বিষয় : মুঘল দরবারে তৈমুরীয় অণুচিত্রকলা ও ইয়ুরোপীয় চিত্রকলা / সৌরভ রায়


“লেখো তুমি জাদুগল্প, রক্তবেশ নল
তোমার রসনা দুটি তবুও অ-বোল
দীঘল সাইপ্রেস যেন ছায়াঘন, একা
পদচাপে বয়ে আসে মসিনীল রেখা
শর-ঋজু, তবু জ্যা-র টঙ্কারে যেন
দিনের দেহতে তুমি রাত বয়ে আনো”

শামস আলদিন মুহাম্মদ বসফি, আনু. ১৫৬৮ – ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ

এখানে বসফি নল, খাগ বা শরের কলমকে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করেছেন, সে যেন রক্তবর্ণ বেশপরিহিত, সাইপ্রেস গাছের মত ছিপছিপে (নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই উপমা ব্যবহার হত)। তার দুটি জিভ (রসনা)বলতে কলমের চেরা নিবের কথা বলা হচ্ছে। সে যেন কথা বলতে পারে, তবু তার মুখে কোন বোল নেই। তার পায়ে পায়ে ছায়া বা কালো আঁধার এসে দিনকে রাত করে দেয় – লেখার সময় সাদা কাগজ যেমন কালির দাগে ভরে ওঠে।
ডেভিড জে রক্সবার্গের করা ইংরাজি অনুবাদ ও টীকা থেকে

“ ছবি আমাদের প্রথমে নিয়ে যায় তার প্রতীকী গড়নে আর তারপর তার অর্থে, যেমন প্রথমে আমরা দেখি একটা রেখার গড়ন, তারপর দেখি অক্ষর আর শব্দকে আর শেষে তার অর্থকে।ঠিক সেই ভাবেই  ইয়ুরোপীয় চিত্রকাররা আমাদের অতিপরিচিত নানা গড়ন এঁকে আর তার সাথে ইহজগতের নানা স্বল্পপরিচিত গড়ন মিশিয়ে দৃশ্যের অতীত এক সত্যের জগতে আমাদের নিয়ে যান। আমাদের মত দর্শক  যারা বস্তুর বাহ্যরূপ ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না তাঁদেরও জ্ঞানচক্ষু এভাবে খোলে। এইভাবেই রেখা, তা লেখায় হোক বা আঁকায়, প্রাচীন জ্ঞানের ধারক ও বাহক হয়ে আমাদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে নিয়ে যায়।   ”
আবুল ফজল আলামী, আইনআকবরী, ‘লেখা ও আঁকার শিল্প‘, আনু. ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দ

 মুঘল সম্রাটেরা যখন তাঁদের দরবারে ইয়ুরোপীয়দের নিয়ে আসা নানা শিল্পসামগ্রী পছন্দ করে সেগুলি শিল্পকর্মশালায় নিজেদের নির্দেশসহ পাঠাতে লাগলেন, তখনই শিল্পীরা সেই সামগ্রীকে খুঁটিয়ে দেখে, যাচাই করে, তার থেকে নতুন কাজের অনুপ্রেরণা নিতে থাকলেন। মুঘল শিল্পীদের দ্বারা ইয়ুরোপীয় শিল্পভাষা থেকে স্বাধীনভাবে এই চয়ন করার ক্ষমতা তৎকালীন বিভিন্ন বাণিজ্যপ্রার্থী ইয়ুরোপীয় রাজশক্তির ওপর মুঘল সাম্রাজ্যের যে জোর ছিল, তারই আংশিক প্রতিফলন। ইয়ুরোপীয় শিল্পভাষার এই মুঘলীকরণে কর্মশালার শিল্পীদের ভূমিকা শুধুই সম্রাটের আজ্ঞাবাহক হিসাবে ছিল না, বিমিশ্রণের এই স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তাঁরা করেছিলেন।

