রওনক মিরাশদারের কবিতা


আসুন, লাশ খাই।
মরা লাশে ভেজাল নেই।

জবাইকৃত লাশেরা হালাল।
দগ্ধরা সুস্বাদু ফ্রাই তো হয়ে আছেই।
খেতে পারেন বাপ-মায়ের লাশও
যে যার ফ্রয়েডীয় বাসনায়।

ভালোদের তুলে এনে খাবো।
তাদের ভালোটা ঢুকুক।
খারাপদের খাবো হিংস্র রিরংসায়,
জীবদ্দশায় শাস্তি দিতে পারি নি বিধায়।

আসুন, মর্গের তালাগুলো ভেঙ্গে ফেলি সময় থাকতেই।

না হলে এই দুর্ভিক্ষে আত্মহত্যা করে
নিজের লাশই খেতে হবে গলবার আগে।

আসুন, লাশ খাই
ঢাকা, ২০১০



এ হাত ধোরো না তুমি
এ হাত শরীরের অধিক
শবচ্ছেদী গন্ধলাগা এই হাত
এ হাত ধরলে তুমি কী পাবে?!

প্রতিশোধসন্ধানী এই হাত
লুসিফার যাদের সভায় ডেকেছিলো
সঙ্গমচিহ্ন এঁকে এ হাত বলেছে বারবার
প্রভু তুমি হে, প্রভু তুমি হে!

এ হাত –
প্রতারণায় অশ্রু মুছেছে যার তার
কামহীন ঘুরে এসেছে অন্যের অপ্রবেশ্য অঞ্চল
অসহায় গালে বসিয়েছে ক্ষমতার প্রমাণ
তাচ্ছ্বিল্যে ছুঁড়ে মেরেছে টিকে থাকবার দাম
একদম ধোরো না এ হাত
তোমার সততার চুনকাম খসে যাবে।

দূরবর্তী নক্ষত্রপ্রেমীর প্রতি সতর্কীকরণ
যেভাবে তাকিয়েছো
যেভাবে আগলেছো
দূরত্বের মুগ্ধতায়

শবলিপ্সু শববাহকের এই হাত
অশ্রুসঘন সে ফাঙ্গাসে পচেছে বারবার
ক্লান্তির এই হাত সময়ের অধিক
তাকে তুমি কী দিয়ে জড়াবে! 

সতর্কীকরণ
ঢাকা, ২০১০ 



ক্যারোটিডে দাঁত রাখতে ধমকালে ভুল, ‘ঘামখোর’!
আর এই গল্প বিক্রি করায় জানি বলবে ‘নামখোর’
যেটুক দিচ্ছো অর্ধ কেবল, তাই দংশী আধেক, অর্ধ ছোবল
ওষুধে তুমি সারো না প্রবল অপবাদ দাও ‘কামখোর’ !

অথচ দেখছিলাম জীবিত আছো কি না
অমন শীতল ব্রীড়াক্রান্ত রিরংসাবিহীনা
শরীর নিয়ে রমণ ক্যানো মিছিলও চলে না!
বাহু, বন্ধন ছাড়িয়ে বললে – ‘পরোয়া করি না’

পরোয়া করে না যারা – ‘মৃত’
যদিও বেফাঁস
তবু কিছু ভুল বলোনি তো!

ক্যারোটিডে দাঁতের অনুসন্ধান
ম্যাসেচুসেটস, ২০১৫



অসুখ কোথায় ছিলো?
টাটকা ক্ষত ও নৈরাজ্যের সঙ্গম সেরে তাকাই চতুর্দিক
আসল অসুখ জমাট ছিলো … বুকের কোটরে

(মধ্যরাতে…)

ভয় কেটে যাচ্ছে
সরে যাচ্ছে কালো কুচমেঘ নির্বিকার আকাশের
আহ, আলো সে তো স্থানিক বিভ্রান্তি
বাঁচতে দাও আর্তনাদের বদলে
পিঠ ছিঁড়েফেঁড়ে বেরোচ্ছে
দিগন্তজয়ী সুবিশাল পাখনা

