুরো ব্যাপারটা উনি নিজেই স্টেইজ করেছেন।

আত্মহত্যা, অবৈধ জঙ্গল, মানসিক বিকারের জগত——এই তিনের স্থান এক এক জায়গায়—-মৃত্যু বরণ করে নক্ষত্রে মিলিয়ে যাওয়া, জঙ্গলে বিছানা পেতে অন্য এক পৃথিবী নির্মাণ, মনের অসুখগুলোকে একটা বিছানায় বসবাস করানো—–
চারদিকে ‘মন’-এর কাঁটাছেড়া আর ব্যক্তিক ক্রাইসিস ‘স্পেস’-এর জয়জয়কার। ভাত-ডাল, রুটি-রুজি ছেড়ে মানুষ আজ মনের সুখ খুঁজতে ব্যস্ত।
খুবই স্বাভাবিক, যে পলিটিকো-রিয়ালিটি ক্রমাগত তার সব দরজা অনেক অনেক দরজা দিয়ে নিগূঢ়ভাবে আটকে দিচ্ছে সেখানে রাজনৈতিক সমাধান তো দূরের কথা, সমস্যাটা রাজনৈতিক কিনা তা-ই বিতর্কের মধ্যে পড়ে।
এই (অ)রাজনৈতিক রাজনীতির খেলায় ব্যক্তি অসহায় হয়ে নিজেকে নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত।

বাড়ি ফেরার পথে এক ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা। সে বলে উঠল, ভাই, জেদ ধরেছি নিজের সাথে নিজে। ‘আগামী এক মাস ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভ্ রাখব, এটা আমার চ্যালেঞ্জ!’
মনে মনে ভাবছিলাম, ছবিমেলার ছবিগুলো এসে মানুষের রূপে ছোট ভাইকে প্রতীকায়িত করল আমার সামনে: ‘নিজের বিরুদ্ধে সে জিহাদ ঘোষণা করছে, বৈকি!’


সাইরেন আর রাজপথ! অমীমাংসিত সব শবেরা

হায়দার বাবা নামে এক বাবা শুধু হাঁটত এই ঢাকা শহরে। তার ছিল অনেক মুরিদ যারা কিনা বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল ‘বাবা’র মৃত্যুর পর। ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে হয়তো।
ঐ বাবাকে আমরা বন্ধুরা ‘ময়লা বাবা’ ডাকতাম এক বিখ্যাত ‘মিথ’-এর কারণে! বাবা নাকি দীর্ঘ দুই যুগ গোসল করেননি, তাই।
সারা বাংলাদেশ আমি এই প্রয়াত বাবার মত হাঁটতে চাই।
আজ হাঁটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু যানবাহন গুলোর ভয়ার্ত সাইরেন আমার হাঁটায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে, প্রচণ্ড। কখনো এম্বুল্যান্স, কখনো পুলিশের ভ্যান। কান দুটোর শ্রাব্যতার সীমা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক।
এই সাইরেন আর রাজপথ! অমীমাংসিত সব শবেরা।

প্রাপ্তিসূত্র - http://imgarcade.com/1/anarchy-graffiti/
প্রাপ্তিসূত্র – http://imgarcade.com/1/anarchy-graffiti/

ক্লিক - শান্ত মহাসেন
ক্লিক – শান্ত মহাসেন

[ইলিয়াছ কামাল রিসাত : সিনেমাখোর, প্রবন্ধ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষে ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে কর্মরত।  – নয় নাম্বার বাসের হেল্পারগণ ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s