বহু পন্ডিতের মতে, মুঘল সম্রাটেরা ইয়ুরোপীয়দের চিত্রশিল্পসামগ্রীতে (যার বেশীরভাগই ছিল খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যহেতু যীশু খ্রিষ্টের জীবন-আধারিত চিত্রণ) আকৃষ্ট হয়েছিলেন কোনও ধর্মীয় কারণে নয়। ইসলাম ইহুদি ধর্ম ও খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে একস্থানিক ও একপিতৃক একটি ‘আব্রাহামীয় ধর্ম’ অতএব খ্রিষ্টধর্মের প্রধান সারতত্ত্ব ও কুশীলবদের মুঘলদের জানা ছিল, যদিও কোরানে খ্রিষ্টের জীবনের নানা ঘটনা যেমন ক্রুশবিদ্ধকরণের ভাষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁদের আকর্ষণের কারণ ছিল ইয়ুরোপীয় চিত্রশিল্পে প্রতিরূপের অভিনব ভাষা, বাস্তবের চোখধাঁধানো অনুকৃতি, গভীর প্রতীকময়তা এবং বিভিন্ন বিমূর্ত আদর্শের (যেমন বিচার, গরিমা, বিজয় ইত্যাদি) মানুষী রূপ। দুই সংস্কৃতির আন্তঃঅনুবাদের একটা ছোট উদাহরণ দিলে আলোচনা আরেকটু স্পষ্ট হবে।

” লাহোরে ১৬০৭ খৃষ্টাব্দে যখন দুই ধর্মের মধ্যে বিতর্কসভার প্রথম কিস্তি শুরু হল, জাহাঙ্গীর ইয়ুরোপীয়ান জেসুইটদের প্রাসাদে ডাকলেন ও তাঁর নিজের গ্রন্থাগার থেকে খোদাইচিত্রের এ্যালবাম আর বিদেশ থেকে আসা খ্রীষ্টান ছবি পাশাপাশি রেখে দেখতে লাগলেন, এদের গল্প, রুপক ও তাৎপর্য বোঝার জন্য। জাহাঙ্গীরের নানা ধারালো প্রশ্ন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে খ্রীষ্টান শিল্পকলায় ছবির রুপক নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ আছে।যেমন খ্রিষ্টান শিল্পীরা সৌন্দর্য আর সম্মানের মধ্যে ভারসাম্য কিভাবে রাখেন তা নিয়ে সম্রাটের মনে প্রশ্ন ছিল। যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধকরণের একটি ছবি দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি আমাদের মহান প্রভু খ্রীষ্টকে আপনারা এত ভক্তি করেন, তাহলে এরকম অসম্মানজনক ভাবে তাঁকে এঁকেছেন কেন?’ আরেকজন মুঘল সভাসদ বললেন, ‘আমরা যখন খ্রীষ্টকে আঁকি, তাঁকে অতি সুন্দর করে দেখাই, ক্রুশবিদ্ধরূপে নয়।’ জেসুইট যাজকেরা বোঝালেন যে এই রূপ অসম্মানজনক নয় বরং তা খুবই সম্মানের। কারণ তা দর্শককে বার বার মনে করিয়ে দেয় যে যীশু খ্রীষ্ট আমাদেরই পাপের কারণে প্রাণ দিয়েছেন আর তাঁর শরীরময় রক্তাক্ত ক্ষত তাঁর আত্মত্যাগের চিহ্ন। জাহাঙ্গীরের এই ব্যাখ্যা পছন্দ হল।  তিনি এর সাথে তুলনা করলেন তাঁর এক সভাসদের, যে সম্রাটকে গুপ্তহত্যার চক্রান্ত করে ধরা পড়ে। কিন্তু তাঁকে প্রাণে না মেরে অন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে বাকি সভাসদরা তাঁকে রোজ দেখেন আর সাবধানে থাকেন। আরেক আলোচনায় এক রাজপুরুষ ইসলামে মূর্তিপূজা নিষেধের সেই পুরনো প্রসঙ্গ তুলে এনে বলেন, ‘আপনারা কি কুমারী মাতা মেরির ছবির উদ্দেশ্যে মাথা নত করেন না মাতা মেরির উদ্দেশ্যে?’ পাদ্রী এই প্রশ্নের উত্তর দেন মুঘল রীতিতে : ‘মহাশয়, আমরা ছবিকে ছবি হিসাবে শ্রদ্ধা করি না। আমরা জনি ছবি শুধু কাগজ,রং আর কালি। ছবিতে যাঁকে দেখানো হচ্ছে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা করি। যেমন জাঁহাপনার ফরমানের কাগজ আমরা কপালে ঠেকাই। কারণ ফরমান শুধু কাগজ আর কালি নয়, তাতে জাহাঁপনার আদেশ আর ইচ্ছেও গ্রথিত আছে।’ ”