ভয় কেটে যাচ্ছে
যেমন সৌখিন বাতি
শাপশাপান্ত ছেটায় তারজ্বলা বাল্বকে
বারুদবিহীন এত দপদপে সুপ্ত আগুন
আজ ঠোঁটেঠোঁট ফোসকা পড়া লোভে
সে ধার শুষে জ্বালিয়েছে
নিজেকে আগুন-জ্বলন্ত জন্তু চুরুট

অভিমান মরে যাচ্ছে (নিপাত যাক)
হৃদ্যতার পাখনা পুড়িয়ে গজিয়ে উঠছে
বৃহত্তম অতীকায় সর্বব্যাপী ঘেঙ্গিশ
বাসনার অন্ধ কর্দম থেকে পা উঠিয়ে
মাকড়সা নতুন জালে সটকে পড়ছে
প্রাক্তন জাল থেকে খসে পড়ার আগে
সুনিপুণ চতুর ছেনাল

যেভাবে সর্বত্র বিবমিষা উদ্রেক করে
আমার আত্মার অহংকার
এক একটা জ্বলন্ত হেমাঙ্গ
ঘোটকেশ্বর ছুটিয়েছে
ভয় কেটে যাচ্ছে। 

উদীয়মান
ম্যাসেচুসেটস, ২০১৬



আজকে বিকেলের নিঃসঙ্গতা কোনো উত্তরাধুনিক নিঃসঙ্গতা ছিলো না।
এ নিঃসঙ্গতা একরৈখিক ধ্রুবক। একান্তই অনুপস্থিতির সন্তান, কষ্টপ্রবণ।

সকালে তোমার সাথে দেখা হওয়া ভিখিরির কথা ভাবলাম।
তোমার সাথে তার দৃষ্টি বিনিময়,
মলিন দাক্ষিণ্য বিনিময়ের সৌভাগ্যকে আমার ঈর্ষা হতে লাগলো।

মধ্যদুপুরে তোমার সুটকেসের চাকা
পা মাড়িয়ে যাওয়া পথচারীর কথা ভাবলাম।
তার নিপাট দুর্ভাগ্যকে আমার ঈর্ষা হতে লাগলো।

বাকি রইলো বাতাসের অবাধগামীতার কথা,
সোয়েটারের বুনো উল, রেজরের ব্লেডের প্রতি নির্বোধ ঈর্ষার কথা।
অসম্ভব আক্ষেপের তেতোমিষ্ট চায়ে রাখলাম চুমুক।

এমন কী উগড়ে দিলাম মিথ্যা ব্যস্ততার একদলা অজুহাত,
অভ্যন্তরে পীড়নপ্রবণ।

অথচ সাড়ে সাতশো কোটি পতঙ্গের পৃথিবীতে
তোমার জন্য এতটা উৎপীড়িত, তটস্থ অন্য কেউ তো নেই।

এক পর্যায়ে নিজের এই দুর্লভ বাণবিদ্ধতাকে
নিজেরই হিংসে হতে লাগলো।

নিঃসঙ্গতার ধ্রুবক
ম্যাসেচুসেটস, ২০১৬



১.

এতকাল পর প্রথম দেখা
শুভমুখ ছুঁয়ে গেলো ডুংরুর
বায়ুকম্পিত পেখম, পেলব
পরমা আমার, চেনো, দ্যাখো
রক্তে খাঁজে আত্মঘাতি নিকোটিন ক্ষত
বুকে জমাট প্রগাঢ় হিম, আহিত, মর্গের মত
শুভনয়না, প্রেম আমার ঝাড়গ্রামবাসিনী
অমন পুণ্যমুখ, অমন পরিত্রাণদায়িনী
তোমাদর্শনে পূরবী! কবি! দেবী!
এই ধাবমান মৃত্যুর অবসান হলো।

২.

