আলাল ও দুলাল অথবা দুই রাজনৈতিক ভাইয়ের গল্প – আহমেদ খান হীরক

১.
আলাল আর দুলাল পিঠাপিঠি ভাই। মায়ের পেটের ভাই। বড় ঘরের বড় আদরের ছেলে তারা। তাদের আরো কিছু ভাই যে নেই তা না। কিন্তু আলাল আর দুলালে মিলে খুব ভালো।
কিন্তু বড় বাড়িতে যা হয় সাধারণত– জায়গা-জমি-সম্পদ নিয়ে শুরু হলো বিবাদ। শুরু হলো ভাগ-বাটোয়ারা। দুলালকে নিয়ে নিজের সম্পদ বুঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মেজো ভাই। বড় ভাইদের সঙ্গে থাকলো আলাল।
মেজো ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে ছিল দুলাল কিন্তু অনেক আশা নিয়েই। বড় বাড়িতে তার কথা তো কেউ শুনতো না। তাকে কেউ গুরুত্বও দিতো না। দুলাল মনে করল মেজো ভাই যখন তার দায়িত্ব নিয়েছে তখন এবার ভালো কিছুই হবে।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুলাল দেখল এ মেজো ভাই যেন বৈমাত্রের চেয়েও খারাপ। তার সম্পত্তির মাছটা পাটটা ধানটা আমটা মেজো ভাই ঠিকই ভোগ করে কিন্তু তিনবেলা খাবার দেয়ার সময় মুখে ঝামটা দেয় ভাবি। উঠতে বসতে কথা শোনায়। ছোটকে আরো ছোট করে রাখে। দুলাল যেন কুঁকড়ে কুঁকড়ে থাকে।
ওদিকে বড় ভাইদের সাথে আলালের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। আলালের এক সময় যশটশ থাকলেও এখন তা যেন হারিয়েই গেছে বড়দের মধ্যে। তার যেন নিজের বলতে কিছু নাই। সে যেন বড়দের মুখের কথা নিজের মুখে ফেরি করে ফেরে। আলাল তবু পেটে খেয়ে পিঠে সওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করে। আলাল ধীরে ধীরে ঘরকুনো আর কোনঠাসা হয়ে যেতে থাকে। আলাল তবু চুপ থাকে।
কিন্তু চুপ থাকে না দুলাল। মেজো ভাইদের সাথে তার আর বনিবনা হয় না। এবার সে নিজের মতো বাঁচতে চায়। স্বাধীনতা চায়। নিজের ঘর নিজে গোছাতে চায়। এমন সাহসের কথা শুনে মেজো ভাইয়েরা বেধড়ক পেটায় দুলালকে। দুলালের শরীরে পড়ে চাবুকের দাগ। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। তবু দুলাল বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। ভেঙে ফেলে ঘরের তালা। মেজো ভাইদের পাষাণ বুক পদদলিত করে। থুতু ছিটিয়ে আসে ওই ঘরের চৌকাঠে। তারপর বড় বাড়ির পাশে, ছোট্ট যে পুকুর নিয়ে তার ঠাঁই, সেখানেই নতুন একটা পর্ণকুটির করে বাস করতে শুরু করে দুলাল। আর ওই ঘরের পাশেই, বড় বাড়িতে, অনেক উঁচুতে, স্বেচ্ছাবন্দী থাকে আলাল। আলাল দূর থেকে দেখে দুলালের স্বাধীনতার সুখ। দুলাল গামছা দিয়ে মাছ ধরতে ধরতে গান গেয়ে ওঠে। দুপুরের চুলা তার বিকেলে জ্বললেও, আলুভর্তা আর মাড়গালা ভাতই দুলাল এত তৃপ্তি নিয়ে খায় যে আলালের বুকটা জ্বলে যায়। আলাল ওপর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দুলালের জন্য সন্দেশ ফেলতে চায়, দুলাল নিষেধ করে। বলে, আমার পুকুরের পানিই এত মিষ্টি যে নতুন আর মিষ্টি লাগবে না!
আলাল বলে, ধুর, শুধু জল খেলে কি হয়? ওইটুকুও মুখে দে…
আলাল আর দুলালের ভাতৃত্বের নতুন মাত্রা শুরু হয়। বড় বাড়ির বড় কারবার, তারা এসব কেউ খেয়াল করে না।