কিন্তু এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন না যে খ্রীষ্টান শিল্পীরাও পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দশক র্পযন্ত যীশু খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় দেখানো অসম্মানজনক বলে মনে করতেন। তারপরে বাইজান্টাইন সম্রাটেরা যখন ক্রুশবিদ্ধকরণের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেওয়া রদ করলেন, যীশু খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় ছবিতে দেখাতেও কোন বাধা রইল না। 


এসব ধর্মতাত্বিক আলোচনার চেয়ে শিল্পকর্মশালার চিত্রীদের উৎসাহ বেশী ছিল খোদাইচিত্রের রেখার গড়ন নিয়ে। গবেষকদের মতে, যেহেতু মুঘল শিল্পীরা আগে কোনদিন ইয়ুরোপীয় খোদাইচিত্র (এনগ্রেভিং) দেখেননি আর তা কিভাবে তৈরি হয় জানতেন না, তাই তাঁরা ভাবতেন এগুলো পালকের কলম দিয়ে আঁকা। এই খোদাইচিত্রে রেখার গড়ন চারুলিপির রেখা (‘খাতহ’) এবং রেখাচিত্রের রেখার (‘তরহ’) মাঝামাঝি, তাই দেখে তাঁরা মুগ্ধ হতেন।


মুঘল শিল্পীদের মধ্যে ক্ষণজন্মা আবুল হাসান (খৃঃ ১৫৮৯ – আনু. ১৬৩০) ইয়ুরোপীয় খোদাইচিত্রের রেখার গড়নকে যেভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, সেভাবে বোধহয় আর কেউ-ই পারেননি। বিপুল আগ্রহ আর অধ্যবসায়ে ক্রমাগত ইয়ুরোপীয় খোদাইচিত্রের ছাপার নকল করে, তা্র ওপর দাগা বুলিয়ে ও রং করে তাঁর ‘ইয়ুরোপীয় শিল্পশিক্ষা’ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এরপর তুলিকালি দিয়ে যখন তিনি আলব্রেখট ডুরারের ‘সেন্ট জন’ ছাপাইচিত্রটির নকল করেন তখন দু’টির রেখার গড়ন প্রায় হুবহু মিলে যায়।
চিত্র ১ক

চিত্র ১খ
উপরে আবুল হাসানের করা  নিচের আলব্রেখট ডুরারের কাজের নকল 

ইয়ুরোপীয় খোদাইচিত্রে রেখার গড়নের দুটি ধরণ আছে। প্রথমটি আসে স্বর্ণকারদের তক্ষনপদ্ধতি থেকে, তা  ‘পরিচ্ছন্ন, গভীর, সরু দাগ’ যা ‘নানা রকম আঁচড়ের মাধ্যমে বিভিন্ন নকশা গড়ে’। আর দ্বিতীয়টি হ’ল ‘সুসম, সমান্তরাল, সমদূরবর্তী একদল দাগের পট্টি যা কোন আকারের চারপাশে ঘুরে তাতে ভাস্কর্যের মাত্রা যোগ করে’। কিন্তু ধাতু বা কাঠের ওপর ধারালো শস্ত্র দিয়ে কাটা দাগ কালি দিয়ে ছাপালে রেখার যে গড়ন দাঁড়ায় তা দেখে কাগজে আর তুলিতে পুরো নকল করা সম্ভব নয়। কিন্তু মুঘল অণুচিত্রকলায় আলোছায়া (ইংরাজীতে ‘শেডিং’, ফার্সিতে ‘পরদাজ’) তৈরির ধরনে খোদাইচিত্রের প্রভাব রয়ে গেছে।’পরদাজ’-এ কাটাকুটি দাগ আর ফোঁটা ফোঁটা দুরকম দিয়েই ছায়া বোঝানোর রেয়াজ ছিল।ভারতের বিভিন্ন তৈমুরীয় শিল্পকর্মশালায় প্রচলিত বে-রং রেখাচিত্র ‘সিয়াহ কলম’ (‘কালো কলম’) বা নিম-রং (শুধু হালকা খয়েরি রঙে রাঙানো) ‘নিম কলম’ রেখাচিত্রের রেখার গড়নেও ইয়ুরোপীয় খোদাইচিত্রের প্রভাব আছে।

চিত্র ২ক

চিত্র ২খ
চিত্র ২গ


উপর থেকে নিচে, পরদাজ, নিম কলম ও ইয়ুরোপীয় এনগ্রেভিং-এর মুঘল নকলের উদাহরণ

এক সংস্কৃতি যখন অন্য সংস্কৃতির ছবি দেখে, তখন সে দেখা সরাসরি হয় না, নানা মনস্তাত্বিক অনচ্ছ  পর্দার ভেতর দিয়ে হয়। সেই পর্দা নিজসংস্কৃতির ছবি-দেখার পূর্বস্মৃতি দিয়ে তৈরি। মনের মধ্যে জমা সেই পূর্বদৃষ্ট ছবির পলি নতুন ছবির গড়ন দেখা বা সেই নতুন ছবির গড়ন নকল করার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। তা চোখ দিয়ে প্রবেশ করে, মগজের দৃশ্যকেন্দ্র পেরিয়ে, হাতে পৌঁছে রেখাঙ্কনের ধারা বদলে দেয়। অচেনা সংস্কৃতির ছবির অচেনা অংশগুলিকে ছেনে তাকে নানা চেনা ছবির অংশের সাথে মিলিয়ে আধচেনা করে নিলে তবেই দর্শক-শিল্পীর মন তাকে পরিপাক করে নিজের করে নিতে পারে। এই পদ্ধতি যুগে যুগে সত্য। 

চিত্র ৩ক

চিত্র ৩খ
চিত্র ৩গ


উপর থেকে নিচে, ভারতীয় দৃশ্যের  জার্মান, ফরাসী ও দিনেমার চিত্রণ 

প্রখ্যাত দিনেমার শিল্পী ও শিল্পসংগ্রাহক রেমব্রাঁ (খৃঃ ১৬০৬-১৬৬৯) যখন বাইবেলের ছবি আঁকার আগে মকশো করার জন্য বা ফরাসি শিল্পী ইউজিন দেলাক্রোয়া (খৃঃ ১৭৯৮-১৮৬৩) তাঁর প্রখ্যাত তেলরঙের ছবি ‘সারদানাপালুসের মৃত্যু’ (১৮২৮ খৃঃ, বর্তমানে প্যারিস শহরের লুভ্র মিউজিয়মে সংরক্ষিত) ছবি আঁকার আগে মকশো করার জন্য যখন মুঘল অণুচিত্রকলার নকল করেন, তখন আমরা মুঘল শিল্পী আবুল হাসানের ইয়ুরোপীয় চিত্রকলার প্রতি আগ্রহের এক বিপ্রতীপ দেখতে পাই। যা এই দুই চিত্রসংস্কৃতির পারস্পরিক দৃষ্টিবিনিময়ের এক ভাষ্য তৈরি করে। কিন্তু এই ভাষ্যের ভরকেন্দ্র ভারতের দিকেই ঝুঁকে আছে।  যে সংখ্যায় মুঘল চিত্রশিল্পীরা ইয়ুরোপীয় চিত্রশিল্পের প্রতি অনুরক্ত, তার সিকিসংখ্যক ইয়ুরোপীয় চিত্রশিল্পীরও মুঘল চিত্রকলার প্রতি অনুরাগের ‘পাথুরে প্রমাণ’ পাওয়া যায় না। রেমব্রাঁ আর দেলাক্রোয়া ছাড়া ঊইলিয়াম শেলিঙ্ক, কিছু ইয়ুরোপীয় এনগ্রেভার আর ভিয়েনার শোয়েনবার্গ প্রাসাদের দেয়ালজোড়া মুঘল অণুচিত্রকলার নিদর্শন দিয়েই ওপারের উদাহরণমালা শেষ করতে হয়। কিন্তু সে সময় ভারত ও ইয়ুরোপের মধ্যে শিল্পসামগ্রী বিনিময়ের খরস্রোত যে দোরোখা ছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন দ্বিমত নেই।


চিত্র ৪ক

চিত্র ৪খ
চিত্র ৪গ

রেমব্রাঁর আঁকা মুঘল অণুচিত্রের নকল

চিত্র ৫ক

চিত্র ৫খ
দেলাক্রোয়ার ‘সারদানাপালুসের মৃত্যু’ ও তার মুঘল-প্রভাবিত খসড়া


চিত্র ৬

 ঊইলিয়াম শেলিঙ্কের ‘শাজাহান  ও তাঁর চার পুত্র’

এই ভারসাম্যহীনতাকে ছদ্ম-ডারঊইনীয় ‘সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব তত্ত্ব’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতর ইয়ুরোপীয় সংস্কৃতি নিকৃষ্টতর মুঘল সংস্কৃতিকে মুগ্ধ করেছিল কিন্তু তার উলটপুরাণ হতে পারে নি। এই ব্যাখ্যা ভুল হবার কারণ – সে সময়ের মুঘল সভ্যতা ছিল ইয়ুরোপীয় সভ্যতার উত্তমর্ণ এবং সেই কারণেই সে নিজের পছন্দমত ইয়ুরোপীয় চিত্রকলার নির্বাচিত অংশ আত্মস্থ করতে পারার মত আত্মবিশ্বাস রাখত। অন্যদিকে ইয়ুরোপীয় সভ্যতার মুগ্ধতা ছিল যতটা না মুঘলদের চিত্রসংস্কৃতির প্রতি, তার চেয়েও বেশি মুঘলদের বিপুল বৈভব, বিলাস ও একচ্ছত্র রাজকীয় ক্ষমতার প্রতি। তিনটির একটিও তৎকালীন ইয়ুরোপের রাজশক্তিদের কাছে সুলভ ছিল না। 
 

কিন্তু আমরা যদি তৈমুরীয় রেখার সুসমতা আর অভঙ্গুরতার কথা আবার মনে করি,  রেমব্রাঁর মুঘল অণুচিত্রকলার প্রতি আকর্ষণের স্বরুপকে আমাদের খুব আশ্চর্যজনক লাগবে। জীবনের যে সায়াহ্নকালে রেমব্রাঁর নিজের আঁকা রেখা ইচ্ছাকৃতভাবে সাদামাটা, এলোমেলো আর ভঙ্গুর হয়ে আসছিল ঠিক সেই পর্বেই তিনি মুঘল অণুচিত্রকলার নকল করার প্রতি আকৃষ্ট হন। এই সাদামাটা, এলোমেলো আর ভঙ্গুর রেখাঙ্কনের পিছনে তাঁর জীবনদর্শন ছিল আদি খ্রীষ্টীয় বিনয় ও দারিদ্র্যপালনের দর্শন। তৎকালীন প্রাচ্যবাদিতার প্রভাবে তিনি প্রাচ্যের মুঘল সভ্যতাকে ইয়ুরোপের সভ্যতার ক্লেদ থেকে মুক্ত আদিমতর ও অকৃত্রিম সভ্যতা বলে ভাবতেন, যেই ভাবনার বাস্তব ভিত্তি খুব একটা ছিল না। কিন্তু দেলাক্রোয়া ছবি আঁকার আগে মুঘল অণুচিত্রকলা মকশো করতেন অনেক সাদামাটা কারণে। আসীরিয় রাজা বা তুর্কি প্রজার ছবি আঁকার জন্য নিদর্শন হিসাবে তাঁর হাতের কাছে মুঘল ছবি ছাড়া আর কিছু ছিল না১০

সপ্তদশ শতকে মুঘল চিত্রসংস্কৃতি আর তার জনক পারসিক চিত্রসংস্কৃতির মধ্যে বিনিময়ের বহমানতা ভাটির বদলে উজানে বইতে থাকে।

“সপ্তদশ শতকে পারস্য আর ভারতের মধ্যে চিত্রসাংস্কৃতিক প্রভাবের ধারা উজানে বইতে থাকে। এই শতকের প্রথম পঁচিশ বছরে রাশি রাশি মুঘল ছবি ইস্ফাহানের রাজসভা আর বাজার ছেয়ে ফেলে।  এই ‘নয়া ভারতীয় ছবি’ যার কাঠামো ও রং পারসিক ছবির মত কিন্তু তাতে ইয়ুরোপীয় ছবির মত বাস্তবের অনুকৃতির ফোড়ন দেওয়া থাকত একই সাথে দর্শক ও শিল্পীদের মনোহরণ করে। শেখ আব্বাসি, মোহাম্মদ জামান, আলিকুলি জব্বাদারের মত চিত্রশিল্পীরা সোৎসাহে এই ধারায় ছবি আঁকতে থাকেন। যে সব ইস্ফাহানী চিত্রশিল্পীরা ভারতফেরত ছিলেন (যেমন দারা শিকোহর প্রিয় শিল্পী মোহাম্মদ খান, যিনি ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ফাহানে ফিরে আসেন) তাঁদের কদর বেড়ে যায়। কিন্তু বেশীর ভাগ ইস্ফাহানী চিত্রশিল্পী যাঁরা খুব সম্ভবতঃ উত্তর ভারতের বা কাশ্মীরের কোনও রাজসভায় কোনোদিন কাজ করেননি বা কোনও ইয়ুরোপীয় ছবি নিজের চোখে দেখেননি, তাঁরাও এইভাবে মুঘল আর ইয়ুরোপীয় চিত্রসংস্কৃতি আত্মস্থ করেন ১১।”
 

তথ্যসূত্র

১. অলিভার লিয়ামেন, কুরানিক অ্যান্ড বিব্লিকাল প্রফেটস : আর দে ওয়ান অ্যান্ড দি সেম পিপল?, আল-বায়ান, ভলুম ১১, নাম্বার ২, ডিসেম্বর ২০১৩

২. গভিন আলেক্সান্ডার বেইলি, হর্হে ফ্লোরেস, নুনো ভাসালো এ সিলভা (সম্পাদিত), বিটুউন রিলিজিয়ন্স : ক্রিশ্চিয়ানিটি ইন আ মুসলিম  এমপায়ার, গোয়া অ্যান্ড দি গ্রেট মুঘল, ক্যালুস্তে গুল্বেকিয়ান ফাউন্ডেশন, ২০০৪

৩. রিচার্ড হ্যারিস, দি প্যাশন ইন আর্ট, এশগেট, ২০০৪

৪.  ইয়ায়েল রাইস, দি ব্রাশ অ্যান্ড দি বুরিন : মোগাল এনকাউন্টারস উইথ ইয়োরোপীইয়ান এনগ্রেভিংস, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভ্যানিয়া, ফিলাডেলফিয়া 

৫. মাইলো বিচ, হর্হে ফ্লোরেস, নুনো ভাসালো এ সিলভা (সম্পাদিত), ভিশনস অফ দি ওয়েস্ট ইন মুঘল আর্ট, গোয়া অ্যান্ড দি গ্রেট মুঘল, ক্যালুস্তে গুল্বেকিয়ান ফাউন্ডেশন, ২০০৪

৬. ওয়েন্ডি থমসন, দি প্রিন্টেড ইমেজ ইন দি ওয়েস্ট, http://www.metmuseum.org/toah/hd/engr/hd_engr.htm

৭. ই এইচ গমব্রিচ, আর্ট এন্ড ইলিউশন :  আ স্টাডি ইন দি সাইকোলজি অফ পিক্টোরিয়াল রিপ্রেসেন্টেশন, লন্ডন, ফাইডন প্রেস, ১৯৮৪

৮. সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম, আ রুমফুল অফ মিরররস : দি আর্টফুল এম্ব্রেস অফ মুঘলস অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কস, আর্স ওরিয়েন্টালিস, ভলুম ৩৯, গ্লোবালাইজিং কালচারস :  আর্ট অ্যান্ড মোবিলিটি ইন এইটিন্থ সেঞ্চুরি,  ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৯-৮৩ 

৯. নিকোলা কোর্টরাইট, অরিজিন অ্যান্ড মিনিংস অফ রেমব্রাঁজ লেট ড্রয়িং স্টাইল, আর্ট বুলেটিন, ভলুম ৭৮, নাম্বার ৩, সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৪৮৫-৫১০

১০. লি জনসন, টুওয়ার্ডস দেলাক্রোয়াস অরিজিনাল সোরসেস, দি বার্লিংটন ম্যাগাজিন, ভলুম ১২০, নাম্বার ৯০০, ৭৫থ এনিভার্সারি ইসু, মার্চ ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ১৪৪ + ১৪৬-১৫১

১১. ইন্ডিয়ান ইনফ্লুয়েন্সেস অন পার্শিয়ান পেইন্টিংস : ইরানিকা অনলাইন


ঋণ স্বীকার

ড. কবিতা সিং, স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড এস্থেটিক্স, জহরলাল ইউনিভার্সিটি

ড. ইয়ায়েল রাইস, ডিপার্টমেন্ট অফ আর্ট অ্যান্ড হিষ্ট্রি অফ আর্ট, আমহার্স্ট কলেজ, ইউ এস এ

ড. ডেভিড জে রক্সবার্গ, ডিপার্টমেন্ট অফ আর্ট হিষ্ট্রি অ্যান্ড আর্কিটেকচার, কেম্ব্রিজ, ইউ এস এ
বাংলা অনুবাদের ইংরাজী উৎস http://bit.ly/2ZpvffG


সৌরভ রায় । ভিজুয়াল স্টাডিস গবেষক, সম্পাদক এবং ইন্টারনেটভাষা বিউপনিবেশিকরণ কর্মী।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s