ভাঁড়টিকে বিদ্রূপ করতে পারো
ও মুখ কালক্রমে শুধু একবার দর্শন
পর কবিসভার এই ভাঁড়ের মনন থেকে
কেবল প্রেমের পঙক্তি ঝরছে
যেন বসন্তের কৌম্যের ধারাপাত
জারুলের সোনালুর অগ্রিম বর্ষণ;
ভাঁড়টিকে বিদ্রূপ করতে পারো
তবু হা ঈশ্বর, কার পুণ্যবলে
প্রাজ্ঞেয় আজ্ঞা হলো
অমন নিমগ্ন ধ্যান, ঈষৎ সিঁদুর
কানের যজ্ঞীয় দুল বিমূর্তবিধুর হোমে
হৃৎপিণ্ড পাগলপারা অথবা গলিত ঝর্ণাধারা
হতে হতে এ অবধি তপ্ততা ফুরোলো, জুড়োলো।

পরমা
ম্যাসেচুসেটস, ২০১৭



রবিবার জানালা পাশে রূপোলী শেয়াল
রেখে উড়ে যাচ্ছে সুমতি হোয়াইট পাইন শূন্য দালানমুখী বাসে
ভিয়েতনাম কারাবন্দী ধূসর সিমেন্টে, আর এক ধূসর আকাশে 
জনশূন্য শহর ভ্রমণে হঠাৎ গেয়ে ওঠো, এই তবে জগতের শেষ
চিরবিস্ময়ের শেষ নয় তবু, সবকিছু একই থেকে গেলে
শিলাবৃষ্টি স্কিটার ডেভিস, শিলাবৃষ্টি!
কাঁটাতোলা সমুদ্রশীতের গর্জনে তুমি ধাতব নক্ষত্র হয়ে ঝরো,
ব্যারেজে দাঁড়িয়ে তোমার আধাশতাব্দীর বন্ধন।


স্কিটার ডেভিস ১৯৬২
ম্যাসেচুসেটস, ২০১৭



ওই ভাবে দেখলে মন খারাপ হবে। 

শীতস্নাত ক্যাফেটেরিয়া, বন্ধ স্যুপের দোকান পাশে রাস্তা কাটাকাটি চলছে, সমস্ত পীতাম্বর লাইলাক হতে নেমে ক্রমে ধূসর চিন্ময়।

ফ্লাডলেন থেকে একটি বাদামী পাতা ‘আমিও যাবো’ বলে ভেসে গেলো ভাসমান অন্য ম্যাপলের আঙ্গুলে। এই সড়কগুলো ঢালু, রাতের দিকে সমুদ্রে ধেয়ে যায়। সমস্ত মৎস্যশিকারি নাও তুমুল আঁশটে ঘ্রাণ, ধারালো জালের ছপাৎ, সাইরেন ও সার্চলাইট জ্বেলে হয়ে যায় পরবর্তী সকালের কাগজ। এই আকাশ কৃষ্ণতারকাময়, আদর দিলে বুকে চেপে বসবে। ঘরে ফেরো, ঘরে ফেরো। ওই ভাবে ভাবলে মন খারাপ হতে পারে।

পরদেশী রাউট
ঢাকা, ২০১৮ 



সেমেটারির বাদামী পাখি,
এই বৈকল্য বহনে আমরা কেউ কারো সন্ন্যাসভার বুঝবো না। 
ঈশ্বর, আমাকে স্বত্ব ত্যাগ করার ক্ষমতা দাও,
সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে কৃতজ্ঞ হবার ক্ষমতা দাও,
সময়কে স্থবির করে ক্ষুদ্র বছরে জন্মমৃত্যু একচক্র করে দাও।  

শীত সেমেটারির গরিব বাদামী পাখি,
তবু তো আমরা কেউ কারো সন্ন্যাসে প্রবেশ করতে পারবো না।

নিউ বেডফোর্ড হেডস্টোনজ
ঢাকা, ২০১৮ 



লোকজন বড় হয়
ঝুলে পড়ে মোটা পেট, ঝুলে পড়ে দাঁত,
সটান চামড়া হয় শুষ্ক মলিন, চুল কমে টাক

সুবিধার শরীর ছাড়ায়েও
বয়স যেন কমই থাকা ভালো
সদা ও সর্বদা শিশু বা তরুণ থাকা ভালো
বয়স বাড়তেছে? উহ হোয়াট দ্যা ফাক