২.
গ্রামে প্রতি বছর পৌষমেলা হয়। সে মেলায় দশগ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসে। আর ঘটা করে হয় গরুর লড়াই। বড় বাড়ির গরু প্রতি বছরেই খুব ভালো করে। কখনো প্রথম কখনো দ্বিতীয় হয়। এবারের মেলাতেও বড় বাড়ির গরু শিং বাঁকিয়ে প্রস্তুত। বড় বাড়ির সবাই খুব উৎসাহ দিচ্ছে। সঙ্গে আলালও আছে। তার মুখেচোখে রঙ। খুশির জেল্লা। সে নিজে এই গরুটাকে ভুষিখৈল খাইয়ে বড় করেছে। বড় আপন তার এই গরু। প্রতিযোগিতা শুরু হতেই আলাল খুব আশ্চর্যের সাথে দেখে দুলালও প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। যে হাড্ডিসার গরুটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে ঘাস খাইয়ে বেড়াতো তারই মাথায় একটা লাল ফেট্টি বেঁধে নিয়ে চলে এসেছে ময়দানে। আলাল ভাবে, করছে কী পাগলটা! গরুটা যে তার মরেই যাবে!
আলাল তাই দুলালকে বোঝায়। খবরদার মাঠে নামাস না গরুটা। দেখছিস না কত বড় বড় গরু এসছে এই মেলায়। তোর গরুটাকে তো ওগুলো গিলেই ফেলবে।
দুলাল হাসে। বলে, ফেলুক না আমার বাঘারুকে! দেখো কেমন তেজ এর শরীরে। আর বুকজুড়ে কেমন লড়াই করার জিদ!
আলাল আবারো সাবধান করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। আর কী আশ্চর্য প্রথম খেলায় বাঘারু নিমপাড়াগাঁয়ের একটা গরুকে শুইয়ে দিয়েছে মাটিতে। দুলাল আলালের দিকে তাকিয়ে হাসে। ভাবটা যেন এরকম কী কেমন বলেছিলাম না! আলাল আশ্চর্য হয় কিছুটা, তবে তেমন পাত্তাও দেয় না। হয়তো নিমপাড়াগাঁর গরুটা বেকুব ছিল। না হলে বাঘারুর একটা গুঁতায় অমন ধুলায় লুটায়!
দেখতে দেখতে খেলা অনেকদূর গড়ায়। এবার বড়বাড়ির গরুর সাথে খেলা পড়ে বাঘারুর। মাঠজুড়ে বড়বাড়ির সমর্থক। হৈহল্লা খুব হচ্ছে। আলাল চুপি চুপি গিয়ে দুলালের সাথে দেখা করে। বলে, ভাই দেখছিসই তো! আমাদের গরুটার যে সাইজ তাতে তোর ওই বাঘারু ফাগারু পাত্তাই পাবে না… তুই এক কাজ কর বাঘারুকে নিয়ে ফিরে যা! আমি তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে বলবো বড়দাকে। কোনো চিন্তা করিস না তুই!
দুলাল কিন্তু খুবই ঘাড়ত্যাড়া। সে বলল, বারে, এতদূর আসছি… এবার বড়বাড়ির সাথে খেলা আর আমি বাঘারুকে না খেলায়ে চলে যাবো? এটা একটা কথা? তুমি কোনো চিন্তা কইরো না আলালদা, দেইখো আমার বাঘারু খুব ভালো ফাইট দিবে!
আলাল বলে, আরে ফাইট দিয়ে লাভ কী, অ্যাঁ? হারলেই বাদ, সে খেয়াল আছে?
দুলাল বলে, হারলে কিন্তু তোমরাও বাদ গো দাদা ভাই, সে খিয়াল কি তোমাদের আছে? যাও, তোমাদের গরুর শিং-এ ভালো করে তেল লাগাওগে!
আলাল দুলালের ওপর একটু মনক্ষুণ্ণই হয়। গরীব থাকলে মানুষের কিছু দোষত্রুটি জন্মে। বামুন হলেই আর কি চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছা হয়, এটাই নিয়ম। বড়দারা যেমন বলে এদের ভাতে পানিতে মাইরা রাখতে হয় তা একেবারেই মিথ্যা না!
আলাল নিজের গরুর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদিকে তৈরি বাঘারুও। খেলা শুরু হয়। তিন মাস আগেও যদি কেউ এই বাঘারুকে দেখতো আর শুনতো গরুর লড়াইয়ে এই বাঘারু অংশ নেবে তাহলে হেসেই গড়িয়ে পরতো সবাই। কিন্তু ময়দানের এই বাঘারুর চোখে যেন অন্য রকম জেল্লা। লড়াই করার অন্য রকম আকাঙ্খা। সব কিছু ধ্বংস করার এক অসম্ভব জেদ। বাঘারু একের পর এক আক্রমণ করতে থাকলো বড়বাড়ির গরুটাকে। গরুটা নিমিষেই লুকিয়ে পড়লো কখনো ধূলায় কখনো কাদায়।
সবার চোখকে ছানাবড়া করে জিতে গেল বাঘারু। বড়বাড়ির গরু বাদ পড়ে গেল প্রতিযোগিতা থেকে। এ বড় লজ্জা, এ বড় অপমান! বড়বাড়ির গরু হেরে গেল এক হাড় জিরজিরে ফকিরনি বাঘারুর কাছে। বড়দারা ফিচফিচ করে কাঁদলেও আলাল চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দুলাল তখন বাঘারুর শরীর পরিচর্যাতে ব্যস্ত। মুখে তার বিজয়ের হাসি।

৩.
অনেক উঁচু থেকে আলাল এখন দুলালকে দেখে ঠিকই, কিন্তু আগের সেই প্রীতি নেই দেখায়। বড়দাদাদের মতো সেও এখন বিশ্বাস করে গরু লড়াইয়ে তারাই কেবল জিততে পারে। ওই হতভাগা দুলালের জিত মানে আসলে পুরো মেলার হার। আলালের এখন ভাবতে কষ্ট হয় একদিন এই দুলালকেই সে সন্দেশ দিতে চেয়েছে! দাদা দাদা বলে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে! বলেছে আমরা তো একই মায়ের পেটের ভাই! অসম্ভব! একই মায়ের পেটের ভাই নয় তারা। দুলাল বড় গাদ্দার! তার এত বড় সাহস সে বড়বাড়ির বিরুদ্ধে যেতে পারে! বড়বাড়ির দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে! বেইমান, বেইমান আসলে ওই দুলাল!
এখন দুলাল গুনগুন করে গান গাইলে গায়ে জ্বালা ধরে আলালের। দুলাল তার দিকে তাকিয়ে হাসলেই মনে করে অপমান করছে বুঝি। আর সবচেয়ে সে ঘৃণা করে ওই দুলালের স্বাধীনতাটুকু। রাত নেই দুপুর নেই সকাল নেই যখন যা খুশি করতে পারছে দুলাল… আর সে, সে এখনো, এই সোনায় মোড়া গৃহে যেন বন্দী! বন্দী!
ঘৃণা হয় আলালের, দুলালের ওপর খুব ঘৃণা হয়। সে ঘৃণার ছায়া, অনেক উঁচু থেকে দুলালের মুখের ওপরও পড়ে। দুলালের চোখ ধ্বকধ্বক করে। সে বাঘারুর শিংগুলো আরো শানাতে থাকে ॥

'লাল ষাঁড়' - আইভান জেনেরালিচ ; প্রাপ্তিসূত্র - http://www.wikiart.org/en/ivan-generalic/the-red-bull-1972
‘লাল ষাঁড়’ – আইভান জেনেরালিচ ; প্রাপ্তিসূত্র – http://www.wikiart.org/en/ivan-generalic/the-red-bull-1972

ফটো - তিতাস চাকমা
ফটো – তিতাস চাকমা

[ আহমেদ খান হীরক – গল্পকার, মিডিয়াকর্মী ]

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s