আমাদের পাঠাইছিলো পড়তে
দশ নয় বারো নয় হয়তো একুশ বছর
আমরা পইড়া বিশ্বাস করছিলাম
কাগজ কলমের কাবজাব
তাই বেলা বারোটায় বুধ মঙ্গলবার
আমরা দেখি নাই বাজার রাস্তাঘাট
কমবেশি আজও তো তা-ই
পেটে ভাতে চাকরীর ঠেলায়
আমাদের কোনো ছুটি নাই
ফাঁকিবাজি ছাড়া
ছুটির মধ্যে খচখচে
চাকরের মন ছাড়া কিছু নাই
প্লেটে অপুষ্টি আর মেদ ছাড়া কিছু নাই
যারা পড়তে গেছে, যারা পড়তে যায় নাই, সবারও
যারা দালালি করছে, যারা দালালের খপ্পরে পড়ছে, সবারও
যাদের টাকা আছে, যাদের টাকা নাই, সবারও 

অনেক প্রেমের পর আমরা টের পাইছি
কেউ আমাদের ভালো বাসে নাই, আর আমরাও
আর অনেক দুঃখের পর টের পাইছি
গুয়ের কীটের মতো দুঃখের বাইরে আমাদের
তেমন কিছু জানা নাই পোন্দাপুন্দি ছাড়া
প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা একতরফা
দুঃখ করতে পারি নাই
ধমনী ও শিরায় এত বিষ নিয়া
আমাদের আনন্দ সংবাদও কাউরে দেই নাই বড়মুখে
মাথায় ও হৃদয়ে নিজেরে অকিঞ্চিৎ জানিয়া

পুষ্টিহীন ছোটখাট মানুষের দেশে
দিনে দিনে আসে নতুন হিপোক্রেসি, নয়া নয়া বিস্ময়
অনেক কবি, অনেক মাহফিল ও টিকটকারের ভিড়ে
একদিন আমরা স্বীকার করবো আমাদের প্রাসঙ্গিকতার শেষ
আমরা স্বীকার করবো বুড়া হইছি – আর ভালো লাগে না
তার আগেই আমরা তো ইস্তফা দিতে পারি
ইচ্ছা হইলে বানাইতে পারি মাটির বাসন, কাঠের আসবাব
যেমন আমি চইলা যাবো শীতের বন্য অঞ্চলে
শীর্ণ জলধারার পাশে থেকে যাবো, ফিরবো না আর।

বয়েস-আপতন
পেনসিলভেনিয়া, ২০২২ 



অজুহাত নাযিলের আশায় বসে থাকি।
যথার্থ অজুহাত দরকার, দরবারে যেতে তোমার।
পকেটে টাকা নিয়ে বলতে পারি ধার চাইতে এলাম।
ঝামেলা চুকিয়ে এসে বলতে পারি, অনেক জঞ্জাল।
সন্ধানী লোকের তীর্থ মানুষও তো হয়,
খলবলিয়ে নাম দেয় গঙ্গা, মদিনা, জেরুজালেমা!
ওগুলো গালগপ্পো, বলে হয়তো ফুঁৎকারে হটাবে।
তুমি আমি মাইনে খাটা কারণের লোক,
সাত দিনের বেশি ঘাড়ে অতিথি সয় না।
তবু পৃথিবীর ধূলিকণায় কিছু কণা একই রকম
পতিত উল্কায়, পিরামিডে, মৎস্যল সমুদ্র বন্দরে।
ভেজা বাতাসে হৃৎপিন্ডের বালু জমাট বাধিয়ে
নববর্ষের বরফ বর্ষায় আতশবাজি ভিড়েতে তাকিয়ে,
আমার জানা আছে তোমার শহরে যাবার বাস রাউট,
জানা আছে ফ্লাইটের টিকেটের দাম, ট্রেন ছাড়বার সময়।
জানা নাই কেবল একটা গ্রহণযোগ্য অজুহাত।

সাক্ষাৎ বিষয়ক
পেনসিলভেনিয়া, ২০২৩



রওনক মিরাশদার।
জন্ম ১৯৮৯, ঢাকায়। গদ্য আর গান তৈরির চেষ্টা করেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান